19/06/2024
আজ আমার মেয়ের জন্মদিন
আমার বৈবাহিক জীবনের বয়স ২৫ বছর। দীর্ঘ এই দিনগুলোর প্রথম পনেরো বছরের সিংহভাগ সময় মাইশা ও তার মা দেশে কাটিয়েছে।তখন আমি ইতালিতে ছিলাম।স্মৃতিবিজড়িত দীর্ঘ এই পনেরো বছরে ওরা গ্রীষ্মে বেড়াতে আসতো ইতালিতে, আমি যেতাম শীতে।উলাঙ্গ অধ্যুষিত ইউরোপের অপসংস্কৃতির বিষাক্ত বাতাসে মাইশা বেড়ে উঠুক এমনটি চাইতো না ওর মা। তাইতো আমার ইচ্ছার বিরুদ্ধে জন্মের ৭ মাস পরে তাদের দেশে চলে যাওয়া ।
এসব না না কারণে চোখের সামনে ছোট্ট মাইশার বিন্দু বিন্দু করে বেড়ে ওঠার দৃশ্য দেখা ও উপভোগ করা থেকে আমি বঞ্চিত।শৈশবে ছোট ছোট আঙুল ধরে পথ চলা, কান পেতে প্রথম বাবা ডাক শোনা ।কৈশোরের দুরন্তপনার অব্যক্ত অনুভূতি আমার স্মৃতিতে নেই বললেই চলে ।
বিজ্ঞানীদের মতে ২ থেকে ৮ বছর বয়স পর্যন্ত বহুল মাত্রায় একটি শিশুর মস্তিষ্কে মানসিকতার বীজ বপন করা হয়।এই সময়ে প্রতি সেকেন্ডে প্রায় ১০ লাখ নিউরাল সংযোগ হয় শিশুর দেহ ও মনে ।এতে মস্তিষ্ক তার ভেতরের জটিল নেটওয়ার্ক সংযোগ গুলোকে পুনর্বিন্যাস করে, যা থেকে মানুষের উপলব্ধি, সমস্যা সমাধানের ক্ষমতা , কর্ম দক্ষতা,বিচার বিবেচনা,ধর্মীয় ও পারিবারিক মূল্যবোধ ইত্যাদির ভীত তৈরি হয়ে থাকে। যার প্রকাশ পায় প্রাপ্ত বয়সে ।সুতরাং একটি শিশুর মানসিকতার ভীত গড়ে ওঠার এই মূল্যবান সময়ে পরিবেশ পরিস্থিতি, সঙ্গ, ফুড হ্যাবিট ইত্যাদির প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রাখা সচেতন বাবা মা উভয়ের দায়িত্ব ও কর্তব্য।
কিন্তু জীবন-জীবিকার চক্রে আবদ্ধ আমার মতো প্রবাসী খেটে খাওয়া বাবাদের অনেকের জীবনে যথাসময়ে যথাযথ দায়িত্বশীল আচরণ করা সম্ভব হয়ে ওঠে না ।কিন্তু এখন মনে হয় আবেগের পাখায় ভর করে বিসর্জনের ভেলায় চড়ে নিজের জীবন যৌবন স্বাদ ও আহ্লাদ শুধু পরিবারের চাওয়া পাওয়ার কাছে বলিদান করাই শেষ কথা নয়। জীবনের এই পড়ন্ত বেলায় এসে আরো উপলব্ধি হচ্ছে যে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ অবাক পৃথিবীতে অর্থ অনর্থের মূল হলেও,অর্থ জীবনের সব কিছু নয়। বরং মস্তিষ্ক বিকাশের সময় ধর্মের বিধান ,আদর্শ আর শাসনের বুননে তৈরিকৃত চাদরে সন্তানকে শক্ত করে জড়িয়ে রাখতে ব্যর্থ হলে তার খেসারত চড়া দামে দিতে হয় জীবনের যেকোনো বাঁকে এসে ।কারণ বাবা হচ্ছে একটি মেয়ের সবথেকে কাছের পৃথিবী।নিকটতম মহাসমুদ্র।যে সমুদ্রের বুকে দিনে রাতে সারাটা জীবন প্রতিফলিত হয় বহু স্বপ্নের বাহক একজন বাবার আদর্শ,বিবেক ,বুদ্ধি ভালোলাগা ও ভালোবাসার আবির মিশ্রিত সূর্য রশ্মি ও চাঁদের আলো ।
অর্থ প্রতিপত্তি প্রযুক্তি ও নানা ভাবে পশ্চিমারা অনেক এগিয়ে থাকলেও পারিবারিক মূল্যবোধ মূল্যায়নে তারা আমাদের চাইতে অনেক পিছিয়ে।শেষ বয়সে নিঃসঙ্গতা মেনে নেয়া এ অঞ্চলের মানুষের জীবনে একেবারেই স্বাভাবিক একটা প্রতিষ্ঠিত রীতি ।ছেলে মেয়েরা বড় হলে তারা তাদের জীবন ও ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যাস্ত হয়ে পড়ে। একই শহরে থেকেও বছরে একবার দেখা না হবার মতো ঘটনা নিতান্তই এখানে স্বাভাবিক । এটাই বাস্তবতা।এখানে আধুনিকতার দ্বন্দ্বের কাছে বলি হচ্ছে মানবতা। ফলে হতাশা, নিঃসঙ্গতা, বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তার হাতে মানুষ বন্দি।সুতরাং আমি বলি সন্তানের সাথে কতোটা সময় থাকা হবে সেটা মুখ্য নয় । বরং তাদের সাথে একসাথে কাটানো মুহূর্তগুলো উপভোগ করা, মূল্যায়ন করা জরুরি ।কারণ জীবন তো সেটাই,যা সততা , মেধা,সুযোগ আর পরিশ্রম দিয়ে একজন মানুষ নিজের মতো করে তৈরি করে থাকে।
আজ মাইশার জন্মদিন।২৩ বছর আগে ঠিক এই দিনে ভোরের আলোর মতো আমার কোল আলোকিত করেছিল সে ।প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি ইতালির উত্তর প্রদেশ বোলজানো হাসপাতালে ২০ জুন ২০০১ সালে ভূমিষ্ঠ হয়েছিল মাইশা।সারা রাত স্বাভাবিক ডেলিভারির চেষ্টা শেষে রোগীর অবস্থা আশঙ্কাজনক হলে ভোরে ওটিতে নেয়া হয় মাইশার মাকে।আমি অপারেশন থিয়েটারের সামনে দাঁড়ানো। হঠাৎ সাদা তোয়ালে দিয়ে জড়ানো তাজা রক্তে ভেজা মাইশাকে এনে আমার কোলে তুলে দিলো ইতালিয়ান নার্স।সেদিন পৃথিবীতে ফোটা সব ফুল দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলাম তাকে। জীবনে এই প্রথম স্বর্গ সুখের স্বাদ অনুভব করেছিলাম আমি।সে এক অন্যরকম স্মৃতি। যা ভাষায় প্রকাশ করার নয়।তাইতো বলি স্মৃতি হচ্ছে বন্ধন। আর বিস্মৃতি হচ্ছে মুক্তি।
সেদিনের সেই ছোট্ট মাইশা আজ বড় হয়েছে।সাথে সাথে আমার চিন্তার আকাশ হচ্ছে মেঘাচ্ছন্ন।মাইশা king's college London এ Child & Adolescent Mental Health এর উপর postgraduate (Master of Science) করছে।ইতোমধ্যে সে London Maudsley Hospital এ Internship (Medicine ) শুরু করেছে।
জন্মদিনে মাইশার জন্য রইলো অনেক অনেক শুভ কামনা।Happy Birthday to you Maisha. Many Many Happy returns of the day.
London 20.06.2024