27/02/2024
এদেশের ঠান্ডার অদ্ভুত একটা বৈশিষ্ট্য আছে। কোনো কারণ ছাড়াই বিনা নোটিশে দলবলসমেত জাঁকিয়ে বসে। আজ প্রকৃতির বিষাদ ভাব অনেকটাই কমে গেছে,- হাড় কাঁপানো ঠান্ডা নাই বললেই চলে। ঝিরঝির হাওয়ায় অন্য রকম একটা সুখ ভাব ছড়িয়ে আছে। আকাশটাও আজকে অন্যদিনের চেয়ে ফকফকা। আমি গার্ডেন টেবিলের সারির সামনে দাঁড়িয়ে আকাশ দেখছি এমন সময় আলেইশা'র মা এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলো।
জো ডার্লিং তুমি কেমন আছো?
আমি হালকা করে হাসলাম।
ভদ্রমহিলা পর পর তিন গ্লাস ব্লাডি মেরি খেলেন, - সাথে তিন শর্ট এলটস টাকিলা। এরপর পাশের টেবিলে বসে থাকা টাকলা মাথার ভদ্রলোককে জড়িয়ে ধরে চুমু খেতে লাগলেন। এদের এই অদ্ভুত ব্যাপার, - মদের আসরে খুব অল্প পরিচয়ে অনেক বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে যায়।
আমি দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছি এমন সময় আলেইশা এসে আগুন চোখে তাকালে।
আমার মা'কে ড্রিংকস তুমি বানিয়ে দিয়েছো তাই না? আমি শুধুমাত্র এক গ্লাস ভোদকা বানিয়ে দিয়ে গিয়েছিলাম। এই এক ঘন্টায় উনি মনে হয় অনেকবার ড্রিংকস নিয়েছে, সব তুমি বানিয়ে দিয়েছো তাই না?
আমি হালকা করে হাসলাম।
জো, আমি তোমাকে বলে গিয়েছিলাম যে আমার মা'কে ড্রিংকস দিবে না। জানো সে কন্ট্রোলে থাকে না,- বলেই আলেইশা নিজেও হাসতে লাগলো।
আমি ভদ্রলোকের দিকে তাকালাম। তার ব্লেড করা টাক মাথা লিপস্টিক ছোঁয়ায় অনেকখানি রঙিন হয়ে আছে। আমার মনে হলো ভদ্রলোকও বেশ আনন্দ পাচ্ছেন। তিনি শক্ত হাতে আলেইশার মা নাতাশাকে জড়িয়ে ধরে আছেন। শুধু আলেইশা মুখ শক্ত করে তাকিয়ে রইলো।
ফ্রান্স থেকে বত্রিশ জনের একদল তরুন তরুনী এসেছে। সবাই ল' এর শেষ বছরের স্টুডেন্ট। এদের মধ্যে এক মেয়ের জন্মদিন। সবাই মিলে জন্মদিনের কেক কেটে হই হুল্লোড় করছে। বারের সামনেই তারা গানের তালে তালে নাচছে। আমি আর ফ্রান্সি ড্রিংকস বানিয়ে দিচ্ছি। মেয়েগুলো ড্রিংকস হাতে নিয়ে বলছে ম্যাক্সি, ম্যাক্সি। ম্যাক্সি কথার মানে কি কে জানে। দু'জন মেয়েকে দেখলাম অনেকখানি কাপড় খুলে ফেলেছে। বুকের নাজুক অংশ বেরিয়ে আছে। আমার থেকে মাত্র হাত খানিক দূরে। আমি চোখ থেকে চশমা খুলে ফেললাম। ফ্রান্সি হাসতে হাসতে বললো, জো, খালি চোখে না দেখলে তৃপ্তি পায় না। সাদা গ্লাসের ফ্রেম তার চোখের সামনে অনেকখানি পর্দা টেনে রাখে।
আলেইশা মুখ শক্ত করে আইরিশ একসেন্টে কইলো, F**king এইল,- আরো কিছু আইরিশ শব্দ।সহজ বাংলায়, লুইচ্চা, বদমাইশ, হারামি কোথাকার।
রাত এগারোটার দিকে ঘটলো বিপত্তি। বিনা নোটিশে আমাদের সাপ্লাইয়ের ঠান্ডা পানি সরবরাহ হঠাৎ করে বন্ধ হয়ে গেলো। আলেইশা উপরে গিয়ে বেশ কিছুটা সময় নিয়ে সব কিছু উল্টেপাল্টে দেখলো। তারপর আমাকে ফোন করে বললো, Joe, we gonna f***ing sut down, f**k them ass. সহজ বাংলায় তরজমা করলে অর্থ দাঁড়ায়, জো, আমরা দ্রুত বন্ধ করতে যাচ্ছি, সবাইকে বের করার ব্যবস্থা করো।
এদের ইংরেজি নিয়েও বেশ সমস্যায় আছি। প্রায় প্রতিদিন সকালবেলা মি. ডুগান সাহেবের দেখা হয়। একটা ল্যাপটপের কালো ব্যাগ কাধে নিয়ে ছুটতে থাকেন। আমাকে দেখলেই বলেন, Ey up mate, morning. How's going on. Si thi!
যার বাংলা অর্থ দাঁড় করালে হয়, শুভ সকাল বন্ধু, কি অবস্থা তোমার। যাই, - আবার দেখা হবে!
আমি হু হ্যাঁ কিছুই বলি না। ডুগান সাহেব কিছু বলার সময়ও দেন না। তিনি কফির কাপ হাতে ছুটতে থাকেন। এদেশে মানুষের এই আরেক সমস্যা,- এরা শুধু ছুটতে থাকে। আপনি যত দ্রুতই হাঁটেন না কেনো দেখবেন পাশের জন আপনার চেয়ে অনেক দ্রুত হেঁটে চলছে। এরা আর যাই হোক কোথাও গিয়ে দাঁড়িয়ে থেকে জটলা পাকায় না,- এরা শুধু ছুটে!
মি. জ্যাক এসেছিলেন সন্ধ্যেবেলা। বলতে গেলে প্রায় প্রতিদিনই আসেন। দুই পাইন্ট মাদ্রি খান, ঘন্টা তিনেক ঝিম ধরে বসে থাকেন। আশির কাছাকাছি বয়স। ফরাসি মেয়েদের সাথে একজন বয়স্ক মহিলাও এসেছিলেন। জ্যাক উনার সাথে চুটিয়ে আড্ডা দিলেন, ভদ্রমহিলার ওয়াইনের বিল দিলেন। এক সাথে পাশাপাশি বসে আর্সেনাল আর ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের খেলা দেখলেন। ভদ্রমহিলা যাবার সময় জ্যাকের গালে আলতো করে কিস খেলেন। আমি এই দৃশ্য দেখে হেসে ফেললাম। বললাম, জ্যাক, ইউ গনা লাভ? জ্যাক লজ্জা পেয়ে বললো আই ডোন্ট মাইন্ড! আই ডোন্ট!
আই ডোন্ট মাইন্ড বললেও জ্যাক খুশির ঠেলায় তিন পেগ হেনেসি ব্রান্ডি খেয়ে ফেললো এবং বের হবার সময় পাবের দরজার সামনে ধপাশ করে পড়ে গেলেন।
আমি জ্যাকের হাত ধরে টেনে তুললাম। মৃদু হেসে বললাম, জ্যাক, চুমুর ভার মনে হয় বেশি ছিলো, সহ্য করতে পারোনি। জ্যাক শব্দ করে হেসে বললো, ইটস ও'কে! আই ডোন্ট মাইন্ড! আই ডোন্ট মাইন্ড!
মি. মার্কোস চুপচাপ বসে আকাশ দেখছেন। আমি পাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কাজ গুছাচ্ছি। হাতে তেমন কোনো কাজও নাই। মেইন্টানেন্সের লোক আসছে, তারা খুটখাট করছে উপরে।
মি. মার্কোস নিরবতা ভাঙলেন।
জো, তোমার বউ বাচ্চা কেমন আছে?
জ্বি স্যার, ভালো।
জানো মেরীর সাথে আমার পরিচয় হয় কলেজে। আমার কলেজ, পড়াশোনা কিছুই ভালো লাগতো না। আমার পছন্দ ছিলো রাগবি খেলা। শুধুমাত্র মেরীকে দেখার জন্য কলেজে যেতাম।
মি. মার্কোস নি:শ্বাস নিলেন।
মেরী কলেজ পাশ করে ইউনিভার্সিটি গেলো আর আমি ড্রপ আউট হয়ে বাবার গ্যারেজ সামলানোতে ব্যস্ত হয়ে গেলাম। প্রায়ই পুরোনো বন্ধুবান্ধবদের সাথে হ্যাং আউটে যাই। রাগবি খেলি। মেরীর সাথে যোগাযোগ বাড়ে। একসময় আমরা এক সঙ্গে থাকা শুরু করে দিলাম। আমাদের দুই সন্তান হলো। আমরা বিয়েও করলাম।
প্রকৃতির একটা অদ্ভুত বিধান কি জানো? স্মুথলি চলা সুসময়ের মাঝে হঠাৎ করে একটা বিশৃঙ্খলা আনা। আমার আর মেরীর জীবনেও হঠাৎ করে সেই বিশৃঙ্খলা হানা দিলো, - মেরীর ক্যান্সার ধরা পড়লো।
তারপর কেমো, হাসপাতালে হাসপাতালে ছুটোছুটি, সকাল বিকাল ডাক্তারের পরামর্শ মতে চলা,- সবই করলাম তবু কোনো লাভ হলো না। মেরী আমাকে ছেড়ে, তার প্রানপ্রিয় দুই সন্তানকে ছেড়ে, - অদ্ভুত শূন্যালোকে যাত্রা করলো। আমি শুধু তার হাত ধরে চুপটি করে বসে রইলাম,- একবার বলতে পারলাম না, হানি, আমাকে একা ফেলে এভাবে চলে যেও না! আমি এই নিষ্ঠুর পৃথিবীতে একা চলতে পারবো না!
মি. মার্কোস চোখ থেকে চশমা খুলে পরিস্কার করতে লাগলেন।
কবিতার ভাষায়, এ-পৃথিবী পায় তারে একবার,- পায় নাকো আর! আমি জানি মেরীকে আমি আর কখনো ফিরে পাবো না। তবু আমি মাঝে মাঝে তার কবরের সামনে গিয়ে আকুতি করি। আমি নাস্তিক মানুষ। তবু চার্চে যাই। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি। শুধু আর একটি বারের জন্য আমি মেরীকে চাই! শুধুমাত্র একটি বার!
জো, আমি জানি সব কিছু মিথ্যে, সব কিছু ভ্রান্তি, সবই মায়া! তবু আমি আরেকটি বার মিথ্যে দিবানিশির প্রেম খেলায় জড়াতে চাই! এ-জীবন ভালোবেসে আরেকটি বার আমি স্বপ্ন দেখতে চাই!
অনেকখানি রাত নেমে এসেছে। চারিদিকে তেমন মানুষের আনাগোনা নাই। আমি ট্রেনে চড়ে বসলাম। ট্রেন মাটির নিচ দিয়ে চলছে। চারদিকে প্রগাঢ় বিষণ্ণতা, তীব্র অন্ধকার! সারাদিনের ক্লান্তিতে চোখ বন্ধ হয়ে আছে। একসময় ঘুমিয়ে গেলাম। ঘুমের মধ্যে শুনলাম মি. মার্কোস বলছে, জো, আমরা সবাই জীবনে পূর্ণ হতে চাই কিন্তু বাস্তবতা হলো মানুষের জীবনে কখনো পূর্ণতা আসে না। তবুও আমরা স্বপ্ন দেখি, ভালোবেসে বুক বাঁধি এবং দিবানিশির মিথ্যে প্রেম খেলায় নিজেকে সপে দেই!