18/04/2022
আমি যে রোগীর সাথে কথা বলছি, সেটা রোবট পেশেন্ট।আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ব্যবহার করা হয়েছে ।
মাঝে মাঝেই মনে হয়, এক জীবনে আল্লাহর কাছে শোকরিয়া করে বোধ হয় শেষ করা যাবে না। কত কিছু দেখার, কত কিছু জানার সুযোগ আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন।
ভিডিও তে আমি যে রোগীর সাথে কথা বলছি, সেটা রোবট পেশেন্ট। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সি ব্যবহার করা হয়েছে, সে কথার প্রতি- উত্তর দিতে পারে, কমান্ড ফলো করতে পারে।জাপানিজ এবং ইংরেজি ২ ভাষাতেই এটা রেস্পন্স করে। জাপানিজ মেডিকেলের ছাত্র- ছাত্রীরা প্রাক্টিস করার জন্য ডামি হিসাবে এসব রোবট পেশেন্ট ব্যবহার করে । রোবট দেখানোর এক ফাঁকে সেনসেই( টিচার) আমাকে জিজ্ঞেস করলো,প্রাক্টিসের জন্য আমাদের দেশে এরকম রোবট পেশেন্ট আমরা ব্যবহার করি কিনা?
প্রশ্ন শুনে মনে মনে হেসে দিলাম। আমি এমন এক দেশ থেকে এসেছি, যেখানে সব চেয়ে সস্তা জিনিস মানুষের জীবন! প্রাক্টিস করার জন্য রিয়েল পেশেন্টর অভাব নাই। রোবটের দরকার কি?
আমার মনে আছে, ফাইনাল প্রফের আগে দিয়ে অনেক রোগীদের হাস্পাতালের সকল খরচ ৫০% কমিয়ে দেওয়া হত, শুধু মাত্র নির্ধিধায় ছাত্র-ছাত্রীদের সকল রকম ক্লিনিকাল এক্সামিনেশন করতে দিবে এই শর্তে রাজি হওয়ার কারনে!
তখন অবশ্য এতকিছু বুঝতাম না, এখন বুঝি, দারিদ্রতার কাছে কতটা অসহায় এই সব মানুষ গুলো! অসুস্থ শরীরে কেউ হাত দিলে কারোরই ভালো লাগে না, তবুও এরা দিত, কারন অর্থের কষ্ট বড় কষ্ট!
তবে সব কিছুরই ভালো- মন্দ দুইটা দিক আছে, অবাধে পেশেন্ট ধরার সুযোগ পায় বলেই বাংলাদেশের বেশিরভাগ ডাক্তারদের খালি হাত আর খালি চোখ একটা সিটি- স্ক্যান মেশিনের থেকে বেশি কথা বলে! অবশ্য যাদের বাংলাদেশের বাইরে কখনো ডাক্তার দেখানোর সুযোগ হয় নি তারা এর গুরুত্ব বুঝবে না।
নিজের একটা ঘটনা শেয়ার করি। আমার গতবছর ৩০ নভেম্বর মেডিস্টিনাল ম্যালিগন্যান্ট লিম্ফোমা ডায়াগনোসিস হয়। আমার সমস্যা নিয়ে প্রথম ডাক্তারের কাছে যাই ২২ সেপ্টেম্বর । ২ মাস সময় লাগে আমার রোগ নির্ণয় করতে। এই ২ মাসে আমি শুধুমাত্র সিটি-স্ক্যন ই করি ৮ বার। অন্যান্য সব টেস্ট এর হিসাব নাহয় বাদ ই দিলাম। নরমাল সিটি, কনট্রাস্ট সিটি, সিটি গাইডেড বায়োপসি, পেট সিটি..... বিভিন্ন রকম সিটি-স্ক্যান! এত অত্যাধুনিক ক্লিয়ার ইমেজের সিটি-স্ক্যান মেশিন আমি আমার ডাক্তার জীবনে চোখে দেখি নাই, রোগী জীবনে এসে দেখেছি। তবে এরা কোন ক্লিনিক্যাল এক্সামিনেশন করে না, ডায়াগনোসিস এর জন্য এরা সম্পুর্ণ ভাবেই টেস্ট ( ইনভেস্টিগেশন) নির্ভর।
আমার প্রশ্ন, আমাদের দেশে যদি কোন রোগী কে শুধুমাত্র কি হইছে সেটা জানতেই ৮ বার সিটি-স্ক্যান করা লাগে সেই রোগী কি আর আদৌ ট্রীটমেন্ট কন্টিনিউ করবে? ক্যান্সার নিয়ে মরে যাবে, তাও জানতেই পারবে না আসলেই কি হইছিলো!
বাংলাদেশের বহু হাস্পাতালে না আছে একটা ভালো ওটি, না আছে ইন্সট্রুমেন্ট, না আছে প্রপার ইনভেস্টিগেশনের সুযোগ! বহু বহু ডাক্তার এসব হাস্পাতালেই দিনের পর দিন সাক্সেস্ফুল সব অপারেশন / ট্রীটমেন্ট করে যাচ্ছে শুধু মাত্র নিজের স্কিল কে অবলম্বন করে। তারপরেও দিন শেষে আমরা কসাই! কারন আমরা অতি সহজলভ্য জিনিস, চাহিবা মাত্র পাওয়া যায়।
আমাদের দেশে যারা বিত্তবান তারা জ্বর, সর্দিকাশি থেকে শুরু করে সকল ধরনের চিকিৎসার জন্য ইন্ডিয়া, সিংগাপুর এদের প্রথম চয়েস, আর যাদের সে সামর্থ নাই তারা বাংলাদেশেই ট্রিটমেন্ট নেন আর মন ভরে, মুখ উজার করে ডাক্তারদের গালি দেন ।
কেউ কেউ আবার আরো এক ডিগ্রী সরেস! গালির সাথে হাত- পা, জুতা, হক-স্টিক এসব ব্যবহার করে পৈচাশিক আনন্দ পান!
তারপরেও আমরা ট্রীটমেন্ট দিয়ে যাই। রোগীর কষ্ট আমাদের কাঁদায়। নিজের সর্বোচ্চ টা দিয়ে যমদূতের সাথে যুদ্ধ করে যাই। কেন করি?
কারন আমরা রোবট পেশেন্টের সাথে ডিল করি না। মেডিকেল জীবনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমরা সত্যিকারের কষ্টে জর্জরিত মানুষের সাথে কাজ করতে করতে তাদের সাথে এক অলিখিত ভালোবাসার মায়ায় জড়িয়ে পড়ি। আমরা রোগীর শরীরের সাথে সাথে তাদের মনেও হাত দিয়ে ফেলি।
রোগীর সুস্থতা আমাদের সাফল্যের আনন্দ দেয়। হাজারো অবমাননার ভীড়ে একজন-দুইজন পেশেন্টের মুখের এক চিলতে হাসি আমাদের ইন্সপিরেশন দেয়। হঠাৎ করে কোন এক বৃদ্ধ রোগীর বলে ওঠা "মাগো! আল্লাহ তোমার অনেক ভালো করবেন" কিংবা, ট্রেন স্টেশনে ছোট্ট বাচ্চা কোলে কোন এক মায়ের আমাকে দেখিয়ে বাচ্চাকে বলা, " বাবা দেখো! তুমি এক আন্টিটার হাতে হইছো! " সামান্য এই কথা গুলো আমাদের চোখে আনন্দঅশ্রু এনে দেয়। জাতি হিসাবে আমরা বড়ই আবেগী জাতি!
Dr. Farzana Sultana
TMDU
Tokyo, Japan.