24/05/2024
যথারীতি বিয়ের মোটিমুটি এক মাস আগে আমার চাকরি এক দুপুরে চলে গেলো , দু বছর কাটিয়েছিলাম সেখানে , বিশিষ্ট মলম বিক্রেতা কোম্পানির এমডি বিনা কারনেই কোন প্রকার নোটিশ ছাড়াই " সি ইউ নট ফর মাইন্ড " বলে দিলো ! এদিকে আমি তো পড়লাম মহা বিপদে কেননা , ঠিক তার দু' দিন আগেই আমার হবু চাচা শশুর ফরমালিটিস হিসেবে "ভাতিজি কে কোথায় বিয়ে দিচ্ছি" শিরোনাম শীর্ষক প্রতিবেদন লিখার জন্য এসেছিলেন অফিসে ।আগে থেকেই সব অভিনেতাদের ঠিক করে রেখেছিলাম বলে ,কারও কারও ওভার অ্যাক্টিং এর ভয় কিছুটা ছিলোই , যা হোক, উনাকে অফিস এর সবথেকে ওয়েল ডেকোরেটেড এরিয়া গুলো ঘুরে দেখালাম এবং বেশ কিছু কঠিন কঠিন শব্দ ব্যবহার করে উনাকে বুঝানোর চুড়ান্ত চেস্টা করলাম যে আমি এই অফিসের মাঝারী লেভেলের "কুতুব"
বুঝলাম উনি ইম্প্রেসড!
যখন আমার চাকরী চলে যায় , তখন বাবা মা ও ঢাকাতেই ছিলেন আমার সাথে ।
অফিস থেকে বের হলাম, বাংলামোটর ওভারব্রীজ এর উপর দাড়িয়ে থাকলাম বেশ কিছু সময় ! অদ্ভুত একটা খারাপ লাগা শুরু হল , গলার কাছে কান্না কেন যেনো দলা পাকিয়ে বার বার উপরে আসার জন্য ধাক্কা দিয়েই যাচ্ছে , পাশকাটিয়ে যাওয়া পথচারী দের দিকেও তাকাতে পারছি না , শুধু মনে হচ্ছিল এরা সবাই জেনে গেছে আমার চাকরী এই এক্টু আগেই চলে গেছে ! চোখে চোখ পড়লেই আমাকে তাচ্ছিল্য নিয়ে জিজ্ঞেস করবে " কি ভাই চাকরী গেলো ক্যামনে ? " যার উত্তর দিতে আমি কোন ভাবেই প্রস্তুত নই !
বেশ কিছু সময় পার করার পরে ধীরে ধীরে নেমে এলাম , মোটরসাইকেলের কাছে গেলাম , সিট কভারে দেয়া নতুন পলিথিন এর দিকে চোখ যেতেই মনে হলো ,
এইতো ,এই এক সপ্তাহ আগে আব্বুর কাছে থেকে এক লক্ষ টাকা নিলাম মোটরসাইকেল কেনার জন্য , কারন হিসেবে বললাম আমার অফিস যাতায়ত এ খুব কস্ট হচ্ছে মোটরসাইকেল না হলেই নয় ! বাবাও বুঝে বললেন আচ্ছা আমি টাকা দিচ্ছি , কিনেও ফেলালাম !
ওই সময় মনে হলো কি উত্তর দেবো এখন আমি আব্বুর কাছে ? মোটরসাইকেলে উঠে হেলমেট টা মাথায় দিয়ে, চাবি ঘুরিয়েই আমি খেয়াল করলাম অঝোর ধারায় দু 'চোখ দিয়ে পানি পড়ছে , হেলমেটের ভাইজর নামিয়ে দিলাম যাতে কেউ দেখতে না পায় ! পরিচিত গ্যারেজ টার দিকে শেষ এক বার চোখ বুলিয়ে বের হয়ে গেলাম , মাথায় উল্টা পাল্টা সব চিন্তা আসছে যেগুলা মুখেও কোনদিন আনিনি !
হবু বউ কে ফোন দিয়ে জানালাম , বলল
আরেহ বাদ দাও কিছুই হয়নাই , আমার তো চাকরী এখনো আছেই প্রথম কয়েকটা মাস না হয় আমিই চালালাম সংসার , তুমি আবার আর একটা চাকরী পাবে দেখে নিও , বেতন ও বেশি পাবে !
আমি খুব শক্ত ও বাস্তববাদী মানুষ হওয়াতে এসব কোন কথাই আমাকে স্পর্শ করলো না , শুধু ফোন রাখার আগে বলালাম " হু"
মোটরসাইকেল টা আজকে খুব ভারী মনে হল , বারবার মনে হচ্ছে কেউ যেনো পেছন থেকে টেনে ধরে আছে , পেছন ফিরলেই জিজ্ঞেস করবে " চাকরী চলে গেছে শুনলাম তোমার ? তা কি কারনে ?"
এক বারের জন্য তাকানোর সাহস হলো না !
কি করবো কাল থেকে ? কিভাবে চলবে সব কিছু ? আব্বুকে আম্মু কে কি জানানো উচিৎ হবে ? নাহ ! এটা করা যাবে না ! তারা কস্ট পাবে ।
মোটরসাইকেলে তেল নেয়ার জন্য আসাদগেটের পাম্পে ঢুকতেই
পেট্রোল পাম্প এ ঢুকতেই চোখে পড়লো বিশাল বিশাল দুইটা ছাতার নিচে কয়েকজন কিছু একটা করছে , দুটি ছাতার একটা কালো রংের যেখানে সাদা রং এ লেখা আছে " UBER" আর একটা লাল ছাতায় লেখা আছে " পাঠাও" ! তখন (2018) এর দিকে প্রায় সব গুলা পেট্রোল পাম্পেই তাদের লোকজন দেখা যেতো , সময় পেলেই জিজ্ঞেস করতেন " ভাই কি রাইড শেয়ারিং করতে চান?" প্রতিবার ভদ্রতার সাথে বলতাম " না ভাই "
সেদিন দেখলাম কেউই কাছে আসছে না , আমি মোটরসাইকেল এক পাশে থামিয়ে গেলাম তাদের কাছে , বললাম " ভাই আমি রাইডশেয়ারিং করতে চাচ্ছিলাম " বললেন কাগজ গুলো দেন , প্রায় মিনিট দশেক পরে উনি বললেন , আজকে রাত 12 টার পরে প্রোফাইল চালু হবে , আমি বললাম আচ্ছা , এবার এলাম শ্যামলী খেলার মাঠের কাছে , একটা দোকান ছিলো যেখানে ভাজা পোড়া পাওয়া যেতো , স্পেশালী তাদের মাশরুম চপ , 5 টাকা দাম ছিলো , প্রচন্ড ভীড় থাকে সবসময় দোকান টা তে ! আশে পাশে বেশ কিছু অফিস থাকায় ছুটির পরেই একটা মিলন মেলা টাইপের পরিবেশ থাকে ,
অন্য সময় আমি 5-6 টা চপ নরমালি খেতাম , সেদিন প্রচন্ড খুধা থাকলেও দুইটা চপ ও খেতে পারলাম না , আশেপাশের লোকজনদের বার বার দেখছি আর ভাবছি এই লোকগুলার মতো সুখী মানুষ আর একটাও নাই , কেননা তাদের চাকরী আছে !
কি করলাম আমি ?
যা হোক , ওখানে বসেই প্লান করলাম কাল থেকে কিভাবে সব কিছু শুরু করবো ,
প্রথমত , বাসায় গিয়ে ঠিক অন্য দিনের মতো অফিস শেষ করে যেভাবে মুভমেন্ট থাকে ঠিক সেটাই করার ট্রাই করবো !
পরের দিন ঠিক যে টাইমে ডেইলি অফিস যেতাম সেভাবেই রেডি হয়ে বের হয়ে যাবো এবং চেস্টা করবো রাইড শেয়ারিং করার , জানতাম এই কাজ টা সহজ হবে না এই গরম ওয়েদারে ,
এরপর, অফিসের আর একজন শেয়ারহোল্ডার " সুজাত" বস কে একটা ফোন করে রিকুয়েস্ট করবো যে যাতে করে অন্তত আমাকে আমার বিয়ে পর্যন্ত টাইম দেয়া হয় , এর পরে আমি নিজে থেকেই চলে যাবো !
যে কথা সে কাজ ,
বাসায় গিয়ে সব কিছু ঠিক ঠাক এমন অভিনয় করলাম , মনে হলো পাশ করে গেলাম ,
পরের কাজ বেশ কঠিন , কেননা "সুজাত" সাহেব ভীষণ ব্যাস্ত মানুষ , ফোনে তাকে পাওয়ায় কঠিন ,
আল্লাহ্র নাম নিয়ে দিলাম ফোন , দেখলাম উনি ধরলেন , বল্লেন , মারুফ বলেন , আমি সালাম দিয়েই বললাম বস , একটা ঝামেলা হয়ে গেছে , বললেন "কি হয়েছে বলেন "?
বিস্তারিত ঘটনা বলতে গিয়ে গলা ধরে এলো , ফুপিয়ে ফুপিয়ে দেখলাম কান্নাও শুরু হয়ে গেছে ,
নিপাট ভদ্রলোক , সুজাত সাহেব বললেন , আরে পাগল কান্নার কি আছে ? আমি জানতাম তা আপনার বিষয় টা , মাত্রই জানলাম ,
এক পর্যায়ে বলেই ফেললাম বস আমাকে শুধু আমার বিয়ে অব্দি সময় দেন , এর পর আমি নিজেই চলে যাবো , আমি আমার শশুর বাড়ির লোকজনের কাছে মুখ দেখাতে পারবো না ! উনি বিষয় টা বুঝলেন , আমাকে ঠান্ডা হতে বললেন , আর তার পরের দিন ঠিক বিকাল 5 টায় একবার উনাকে ফোন করতে বললেন ! আমি কিছুটা আশা পেলাম মনের মাঝে ।
পরের দিন যথাবৎ সকাল 7:30 এর ভেতরেই বের হয়ে গেলাম , শেখেরটেক 8 নাম্বার রোড এ গিয়ে রাইড শেয়ারিং ওপেন করতেই রাইড রিকুয়েস্ট আসলো এক্সেপ্ট করেই গেলাম , দেখলাম মিরপুর যাবেন উনি , আমি রাজি হলাম , যাত্রার এক সময় আমাকে জিজ্ঞেস করলেন " ভাই কোথায় চাকরী" করেন ? ভেতর টা আবার মোচড় দিয়ে ঊঠলো , আমি বললাম , ভাই চাকরী করতাম গত কাল চাকরী চলে গেছে ! লুকিং গ্লাস এ দেখলাম উনি বেশ চমকে গিয়েছেন , আরো অনেক কথা হলো , নেমে উনি 90 টাকার ভাড়া আমাকে 110টাকা দিয়ে বললেন " ভাই কিছু মনে নিয়েন না আমি 20 টাকা বেশি দিলাম আপনার বেশভূষা দেখে আপনাকে টিপ্স অফার করাটা ভদ্রোচিত হবে কি না বুঝতে পারছি না " আপনি রাখলে খুশী হবো !
আমি হেসে বললাম জি প্লিজ !
ঘন্টা 3-4 পরে একটু বিরতি দিলাম , তখন আমি বাড্ডা এরিয়া তে , খেয়াল করলাম , কোমরে বেশ ব্যাথা অনুভব করলাম , যদিও এই ব্যাথাই আমাকে এক সময় অনেক অনেক লং রাইড করতে শিখিয়েছিল , সে গল্প আসবে সামনে !
আমার টারগেট ছিলো মোটামুটি 5 টা অব্দি চালাবো , দেখলাম আমার সেদিনের কামাই 554 টাকা !
এবার ফোন করতে হবে সুজাত সাহেব কে,
বাসার নিচে গিয়ে এক্টু আড়াল করলাম নিজেকে , বিসমিল্লাহ বলে ফোন করলাম সুজাত সাহেব কে , উনি ফোন ধরেই বললেন , " আমি একটা মিটিং এ আছি ঘন্টা খানেক পরে ফোন করেন "
আমি বললাম আচ্ছা !
ঘন্টা খানেক পরে আবারো ফোন করলাম, উনি বললেন " আপনি আগামী কাল সকাল 11 টায় আমার সাথে দেখা করেন অফিস এসে,
পরদিন চলে গেলাম , উনি বেশ কিছু কথার পরে বললেন ,
"আপনি আগামীকাল থেকে অফিস শুরু করবেন , চিন্তা করবেন না !
এক মুহুর্তের জন্য আমি আমার নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম না ! মনে হল আমি নিশ্চয় সপ্ন দেখছি !
কি অদ্ভুত আনন্দ অনুভূত হলো বলে বোঝানো দায় !
কিন্তু কে জানতো এই আনন্দের পরিসীমা মাত্র 2 দিন ?