31/08/2024
গত ১৫ বছরে আওয়ামী লীগের হাতে সবচেয়ে নিগৃহীত দলটির নাম বিএনপি। অনেকেই মনে করেন, ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলোই আওয়ামী লীগের মূল শত্রু। কিন্তু গত ১৫ বছরের আচরণে বারবার মনে হয়েছে আওয়ামী লীগ একমাত্র বিএনপিকেই শত্রু হিসেবে বিবেচনা করছে, যেন বিএনপিকে ঠেকানো গেলেই ক্ষমতায় থাকা সম্ভব হবে।
অভ্যুত্থানের পর এখন এক এক করে ইসলামী দলগুলো গর্ত থেকে বের হচ্ছে এবং অভ্যুত্থানের ফল ভোগ করতে সামনের কাতারে এসে দাঁড়িয়েছে। প্রাথমিক উত্তেজনার পর এ মুহূর্তে বিএনপিকে অনেকটাই ব্যাকফুটে ঠেলে দেয়া হয়েছে। সে হিসেবে আসার আগে দেখি গত ১৫ বছরে বিএনপির ত্যাগের কিছু হিসাব নিকাশ। বাংলাদেশে সারা দেশে জনসমর্থন হিসেব করলে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগ এবং বিএনপিই সামনে আসবে। জাতীয় পার্টিরও কিছু ভোট আছে বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে। তারা বহুভাগে বিভক্ত। রুট লেভেলে কে বিএনপি করে আর কে আওয়ামী লীগ, তা সবাই জানে। সুতরাং রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর গত ১৫ বছরে ব্যাপকহারে রুট লেভেলে বিএনপির নেতাকর্মী নিগ্রহের শিকার হয়েছে।
বাম দলগুলোর তেমন ভোট নেই। তারা সংখ্যায় অল্প। জুনায়েদ সাকির মতো লোকজন নিয়মিতই মিডিয়ায় ফুটেজ খেয়েছে। তারা তেমন একটা অত্যাচারের শিকার হয় নি। ইসলামী দলগুলোর কেউ কেউ আওয়ামী লীগের জোটে যোগ দিয়েছে। হেফাজতে ইসলামের মতো সংখ্যায় বেশি দলকে বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা দিয়ে পক্ষে রাখা হয়েছে, যদিও অন্তর্কলহের সুযোগে মামুনুল হকের মতো তাদের দুয়েকজন নেতাকে সাময়িক জেলে আটকিয়ে রাখা হয়েছিলো। চরমোনাই পীরের মতো কিছু দল প্রকাশ্যে হম্বিতম্বি করলেও আওয়ামী লীগের অধীনে নির্বাচনে গিয়েছে এবং অত্যাচার নিপীড়নের শিকার হয় নি। জামায়াতে ইসলামী, আনসারুল্লাহ, হিজবুত তাহরীরের মতো দলগুলো মূলত আন্ডারগ্রাউন্ডে কাজ করেছে। ক্ষমতার কেন্দ্রে তাদের সুপ্ত সমর্থক থাকায়, তাদেরকে সরকারের অনেকেই ধরতে চায় নি, কখনো ধরতে চাইলেও ধরা সম্ভব হয় নি। দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে যেখানে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ, এমনকি সেখানেও এরা রাজনৈতিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পেরেছে। ৫ই আগস্টের পর এখন এদের কার্যক্রম যে চলমান ছিলো, তা পুরোপুরি প্রকাশ্য।
অন্যদিকে রুট লেভেল থেকে শুরু করে একেবারে টপ লেভেল পর্যন্ত বিএনপির নেতাকর্মীরা মামলা-হামলার শিকার হয়েছেন। খালেদা জিয়ার মতো নেত্রীকে মাত্র ৩ কোটি টাকার মামলায় ফাঁসিয়ে আজীবন জেলে রাখার বন্দোবস্ত করা হয়েছে। তারেক রহমানকে ফাঁসির রায় না দিয়ে বুদ্ধি করে যাবজ্জীবন দেয়া হয়েছে, যাতে তাকে ইংল্যান্ড থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে সাজা ভোগ করানোর পথ খোলা থাকে। ফাঁসির রায় দিলে পশ্চিমারা মানবতার কারণে কাউকে ফেরত দেয় না। মির্জা ফখরুল, রিজভি, গয়েশ্বর, আলাল, দুদু, এমনকি মির্জা আব্বাসের মতো নেতাদেরকে সরকার যখনই চেয়েছে, তখনই আটক করে হাজতে পুরেছে। মোদ্দাকথা, গত ১৫ বছরে বিএনপি যে পরিমাণ অত্যাচার ভোগ করেছে, জামায়াত বা অন্য কোনো দল তার ধারেকাছেও নিগৃহীত হয় নি।
বিএনপি এই পুরো সময়েই জোটের অন্যান্য দলগুলোর প্রতি সম্মান রক্ষা করে চলেছে। এখন এনজিও সরকার যারা চালাচ্ছেন, সেই সুশীল সমাজ বারবার চাপ দেয়া সত্ত্বেও তারা জামায়াতকে ছাড়ে নি। দলের ভিতরে চাপ ছিলো, বিদেশী চাপও ছিলো। কিন্তু জোটের ব্যাপারে সংখ্যায় ছোট বলে কাউকেই তারা ত্যাগ করে নি। অন্যদিকে এনজিও সরকার ক্ষমতায় বসার পরই জামায়াত যেমন তাদের চোখের মণি হয়েছে, বিএনপি যেন তাদের সৎপুত্র হয়ে গেছে।
এখন পর্যন্ত ড. ইউনূসের মামলা খারিজ হয়েছে, জামায়াতের নিষেধাজ্ঞা উঠিয়ে নেয়া হয়েছে, ইসলামী জ*ঙ্গী দলগুলোর নেতাকর্মীদেরকে জেল থেকে বের করা হয়েছে। এদের মধ্যে আছে খু*নি আনসারুল্লাহর প্রধান জসিম উদ্দিন রাহমানী, শিবির নাসিরের মতো টপ স*ন্ত্রাসীরা। শুধু যে রাজনৈতিক স*ন্ত্রাসীরা ছাড়া পেয়েছে তা নয়, ছাড়া পেয়েছে কুখ্যাত সুইডেন আসলাম (১৩ই আগস্ট), ধানমন্ডির ইমন (১৫ই আগস্ট), কি*লার আব্বাস (১১ই আগস্ট) - এর মতো পেশাদার খু*নিরা। এরা এমনকি জে*লে বসেও স*ন্ত্রাসী বাহিনীকে নিয়ন্ত্রণ করতো।
কিন্তু সরকার পতনের আন্দোলন করে বিএনপির অর্জন সবেধন নীলমণি খালেদা জিয়ার সাজা প্রত্যাহার। শোনা যাচ্ছে, তাকে আদতে মাইনাস করে বিদেশে পাঠিয়ে দেয়ার জন্যই এটা করা হয়েছে। তড়িঘড়ি করে পাসপোর্টের ব্যবস্থা করায় মাইনাসের প্রসঙ্গ বিশ্বাসযোগ্য বলেই মনে হচ্ছে। রুট লেভেলে বিভিন্ন জ্বা*লাও-পোঁ*ড়াওয়ের জন্য বিএনপির নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা দেয়া হচ্ছে।
অন্যদিকে বিএনপির সভাপতি তারেক রহমানের সাজা প্রত্যাহার করা হয় নি। জ*ঙ্গীদের পর্যন্ত ছেড়ে দেয়া হলেও তারেক জিয়া ৩ সপ্তাহেও দেশে ফিরতে পারেন নি। তার ব্যাপারে সবাই চুপচাপ। কোনো আলোচনা নেই। শীর্ষ স*ন্ত্রাসী ও জ*ঙ্গীদেরকে ছেড়ে দেয়ার ব্যাপারে কোনো আইনের তোয়াক্কা করা হয় নি। তাহলে তারেকের সাজা মওকুফের ব্যাপারে কেন সবাই চুপচাপ? অন্তত রাষ্ট্রপতিকে দিয়েওতো তাকে ক্ষমা করে ক্লিনশিট দেয়া যায়। গত ১৫ বছরে বিএনপির রাজনীতি স্থবিরতার শিকার হয়েছে মূলত নেতৃত্বের অভাবে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তারেক জিয়া দেশে এসে দলের হাল ধরলে বিএনপি যে গতি পাবে, তাকেই ভয় করছে ড. ইউনূসের নেতৃত্বে এনজিও সরকার। তাদেরকে সঙ্গ দিচ্ছে জামায়াত। বিএনপিকে ক্ষমতার সমীকরণ থেকে মাইনাস করা হয়েছে।
আজ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর মুখ ফুটে বলে ফেলেছেন, "আমাদের যে জোট ছিল, আন্দোলনের জন্য জোট, সেটা অনেক আগেই অকার্যকর হয়ে গেছে। এটা এখন কোনো কাজ করে না। অনেক আগেই আমরা যুগপৎ আন্দোলন শুরু করেছি, বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে আলোচনা করে প্রগ্রাম ঠিক করে যুগপৎ আন্দোলন করেছি সরকার পতন অবধি। এটা এখন বলবৎ নেই।" অর্থাৎ, জামায়াত এখন আর তাদেরকে চিনে না।
প্রশ্ন হলো, এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি এক হয়ে কি আবার অবৈধ এনজিও সরকারের বিরুদ্ধে ভোটের অধিকারের জন্য আন্দোলন করতে পারবে? সজীব ওয়াজেদ জয় তাদের পক্ষ থেকে প্রস্তাব দিয়ে রেখেছেন। মির্জা ফখরুলও সে প্রস্তাবকে নাকচ করে দেন নি। খালেদা জিয়ার বক্তব্যেও মনে হয়েছে তিনি অতীত তিক্ততা ভুলে গণতন্ত্রের জন্য কাজের পক্ষে। বাংলাদেশের প্রায় দুই তৃতীয়াংশ মানুষই এই ২ দলের সমর্থক। সুতরাং সুষ্ঠু ভোটের বিচারে এই ২ দলের বাইরের কেউ গণতান্ত্রিকভাবে সরকার গঠন করতে পারবে না। তবে তার আগে অবৈধ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারকে তো তাড়াতে হবে।
এরপরও আমার বিবেচনায় অদূর ভবিষ্যতে এই ২ দল এক হয়ে ড. ইউনূসের এনজিও সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার সম্ভাবনা খুবই কম। ১৯৯১ থেকে ২০২৪ পর্যন্ত অনেক হিসাবই রয়ে গেছে একে অন্যের বিপক্ষে। গ্রেনেড হামলাসহ কিছু মারাত্মক ভুল সিদ্ধান্ত যেমন আছে, তেমন আছে বিএনপির কিছু অর্বাচীন সেক্টর কমান্ডার জিয়াকে স্বাধীনতার ঘোষক বলে প্রচার করা, আবার আওয়ামী লীগের কিছু অর্বাচীন জিয়াকে রাজাকার বলে প্রচার করা।
এই হিসাব নিকাশগুলোকে কাটিয়ে ওঠার কাজটা সহজ হবে না। তবে এনজিও সরকার যেভাবে দেশকে ধংস করার দিকে আগাচ্ছে, তাতে আফগানিস্তান বা সিরিয়ার পরিণতি ঠেকাতে গণতান্ত্রিক শক্তিগুলো একসময় এক হয়ে যাবে, সন্দেহ নেই।
20240807 ®