09/02/2025
মার্কিন স্টেট ডিপার্মেন্টের কর্মকর্তা মাইক বেঞ্জ এর ইন্টারভিউটির বাংলা করে দেয়া হলো-
এই আগস্ট মাসে, বাংলাদেশের একজন প্রধানমন্ত্রীকে মূলত এক ধরনের সামরিক অভ্যুত্থান এবং "কালার রেভোলিউশন" (রঙিন বিপ্লব)-এর মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয়।
ম্যাক্স ব্লুমেনথাল-এর "দ্য গ্রে জোন" এই বিষয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা আমি গত এক সপ্তাহ ধরে অনেকবার আলোচনা করেছি। কারণ এটি একটি পরিষ্কার উদাহরণ, যেখানে এই ধরনের রাজনৈতিক পরিবর্তনের বিভিন্ন দিক উঠে এসেছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অসন্তোষ ও ষড়যন্ত্রের শুরু
প্রায় ২০১৮ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে, এটি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে, যুক্তরাষ্ট্রের নীতি-নির্ধারকরা শেখ হাসিনার নির্বাচনী বিজয়ে খুশি ছিল না।
🔹 যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টে একাধিক গোপনীয় মূল্যায়ন পাঠানো হয়।
🔹 সেখানে বলা হয়, কীভাবে বাংলাদেশের বিরোধী দল বিএনপি-কে সমর্থন দিয়ে শক্তিশালী করা যায়।
🔹 কারণ যুক্তরাষ্ট্র মনে করত, বিএনপি তাদের স্বার্থের জন্য বেশি উপকারী।
যদিও ফাঁস হওয়া নথিগুলোতে বিস্তারিত উল্লেখ করা হয়নি, তবে বিভিন্ন জায়গায় দেখা যায়, শেখ হাসিনার সরকার এবং যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির মধ্যে একাধিক সংঘাত ছিল।
হিলারি ক্লিনটনের হুমকি ও সামরিক ঘাঁটি নিয়ে বিরোধ
উইকিলিকস থেকে জানা যায়, যখন হিলারি ক্লিনটন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন, তখন তিনি শেখ হাসিনার ছেলের বিরুদ্ধে "আইআরএস"-এর মাধ্যমে কর পরিদর্শনের হুমকি দেন।
শেখ হাসিনা নিজেই বলেছেন, তিনি মনে করেন, তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছে কারণ তিনি বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি তৈরি করতে দেননি।
এটি অনেক দেশের সঙ্গেই ঘটে—কারণ বেশিরভাগ দেশই তাদের ভূমিতে বিদেশি সেনা চায় না।
🔹 তারা চায় না যে, তাদের ৫০০ একর জমি বিদেশি সামরিক ঘাঁটির দখলে চলে যাক।
🔹 তারা চায় না যে, এই ঘাঁটি অন্য কোনো দেশের সঙ্গে উত্তেজনা তৈরি করুক।
এমন ঘটনা রোমানিয়াতেও ঘটছে, যেখানে বৃহত্তম ন্যাটো সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা হচ্ছে, যা সরাসরি ক্রিমিয়ার দিকে মুখ করা।
যুক্তরাষ্ট্রের পরিকল্পিত সরকার পরিবর্তন (Regime Change)
চলুন ধরে নেই—
✅ যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের জন্য যদি বাংলাদেশে সামরিক ঘাঁটি তৈরি করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়,
✅ কিন্তু বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যদি এতে রাজি না হন,
✅ তাহলে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারকরা সিদ্ধান্ত নেয়, সরকার পরিবর্তনের (regime change) জন্য কাজ করবে।
এটি নৈতিকভাবে ভালো বা খারাপ, সেই বিতর্কে না গিয়েও বলা যায় যে—
📌 যদি হোয়াইট হাউস, স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিল একমত হয় যে, এই সরকারকে সরাতে হবে, তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সব ধরনের কৌশল ব্যবহার করবে।
📌 এর মধ্যে থাকবে—
🔹 দেশকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করা
🔹 বিরোধী দলকে সমর্থন দিয়ে শক্তিশালী করা
🔹 "গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার" নামে বিভিন্ন সংগঠনকে কাজে লাগানো
🔹 অবশেষে হয় নির্বাচনের মাধ্যমে, নয়তো "কালার রেভোলিউশনের" মাধ্যমে সরকার ফেলে দেওয়া
এটিই ছিল বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির পেছনের মূল ষড়যন্ত্র।
ধরুন, এটি যদি যুক্তরাষ্ট্রের সরকার, স্টেট ডিপার্টমেন্ট, হোয়াইট হাউস এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের একটি সুস্পষ্ট বা গোপন নীতি হয়, যেখানে তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে—
🔹 এই সরকারকে সরিয়ে ফেলতে হবে।
🔹 দেশটিকে রাজনৈতিকভাবে অস্থিতিশীল করতে হবে।
🔹 বর্তমান সরকারকে দুর্বল করে দিতে হবে।
🔹 সেই দেশে নিজেদের অনুগত রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান ও কর্মীদের শক্তিশালী করতে হবে।
🔹 পরবর্তী নির্বাচনে তাদের অনুকূল সরকার আনতে হবে অথবা ‘কালার রেভোলিউশনের’ মাধ্যমে সরাসরি সরকার ফেলে দিতে হবে।
এমন পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীকে হয়ত হেলিকপ্টারে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হতে পারে, যেমনটা বাংলাদেশে ঘটেছে।
গ্রে জোন-এর ফাঁস হওয়া নথির তথ্য
⚡ "দ্য গ্রে জোন"-এ ফাঁস হওয়া দলিলপত্র দেখায়, কীভাবে যুক্তরাষ্ট্র এই পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেছে।
এতে বিশেষভাবে উঠে এসেছে ন্যাশনাল এন্ডাওমেন্ট ফর ডেমোক্রেসি (NED)-এর রাজনৈতিক শাখাগুলোর ভূমিকা—
🔹 এর মধ্যে রিপাবলিকান দলের শাখা হলো "ইন্টারন্যাশনাল রিপাবলিকান ইনস্টিটিউট (IRI)"।
🔹 ডেমোক্র্যাটিক দলের শাখা হলো "ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইনস্টিটিউট (NDI)"।
🔹 এই দুই সংস্থা মূলত যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতির অংশ হিসেবে গণতন্ত্র প্রচারের নামে সরকার পরিবর্তনে কাজ করে।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে অস্থিরতা তৈরি করার পরিকল্পনা
২০১৯-২০২০ সালে, যখন যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত বিএনপি নির্বাচন থেকে পরাজিত হয়, তখন IRI একটি পরিকল্পনা তৈরি করে।
📌 পরিকল্পনার মূল উদ্দেশ্য ছিল—
✅ বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করা। (এটি সরাসরি উদ্ধৃতি)
✅ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে কাজে লাগিয়ে সরকারবিরোধী আন্দোলন উসকে দেওয়া।
✅ দেশের রাজনৈতিক পরিসরকে দুর্বল করে দেওয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যৎ নির্বাচনকে প্রভাবিত করা।
যুক্তরাষ্ট্রের কৌশল
👉 "গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা"র নামে অর্থায়ন ও প্রশিক্ষণ দেওয়া
👉 বিরোধী দলকে সংগঠিত করা
👉 গণমাধ্যম, এনজিও, ও ছাত্র সংগঠনগুলোকে ব্যবহার করা
👉 যেকোনোভাবে সরকারকে দুর্বল করা ও পরিবর্তন করা
এই নথিতে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করতে কাজ করেছে।
বাংলাদেশের রাজনীতিকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা
যুক্তরাষ্ট্র ১৭০ জন তথাকথিত "গণতন্ত্রপন্থী কর্মী" ও ৩০৪ জন গুরুত্বপূর্ণ তথ্যদাতা চিহ্নিত করে, যাদের সাথে তারা কাজ করেছে।
📌 তাদের কৌশল ছিল—
🔹 বাংলাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও সাংস্কৃতিক বিভাজনকে কাজে লাগানো।
🔹 দেশের রাজনীতিকে দুর্বল করা বা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তিকে মজবুত করা।
এজন্য তারা LGBTQ+ গোষ্ঠী, সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠী, ছাত্র আন্দোলন ও তরুণদের ব্যবহার করার পরিকল্পনা করে।
🔹 তারা লক্ষ করে যে, বাংলাদেশে তরুণদের মধ্যে র্যাপ সংগীত জনপ্রিয়।
🔹 তারা দেখে যে, আগের বছর স্থানীয় কিছু রাজনৈতিক ইস্যুতে ছাত্রদের আন্দোলন হয়েছিল।
🔹 তারা ভাবে, এই বিষয়গুলোকে কাজে লাগিয়ে আন্দোলন উসকে দেওয়া সম্ভব।
সংগীতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার
তারা ঠিক কী করল?
👉 যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের করের টাকা (taxpayer money) নিয়ে ব্যবহার করল।
👉 এই টাকা স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে আসে এবং USAID-এর মাধ্যমে পরিচালিত হয়।
👉 তারা বাংলাদেশি র্যাপারদের ফান্ড দেয় সরকারবিরোধী গান বানানোর জন্য।
👉 এই গান ও মিউজিক ভিডিওর মাধ্যমে তরুণদের রাস্তায় নামতে উৎসাহিত করা হয়।
👉 বলা হয় "শান্তিপূর্ণ বিক্ষোভ" করতে, কিন্তু আসলে এটি দাঙ্গায় পরিণত হয়।
এভাবেই সংস্কৃতি, ছাত্র আন্দোলন, সংখ্যালঘু গোষ্ঠী ও সংগীতকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশে অস্থিরতা তৈরির চেষ্টা করা হয়।
সরকারবিরোধী সংগীতের মাধ্যমে জনগণের মনে ক্ষোভ ছড়ানোর পরিকল্পনা
📌 IRI তাদের "Baseline Assessment" রিপোর্টে যা জানিয়েছিল:
🔹 তারা এমন একটি গান স্পন্সর করেছিল, যার উদ্দেশ্য ছিল জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভ সৃষ্টি করা।
🔹 সরকারের জনপ্রিয়তা নষ্ট করতে এই গান ব্যবহার করা হয়।
🔹 একটি গান মানুষকে রাস্তায় নামার জন্য উসকে দেয়, আরেকটি গান সরকারকে অবিশ্বাস করতে শেখায়।
👉 এই রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, এ ধরনের গান ও প্রচারণা কাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলবে, তা তারা আগেই বিশ্লেষণ করেছিল।
👉 তারা মাঠপর্যায়ে গবেষণা করে দেখেছিল, কোন গোষ্ঠীগুলো এসব বার্তার প্রতি সবচেয়ে সংবেদনশীল হবে।
👉 এই কৌশলের মূল উদ্দেশ্য ছিল— জনগণের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করা ও সরকারবিরোধী মনোভাব তৈরি করা।
উগ্রবাদী ও অপরাধীদের কাজে লাগানোর পরিকল্পনা
🔹 যখন একটি সরকার জনগণের মধ্যে জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, তখন বৈশ্বিক রাজনীতির শক্তিশালী গোষ্ঠীগুলো সমাজের প্রান্তিক, উগ্রবাদী ও অপরাধীদের কাজে লাগিয়ে অস্থিরতা সৃষ্টি করে।
🔹 কিছু ক্ষেত্রে, তারা সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও অস্থায়ী মিলিশিয়া দলগুলোকেও অর্থায়ন করে।
👉 ২০০৯ সালে কিউবার জন্য করা এক গোপন রিপোর্টে বলা হয়:
🔸 "Afro-Cuban" সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ণবাদী বিদ্বেষ উসকে দিয়ে কিউবার সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলা যেতে পারে।
🔸 সমাজের অবহেলিত জনগোষ্ঠী, বেকার মানুষ, অপরাধী, মাদকাসক্ত ও যৌনকর্মীদের কাজে লাগানো সম্ভব।
🔸 USAID (যুক্তরাষ্ট্রের সাহায্য সংস্থা) এই প্রক্রিয়ার অংশ হতে পারে।
📌 এখানেও একই কৌশল ব্যবহার করা হয়:
👉 কিউবার জনগণের মধ্যে সরকারের প্রতি ক্ষোভ তৈরি করতে র্যাপ সংগীতকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়।
👉 কারণ, ঐ সময় কিউবায় র্যাপ সংগীত তরুণদের মধ্যে খুব জনপ্রিয় ছিল।
👉 তাই যুক্তরাষ্ট্রের টাকায় র্যাপারদের দিয়ে সরকারবিরোধী গান তৈরি করা হয়।
এভাবেই বিশ্বব্যাপী একই প্যাটার্নে রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করা হয়— সংস্কৃতি, সংগীত, জাতিগত বিভেদ ও প্রান্তিক গোষ্ঠীগুলোকে কাজে লাগিয়ে একটি দেশের ভিতর থেকে বিপ্লব উসকে দেওয়া হয়।