19/12/2024
🔴হুন্ডির ইতিহাস
উপমহাদেশে হুন্ডির উদ্ভব মুঘল আমলে। রাজধানী দিল্লি থেকে প্রদেশগুলোর দূরত্ব ছিলো অনেক বেশি। তাছাড়া পথঘাটও ছিল অনেক দুর্গম ও বিপদসঙ্কুল। প্রদেশগুলো থেকে আদায় করা রাজস্ব দিল্লিতে প্রেরণের জন্য স্থানীয় মহাজনদের সাহায্য গ্রহণ করতেন বিভিন্ন প্রদেশের মুঘল প্রশাসকরা। এই স্থানীয় মহাজনদের ছিল ভারতজুড়ে নিজস্ব নেটওয়ার্ক। তারা নিজেদের মধ্যে অর্থ বিনিময় করতেন এক ধরনের স্বীকৃতিপত্র বা দলিলের মাধ্যমে, যাকে তুলনা করা যায় আধুনিক ব্যাংকিংয়ের চেকের সাথে। এই দলিলকেই বলা হতো হুন্ডি।
ভারতের বিভিন্ন শহরে গড়ে ওঠা মহাজনদের এই নেটওয়ার্ক আবার বজায় থাকতো তাদের পরিচিতি, দীর্ঘদিনের লেনদেন এবং পারস্পরিক বিশ্বস্ততার মধ্য দিয়ে। মুঘল প্রশাসকরা দিল্লিতে রাজস্ব পাঠানোর জন্য এই মহাজনদের ওপর নির্ভর করতেন। এই মহাজনরাই তাদের নিজস্ব নেটওয়ার্কের মাধ্যমে অর্থ পৌঁছে দিতেন কাঙ্ক্ষিত গন্তব্যে। ১৭৫৭ সালের পলাশী ট্রাজেডির অন্যতম কুশীলব জগৎ শেঠও ছিলেন একজন হুন্ডির মহাজন। পুরো ভারত জুড়ে ছিল তার হুন্ডির কারবার। মুঘল আমলের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ আমলেও জনপ্রিয়তা পায় হুন্ডি। এর কার্যকারিতার জন্য ব্রিটিশরাও একে অর্থ লেনদেনের দেশীয় ব্যবস্থা হিসেবে মেনে নেয়। এমনকি একে বৈধতা দেবার জন্য রানীর সিলসহ স্ট্যাম্প ব্যবহারের প্রচলন করে।
কেন হুন্ডি করা হয়?
ওয়াশিংটনভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেগ্রিটির (জিএফআই) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে বাংলাদেশ থেকে ৪ হাজার ৯৬৫ কোটি ডলার পাচার হয়েছে, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় সোয়া ৪ লাখ কোটি টাকার মতো। অর্থাৎ যখনই পাচার বাড়ে, তখনই হুন্ডি চাঙা হয়ে ওঠে।
বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিটের (বিএফআইইউ) দেওয়া তথ্য অনুযায়ী অবৈধ গেমিং, বেটিং বা জুয়া এবং অনলাইনে বৈদেশিক মুদ্রার বাণিজ্যের মাধ্যমে পাচার হচ্ছে নগদ ডলার। আর এ বিষয়ে বিস্তারিত তদন্তে নেমেছে সিআইডি। বিদেশে শ্রমিক পাঠানো বাড়লেও বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স কমছে। আবার বিদেশ ভ্রমণ নানাভাবে নিরুৎসাহিত করার পরও দেশের বাজারে নগদ ডলারের ব্যাপক সংকট তৈরি হয়েছে।
অবৈধ অর্থ লেনদেনে
বিদেশ থেকে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠানো ও দেশ থেকে অর্থ পাচার এই দুটো বিষয়ই ওতপ্রোতভাবে জড়িত। আর পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে। প্রচলিত ব্যাংকিং চ্যানেলে বিদেশ থেকে ডলার আনলে বা ডলার এনে ঘোষণা দিলে সেটা বৈদেশিক মুদ্রার ভান্ডারে যোগ হয়। কিন্তু অনুমোদিত চ্যানেলের বাইরে দেশে অর্থ আসলে সেটা রিজার্ভে জমা হয় না। আবার অবৈধ আয়, চাঁদাবাজি-তদবিরে আয় করা অর্থ, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ সাধারণত দেশ থেকে পাচার হয়। এছাড়া রফতানি মূল্য কম দেখিয়ে এবং আমদানি মূল্য বেশি দেখিয়ে বৈদেশিক মুদ্রা পাচার করা হয়। পুরো প্রক্রিয়াটি সংঘটিত হয় হুন্ডির মাধ্যমে।
প্রযুক্তির সহায়তায়
একটা সময় হুন্ডি ঝুঁকিপূর্ণ থাকলেও প্রযুক্তির ছোঁয়ায় লেনদেনকারীদের জন্য তা এখন অনেকটাই ঝাঁমেলা মুক্ত। বিদেশে বসে দেশে পরিজনদের কাছে টাকা পাঠানো শুধু একটা ফোনকলের ব্যাপার মাত্র। বিদেশের কর্মস্থল থেকে এজেন্টকে ফোন দিয়ে পরিমাণ বলে দিলেই তারা সমপরিমাণ টাকা পৌঁছে দিয়ে আসেন গ্রাহকের স্বজনের কাছে। এক্ষেত্রে তারা ব্যবহার করেন বিভিন্ন মোবাইল ব্যাংকিং কোম্পানির সেবা। এছাড়া গ্রামে বা শহরে একেবারে গ্রাহকদের বাড়িতে গিয়েও হাতে হাতে টাকা পৌঁছে দেন হুন্ডির কারবারিরা।
প্রবাসীরা কেন হুন্ডিতে ঝুঁকে
শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের হিসাবে ২০২১ সালে ৬ লাখ ৩০ হাজার শ্রমিক বিদেশে গেছেন। চলতি বছরের প্রথম ৬ মাসেই বিদেশে গেছেন আরও ৬ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক। এরপরও রেমিট্যান্স কমছে। বিশেষজ্ঞ মহল এর মূল কারণ হিসাবে হন্ডিকেই দেখছে।
প্রবাসীরা কেন হুন্ডিতে টাকা পাঠায়, এই বিষয়ে প্রবাসী দিগন্তের নিজস্ব অনুসন্ধানে বেশ কয়েকটি তথ্য উঠে এসেছে।
হুন্ডির অপকারিতা ও ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে প্রবাসীদের অজ্ঞতা।
দেশের রেমিটেন্স পাঠানোর ক্ষেত্রে বৈধ চ্যানেলের চেয়ে হুন্ডিতে রেট বেশি পাওয়া।
অনেক প্রবাসী অবৈধভাবে প্রবাসে অবস্থান করার কারণে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে না পারা।
অনেক প্রবাসী কর্মী প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তিবদ্ধ বেসিক স্যালারির বাহিরে উপরি উপার্জন করে যা বিভিন্ন দেশের হুন্ডি আইনের কারণে বৈধ চ্যানেলে পাঠাতে পারেনা বিদায় হুন্ডিতে ঝুঁকে।
আবার বেশ কিছু দেশ থেকে সরাসরি রেমিটেন্স পাঠানোর সুযোগ না থাকায় ও হুন্ডির প্রতি ঝুঁকে প্রবাসীরা।
আবার কিছু প্রবাসী বলেছে, তাদের কাজের অবস্থান প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখান থেকে সহজে কোন বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠানো সম্ভব হয় না, অনেক ক্ষেত্রে তারা আবার ছুটি ও পায় না, এমতাবস্থায় প্রযুক্তির সহায়তায় হুন্ডির প্রতি ঝুঁকছে তারা।
এছাড়াও ইদানিং কিছু অসাধু লোক সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলো ব্যবহার করে হুন্ডির লোভনীয় প্রচার-প্রচারণা চালাচ্ছে যা দেখেও প্রবাসীরা হুন্ডির প্রতি আগ্রহী হচ্ছে।
হুন্ডির অপকারিতা ও ক্ষতি
এক সময় হুন্ডি পদ্ধতির ব্যাপক জনপ্রিয়তা ছিল। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় হুন্ডিকে রেমিট্যান্স ধ্বংসকারী পদ্ধতি হিসেবে ধরা হয়। এতে ব্যাংকিং নিয়ম অনুসরণ করা হয় না। ফলে রাজস্ব আয় থেকে বঞ্চিত হয় সরকার। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী এটি অপরাধ। হুন্ডির নানা ক্ষতির দিক রয়েছে। যেমন:-
আয়কর কর ছাড় মেলে না।
বৈধ উপার্জন অবৈধ হিসাবে রূপান্তরিত হয়।
হুন্ডির লেনদেহ নানা দেশের নির্ধারিত সংস্থা দ্বারা যাচাই হয়। যেমন, বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (BFIU)।
হুন্ডিতে টাকা পাঠালে প্রবাসী রাষ্ট্রীয় সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হন।
অর্থ পাঠানা ও অর্থ প্রাপ্তি ঝুঁকিপূর্ণ হয়। অনেক সময় নানা জটিলতা সৃষ্টি হয়।
ব্যাংকিং সুবিধা বা বিনিয়োগ পাওয়া যায় না।
হুন্ডির ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ হ্রাস পায়। এতে নিজের ও প্রবাসের দেশের অর্থনীতির ক্ষতি হয়। ফলে দুই দেশের হিসাবে গড়মিল হলে সম্পর্কে ঝামেলা হতে পারে।
অবৈধ টাকার মালিকরা প্রবাসীদের টাকা বিদেশে রেখে সম্পদ পাচার করার সুযোগ পেয়ে যায়।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নজরে এলে অপরাধীদের শাস্তির মুখে পড়তে হবে।
হুন্ডি সমস্যা সমাধানের পথ
হুন্ডি বন্ধে বিদেশে অবস্থিত দূতাবাসগুলো সক্রিয় ভূমিকা রাখতে পারে। রেমিট্যান্সের বড় উৎসের দেশগুলো; বিশেষ করে সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কুয়েত, কাতার, বাহরাইন, ওমান, ইটালি, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য— এসব দেশের দূতাবাসগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও সংস্থার সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করলে খুব দ্রুত সুফল পাওয়া যাবে।
এছাড়া দেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ শাখার মাধ্যমে প্রয়োজন হলে জেলায় জেলায় বিশেষ টিম গঠন করে হুন্ডি লেনদেনকারীদের বিরুদ্ধে ‘মানি লন্ডারিং প্রিভেনশন অ্যাক্ট- ২০১২’ সহ প্রযোজ্য সকল প্রচলিত আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা করতে হবে। দূতাবাসগুলোতে কোনো প্রবাসী কর্মী সেবা নিতে গেলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর স্লিপ প্রদর্শন বাধ্যতামূলক করতে হবে। পাশাপাশি প্রণোদনার হার আরও বাড়াতে হবে।
হুন্ডি প্রসঙ্গে দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন,
রেমিট্যান্স হুন্ডি হওয়া মানেই অর্থপাচার। অর্থাৎ দেশে যে বৈদেশিক মুদ্রা আসার কথা ছিল তা আসছে না। বিদেশেই থেকে যাচ্ছে। কিন্তু দেশে সমপরিমাণ অর্থ লেনদেন হচ্ছে। এর প্রভাবে আজ টাকার সঙ্গে ডলারের মূল্যের এত ব্যবধান।
হুন্ডি রোধে কী করা প্রয়োজন— জানতে চাইলে টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক বলেন,
‘প্রথমে যারা এর সঙ্গে জড়িত তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি প্রবাসীরা যেন হুন্ডিতে অর্থ না পাঠান এজন্য অফিসিয়াল চ্যানেলে প্রণোদনা বাড়াতে হবে। যাতে বৈধ পথে হুন্ডির সমপরিমাণ অর্থ তিনি পান। তবে, এ সুবিধা সবাইকে না দিয়ে শুধুমাত্র প্রবাসী শ্রমিকদের দিলে ভালো হবে।’
হুন্ডি বিষয়ে আইন কী বলে
বাংলাদেশ সরকার ২০০২ সালে মানি লন্ডারিং আইন প্রণয়ন ও প্রবর্তন করে যার নাম "মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০০২ "। পরবর্তীতে, বাংলাদেশে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ সংক্রান্ত বিদ্যমান আইন ও অধ্যাদেশ রহিত করে "মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২" নামে নতুন একটি আইন পাশ হয়। যেহেতু মানি লন্ডারিং কার্যক্রমে মুদ্রা পাচার জড়িত এবং এতে ব্যাংকসমূহের সহায়তা প্রয়োজন, তাই এই আইন প্রয়োগের দায়িত্ব কেন্দ্রীয় ব্যাংক অর্থাৎ বাংলাদেশ ব্যাংককে দেয়া হয়েছে। উক্ত আইনে ২৮টি সম্পৃক্ত অপরাধের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থ ও সম্পত্তি অর্জন বা স্থানান্তরের উদ্দেশে উল্লেখিত সম্পৃক্ত অপরাধ সংগঠন বা এর সাথে জড়িত কার্যক্রম মানিলন্ডারিং হিসেবে বিবেচিত হয়। এই আইনে প্রদত্ত ক্ষমতা ও কার্যাবলী সুষ্ঠুভাবে সম্পাদনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট নামে একটি পৃথক কেন্দ্রীয় সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয় যেটি বাংলাদেশ ব্যাংক দ্বারা পরিচালিত হয়।
উক্ত আইনে, মানিলন্ডারিং অপরাধের শাস্তি রাখা হয়েছে:
ব্যক্তির ক্ষেত্রে: অন্যূন ৪ (চার) বছর এবং অনধিক ১২ (বার) বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড এবং অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির দ্বিগুণ মূল্যের সমপরিমাণ বা ১০ (দশ) লক্ষ টাকা পর্যন্ত, যাহা অধিক, অর্থদণ্ড এবং
প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে: অপরাধের সাথে সংশ্লিষ্ট সম্পত্তির মূল্যের অন্যূন দ্বিগুণ অথবা ২০ (বিশ) লক্ষ টাকা, যাহা অধিক হয়, অর্থদণ্ড এবং উক্ত প্রতিষ্ঠানের নিবন্ধন বাতিল করা।