12/31/2024
সিলটীয়ারা হল মঙ্গোলয়েড জাতিগোষ্ঠির মানুষ। মঙ্গোলয়েড জাতির সাথে অস্ট্রোএসিয়াটিক জাতির মিশ্রণের ফলে আধুনিক সিলটীয়া জাতির জন্ম হয়েছিল। তাছাড়াও পরবর্তীতে আরব, তুর্কিস, চীনা, ইরানি, পর্তুগিজদের মতো বিভিন্ন জাতির মানুষের সাথে সিলটীয়াদের মিশ্রণ ঘটে আজ সিলটীয়ারা এক বৈচিত্র্যময় বৈশিষ্ট্য এবং চেহারা পেয়েছে।
সিলটীয়া জাতির DNA ফলাফল থেকে জানা গিয়েছে সিলটীয়া জাতির DNAএর সাথে অসমীয়া জাতির DNA সব থেকে বেশি মিলে। সিলটীয়াদের DNA ফলাফলের নমুনা থেকে দেখা যায় সিলটীয়াদের বেশিরভাগ অংশ Nort East Indian (উত্তর পূর্ব ভারতীয় আদিবাসী) মঙ্গোলয়েড জাতির DNA থেকে আসা। এতে প্রমাণ হয়েছে সিলটীয়াদের পূর্ব পুরুষ মঙ্গোলয়েড জাতির মানুষ ছিল। যারা মূলত উত্তর পূর্ব ভারতীয় সব আদিবাসী জাতিগুলোর পূর্ব পুরুষ। তাছাড়া ৭শত বছর আগেও সিলটীয়া জাতির সাথে প্রচুর বালচ, ইরানি, তুর্কিস, উজবেকিস্তানী, আফগানিস্তানী, তাজিকিস্তানী, ফিলিপাইনী, আরব, চীনা, কলাম্বিয়ান, পর্তুগীজ, ক্যামের, জাপানি, ইন্দোনেশিয়ান জাতির মিশ্রণ ঘটেছে।
সিলটীয়া জাতিকে নিয়ে যত গবেষকরা গবেষণা করেছেন এবং বই লিখেছেন। তাদের সবাই বার বার একটি কথাই বলেছেন। প্রাচীন কালে সিলটীয়া, অসমীয়া, চাটগাঁইয়া, চাকমা, রংপুরীয়া, মারমা, ত্রিপুরী, মণিপুরী, গারো, হাজং, তঞ্চঙ্গা, ডালু, কোচ জাতিগুলো একই জাতি ছিল এবং তারা একই চীনা তিব্বতীয় ভাষায় কথা বলতেন। প্রত্যেক গবেষকদের গবেষণা থেকে বার বার একই তথ্য ওঠে এসেছে, যে সিলটীয়া জাতির সাথে বাঙালি জাতি বা বাংলা ভাষার কোনো সম্পর্ক নেই এবং অতীতেও ছিল না।
সিলট রাজ্য এবং সিলটীয়া জাতির নামকরণের ইতিহাস:
খ্রিষ্টপূর্ব ২০০০ বছর আগে যখন সিলটীয়া জাতির পূর্ব পুরুষরা Sino Tibetian ভাষায় কথা বলতেন। তখন সেই চীনা-তিব্বতীয় ভাষার সির শব্দ থেকে সিরট তথা সিলট নামের উৎপত্তি। সিলটীয়া ভাষায় এখনো রেশমকে "সির" বলা হয়। উত্তর পূর্ব ভারতের আদিবাসী মঙ্গোলয়েড জাতিগোষ্ঠীর কয়েকটি শাখার পেশা ছিল রেশম চাষ ও বস্ত্রবয়ন করা। তাদের একটি শাখা ছিলেন আধুনিক সিলটীয়া জাতির পূর্ব পুরুষ। Sino Tibetian ভাষা পরিবারের বেশিরভাগ ভাষায় রেশমকে সিরকেক বলা হয়। চীনা ভাষায় সী বা সীছৌ, কোরীয়ান ভাষায় সিরকে, গ্রিক ভাষায় সির ও ল্যাটিন ভাষায় সিরিকাম বলা হয়। আন্তবানিজ্যের ক্ষেত্রে এদেশের উত্তর পূর্ব ভারতের রেশম ব্যবসায়ীরা সির বা সিরি জাতি বলে অভিহিত হয়ে শেষ পর্যন্ত এই পরিচয়েই চিহ্নিত হয়ে পড়েন। উক্ত রেশম ব্যবসার বিখ্যাত বিক্রয় কেন্দ্র সিরহাট, সিরিহাট অপভ্রংশ সিরহট > সিরট নামে ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে।
পরবর্তীতে বৈদিক ব্রাহ্মণরা সিরিহাট কে সংস্কৃত শ্রীহট্ট রূপে কাগজপত্রে চালু করেন। তবে আমজনতার মুখে সিরট > সিলট বহুল ব্যবহৃত তখনো ছিলো এখনও আছে।
ঐতিহাসিক A***n খ্রিষ্টপূর্ব ৪০০ অব্দে সিরট কে sirioto, খ্রিষ্টীয় ২য় শতকে ঐতিহাসিক Ailien তার বিবরণে siratae এবং খ্রিষ্টীয় ১ম শতকে লিখিত Periplus of the Erythrean sea গ্রন্থে siratae লিখিত হয়েছে। খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকে পর্তুগীজ ভৌগলিক Goa do borros কৃত মানচিত্রে Siriot নামে এই অঞ্চলকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
Plinny, Ctesius, Girini, Curtias, Hacataeus, Strabo, Dyonysius, Pompenius, Herodotus প্রমুখ ঐতিহাসিক, ভৌগলিক, বণিক ও পর্যটকদের বিবরণে রেশম ব্যবসায়ীরা সের/সির নামে এবং তাদের আবাসভূমি সিরট / সিরিয়ট নামে বহুল বিদিত ছিলো।
আইন ই আকবরি, ফতোয়ায়ে আলমগিরি, তবকাতে নাসিরি, রিয়াজ উস সালাতিন, বাহারিস্তান ই গায়েবি প্রভৃতি গ্রন্থে নাওরা সিলহেট বা সরকারে সিলাহাট উল্লেখ করা হয়েছে। ঢাকা যাদুঘরে রক্ষিত Henry Ernest Stapleton কর্তৃক সংগৃহীত শিলালিপি যাকে সিলেট বিজয়ের প্রামাণ্য দলিল ধরা হয়, তাতেও ফার্সিতে সিরিহট/ সিরিহাট লেখা আছে। ব্রিটিশ শাসকরা ইংরেজিতে Sylhet এবং বাংলায় সিলেট প্রচলন করেন যা অদ্যাবধি প্রচলিত আছে।
সাধারণ জনগণ এখনও তাদের জন্মভূমিকে ছিলট আর নিজেদের ছিলটি বলেই পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন।
( সংক্ষেপিত)
তথ্যসূত্র -
সিলটে প্রচলিত পই-প্রবাদ ডাক- ডিটান,
লেখক - দেওয়ান গোলাম মোর্তাজা
প্রকাশক - বাংলা একাডেমি
প্রকাশকাল - ১৯৯৮
( এই আলোচনা থেকে দেখা যাচ্ছে কাগজেকলমে সিরউ> সিরআট> সিরিঅট> সিরট> শ্রীহট্ট> সিলট এসে স্থিতিশীল হয়েছেন।)