06/16/2021
মধ্যযুগ
১। তরাইনের যুদ্ধ সম্পর্কে কি জানো।
আফগানিস্তানের অন্তর্গত গজনীর [শাসকবংশীয়] মুহম্মদ ঘুরী [ভারতের মূলতান,
ও লাহোর দখল করার পর] দিল্লি ও আজমীরের চৌহানবংশীয় অধিপতি তৃতীয় পৃথ্বীরাজের বিরুদ্ধে তরাইনের প্রান্তরে ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে যুদ্ধ করেন এবং নিদারুণ ভাবে পরাজিত হন। কিন্তু [পর বৎসর অর্থাৎ] ১১৯২ খ্রিস্টাব্দে তিনি তরাইনের দ্বিতীয় যুদ্ধে পৃথ্বীরাজকে পরাজিত [ও বন্দী] করেন। এর ফলে গঙ্গা-যমুনা বিধৌত সমভূমিতে তুর্কি আধিপত্য বিস্তারের পথ প্রস্তুত হয়।
২। তুর্কিদের নিকট ভারতীয়দের পরাজয়ের কয়েকটি প্রধান কারণের উল্লেখ কর।
ভারতীয়দের নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব, সাধারণ শত্রুর বিরুদ্ধে এক সঙ্গে যুদ্ধ করার অক্ষমতা, জাতিভেদ প্রথাজনিত সামাজিক অনৈক্য, নৈতিক অবক্ষয়, সেকেলে এবং ত্রুটিযুক্ত রণকৌশল, আধুনিকঅস্ত্রশস্ত্রের অভাব, দ্রুতগামী অশ্বের কম ব্যবহার, শত্রুপক্ষের গতিবিধি ও ক্ষমতা সম্পর্কে অজ্ঞতা এবং প্রতিভাবান সেনাপতির অভাব তাদের পরাজয়ের প্রধান কারণ ছিল। [তুর্কিদের উন্নত রণকৌশল, অশ্বের ব্যাপক ব্যবহার, তীরন্দাজদের অসাধারণ দক্ষতা এবং সর্বোপরি তুর্কি সেনাপতিদের সামরিক প্রতিভা তাদের সাফল্যকে নিশ্চিত করে তুলেছিল।] ।
৩। কোন তুর্কিবীর নবদ্বীপ দখল করেন ?
ইখতিয়ার উদ-দীন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী নামে এক তুর্কিজাতীয় ভাগ্যান্বেষী সেনানায়ক বিহার জয়ের পর ১২০৫ খ্রিস্টাব্দে বাংলার সেনবংশীয় রাজা লক্ষ্মণসেনকে অতর্কিতে আক্রমণ করে পরাজিত করেন এবং নবদ্বীপ তার করায়ত্ত হয়। [শীঘ্রই বাংলার রাঢ় ও বরেন্দ্র তার পদানত হল। তিনি লক্ষ্মণাবতী (লক্ষ্মৌতি) বা গৌড়ে রাজধানী স্থাপন করেন। মিনহাজ উদ্দীনের ‘তবাকৎ-ই-নাসিরী’ নামক গ্রন্থ থেকে ইখতিয়ারএর নবদ্বীপ জয় সম্পর্কে জানা গেছে।]
৪। লাখবক্স কাকে বলা হত ?
দিল্লির প্রথম স্বাধীন সুলতান কুতুবউদ্দীন আইবক (১২০৬-১২১০ খ্রিস্টাব্দ) লাখবক্স নামে পরিচিত ছিলেন। তিনি লাখ লাখ টাকা দান করতেন বলে তাঁর ঐরূপ নামকরণ। হয়। তিনি আবার লক্ষ লক্ষ লোকের প্রাণ হরণ করতেও দ্বিধা করতেন না।
৫। দাস বংশ নামটি কি সঙ্গত ?
১২০৬ খ্রি. থেকে ১২৯০ খ্রি. পর্যন্ত তিনটি পৃথক রাজবংশ দিল্লিতে রাজত্ব করেছিল। এই রাজবংশগুলি একত্রে দাসবংশ নামে পরিচিত। এই নামকরণের কারণ—এই বংশগুলির প্রতিষ্ঠাতাগণ [অর্থাৎ কুতবউদ-দীন আইবক, ইলতুৎমিস এবং বলন] প্রথম জীবনে ক্রীতদাস ছিলেন। কিন্তু বলবন ছাড়া অন্যদের প্রভূগণ তাদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেবার পর তারা দিল্লির সিংহাসনে বসেছিলেন। তাদের ব্যাশের অন্য কেউ দাস ছিলেন না।] সুতরাং এই রাজবংশগুলিকে দাসৰশে বলা অযৌক্তিক।
অতিরিক্ত তথ্য জেনে রাখুন - [ কেউ কেউ এই বংশগুলিকে ‘মামেলুক’ বলেন। স্বাধীন পিতামাতার কোন সন্তান যদি ভাগ্যের দোষে দাসে পরিণত হয় তবে তাকে বলা হত মামেলুক। উপরে উল্লিখিত তিনটি বংশের প্রতিষ্ঠাতাগণ প্রথম জীবনে দাস ছিলেন বলে এই বংশগুলিকে ‘মামেলুক বললে খুব একটা দোষের হয় না। আধুনিক ঐতিহাসিকদের মতে, এই রাজবংশগুলিকে ইলবারী তুর্কি বংশ’ বলাই অধিকতর সঙ্গত।]
৬। দাসবংশের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বা শ্রেষ্ঠ সুলতান কে ছিলেন ?
সাধারণতঃ সুলতান ইলতুৎমিসকে দাসবংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান বলা হয়ে থাকে। তিনি নানা অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ ও বৈদেশিক আক্রমণ থেকে দিল্লির শিশু সুলতানিকে রক্ষা করেছিলেন। বিশেষ করে মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ দিগ্বিজয়ী মোঙ্গল অধিপতি চিঙ্গীজ খাঁ-র নিশ্চিত আক্রমণ থেকে তিনি দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র ও ভারতকে রক্ষা করেছিলেন। তিনি একটি শাসনব্যবস্থাও গড়ে তোলেন।
জেনে রাখুন: [ইলতুৎমিস একটি প্রশাসনযন্ত্র গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন, বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের প্রথাকে সুদৃঢ় করতে উদ্যোগী হন, ভারতে ইক্তা ব্যবস্থার প্রবর্তন করেন, মধ্য এশিয়ার বহু জ্ঞানী-গুণীকে নিজের দরবারে আশ্রয় দেন, ইসলামী দুনিয়ায় দিল্লির মর্যাদা বৃদ্ধি করেন এবং বিভিন্ন ধরনের মুদ্রা চালু করে যশস্বী হন। তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রজা, হিন্দুদের প্রতি মোটামুটি ভাবে ভাল ব্যবহার করতেন। তার নির্মিত ভিত্তির ওপরেই বলবন বিরাট সৌধ নির্মাণ করেছিলেন। বাগদাদের খলিফা ইলতুৎমিসকে ‘প্রধান রাজা’ রূপে মেনে নেওয়ায় তার মর্যাদা বৃদ্ধি পেয়েছিল। তিনি গজনীর অধীনতা থেকেও নিজেকে মুক্ত করেন।
ইলতুৎমিসের রাজস্ব-ব্যবস্থা অবশ্য দুর্বল ছিল। তিনি সুলতানের সঙ্গে উচ্চপদস্থ তুর্কি আমীরদের সাংবিধানিক সম্পর্ক নির্দিষ্ট করে দেননি। তিনি প্রশাসনে কেবল তুর্কি ও তাজিকদের নিয়োগ করতেন, ভারতীয় মুসলমানদের নয়, হিন্দুদের তো নয়ই। এর পরিণাম শুভ হয়নি।]।
৭। “মামেলুক কথাটির অর্থ কী ?
তুর্কিদের মধ্যে যারা স্বাধীন মাতা-পিতার সন্তান তাদের মামেলুক’ বলা হত। অন্য মতে মামেলুক বলতে বোঝাত সেই সব তুর্কি দাসদের-যাদের সামরিক কাজে ব্যবহার করা হত। সাধারণ দাস থেকে তাদের পৃথক করার জন্যই মামেলুক’ শব্দটির ব্যবহার।
৮। খুৎবা কী ?
মুসলমানগণ প্রতি শুক্রবার দ্বিপ্রহরে মজিদে গিয়ে আল্লাহর নিকট যে প্রার্থনা করেন তাকে বলা হয় খুৎবা। এতে প্রথম দিকে খলিফা বা ধর্মগুরুর নাম উল্লেখ করা হত। পরে স্বাধীন মুসলিম রাজ্যগুলিতে মুসলমানগণ খুৎবায় তাদের স্বাধীন সুলতানের নামই উল্লেখ করত।
৯। কুতুবউদ্দীন আইক-এর সর্বপ্রধান কীর্তি কী ?
অনেকের মতে, কুতুবউদ্দীন আইবক আফগানিস্তানের অন্তর্গত গজনীর সুলতানের অধীনতাপাশ ছিন্ন করে নিজেকে দিল্লির স্বাধীন সুলতান রূপে ঘোষণা করেন। এর ফলে। দিল্লির সুলতানগণ তাদের ভারতীয় রাজ্যকে মধ্য এশিয়ার অস্থির রাজনীতির অবার্ত থেকে মুক্ত করে ঐ রাজ্যটির স্বাধীন ভাবে বিকাশের পথটি প্রস্তুত করে দেন। তিনিই ছিলেন দিল্লির সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা।
১০। চৌগান কী ?
মধ্যযুগে ঘোড়ার পিঠে চড়ে যে হকিজাতীয় খেলা হত তাকে বলা হত চৌগান বা পোলো। দিল্লির সুলতানির প্রতিষ্ঠাতা কুউদ্দীন আইবক এই চৌগান খেলার সময় ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মারা যান (১২১০ খ্রিস্টাব্দে)।।
১১। কুতুবউদ্দীন আইবক-এর আইবক' কথাটির অর্থ কী?
‘আইবক’ কথাটি তুর্কিস্তানের একটি উপজাতিকে বোঝায়। তিনি ঐ উপজাতিভুক্ত একটি পরিবারের সদস্য ছিলেন।
১২। দিল্লির সুলতানগণ কি পাঠান ছিলেন ?
দিল্লির সুলতানগণ তুর্কি জাতীয় ছিলেন, পাঠান নন।
১৩। কুউদ্দীন আইবক কি স্বাধীন সুলতান ছিলেন ?
কুতুবউদ্দীন আইবক স্বাধীন সুলতানরূপে গণ্য হতেন কি না সে বিষয়ে বিতর্ক আছে। চতুর্দশ শতকে ভারতে আগত মরক্কো নিবাসী পর্যটক ইবন বতুতা-র মতে, কুউদ্দীন স্বাধীন ছিলেন না। তিনি তার নামে কোনও মুদ্রা চালু করেছিলেন কি না অথবা খুৎবায় তার নামের উল্লেখ থাকত কি না সে বিষয়ে সন্দেহ আছে।
[ফীরুজ তুঘলকের মতে, খুৎবায় কুউদ্দীনের নাম উল্লেখ করা হত না। বাগদাদের খলিফাও কুতুবউদ্দীনের কর্তৃত্ব মেনে নেননি।]
১৪। চিঙ্গীজ খা বা চেঙ্গিস খাঁ কখন সিন্ধু নদের তীরে এসে পৌঁছান ? তিনি কেন এসেছিলেন ?
চিঙ্গীজ খাঁ ১২২১ খ্রিস্টাব্দে ভারতের সিন্ধুনদের তীরে এসে উপস্থিত হন মধ্য ।এশিয়ার শক্তিশালী রাজ্য, জালালুদ্দীন মঙ্কবাণী কর্তৃক শাসিত খোয়ারিজম রাজ্যটি দখল করার পর। খোওয়ারিজমের শাসক জালালুদ্দীনের পশ্চাদ্ধাবন করে তিনি সিন্ধুতীরে এসেছিলেন।
১৫। কে নিজেকে ‘Scourge of God' (ঈশ্বরের চাবুক বা অভিশাপ) বলতেন ?
মোঙ্গলরাজ চিঙ্গীজ খাঁ। এঁর বিশাল সাম্রাজ্য চীন থেকে ভূমধ্যসাগর এবং কাস্পিয়ান সাগর থেকে যেক্সারটেস (Jaxartes) নদী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
১৬৷ চিঙ্গীজ খাঁ কোন ধর্মাবলম্বী ছিলেন ?
চিঙ্গীজ খাঁ তিব্বতে প্রচলিত বৌদ্ধধর্মে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি ছিলেন ইসলাম ধর্মের ঘোর বিরোধী।
১৭। কুতুবউদ্দীন আইবকের প্রধান রাজধানী কোথায় ছিল ?
লাহোরে।
১৮। তথাকথিত দাস বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান কে ছিলেন ?
ইলতুৎমিস। তিনি দিল্লিকে তার রাজধানী করেন, অত্যন্ত প্রতিকূল পরিস্থিতিতে শিশু সুলতানী রাজ্যটিকে [প্রকৃত অর্থেই] সার্বভৌম ও সুদৃঢ় করে তোলেন, একটি শাসন ব্যবস্থার পত্তন এবং রৌপ্য ও তাম্রমুদ্রার প্রচলন করেন। খলিফা তার রাজ্যকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন [১২২৯ খ্রিস্টাব্দ]। [ইতুৎমিসের রৌপ্যমুদ্রাকে তঙ্কা’ এবং তাম্রমুদ্রাকে “জিতল’ বলা হত।] তিনি ভারতে ইক্তা ব্যবস্থার প্রচলন করেন এবং একটি সৈন্যবাহিনী গড়ে তোলেন।
১৯। কার সম্মানে কুতবমিনারটি নির্মিত হয় ?
খাজা কুতুবউদ্দীন বক্তিয়ার কাকী নামক এক প্রখ্যাত ফকিরের সম্মানে দিল্লির কুতবমিনারটি তৈরি করা হয়। কুতুবউদ্দীন আইবক এর নির্মাণকার্য শুরু করলেও ইলতুৎমিস ১২৩১-৩২-এ তা সম্পূর্ণ করেন।
২০। ইলতুৎমিসের প্রধান ত্রুটিগুলি কী ছিল ?
ইলতুৎমিস তুর্কি আমীরদের সঙ্গে তার সম্পর্ক কীরূপ হবে তা স্থির করে উঠতে পারেননি। বয়োবৃদ্ধ আমীরদের সামনে তিনি সিংহাসনে বসতে দ্বিধা করতেন। তিনি ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানদের উচ্চ সরকারি পদে এবং সৈন্যবাহিনীতে নিয়োগ করতেন। বেসামরিক শাসনব্যবস্থার পত্তন করতেও তিনি ব্যর্থ হন। [ সেই অর্ধ-বর্বর যুগে কন্যা রাজিয়াকে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারিণী মনোনীত করে তিনি বাস্তববুদ্ধিরও পরিচয় দেননি।]
২১। ইলতুৎমিসের প্রধান কীর্তিগুলি কী ?
ইলতুৎমিস বৈদেশিক আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে কুটকৌশল ও সামরিক ক্ষমতার সাহায্যে দিল্লির শিশু সুলতানী রাজ্যটিকে রক্ষা করেন এবং তার ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেন। তিনিই ছিলেন দিল্লির সুলতানীর প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা। তিনি দুর্ধর্ষ মোঙ্গলবীর চিঙ্গীজ খাঁর আক্রমণের আশঙ্কা থেকে ভারতকে রক্ষা করে অতি প্রশংসনীয় কাজ করেছিলেন।
২২। খলিফা কর্তৃক ইস্তুৎমিসের রাজকীয় উপাধি মেনে নেওয়ার তাৎপর্য কী ?
১২২৯ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদের খলিফা ইলতুৎমিসকে দিল্লির স্বাধীন সুলতান হিসাবে মেনে নেবার ফলে তিনি বৈধ শাসকরূপে বিবেচিত হন এবং তাঁর মুসলমান প্রজাদের নিকট তার মর্যাদা বৃদ্ধি পায়।
23 'The times of hereditary descent are over’- কে কাকে একথা বলেছিলেন ?
ইলতুৎমিস একথা বলেছিলেন গজনীর পদচ্যুত সুলতান তাজউদ্দীন ইলদুজকে যিনি ভারতে এসে লাহোর দখল করে মুহম্মদ ঘুরীর উত্তরাধিকারী হিসাবে দিল্লির সিংহাসন দাবি করেছিলেন।
২৪। দিল্লির কোন সুলতান তার মুদ্রায় নিজের কন্যার নাম মুদ্রিত করতেন ? —ইতুৎমিস।
২৫৷ চল্লিশের চক্র কী ?
দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিসের শাসনকালে ৪০ জন তুর্কি আমির একটি গোষ্ঠী গঠন করে উচ্চতম সরকারি পদসমূহ ও ভালো ভালো জায়গির দখল করে এবং পরবর্তীকালে তাদের পছন্দমতো ব্যক্তিদের সিংহাসনে বসায় এবং অপছন্দের সুলতানদের সিংহাসনচ্যুত করে। বলবন এই গোষ্ঠীকে দমন করেন। এই গোষ্ঠীটি চল্লিশের চক্র বন্দেগান-ইচাছেলগান’ বা ‘The Forty] নামে খ্যাত। .
২৬। ইলতুৎমিসের মৃত্যুর পর কে দিল্লির সিংহাসনে বসেন ?
ইলতুৎমিসের পুত্র রুকনউদ্দীন ফীরুজ। দিল্লির তুর্কী আমীরগণ ইলতুৎমিসের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে তার কন্যা রাজিয়া-র পরিবর্তে তার জ্যেষ্ঠ পুত্র রুকনউদ্দীনকে দিল্লীর সিংহাসনে বসান (১২৩৬)। |
২৭। রাজিয়ার পতনের মূল কারণ কী ?
অনেকের ধারণা, রাজিয়া পর্দা না মেনে পুরুষের বেশে প্রকাশ্যে চলাফেরা করায় এবং একজন অ-তুর্কি, হাবসী জাতীয় ক্রীতদাসের প্রণয়াসক্ত হওয়ায় তুর্কি আমীরগণ তাঁর পতন ঘটায়।] রাজিয়া সমস্ত শাসন-ক্ষমতা নিজের হাতে কেন্দ্রীভূত করতে চেয়েছিলেন। তিনি উচ্চ পদসমূহে তুর্কি জাতীয় আমীরদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করার জন্য বেশ কিছু অ-তুকীকে উচ্চ সরকারি পদে নিয়োগ করেন। এজন্য তুর্কী আমীরগণ জোটবদ্ধ হয়ে তাঁর পতন ঘটায়।
২৮। শাহ তুর্কান কে ছিলেন ?
ইলতুৎমিসের এক বেগম প্রথম জীবনে অন্তঃপুরের দাসী ছিলেন। রুকনউদ্দীন ছিলেন তার পুত্র। তিনি ছিলেন উচ্চাকাঙিক্ষণী, ন্যায়-অন্যায়-বোধশূন্যা ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারিণী। প্রশাসনের উপর সর্বময় কর্তৃত্ব স্থাপন করার চেষ্টা করে তিনি তুর্কী আমীরদের নিকট অপ্রিয় হন। চারদিকে বিদ্রোহ শুরু হয়ে যায়। [এই সুযোগে রাজিয়া তার বিমাতার বিরুদ্ধে প্রচার চালিয়ে দিল্লির জনতাকে হাত করেন।] [বিক্ষুব্ধ তুর্কী আমীর ও দিল্লির জনতার সাহায্যে] রাজিয়া শাহ তুর্কানকে বন্দী করেন। [তিনি রুকঊদ্দীনকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন (১২৩৬)।]
২৯। জামালউদ্দীন ইয়াকুৎ সম্পর্কে কী জানেন ?
ইনি ছিলেন আবিসিনিয়ার বাসিন্দা, একজন হাবশী ক্রীতদাস। সুলতান রাজিয়া তাকে রাজকীয় আস্তাবলের অধ্যক্ষ নিযুক্ত করায় তুর্কী আমীরগণ ক্ষুব্ধ হয়। তাদের মতে, সমস্ত রাজকীয় উচ্চপদে তাদেরই একচেটিয়া অধিকার ছিল এবং থাকবে। [ইসামী ও ইবন বতুতার মতে, ইয়াকুতের সঙ্গে রাজিয়ার প্রণয় ছিল—যদিও সমসাময়িক ঐতিহাসিক মিনহাজউদ্দীন এ বিষয়ে কিছু লিখে যাননি।] ইয়াকুৎ তুর্কী আমীরদের ষড়যন্ত্রে নিহত হন।
৩০। রাজিয়া ছিলেন সর্ববিধ গুণের অধিকারিণী।'—কে রাজিয়া সম্পর্কে এ কথা বলেছিলেন ?
মিনহাজউদ্দীন এ কথা বলেছিলেন সুলতান রাজিয়া সম্পর্কে।
৩১। সুলতান রাজিয়ার কয়েকটি রাজোচিত গুণের উদাহরণ দাও।
সুলতান রাজিয়া সমরকুশলা, কূটবুদ্ধি সম্পন্না, রাজকীয় ক্ষমতাবৃদ্ধি করতে দৃঢ়সঙ্কল্প এবং দূরদর্শিনী ছিলেন। তিনি কূটবুদ্ধির সাহায্যে তাঁর বিরুদ্ধে সঙঘবদ্ধ প্রাদেশিক শাসনকর্তাদের জোটকে ভেঙে দেন। [এবং তাকে বন্দিকারী ভাতিণ্ডার শাসনকর্তা আলতুনিয়াকে বিবাহ করে হৃত ক্ষমতা পুনরুদ্ধারে সচেষ্ট হন।]। খোওয়ারিজম-এর সুলতানের সঙ্গে সামরিক চুক্তি না করে তিনি মােঙ্গল আক্রমণের আশঙ্কা থেকে তাঁর। রাজ্যকে রক্ষা করেন।] তিনিই সর্বপ্রথম তুর্কি আমীরদের একচেটিয়া অধিকার খর্ব করার। চেষ্টা করে রাজকীয় ক্ষমতাকে অপ্রতিহত করতে উদ্যোগী হয়েছিলেন। ।
৩২। রাজিয়ার ত্রুটি-বিচ্যুতি সম্পর্কে কী জানো ?
রাজিয়া পুরুষের মতো পশাক পরে দরবারে এসে এবং প্রকাশ্যে ঘোড়া ও হাতির পিঠে চড়ে যাতায়াত করে গোঁড়া আমীর ও উলেমাদের বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিলেন। এটা তার বাস্তববুদ্ধির অভাবই সুচিত করে।] তুর্কি আমীরদের প্রাধান্য নষ্ট করে অ-তুর্কি আমীরদের উচ্চপদে নিয়োগের প্রয়াসকেও বিবেচনা-প্রসূত বলা যায় না। সেই অর্ধ-বর্বর যুগে নারীর সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তার সচেতন থাকা উচিত ছিল।] রাজিয়া রাজপুত রাজ্যগুলিও দখল করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন।
৩৩। সুলতান রাজিয়ার শাসন কেন স্থায়িত্ব অর্জনে ব্যর্থ হয়েছিল ?
সুলতান রাজিয়া তুর্কি আমিরদের ঔদ্ধত্য ও একচেটিয়া প্রাধান্য ভোগের দাবিকে খর্ব করার জন্য অ-তুর্কিদের [এমনকি বিদেশিদেরও] উচ্চপদে নিযুক্ত করায় এবং পর্দাপ্রথা অগ্রাহ্য করে পুরুষের বেশে রাজসভায় ও যুদ্ধে যাওয়ায় প্রভাবশালী তুর্কি আমীররা বিদ্রোহ করে এবং উলেমারাও তার বিরুদ্ধে চলে যায়। ভালো যোদ্ধা না হওয়ায় তিনি পরাজিত হন ও রাজ্যপাট হারান।
৩৪। চিঙ্গীজ খাঁ কে ছিলেন ?
ত্রয়োদশ শতকে মধ্য এশিয়ার মহাপরাক্রান্ত সম্রাট চিঙ্গীজ খাঁ খীবা-র সুলতান জালাল-উদ্দীন মঙ্গাবরনীকে পরাজিত করে তার রাজ্য শ্মশানে পরিণত করেন। জালালউদ্দীনের পশ্চাদ্ধাবন করে তিনি ভারতের সিন্ধুনদের তীরে এসে উপস্থিত হন। ইলতুৎমিস জালাল-উদ্দীনকে আশ্রয় না দেওয়ায় তিনি পারস্যে পালিয়ে যান। চিঙ্গীজ খাঁ-ও ভারত পরিত্যাগ করেন। [চিঙ্গীজের আক্রমণ ঘটলে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্র অবশ্যই ধ্বংস হয়ে যেত। সুতরাং ইলতুৎমিস ছিলেন দিল্লির সুলতানির ত্রাণকর্তা।]
৩৫। ১২৪০ খ্রিঃ রাজিয়ার পতন ঘটিয়ে চল্লিশের চক্র মুইজ-উদ-দীন বহরম শাহ এবং আলা-উদ-দীন মাসুদ শাহকে সিংহাসনে বসায়। এই চক্রের ইঙ্গিতে তারা উভয়েই পদচ্যুত ও নিহত হন। এই দুজন সুলতানের রাজত্বকালেই মধ্য এশিয়ার দুর্ধর্ষ মোঙ্গলগণ ভারত আক্রমণ করেছিল।
৩৬। নাসীর-উদ-দীন মামুদ (১২৪৬ -১২৬৬ খ্রিঃ)—তিনি চল্লিশের চক্রের নিকট বিশেষ করে তার সর্বাপেক্ষা প্রভাবশালী নেতা উলুঘ খাঁ-র হাতে সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেওয়ায় দীর্ঘকাল যাবৎ প্রায় নির্বিঘ্নে রাজত্ব করতে পেরেছিলেন।
৩৭। নাসীর-উদ-দীন উলুঘ খাঁর কন্যাকে বিবাহ করেন । বলবন জামাতার হয়ে রাজ্য শাসন করতে থাকেন।
৩৮। সম্ভবতঃ উলুঘ খাঁ বিষ প্রয়োগে নাসীর-উদ-দীনকে হত্যা করিয়েছিলেন।
৩৯। ইমাদ-উদ-দীন রাইহান নামে এক ধর্মান্তরিত হিন্দু আমীর এক বৎসরের বেশি সময় ধরে উলুঘ খাঁকে দরবার থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছিলেন।
৪০। উলুঘ খাঁ নাসীর-উদ-দীনের ৪ পুত্র ও ইলতুৎমিসের অন্যান্য বংশধরদের হত্যা করেন। তিনি গিয়াস-উদ-দীন বলবন নাম নিয়ে দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
৪১। গিয়াস-উদ-দীন বলবন (১২৬৬-১২৮৭ খ্রিঃ) সম্পর্কে প্রয়োজনীয় তথ্যাদি।
তার সিংহাসনে আরোহণের সময় শাসকশক্তির প্রতি জনসাধারণের কোন ভীতি ছিলনা | ফলে দেশে অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছিল। বলবন জনসাধারণের মনে শাসকশক্তির প্রতি ভীতির উদ্রেক করতে বদ্ধপরিকর হন।
বলবন তার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতার ফলে বুঝতে পেরেছিলেন যে, তুর্কি আমীরদের ক্ষমতা ও ঔদ্ধত্য খর্ব করতে হবে এবং চল্লিশের চক্র ভেঙে দিতে হবে।
৪২। বলবন নানা উপায়ে সুলতানের বিশেষ মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করেন।
৪৩। বলবন সুলতানের দৈব অধিকার তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বলতেন রাজার অলৌকিক সম্ভ্রম ও পদমর্যাদা জনসাধারণকে তাঁর প্রতি নিশ্চিতভাবে অনুগত করে তোলে।
৪৪। বলবনের রাজসভা ছিল অত্যন্ত গুরুগম্ভীর। সেখানে হাস্যকৌতুক, চাপল্য, মদ্যপান, দূতক্রীড়া প্রভৃতির স্থান ছিল না।
৪৫। বন চল্লিশের চক্রের সদস্যদের নানা অজুহাতে কঠোরতম শাস্তি প্রদান করেন। অনেকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত হয়। নিজের আত্মীয় ও ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিদেরও কঠোর শাস্তি দিতে তিনি দ্বিধা করতেন না।
৪৬। রাজশক্তিকে সুসংহত করার জন্য বন একটি নিপুণ গুপ্তচর ব্যবস্থা গড়ে তোলেন।
৪৭। বলবন সৈন্যসংখ্যা বৃদ্ধি করেন, সৈন্যদের নগদে বেতন দেবার ব্যবস্থা এবং ঘন ঘন কুচকাওয়াজের বন্দোবস্ত করেছিলেন।
৪৮। বলবন মেওয়াট-এর হিন্দু দস্যু, দোয়াব ও রোহিলখণ্ডের হিন্দুদের বিদ্রোহ নির্মম হস্তে দমন করেন। সম্ভবতঃ তথাকথিত এই দস্যু ও বিদ্রোহীরা নির্যাতিত ও শোষিত হিন্দু কৃষক ছিল।
৪৯। বাংলার সহকারী শাসনকর্তা তুঘ্রিল খাঁ নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করলে সুলতান বলবন তার বিরুদ্ধে ২টি অভিযান প্রেরণ করেন কিন্তু সেগুলি ব্যর্থ হয়। এরপর স্বয়ং সুলতান প্রায় ২ লক্ষ সৈন্য নিয়ে বাংলায় আসেন এবং তুঘ্রিল খাঁকে বন্দী ও হত্যা করেন। বলবনের নির্দেশে তুঘ্রিল খাঁর আত্মীয়-পরিজন এবং অনুচরদের শূলে চড়ানো।
৫০। মোঙ্গলগণ বনের রাজত্বকালে বারবার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত দিয়ে ভারতে হানা দিচ্ছিল। তাদের প্রতিহত করাকেই বন্ধন তার প্রধান কর্তব্য বলে মনে করায়। ভারতে রাজ্য বিস্তার করার জন্য কোনরূপ চেষ্টা করেননি। তিনি উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলকে সুরক্ষিত করে তুলেছিলেন।
৫১। মুলতান-দীপালপুরের শাসক শের খা বেশ কিছুকাল মোঙ্গলদের আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন। কিন্তু বলবন তার প্রভাব-প্রতিপত্তিতে ঈর্ষান্বিত হয়ে তাকে হত্যা করান।
৫২। বন্ধনের জ্যেষ্ঠপুত্র যুবরাজ মহম্মদ মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিরোধে কৃতিত্ব দেখালেও মোঙ্গলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সময় নিহত হন। তাঁর অকাল মৃত্যু বৃদ্ধ বলবনের মৃত্যুকে ত্বরান্বিত করেছিল।
৫৩। এখানে উল্লেখযোগ্য, ১২৫৮ খ্রিঃ-তে মোঙ্গল নেতা হুলাগু বাগদাদ দখল করে খলিফা মুস্তাসিমকে হত্যা করে খলিফা সাম্রাজ্যের অবসান ঘটিয়েছিলেন। এ থেকে মোঙ্গলদের পরাক্রম সম্বন্ধে স্পষ্ট ধারণা করা যায়।
৫৪। যুবরাজ মহম্মদ কবি আমীর খসরু ও আমীর হাসানের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি পারস্যের বিখ্যাত কবি সাদীকে ভারতে আসার জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। কিন্তু বার্ধক্যের জন্য কবি তার আমন্ত্রণ গ্রহণ করতে পারেননি।
৫৫৷ বলবন ভাল যোদ্ধা, সুনিপুণ শাসক, ন্যায় বিচারক, বাস্তবজ্ঞানসম্পন্ন ও বিদ্বজ্জনের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। তিনি দেশে শান্তি-শৃঙ্খলা স্থাপন করেন, তুর্কি আমীরদের প্রাধান্য খর্ব করেন, চল্লিশের চক্র ভেঙে দেন, মোঙ্গল আক্রমণ প্রতিহত করেন, বাংলার শাসনকর্তার এবং হিন্দুদের বিদ্রোহ দমন করেন এবং সুলতানের মর্যাদা বহুলাংশে বৃদ্ধি করতে সক্ষম হন। তিনি সুলতানি রাষ্ট্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করেছিলেন। এজন্য অনেকে তাকে দিল্লির সুলতানি রাষ্ট্রের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলে থাকেন। [তবে তিনি যোগ্য তুর্কি আমীরদের নির্বিচারে হত্যা করে ভুল করেছিলেন। এই সুযোগে পরবর্তীকালে খলজীগণ ক্ষমতা দখল করে নেয়। তিনি হিন্দুস্তানী মুসলমানদের উচ্চ সরকারি পদ থেকে বঞ্চিত করে তাদের অসন্তুষ্ট করে তোলেন। সর্বোপরি তার অকারণ নিষ্ঠুরতাকে সমর্থন করা যায় না।] .
৫৬। বলবন কী করে দিল্লির সিংহাসনের মর্যাদা বাড়ান ?
[সুলতান গিয়াস-উদ-দীন] বলবন দিল্লির সিংহাসনে বসে দেখেন, [শাসকের প্রতি শাসিতের ভীতির মনোভাব নেই। বিশেষ করে] তুর্কি আমীরগণ নিজেদের সুলতানের সমকক্ষ বলে মনে করছে। এই অবস্থায় সিংহাসনের মর্যাদা বাড়াবার জন্য বলবন তার সউচ্চ বংশগৌরব ও দৈব অধিকারের কথা প্রচার করেন। তিনি তার দরবারে নানা পারসিক প্রথা ও আড়ম্বরও চালু করেন। [দরবারে সর্বপ্রকার চাপল্য ও হাসি-ঠাট্টা বর্জিত হয়। সুসজ্জিত হয়ে এবং দীর্ঘদেহী, ভীতিপ্রদ দেহরক্ষীদের দ্বারা বেষ্টিত হয়ে সুলতান দরবারে আসতেন।] তিনি [ছলে-বলে-কৌশলে ] চল্লিশের চক্রের অধিকাংশ সদস্যকে হত্যা করে নিষকন্টক হন।
[তিনি নিষ্কণ্টক হলেও তার মৃত্যুর পর যোগ্য নেতার অভাবে তুর্কীদের আধিপত্য দুর্বল হয়ে পড়ে। এই সুযোগে খলজীরা ক্ষমতা দখল করে নেয়।]
৫৭। দিল্লির কোন সুলতানের আমলে একজন হিন্দুস্থানী মুসলমান উচ্চতম পদে নিযুক্ত হয়েছিলেন ?
ইলতুৎমিসের পুত্র বা পৌত্র নাসীরুদ্দীন মামুদের রাজত্বকালে নাসীরুদ্দীন ১২৫৩ খ্রিস্টাব্দে তার অতি ক্ষমতাশীল অমাত্য বাহাউদ্দীন বলবনকে পদচ্যুত করে হিন্দুস্থানী। মুসলমান ইমাদউদ্দীন রাইহানকে নায়েব-ই মামলিকাৎ নামক সর্বোচ্চ পদে নিযুক্ত করেন। কিন্তু বলবন ও অন্যান্য আমীরের ষড়যন্ত্রে রাইহান ১২৫৪-য় পদচ্যুত হন। [বলবন উলুঘ খাঁ নামে এই সময় পরিচিত ছিলেন।]
৫৮। দিল্লির কোন সুলতান ‘রাজত্ব করতেন কিন্তু শাসন করতেন না ?
সুলতান নাসীরুদ্দীন মামুদ (১২৪৬-১২৬৬ খ্রিস্টাব্দ)। ব্যক্তিত্বহীন, শান্তিপ্রিয় এই সুলতানের হয়ে শাসনকার্য চালাতেন তারই অমাত্য বাহাউদ্দীন বলবন।
৫৯। চল্লিশের চক্র’ কর্তৃক পদচ্যুত কয়েকজন সুলতানের নাম কর।
রাজিয়া, মুইজউদ্দীন বহরাম শাহ্ ও আলাউদ্দীন মাসুদ শাহ।
৬০। বলবন অন্য কোন নামে পরিচিত ছিলেন ? - উলুঘ খান।
৬১। বলবনের নিষ্ঠুরতার একটি প্রমাণ দাও।
একটি সমসাময়িক বিবরণ থেকে জানা গেছে যে, বলবন তার প্রভু ও জামাতা সুলতান নাসীরউদ্দীনকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করেন এবং তার ৪ পুত্র ও ইলতুৎমিসের অন্যান্য বংশধরগণও তার হস্তে নিহত হন।
৬২। বলবনের প্রধান কীর্তিগুলি সম্পর্কে লিখ।
বলবন [১২৬৬-১২৮৭ খ্রিস্টাব্দ] নানাভাবে সুলতানের মর্যাদা ও ক্ষমতা বৃদ্ধি করেন। সুলতানের প্রতিদ্বন্দ্বী চল্লিশের চক্র’ ভেঙে দেন, [গুপ্তচর ও সংবাদ লেখকদের। সাহায্যে তার প্রতি] বিরূপ কী আমীরদের চিহ্নিত করে তাদের নির্বিচারে হত্যা করেন, নির্মম ভাবে অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহগুলি দমন করেন এবং মোঙ্গলদের পুনঃ পুনঃ আক্রমণ প্রতিহত করার পর উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অঞ্চলটি সুরক্ষিত করে রাখেন। [তার সামরিক সংস্কারও উল্লেখযোগ্য।]
৬৩। বলবনের আমলে বাংলার বিদ্রোহ সম্পর্কে লিখ।
[বলবনের একদা ব্যক্তিগত ক্রীতদাস এবং পরে বাংলার সহকারী শাসনকর্তা তুঘ্রিল খাঁ নিজেকে স্বাধীন সুলতানরূপে ঘোষণা করলে বলবন তার বিরুদ্ধে পর পর দুটি। সামরিক অভিযান প্রেরণ করলেও তারা তুঘ্রিলের নিকট পরাজিত হয়। শেষ পর্যন্ত সুলতান স্বয়ং [দু’লক্ষ সৈন্য নিয়ে ] বাংলায় গিয়ে তুড্রিল খাঁ ও তাঁর অনুচর ও সমর্থকদের নির্মমভাবে হত্যা করে বাংলা পুনর্দখল করেন।
৬৪। কে, কখন বাগদাদের খলিফা বংশ ও সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান ?
মোঙ্গলবীর হুলাগু ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ দখল করে খলিফা মুস্তাসিমকে হত্যা করে খলিফার সাম্রাজ্যের অবসান ঘটান।
৬৫। কোন কোন মামলুক সুলতানের আমলে মোঙ্গলগণ ভারত আক্রমণ করে ?
ইলতুৎমিস, মুইজউদ্দীন বহরাম শাহ, আলাউদ্দীনমাসুদ শাহ নাসীরউদ্দীন মামুদ ও গিয়াসদ্দীন বলবন-এর আমলে মোঙ্গল আক্রমণ ঘটে।
৬৬। বলবনের কয়েকটি সীমাবদ্ধতার উল্লেখ কর।
বলবন নীচু জাতীয় প্রজাদের, ভারতীয় হিন্দু ও মুসলমানদের ঘৃণা করতেন, কারণে-অকারণে তুর্কী আমীরদের হত্যা করে দক্ষ প্রশাসক ও সেনাপতির অভাব ঘটান, বিদ্রোহ দমনে অমানুষিক নিষ্ঠুরতা দেখান, মোঙ্গলদের ত্রাস, প্রখ্যাত সেনাপতি শের খাঁকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করান এবং প্রয়োজনীয় সৈন্যবাহিনী পোষণ করতে ব্যর্থ হন। [এসবের ফলে তার রাজ্যের ভিত্তি দুর্বল হয়ে পড়ে।] ।
৬৭। বলবন কেন রাজ্য বিস্তারের জন্য চেষ্টা করেননি ?
পুনঃ পুনঃ মোঙ্গল আক্রমণ ঘটায় এবং নানা বিদ্রোহ দমনে ব্যস্ত থাকায় বলবন রাজ্য বিস্তারে সময়, শক্তি ও অর্থ ব্যয় না করে রাজ্যের সংহতিসাধন ও রক্ষণেই মন দিয়েছিলেন। এটি তার প্রজ্ঞা ও সংযমের পরিচায়ক।
৬৮। বুঘরা খাঁ সম্পর্কে কী জানো ?
বলবনের কনিষ্ঠ পুত্র বুঘরা খাঁ ছিলেন বাংলার শাসনকর্তা। তিনি বলবনের পর দিল্লির সুলতান হতে অনিচ্ছা প্রকাশ করেন। তার পুত্র কাইকোবাদ ব্যভিচারে লিপ্ত হলে তিনি তাঁকে সুপথে ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হন। এরপর বুঘা খাঁ [সুলতান নাসীরুদ্দীন নাম নিয়ে ] নিজেকে বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন। [লখনৌতিতে তার রাজধানী স্থাপিত হয়।] ।
৬৯। বলবনের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে সংক্ষেপে লিখ।
বলবন প্রথম জীবনে দাস ছিলেন। এই অবস্থায় তিনি আত্মগৌরব বদ্ধির জন্য নিজেকে পারস্যের এক পৌরাণিক রাজবংশের লোক এবং দৈব অধিকার সম্পন্ন বলে প্রচার করেন। তিনি সভ্রান্ত লোকেদের সঙ্গে মেলামেশা, প্রতিপত্তিশালী আমীরদের মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়া, সর্বদা গুরুগম্ভীর থাকা, কঠোর আচরণ ও আড়ম্বরপূর্ণ পরিবেশ প্রভৃতির সাহায্যে সুলতানের মহিমা প্রতিষ্ঠিত করেন।
৭০। ইলতুৎমিস ও বলবনের মধ্যে কে শ্রেষ্ঠ ছিলেন ?
দু’জনেই যোগ্য সুলতান তবে ইলতুতমিস বিদেশি আক্রমণ ও অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহ থেকে শিশুরাষ্ট্র, দিল্লির সুলতানীকে রক্ষা করে তার মর্যাদা বৃদ্ধি করে অতুলনীয় কাজ করেছিলেন। বলবন ইতুৎমিসের তৈরি ভিত্তির উপর প্রাসাদ নির্মাণ করেন। সুতরাং বেশি কৃতিত্ব ইলতুৎমিসেরই প্রাপ্য।
৭১। বনের মৃত্যুর পর (১২৮৭ খ্রিঃ) তাঁর পৌত্র কায়কোবাদ সিংহাসনে বসেন। (১২৮৭-১২৯০ খ্রিঃ)। তিনি ছিলেন অত্যন্ত উচ্ছঙ্খল ও অপদার্থ।
৭২। বানের দ্বিতীয় পুত্র বুঘরা খান বাংলায় স্বাধীন ভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।
৭৩। কায়কোবাদ পক্ষাঘাত রোগে পঙ্গু হয়ে পড়লে তার তুর্কি আমীরগণ তার শিশুপুত্র কায়ুমার্সকে সিংহাসনে বসায়। কিন্তু জালাল-উদ্দীন ফারুজ খলজী নায়ে জনৈক সেনাপতি কায়কোবাদ ও কায়ুমার্সকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসন দখল করে দিল্লিতে খলজী বংশের পত্তন করেন।
৭৪। মামেলক বংশের উচ্ছেদ সাধন করে দিল্লির সিংহাসনে জালাল-উদ্দীন ফীরুজ খলজীর উপবেশনকে (১২৯০-১২৯৬ খ্রিঃ) অনেকে ‘খলজী বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন। এর ফলে দিল্লির তথাকথিত দাসবংশের অবসান ঘটল এবং ঐতিহাসিক বরণীর মতে, তুর্কিদের হাত থেকে খলজীদের হাতে শাসন ক্ষমতা চলে গেল। বলা হয়ে থাকে যে, খলজীগণ আফগান জাতীয় ছিল।]
প্রকৃত ঘটনা অবশ্য অন্যরূপ। রাজবংশের পরিবর্তনের ফলে তুর্কিদের আধিপত্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়নি, সাম্রাজ্যের নীতিতে ও শাসন ব্যবস্থায়ও আমূল পরিবর্তন ঘটেনি। তা ছাড়া খলজীগণও তুর্কি ছিল, আফগান নয়। সুতরাং ‘খলজী বিপ্লব’ কথাটি গ্রহণযোগ্য। নয়।
৭৫। জালালউদ্দীন খলজী ছিলেন অতিশয় দয়াশীল, ক্ষমাপরায়ণ এবং স্নেহদুর্বল। তিনি বিদ্রোহীদেরও নির্দ্বিধায় ক্ষমা করে দিতেন। তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র এবং জামাতা আলীগুরসাপকে (পরবর্তী কালের আলা-উদ্দীন-খলজী) বিশ্বাস করে তিনি গুরসাপের আততায়ীদের হস্তে নিহত হন।
৭৬। জালাল-উদ্দীন মোঙ্গলদের একটি আক্রমণ প্রতিহত করে বন্দী মোঙ্গলদের ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করেন। তারা ‘নব মুসলমান’ বলে পরিচিত হয় এবং দিল্লির নিকটে বসবাস করতে থাকে।
৭৭। জালাল-উদ্দীন তাঁর ভ্রাতুস্পুত্র ও জামাতা গুরসাপকে কারা-মানিকপুরের শাসনকর্তা নিযুক্ত করেন। তার পত্নী এবং শাশুড়ী অনবরতঃ তার বিরুদ্ধাচরণ করতেন বলে তিনি বিরক্ত হয়ে ক্ষমতালাভের জন্য সচেষ্ট হন।
তিনি প্রথমে সুলতানের অনুমতি নিয়ে মালবের ভিসা লুণ্ঠন করেন এবং পরে সুলতানকে না জানিয়েই বিন্ধ্যপর্বত অতিক্রম করে দেবগিরি আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে। প্রভূত ধনসম্পদ হস্তগত করেন (১২৯৫ খ্রিঃ)। এরপর তিনি সুলতানকে হত্যা করে দিল্লির সিংহাসনে বসেন।
৭৮। নব মুসলমান কাদের বলা হত ?
সুলতান জালাল-উদ্দীন খলজী যুদ্ধে মোঙ্গল আক্রমণকারীদের পরাজিত করে তাদের অনেককে বন্দী করেন। তাদের ইসলামে ধর্মান্তরিত করার পর সুলতান দিল্লির নিকটবর্তী স্থানে তাদের বসবাসের ব্যবস্থা করেন। এদের বলা হত নব মুসলমান। (পরবর্তী সুলতান আলা-উদ্দীনের সন্দেহ হয় যে, নব মুসলমানগণ তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তিনি ৩০ হাজার নব মুসলমানকে হত্যা করেছিলেন।)
৭৯। খলজী বিপ্লব কী ?
মামেলুক বা দাসবংশের রাজত্বকালে সুলতানি সাম্রাজ্যের সকল বিষয়ে তুর্কিদের একচেটিয়া প্রাধান্য ছিল। তথাকথিত আফগান-বংশীয় খলজীগণ দিল্লিতে ক্ষমতাসীন হয়ে তুর্কীদের একচেটিয়া প্রাধান্যের অবসান ঘটায়, প্রায় সারা ভারত দখল করে, বহু উল্লেখযোগ্য শাসন-সংস্কার চালু করে এবং সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে প্রশংসনীয় উন্নতি সাধন করে। একেই বলে খলজী বিপ্লব। তবে খলজীগণও তুর্কীজাতীয় ছিল।
৮০। কে খলজী বিপ্লব ঘটান ?
বলবনের উত্তরাধিকারী কাইকোবাদের আমলে তার আজ-ই-মামালিক, মালিক জালালুদ্দীন ফীরুজ খলজী ১২৯০ খ্রিস্টাব্দে [তুর্কী আমীরদের দ্বারা পদচ্যুত কাইকোবাদ এবং নতুন সুলতান কাইকোবাদের শিশুপুত্র কায়ুমার্সকে হত্যা করে] নিজেকে সুলতান বলে ঘোষণা করেন। এই ঘটনা ‘খলজী বিপ্লব’ নামে খ্যাত। এর ফলে তুর্কী আমীরদের ক্ষমতা বিনষ্ট হয় এবং খজী ও হিন্দুস্তানী আমীরদের ক্ষমতালাভ ঘটে।
৮১। মালিক নিজামুদ্দীন সম্পর্কে কী জানো ?
মালিক নিজামুদ্দীন দিল্লির অপদার্থ, তরুণ সুলতান কাইকোবাদ-এর শাসনকালে [১২৮৭-৯০ খ্রিস্টাব্দে] প্রকৃত শাসন ক্ষমতা করায়ত্ত করেন, তার বিরোধী তুর্কি আমীরদের হত্যা করতে থাকেন এবং শেষ পর্যন্ত [কাইকোবাদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার মিথ্য অভিযগে] বলবনের জ্যেষ্ঠপুত্র মহম্মদের পুত্র কাইখসরুকে হত্যা করান। দিল্লির বৃদ্ধ কোতোয়াল ফকরউদ্দীনের জামাতা, দক্ষ প্রশাসক নিজামুদ্দীনকে বিষপ্রয়োগে হত্যা করা হয়। নিজামুদ্দীন দক্ষ প্রশাসক ছিলেন।
৮২। কাইখসরুর ভাগ্যবিপর্যয় সম্পর্কে কী জানো ?
বলবন [তার মৃত্যুর আগে] তাঁর পৌত্র কাইখসরুকে তার সিংহাসনের উত্তরাধিকারী বলে ঘোষণা করেছিলেন। [তুর্কী আমীরগণ তাঁর এই সিদ্ধান্ত মেনে নেন।] বলবনের মৃত্যুর পর দিল্লির বৃদ্ধ কোতোয়াল ফকরউদ্দীন প্রমুখ আমীরবর্গ বলবনের কনিষ্ঠপুত্র। বুঘরা খ