22/12/2024
পাইন্দংয়ের গর্বের ধন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের অধ্যাপক আবুল বাশার স্যারের লেখাটি পড়ে আসেন সুযোগ থাকলে...
কোটি কোটি তরুণের বুকে কিসের বাজনা বাজে ? আর ঐ বাজনার মূলে কি আছে?
বৈষম্যহীন সমাজ ব্যাবস্থার মূলে যে পাঁচটি স্তম্ভ রয়েছে সেগুলো হলো : সমতা, স্বাধীনতা, মৈত্রী, ন্যায়-বিচার আর সর্বোপরি সততা। আর এই সমাজ-ব্যবস্থার মূল কাঠামো গড়ে ওঠে অকৃত্রিম বন্ধুতা, উদার সহিষ্ণুতা, অবিচল ধৈর্য্য, মানবিক ও সামাজিক নয়াপরায়ণতা আর নিরন্তর ত্যাগের উপর ভিত্ত্বি করে। কোনোদেশে, কোনো যুগে বা কালে এরূপঃ সমাজবাবস্থা মূল্য ছাড়া পাওয়া যায়নি । বস্তুত: কিনতে হয়েছে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে - এই মূল্যটি হলো অকাতরে প্রাণ বিসর্জন দেয়া। আমরাও জুলাই অভ্যুত্থানে অকাতরে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়েছি। জুলাই'২৪-এ ছাত্র-জনতা দৃঢ়-প্রতিজ্ঞায় একটি মাত্র শপথ নিয়েছিলেন তা হলো- হয় 'মুক্তি' নয়তো 'মৃত্যু' - ফলে পুরো জুলাই মাস তাঁরা ঠিকমতো একবেলা খেতে পারেননি, ঘুমাতে পারেননি, মা-বাবা, ভাই-বোনের সাথে এক টেবিলে একবেলা নাস্তা করার সৌভাগ্য হয়নি, অনেকে অন্ধকার গুমঘর থেকে আর কখনো ফিরেই আসবেন না, শহীদগণের রক্তে রাজপথ এখনো দগদগে লাল - সর্বোপরি, তাঁদের অজানা সংখ্যক সহপাঠীর লাশ হয়তো কালো কঙ্কাল হয়ে এখনো পড়ে আছে কোনো অজানা গ্যাস -চেম্বারে অথবা হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন ভয়ানক যন্ত্রনায় I তাঁরা আবার পুরো অগাস্ট মাস রাস্তা ঝাড়ু দিয়েছেন, চোখের পানি আর রং মিশিয়ে দেয়ালে দেয়ালে হারানো বন্ধুদের গ্রাফিতি এঁখেছেন, অনিয়ন্ত্রিত ট্রাফিকের দায়িত্ব পালন করেছেন, ড্রোন উড়িয়া ডাকাত ধরেছেন, বাজার মূল্য তদারকি করেছেন, মন্দির -মসজিদ-প্যাগোডা- গির্জা পাহারা দিয়েছেন। এরপর জীবন বাজি রেখে তাঁরা বন্যার্তদের পাশে দাঁড়িয়েছেন, ফ্যাসিবাদের উত্থান ঠেকাতে আর দেশ-বিদেশের ষড়যন্ত্র রুখে দিতে বার বার রাস্তায় নেমেছেন। সবশেষে জঙ্গি ইস্কনের ষড়যন্ত্রের বলি হয়ে আবার প্রাণ দিয়েছেন।
এখনো তাঁরা আহত সহপাঠীর মা-বাবাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন, চাঁদা তুলে তাঁদের চিকিৎসার খরচ জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছেন, শহীদ হওয়া সহপাঠীদের মা-বাবার কোলে মাথা রেখে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছেন- তাঁদের সম্মিলিত কান্নার আওয়াজে সৃষ্টিকর্তার আরশ কাঁপে কিন্তু নতুন ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রকারী পাষাণরা নির্বিকার। আজ বিজয়ের উল্লাসে তারা উম্মত্ত, অন্ধ - ক্ষমতার সিংহাসনে যেতে আর তর সইছেনা । অথচ সে বিজয় তারা ছিনিয়ে আনেনি, এনেছেন সায়ীদ, মুগ্ধ'রা। আমি মনে-প্রাণে ঘৃণা করি এসব দল, ব্যাক্তি, ও কুচক্রীকে এবং মনে-প্রাণে বিশ্বাস করি তারাও পরাজিত হবে কোটি তরুণের পবিত্র আহবানে।
তথাকথিত উন্নয়ন ও গণতন্ত্রের লেবাসে বিগত ৫০ বছরে বিভিন্ন দল বিভিন্ন মোড়কে দিনে দিনে এদেশে যে ভয়াবহ স্বৈরতন্ত্রের জন্ম দেয় তার নিষ্টুর শাসন, শোষণ, বঞ্চনা, নির্যাতন,আক্রমণ, বৈষম্য ও জুলুমের বরাবরই রক্ষাকবচ ছিল ওইসব স্বৈরাচারের সৃষ্ট এই দেশেরই একদল নিকৃষ্ট অলিগার্কিরা। তারা দেশের অত্যন্ত ক্ষুদ্র একটি সুবিধাভুগী শ্রেণী যাদের হাতে শুধু অর্থনৈতিক নয়; সকল ক্ষমতা যেমন: রাজনৈতিক, শিক্ষা, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, প্রশাসনিক, গণমাধ্যম, সামরিক, ধর্মীয়, কর্পোরেট ইত্যাদি কুক্ষিগত ছিল। বিগত স্বৈরাচারের আমলে এই ধারা চূড়ান্ত রূপ লাভ করে। স্বাধীনতার পর থেকেই এ দেশের মানুষ বেশ কয়েকটা ছাতার নিচে মাথা গুঁজেছিলো, কিন্তু কোনো নিশ্চিত আশ্রয় পায়নি বরং হজম করেছে ঐ অলিগার্কিদের সামষ্টিক বৈষম্য আর দুঃশাসন। সেরকম এক দাম্বিক অলিগার্ক শাসকের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য জুলাইয়ে কোটি কোটি তরুণ ও শ্রমিক-জনতা রাজপথে নেমেছিল, হাজারো তরুণ অকাতরে বিলিয়ে দিলো তাঁদের প্রাণ, বিনিময়ে তাঁরা চেয়েছিলো শুধু একটা বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা। এই তরুণরা নির্লোভ, নির্ভীক, নিরন্ন, নিরস্ত্র,সরল ও সাদামনের। সত্যি বলতে কি তাঁরা রাজনীতি ও ক্ষমতার মারপ্যাঁচ ও খুঁটচাল বোঝেনা, পাত্তা দেয়না ধেয়ে আসা সহস্র বুলেটকে। তাঁরা বোঝে শুধু একটা পরিচ্ছন্ন ও অনাবিল রাষ্ট্র তথা সমাজ ব্যবস্থা যেখানে মুক্তবিহঙ্গের মতো তাঁরা বিচরণ করতে পারবেন। তাই অন্ধ-ক্ষমতালোভী ষড়যন্ত্রকারীদের প্রতি বিনীত অনুরোধ - অনুগ্রহ করে, কোটি কোটি তরুণদের নার্ভ, পালস, মন ও হৃদয়ের গভীরে পৌঁছার চেষ্টা করুন, বুঝার চেষ্টা করুন সেখানে কিসের বাজনা বাজে?
আমি নিশ্চিত দেখতে পাচ্ছি, আপনাদের পরাজয় অনিবার্য; আবারো বলছি, জয়ী হতে চাইলে অনুগ্রহ করে তরুণদের নার্ভ, পালস, মন ও হৃদয়ের গভীরে পৌঁছার চেষ্টা করুন, বুঝার চেষ্টা করুন সেখানে কিসের বাজনা বাজে? সেই বাজনায় দেখবেন এক অনিয়ন্ত্রিত কিন্তু বাস্তব স্বপ্নগুচ্ছ - যে স্বপ্ন আপনি জীবনেও কল্পনা করতে পারেননি। ক্ষমতার সিংহাসন নয়, আগে তাঁদের সেই স্বপ্নগুচ্ছকে ধারণ করার চেষ্টা করুন, মনে-প্রাণে নিজেকে পরিবর্তন করুন, নিজে আলোকিত হয়ে উঠুন, নিজের দল বা গুষ্টিকে আলোকিত করে তুলুন, তারপর স্বপ্ন-সারথি হয়ে এই কোটি কোটি স্বপ্নবাজদের পাশে থাকুন, বেশি এগিয়ে যাবার চেষ্টা করলে হোঁচট খাবেন, নিশ্চিত। কোনো চাতুরী, ষড়যন্ত্র বা অপকৌশলের চেষ্টা করলে ধূলিসাৎ হয়ে যাবেন। হাজারো সায়ীদ, মুগ্ধ, তরু, শান্ত'দের আমরা এখনই ভুলে গেলেও ঐ তরুণরা তাঁদেরকে হৃদয়ে গেঁথে রেঁখেছেন সযত্নে এবং সেখানে তাঁরা অমর, অক্ষয় ও অম্লান থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্মে।
ওহে উম্মত্ত জনতা! হাজারো শহীদদের এখনই ভুলে গেলে! শুধু এক ইয়ামিনের অর্ধমৃত শরীরটাকে ঢাকা জেলা ১৪ নম্বর পুলিশ ভ্যানের ছাদের প্রায় ১৪ ফুট উপর থেকে ছুঁড়ে ফেলার নৃশংস দৃশ্য এখনো কোটি কোটি চোখে প্লাবন ডাকে। সেই ভিডিও যে দেখেছে সে এখনো ঠিকমতো ঘুমাতে পারেনা। মুগ্ধ! তাঁর কথা কি বলবো! পানি বা পানির বোতলে দেখলে এখনো শরীর ও কণ্ঠ থরথর করে কাঁপে লক্ষ লক্ষ মা-বাবা ও কোটি কোটি সহপাঠীর। এক ঢোঁক পানি গলা দিয়ে নামাতে গেলে সহস্র সমুদ্র পানি চোখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। রোজা রাখা ইয়ামিনের পবিত্র নিথর দেহটা সামান্য একটু নড়ে উঠে তরুণদের বলে গেছেন 'আমি গেলাম তোমরা হার মানিওনা'। বিশ্বাস করুন, তাঁরা কক্ষনো হার মানেনি, মানবেও না। আবু সায়ীদের মতো বুক চিতিয়ে আছে হাজারো আবু সায়ীদ। উদয়ের পথের বাণী তাঁদের জানা, ওঁরা এখন কোটি কোটি যাঁরা নিঃশেষে প্রাণ দান করার জন্য প্রস্তুত। কারণ, তাঁরা আগামী ফাগুনের আগেই কয়েক হাজারগুন হয়ে গেছেন।
আমার জীবনে প্রথম যখন লজিং টিউশন আসে তখন আমি নবম শ্রেণীর ছাত্র। সেই সময় থেকে আজ (চবি'র অধ্যাপক) পর্যন্ত আমি গভীরভাবে সংশ্লিষ্ট আছি এই স্বপ্নবাজদের সাথে প্রতিদিন, প্রতিনিয়ত। আমি তাঁদের প্রতিটি রক্তকণা পড়তে পারি। তাই আপনাদের বলছি, এই রক্তকণার প্রতিটি ফাঁকে ফাঁকে অসংখ্য ও অদম্য স্বপ্নের বাজনা বাজে।সেই স্বপ্নগুলোকে ধারণ করার চেষ্টা করুন। জেনে রাখুন, ঐ স্বপ্নগুলোর অনুরণন শেষ হয় একটা গন্তব্যে আর তা হলো: একটা বৈষম্যমুক্ত, শোষণমুক্ত ও সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ- যেখানে আর কখনো আবু সায়ীদ ও মুগ্ধদের মায়ের বুক খালি হবেনা বরং বাংলার প্রতিটি মা আস্বস্ত থাকবেন যে দিনশেষে তাঁর সন্তান ঘরে ফিরে আসবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে কোনো দলীয় গুন্ডাদের বিচরণ থাকবেনা বরং থাকবে মেধাবীদের দৃপ্ত পদচারণা, দেশ - বিদেশের বিভিন্ন খাতে তাঁদের থাকবে ন্যায্য হিস্যা বা অধিকার আর উজ্জ্বল অবদান, কেও বিচারহীনতায় দিনাতিপাত করবেনা বরং সর্বত্রই থাকবে সুবিচার ও সুশাসন, কেও জবাবদিহিতার উর্ধ্বে নয় বরং সবাই থাকবে স্বচ্ছ জবাবদিহিতার বেড়ার ভিতরে, মানবতার গানে মুখরিত থাকবে এই সমাজের প্রতিটি প্রাণ আর প্রতিটি কোণা, যে গানের মূর্ছনায় সবাই ভুলে যাবে সমস্ত হিংসা, বিদ্বেষ, ঘৃণা আর দৈন্যতা। আর এই লক্ষ্য অর্জন করতে লাগবেনা কোনো বিদেশী রাষ্ট্রের আর্থিক অনুদান বা আই.এম.এফ এর বিলিয়ন ডলার লোন, শুধু দরকার রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও মানবিক ঐক্য। এই সামগ্রিক ঐক্য আসতে পারে শুধুমাত্র ছোট্ট একটা পরিবর্তনের মাধ্যমে আর তা হলো 'বিশ্বাস' যার মূলে থাকবে - অকৃত্রিম সততা, উদার সহিষ্ণুতা, অবিচল ধৈর্য্য, মানবিক ও সামাজিক নয়াপরায়ণতা আর নিরন্তর ত্যাগের মাধ্যমে এক সৃষ্টিকর্তার সন্তুষ্টির নিমিত্তে সবকিছুর আরাধনা - যাতে বিব্রত রয়েছে সুনিশ্চিত সফলতা; তাতে শুধু একটা দেশ না, সমগ্র মানব জাতির জন্য অফুরন্ত কল্যাণ নিহিত রয়েছে । নতুবা, বিশাল বিনিময়ে পাওয়া আজকের এমন একটা পবিত্র অর্জন বা সুযোগ বা অপর্চুনিটি নিমিষেই মিলিয়ে যেতে পারে শুধু সামান্য উন্মত্ততা, অহংকার, অসহিষ্ণুতা, অমানবিকতা ও অসতর্কতার জন্য।
পুনশ্চ: বাংলাভাষা আমার অকৃত্রিম অহংকার কিন্তু পেশাগত কারণে গত ২০/২২বছর ধরে বাংলার চর্চা কম- তাই বানান, বাক্য ও কাঠামোতে ভুলের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করছি। একেতো দেশের বাইরে যাওয়ার জন্য সবকিছু গুছিয়ে ওঠা আর পিএইচডি থিসিস নিয়ে ভীষণ ব্যস্ততা; তাসত্ত্বেও আমার কিছু নাছোড়-বান্ধা তরুণ ছাত্রদের প্রোগ্রাম মিস করায় তাদের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্যের একাংশ এখানে তুলে ধরলাম । ধন্যবাদ সবাইকে।।
আবুল বশর
অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।