13/02/2024
প্রায় অর্ধশত বছর আগে মহীনের ঘোড়াগুলি অবাক বিস্ময়ে বলেছিল পৃথিবী ছোট হতে হতে স্যাটেলাইট আর কেবলের মাঝে ড্রয়িং রুমে রাখা বোকা বাক্সে বন্দী। তবে সময়ের ফেরে পৃথিবী বোকা বাক্সের সীমানা ছাড়িয়ে এখন নিদারুণ স্মার্ট এক ছোট খাট বাক্সে গড়েছে নিজের বসতি।
ইন্টারনেটের বিপ্লবে পৃথিবী অনেকেটাই হাতের মুঠোয় চলে এসেছে, ফলে মুঠো খুললেই দেখা মেলে প্রয়োজনীয় সকল তথ্যের। এই ব্যাপারটি যতটা স্বস্তিকর শুনতে এর বৈপরীত্য ঠিক ততটাই ভয়ানক। ফলে হাতের মুঠোয় যে তথ্য পাওয়া যায় না তার অস্তিত্ব ততটাই প্রশ্নবিদ্ধ। ব্যাপারটা অনেকেটাই প্রাচীন ইংরেজি প্রবাদ ”Out of Sight, Out of Mind”-এর প্রতিনিধিত্ব করে।
আধুনিক ব্যবসায়ের জগতে ইন্টারনেটের বিপ্লব যেমন উন্মোচিত করেছে নতুন দ্বিগন্তের, ঠিক তেমনি বুনেছে মরণজাল-ও। প্রতিযোগিতামূলক ব্যবসায়ের এই সময়ে অনলাইনে যে ব্যবসায়কে খুজে পাওয়া যায়না, কাস্টমারের কাছে তার অস্তিত্ব নেই বললেই চলে। তাই নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে ইন্টারনেটের কোণে ঘর সাজানো প্রতিটি ব্যবসায়ের জন্য অত্যাবশ্যক এখন।
ফেসবুক ইন্টারনেটের এমনই একটি কোণ যেখানে রয়েছে অগণিত বাসিন্দা। প্রায় ২.৭০ বিলিয়ন মানুষের নিত্য আনাগোনা ফেসবুকে। মার্কেটিং-এর প্রাচীন প্রবাদ “মানুষ যেখানে মার্কেটিং সেখানে” কথার উপর ভিত্তি করে বলাই যায় সম্ভাব্য কাস্টমার খুজে পাবার সব থেকে সহজ এবং অন্যতম নির্ভরযোগ্য মাধ্যম নিঃসন্দেহে ফেসবুক। তাইতো দিন দিন নামী-দামী ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ছোটখাটো অনেক ব্যবসায়ই ফেসবুককে ব্যবহার করছে কাস্টমারের সাথে সম্পর্ক গড়ার মাধ্যম হিসেবে। কিন্তু অনেকেই যেখানে দাপিয়ে বেরাচ্ছে ফেসবুক মার্কেটিং-এর জোড়ে ঠিক সেখানেই পিছিয়েও পড়ছে অনেক ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান।
এখানে কারো পৌষ মাস এবং কারো সর্বনাশের পিছনের কারন একটাই।
সঠিক স্ট্র্যাটেজির অভাব।
আমরা অনেকেই ফেসবুক মার্কেটিং বলতে একটি পেইজ খুলে কিছু লাইক পাওয়া/কেনা এবং বুস্টকে বুঝে থাকি। যা আসলে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ধারণা।
তবে বৃহৎ ধারণা কোনটি?
বৃহৎ ধারণা হলো এই প্লাটফর্মটি এতটাই স্বয়ং সম্পূর্ণ যে কোনো ওয়েবসাইট ছাড়া কেবল ফেসবুক ব্যবহার করেও ডিজিটাল মার্কেটিং-এর অধিকাংশ সুবিধা লাভ করা সম্ভব। আপনি ব্র্যান্ড, পন্য কিংবা সেবামূলক যে ধরনের ব্যবসায় পরিচালনা করে থাকেন না কেন আপনার প্রাথমিক ডিজিটাল স্টোরফ্রন্ট হিসেবে অনায়েসেই ব্যবহার করতে পারবেন ফেসবুককে এবং আশার কথা হচ্ছে আপনি ই-কমার্স সাইটের মত এখানেও প্রোডাক্ট লিস্টিং করতে পারবেন অথবা সেবা ভিত্তিক ব্যবসায় হয়ে থাকলে তাও অনায়েসেই তুলে ধরতে পারবেন নির্দিষ্ট কাস্টমারের কাছে।
আপনার কাস্টমারকে নিয়ে গড়ে তুলতে পারবেন নিজস্ব কমিউনিটি। এছাড়াও ফেসবুক ব্যবহারে আপনি জানতে পারবেন রিয়েল টাইম কাস্টমার ইনসাইট যা আপনাকে সাহায্য করবে আপনার চূড়ান্ত মার্কেটিং গোল (কাস্টমার সন্তুষ্টি) অর্জন করতে।
তবে এই সবই সম্ভব হবে যখন আপনি ফেসবুক মার্কেটিং-এর গোল্ডেন রুল মেনে চলবেন।
গোল্ডেন রুল কি?
গোল্ডেন রুল হচ্ছে ফেসবুক মার্কেটিং-এ সাফল্য অর্জন করতে নিচের এই নিয়মগুলো মাথায় নিয়ে কাজ করা।
১। প্রোফেশনালি অপ্টিমাইজড পেইজ ব্যবহার করাঃ
আমরা সকলেই ফেসবুক ব্যবহার করি আমাদের ব্যক্তিগত যোগাযোগ মাধ্যম হিসেবে তবে ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে এই মাধ্যমকে অবশ্যই প্রফেশনালি তুলে ধরতে হবে। পার্সনাল প্রোফাইল নয় বরং ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে একটি পেইজ খুলতে হবে। প্রফেশনালি ফেসবুক পেইজ খোলার সময় যে বিষয়গুলো মাথায় রাখবেন:
- ব্যবসায়ের উদ্দেশ্য ও ধরণ অনুযায়ী পেইজ ক্যাটাগরি সিলেকশন
- প্রতিষ্ঠানের সাথে মিল রেখে নাম - লোগো সম্বলিত প্রোফাইল ছবি
- এবাউট সেকশনের সকল অপশন যথাযথ তথ্যের সাহায্য পুর্ণ করা
- ডেস্ক্রিপশনে সংক্ষেপে ব্যবসায়ের যথাযথ বিবরন এর কোনো একটি বাদ রেখে পেইজ খোলা বিফলতার বীজ বোনার মতই।
২। কন্টেন্ট ক্যালেন্ডারের ব্যবহারঃ
কথায় আছে “Fail to plan is like planning to fail”। সোশ্যাল মিডিয়া মার্কেটিং-এ সাফল্য পেতে হলে বিনা পরিকল্পনায় এগোনোই যাবে না। একেবারে রুল অব থাম্ব হিসেবে ধরে নিতে পারেন এটাকে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে কিভাবে প্ল্যান করবেন? কন্টেন্ট প্ল্যানিং ব্যাপারটা অনেকটা সুষম মিলের মত, সুস্বাস্থ্যের জন্য যেমন আহারে সকল উপাদান-ই পরিমিত পরিমাণে রাখতে হয় তেমনি সফল ফেসবুক মার্কেটিং-এর জন্যও ক্যাম্পেইনে প্রায় সকল ধরনের কন্টেন্টের সংমিশ্রণ থাকতে হবে। মাসের শুরুতে বসে একটি প্লান করে ফেলুন এই মাসে কাস্টমারের সাথে কোন কোন বিষয়গুলো নিয়ে কিভাবে যোগাযোগ করবেন, বিশেষ কোনো দিবস আছে কিনা থাকলে তা নিয়ে কন্টেন্ট প্লান করুন।
প্ল্যানিং-এর সময় কন্টেন্টের ধরন যেমন কন্টেন্ট কি লিখিত হবে নাকি ভিডিও নাকি ছবি কিংবা এনিমেশন তা নির্ধারন করে ফেলুন। প্ল্যানটি একটি এক্সেল শিটে তুলে কোন দিন কোন সময়ে কোন কন্টেন্ট প্রকাশ করবেন তা একটি ক্যালেন্ডারে সাজিয়ে ফেলুন। প্ল্যান অনুযায়ী কন্টেন্ট বানিয়ে তা ক্যালেন্ডার অনুযায়ী নিয়মিত প্রকাশ করুন।
৩। ভ্যালু এড করুনঃ
কন্টেন্ট প্ল্যানিং-এর সময় মাথায় রাখতে হবে কন্টেন্ট যেন ব্যালেন্সড হয়। কেবল সেলিং কন্টেন্ট নয় বরং সেলিং কন্টেন্টের পাশাপাশি ইনফরমেশনাল, এন্টারটেইনিং, রেলেভেন্ট নিউজ-ও শেয়ার করতে হবে। মনে রাখতে হবে কন্টেন্ট যেন অডিয়েন্সের লাইফে ভ্যালু এড করতে পারে। পরিসংখ্যান বলে, কেবল সেলিং পোষ্ট অডিয়েন্সকে বিরক্ত করে তাছাড়া আপনার অডিয়েন্স এবং আপনার মাঝে কেবল কেনা-বেচা ছাড়াও সম্পর্ক তৈরী করতে না পারলে, কাল
প্রতিযোগীর পন্য একটু ভালো দেখলেই সে আপনাকে ছেড়ে তার কাছে চলে যাবে চোখের পলকেই। তাই অডিয়েন্সের গেইনের কথা মাথায় রেখে কন্টেন্ট তৈরী করুন, সম্পর্ক মজবৃত করুন।
৩। পেইড এবং অর্গানিক প্রোমোশনের সংমিশ্রণঃ
কেবল কাড়ি কাড়ি টাকা বুস্টের পেছনে খরচ করলেই যেমন সেল পাওয়া যায় না তেমনি কেবল অগানিক উপায়েও টার্গেটেড ওডিয়েন্স রিচ করা সম্ভব হয়না। সেল ব্যালান্সে রাখতে হলে প্ল্যান করে
পেইড এবং অর্গানিক উপায়ে কন্টেন্ট প্রমোট করতে হবে। ফেসবুক অ্যালগরিদম অনুযায়ী একটি কন্টেন্ট অর্গানিক উপায়ে তার মোট অডিয়েন্সের সর্বোচ্চ ২% মানুষের কাছে পৌছে, তাও নানাবিধ শর্ত সাপেক্ষে। তবে সব শর্ত যেখানে যেয়ে মিলায়
তা হলো অর্গানিক রিচ বৃদ্ধির জন্য এঙ্গেজিং কন্টেন্ট। এঙ্গেজিং কন্টেন্ট পোষ্ট করতে হবে নিয়মিত, তা হতে পারে ইনফরমেশনাল, এন্টারটেইনিং, রেলেভেন্ট নিউজ।
তবে সময়ের সাথে সাথে ফেসবুকে অর্গানিক রিচ কমে যাওয়ায় সেলের জন্য পেইড প্রমোশন একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠছে।
পেইড প্রমোশন থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল পেতে একটি লিকপ্রুফ ফানেল তৈরি করে প্রমোশন করতে পারেন।
৪। ইম্প্রোভাইজেশনঃ
ডিজিটাল মার্কেটিং-এর সব থেকে বড় সুবিধা হচ্ছে এখানে সবসময়ই রিয়েল টাইম ওডিয়েন্স ইনসাইট পাওয়া যায়। তাই সহজেই কোন স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে এবং কোন স্ট্র্যাটেজি কাজ করছে না তা আমলে নিয়ে দ্রুতই স্ট্র্যাটেজি পরিবর্তন করা যায়।
ফেসবুক মার্কেটিং-এ সাফল্যের জন্য এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কন্টেন্ট পাব্লিশ করার পর তার সাফল্য দেখতে নিয়মিত অডিয়েন্স ইনসাইট চেক করুন, পোস্টের এঙ্গেজমেন্ট রেট বিবেচনা করে পরবর্তী মার্কেটিং স্র্যাটেজি প্ল্যান করুন।
৫। অডিয়েন্সকে শুনুন, বুঝুনঃ
মানুষ স্বভাবতই এটেনশন পেতে ভালোবাসে, আপনার অডিয়েন্স-ও এর উর্ধ্বে নয়।
অডিয়েন্সের কমেন্ট, মেসেজের নিয়মিত রিপ্লাই করুন। তাদের কাছ থেকে মতামত গ্রহন করুন, আপনার ব্র্যান্ডকে তাদের খুব কাছে নিয়ে যান এবং তারা আপনার ব্ল্যান্তকে যেভাবে চায় সেভাবেই নিজেকে তুলে ধরুন। নিয়মিত যোগাযোগই পারে আপনার ব্র্যান্ড এবং টার্গেটেড কাস্টমারের মধ্যে একটি মানবীয় সম্পর্ক স্থাপন করতে।
সর্বোপরি আপনার সকল কাজ একটি নিদিষ্ট উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে ধারাবাহিকভাবে পরিচালনা করতে পারলে সাফল্য আসবেই, তবে এর বিপরীতে বিফলতাও ফাঁকি দিবে না। তাই ধৈর্যের সাথে নিয়মিত পোষ্ট করে, কাস্টমারের সাথে যোগাযোগ রেখে ব্যবসায় পরিচালনা করুন।
পোষ্টটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন আপনার বন্ধুদের সাথে।
ফেসবুক মার্কেটিং রিলেটেড যেকোনো সাহায্যের জন্য ম্যাসেজ দিন আমাদের পেজে 🙂