23/01/2022
ফ্রিলান্সিং এর রক্তচোষা ছারপোকাদের গল্পঃ
ছারপোকা, পরজীবী প্রাণী, বড় বড় প্রাণীদের রক্ত চুষে খায়। সহজে ধ্বংস করা যায় না। সময় মত ব্যাবস্থা না নিলে, এরা রক্ত চুষতে চুষতে সেই প্রাণীর মৃত্যুর কারন পর্যন্ত হতে পারে। ঠিক তেমনি ভাবে ফ্রিলান্সিং সেক্টরেও অনেক রক্তচোষা আছে, যারা প্রতিনিয়ত এই সেক্টরকে ধ্বংস করার জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে। যারা এই সেক্টরে পুরাতন আছেন তারা এসব ভাল করেই জানেন। কিন্তু যারা একেবারেই নতুন বা শুরু করতে যাচ্ছেন তারা হয়ত জানেন না। মুলত তাদের সবাধান করার জন্য এই পোষ্ট। তা হলে শুরু করা যাক।
বিডারঃ
এই প্রজাতি প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বর্তমান Upwork যখন ওডেস্ক ছিল তখন একই একাউন্ট থেকে, বিশেষ টেকনিক খাটিয়ে হাজার হাজার জবে বিড করা যেত। এই বিডারদের কাজ ছিল প্রতিনিয়ত বিড করে কাজ নামানো। সেটা যেভাবেই হোক। এক অফিসে বসে ৮/১০টা পিসিতে সারাদিন বিড করার ঘটনাও দেখেছি। এই মার্কেটপ্লেস আমাদের জন্য এত কঠিন হবার পিছনে এই স্পামারদের বিরাট ভুমিকা আছে। Upwork এ বিড সিস্টেম কঠোর এবং পেইড হবার পর এরা মুলত বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
একাউন্ট এপ্রুভারঃ
এরা এখন খুব সক্রিয়। এরা Upwork এ একাউন্ট এপ্রুভ করে দেয়ার নাম করে টাকা নিয়ে থাকে। এদের ব্যাবসা এতটাই রমরমা যে, ফেসবুক বুস্টীং করে এরা লোক জোগাড় করে। ৫০০ থেকে শুরু করে ৫ হাজার টাকা পর্যন্ত নিয়ে থাকে। মুলত কান্ট্রি এবং ক্যাটাগরি চেঞ্জ করে এরা একাউন্ট এম্প্রুভ করায়। যেটা আপনিও সহজেই পারবেন। এর পরে ছাগল প্রজাতির মানুষদের কাছে বিক্রি করে। এসব একাউন্ট খুব বেশিদিন টেকে না। মনে রাখতে হবে একাউন্ট যেভাবে এপ্রুভ হোক না কেন, আপনাকে ভিডিও ভেরিফিকেশন করতেই হবে। আর তখনই খাবেন ধরা।
গিগ লাইকারঃ
এই প্রজাতি ইদানীং বের হয়েছে, এরা আপনার গিগ ৫০০/১০০০ এই রকম হিসেবে ফেবারিট করে দেবে। বিনিময়ে মোটা অংকের টাকা নেবে। অনেকেই মনে করেন, গিগ বেশি বেশি ফেবারিট হলে কাজ বেশি আসে। এটা পুরাপুরি ভুল ধারণা। বরং এদের কাছ থেকে এই ধরনের সার্ভিস কিনলে আপনার একাউণ্ট হারাতে পারেন। আমার কাছের একজনের কাছে এক ট্রেনিং সেন্টারের মালিক দাবী করেছিল যে তার নাকি ২৩০০+ একটিভ ফাইভার প্রফাইল আছে। তবে একটা ঘরে ৩৩টা পিসিতে ৩৩টা ফাইভার একাউন্ট চালায় এমন পাবলিকের গল্প আমি নিজে শুনেছি। এরা কিভাবে কি করে সেটা কেউ জেনে থাকলে একটু কমেন্টে জানান।
চোষা মজিদঃ
রক্তচোষা মজিদ প্রকৃতির কিছু পাবলিক আছে, এরা মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ নামিয়ে, সাধারণ পাবলিকদের দিয়ে প্রায় বিনামুল্যে কাজ করিয়ে নেয়। অনেক সময় ফুটো পয়সাও দেয় না। এই ধরনের "রক্তচোষা মজিদেরা" বিভিন্ন গ্রুপে জব পোষ্ট করে তাদের এই অনৈতিক কাজ করে যাচ্ছে। নতুনেরা এদের কাছ থেকে সাবধান। আগ্রিম না নিয়ে কখনো কাজ করবেন না।
গিগারঃ
এটা নতুন প্রজাতি। এরা আপনাকে গিগ বানিয়ে দেবে বিনিময়ে টাকা নেবে। আমি বেশ কিছু পাবলিক দেখেছি যারা এই সার্ভিস দেয়। আমার কথা হচ্ছে যে বান্দা গিগ বানাতে পারে না সে কিসের ফ্রিলান্সিং করবে 🙂 এর থেকে হাস্যকর কিছু হতে পারে না। কাজেই এই ভুল কেউ করবেন না। এছাড়া কিছু ট্রেনিং সেন্টার আছে যারা কিছু লোকই নিয়োগ দেয় গিগ তৈরি করার জন্য। তাদের সারাদিনের কাজ হচ্ছে বসে বসে কপি অন্যের গিগ কপি পেস্ট করে পাবলিশ করা। শুনেছি গিগে কোন অর্ডার আসলে তার একটা কমিশন পায়। আগেই বলেছি শত শত ফাইভার একাউন্ট চালায় এমন অনেক ট্রেনিং সেন্টার আছে। তারাই মুলত এই কাজ করে। কিন্তু তাদের কাজের পদ্ধতি এখনো অজানা। কেউ জেনে থাকলে কমেন্ট করবেন।
রিভিউ বিক্রেতাঃ
এরা অনেক পুরাতন এবং শক্তিশালী প্রজাতি। এরা মার্কেটপ্লেসে রিভিউ বিক্রি করে। Fiverr এ ইদানীং কাজ কমে যাওয়াতে এদের চাহিদা বেড়ে গেছে। কিছু ইউটীউবার নতুনদের মধ্যে এই ধারণা তৈরি করেছে যে রিভিউ না কিনলে নতুন একাউন্ট দাড়াবে না। ফলে রিভিউ কেনা বেচার মার্কেট এখন অনেক রমরমা। আমি বলব যাদের ফ্রিলান্সিং এর শুরু, এই ধরনের অনৈতিক কাজ দিয়ে, তাদের দ্বারা আর যাই হোক ভাল কিছু হতে পারে না। আর মনে রাখতে হবে Fiverr আমাদের থেকে অনেক বেশি চালাক। এসব থেকে দূরে থাকাই ভাল।
একাউণ্ট খাদকঃ
এই প্রজাতির কাজ হচ্ছে অন্যের একাউন্ট খেয়ে দেয়া। ব্যাক্তিগত আক্রোশ বশত বা ঈর্ষার বশবর্তী হয়ে এই কাজ করে। আমি এই ধরনের গ্রুপ দেখেছিলাম যারা টাকার বিনিময়ে এই কাজ করে। মুলত টারগেটেড প্রোফাইলে ৫/৬ টা বায়ার প্রোফাইল থেকে অর্ডার করে। এর পরে সেলারের সাথে ঝামেলা করে, সাপোর্টে রিপোর্ট করে রিফান্ড নিয়ে নেয় এবং একাউণ্ট ব্যান করায়। এছাড়া গিগের ইমেজ অন্য কোথাও আপলোড দিয়ে, সেই ইমেজ নিজের দাবি করে, সাপোর্টে রিপোর্ট করে গিগ ডিলিট করায়, এমনও দেখেছি। এছাড়া বট ইউজ করে গিগে হাজার হাজার ক্লিক ভিউ করিয়ে সহজেই যে কোন প্রোফাইলের বারোটা বাজানো যায়। যেসব আবাল শ্রেণীর সেলার নিজের ফেসবুক প্রোফাইল এবং যত্র তত্র গিগ শেয়ার দিয়ে বেড়ান এবং যত্রতত্র ডলারের স্ক্রিনশট দিয়ে বেড়ান, তারা সাবধান হয়ে যান।
ট্রেনিং সেন্টারঃ
ফ্রিল্যনাসিং মার্কেটগুলোর বিশেষ করে Fiverr এর বারোটা বাজানোর পিছনে এদের ভুমিকা সব থেকে বেশি। ব্যাঙের ছাতার মত গড়ে ওঠা এইসব ট্রেনিং সেন্টার ফ্রিলান্সার বানাক বা না বানাক, দেশে গাধা গরু প্রডাকশনে বিশাল ভুমিকা রাখছে। এসের সম্পর্কে বলার কিছু নেই। মার্কেটপ্লেস থেকে ১ ডলার ইনকাম না করেও সফল ভাবে ট্রেনিং সেন্টার চালাচ্ছে, বাড়ি গাড়ি করেছে, এমন বহু পাবলিক আছে। তবে আশার কথা হচ্ছে দেশে অনেক ভাল ভাল ট্রেনিং সেন্টার ইন্সটিটিউট এবং অনলাইন লার্নিং প্লাটফর্ম গড়ে উঠেছে, ভাল ফিডব্যাক দেখে তাদের কাছ থেকে শিখতে পারেন।
দরবেশ বাবাঃ
চারিদিকে এখন ফ্রিল্যনাসিং দরবেশ বাবাদের ছড়াছড়ি। এদের কাছে আছে সিক্রেট টিপস। আর সাফল্যের ১০০% গ্যারান্টি। এরা সব বিষয়ে অভিজ্ঞ। সিক্রেট গ্রুপে খুলে, ভিডিও টিউটোরিয়াল বা সার্ভিস বিক্রি করে কোটি কোটি টাকা এরা হাতিয়ে নিয়ে গা ঢাকা দেয়। বেশ কিছুদিন পরে আবার নতুন করে শুরু করে। ভুক্তভুগিদের কিছু করার থাকে না, চোখের পানি ফেলা ছাড়া। এই ধরনের প্রচুর ঘটনা জানি। লিখতে গেলে মহাভারত হয়ে যাবে। তাই আমি বলব এদের থেকে ১০০ হাত দূরে থাকবেন। বেশি গুগল সার্চ করা শেখেন। নেটে সব দেয়া আছে। দরবেশ বাবার কাছে যেয়ে প্রতারিত হবার কোন দরকার নেই।
ডলার ব্যাপারীঃ
ফ্রিল্যান্সিং করেন আর এদের চেনেন না এমনটা হতেই পারে না। শুনলে অবাক হবেন যে এরা আবার নিজেদেরকে ফ্রিল্যান্সার হিসাবে দাবি করে। এই সব ডলার ব্যাপারীরা মুলত ফ্রিল্যান্সারদের কাছ থেকে একটু বেশি দামে ডলার কিনে, চড়া দামে বিক্রি করে থাকে। মুলত যারা অনলাইন জুয়া খেলে, এরাই মুলত তাদের প্রধান ক্রেতা। IPL, BPL বেটীং সহ বেটীং করার জন্য শত শত এপস চালু হয়েছে। আমাদের গ্রামেই অনেকে এর সাথে জড়িত। প্রতিদিন প্রায় ১২লক্ষ টাকার বেটীং লেনদেন করে এমন পাবলিক আমাদের এলাকাতেই আছে। আমার কথা হচ্ছে আপনি হালাল ভাবে কস্ট করে মারকেটপ্লেস থেকে ইনকাম করে, সামান্য কিছু লাভের আশায় সেটা এসব বাটপাড়দের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন হারাম কাজের জন্য। বিষয়টা দুঃখজনক। শুধু তাই না ডলার কেনাবেচার জন্য রীতিমত বড় বড় গ্যংগ্রুপ গড়ে উঠেছে। ডলার বিক্রি করার জন্য এরা নিদিষ্ট এলাকায় আসতে বলে। টাকা নিয়ে গেলেই ধরা। মারধোর করে সব কেড়ে নেবে। আপনি চাইলেও আইনের আশ্রয় নিতে পারবেন না, কারন ডলার কেনাবেচা করা এদেশে অবৈধ। গাজিপুরের দিকে এক বড় ডলার গ্যাং গ্রুপের গল্প শুনেছিলাম। যাদের পাল্লায় পড়ে অনেকেই সর্বস্বান্ত হয়েছে। কাজেই সাবধান।
ভন্ড ফ্রিল্যান্সার ইউটিউবারঃ
ফ্রিলান্সিং মার্কেটপ্লেস বিশেষ করে Fiverr এর বারোটা বাজাবার পিছনে ট্রেনিং সেন্টারের পরে সব থেকে বড় ভুমিকা এইসব ফ্রিলান্সার নামধারী ইউটীউবারদের। নিজেদের ভিডিওতে লাইক ভিউ বাড়াতে বিভিন্ন চটকদার হেডলাইন দিয়ে এরা ভিডিও ছাড়ে। দেশে ফ্রিলান্সার নামধারী স্পামার মুলত এরাই তৈরি করেছে। বিভিন্ন ভুল তথ্য দিয়ে মানুষদের বিভ্রান্ত করছে। দেখার কেউ নেই।
এর বাহিরেও আর কোন প্রজাতির ছারপোকাদের কথা জানা থাকলে কমেন্টে জানাতে পারেন। সবার উপকারের জন্য পোষ্টে এড করে দেয়া যাবে।
পরিশেষে একটা কথাই বলব, যারা একেবারে নতুন ফ্রিলান্সিং এ আসতে চাচ্ছেন তারা নিদিষ্ট একটা বিষয়ে ভাল করে শিখে, এর পরে মারকেটপ্লেসে আসেন। আশা করা যায় ভাল কিছু হবে। দুষ্ট লোকের মিথ্যে কথায় প্রতারিত হবে না। যাচাই বাছাই করুন। নিজের বিবেক বুদ্ধি কাজে লাগান। আশা করি আপনি সফল হবেন।
ধন্যবাদ!
(আমার পূর্বের লেখার পরিমার্জিত সংস্করণ, সবাইকে সাবধান করার জন্য আবারো পাবলিশ করা হল। লেখাটি আমার ব্যাক্তিগত ব্লগে পূর্বপ্রকাশিত)
Golam Kamruzzaman