19/10/2021
ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী (আরবি: مَوْلِدُ النَبِيِّ মাওলিদু এন-নাবীয়ী, আরবি: مولد النبي মাওলিদ আন-নাবী, কখনো কখনো সহজভাবে বলা হয় مولد মাওলিদ, মেভলিদ, মেভলিট, মুলুদ আরো অসংখ্য উচ্চারণ; কখনো কখনো: ميلاد মিলাদ) হচ্ছে শেষ নবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) জন্মদিন হিসেবে মুসলমানদের পালিত একটি উৎসব। হিজরি বর্ষের তৃতীয় মাস রবিউল আউয়াল-এর বারো তারিখে এ উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশি মুসলমানরা এই দিনকে ঈদ-ই-মিলাদুন্নবী বলে অভিহিত করি। অপরদিকে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কাছে এই দিন নবী দিবস নামে পরিচিত।
মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) মক্কা নগরীর কুরাইশ বংশের বনু হাশিম গোত্রে ৫৭০ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট বা আরবি রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ জন্মগ্রহণ করেন। ৮ই জুন ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে রবিবারে বা ১১ হিজরি সালের রবিউল আউয়াল মাসের ১২ তারিখ সন্ধ্যায় তিনি মদিনায় আয়িশার গৃহে মৃত্যুবরণ করেন।
হিজরী ৪র্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি থেকে মিলাদুন্নবীর প্রচলন শুরু হয়। রাসূল (সাঃ) এর জন্মদিন পালনের মূল প্রর্বতক ছিল খলীফা আল মুয়িজ্জু লি-দীনিল্লাহ। এখানে উল্লেখ্য যে, মিশরের এইসব অনুষ্ঠানাদি তখনো মুসলিম বিশ্বের অন্যত্র ছড়িয়ে পড়েনি। পরবর্তীতে যিনি ঈদ-ঈ-মিলাদুন্নবীকে মুসলিমবিশ্বের অন্যতম উৎসব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেছেন, তিনি হলেন, ইরাক অঞ্চলের ইরবিল প্রদেশের আবু সাঈদ কুকবুরী । সে হিসেবে জানা যায়, ৭ম হিজরী থেকে আনুষ্ঠানিক ভাবে মিলাদ (ঈদ-ঈ-মিলাদুন্নবী) উদ্যাপন শুরু হয়। মিলাদের উপর সর্বপ্রথম গ্রন্থ রচনা করে আবুল খাত্তাব ওমর ইবনে হাসান ইবনে দেহিয়া আল কালবী ।
মহানবী হজরত মুহম্মাদ (সা.) ছিলেন সব শ্রেণী-পেশার মানুষের জন্য এক অনুপম আদর্শ। তিনি ছিলেন শিশুর আদর্শ, যুবকের আদর্শ, সৈনিকের আদর্শ, সেনাপতির আদর্শ, স্বামীর আদর্শ, পিতার আদর্শ, নানার আদর্শ, ব্যবসায়ীর আদর্শ, শিক্ষকের আদর্শ ও রাষ্ট্রনায়কের আদর্শ। পৃথিবীর অন্যকোনো মহামানবের ভেতরে এমন অপুর্ব দৃষ্টান্ত পাওয়া যাবে না, যার সমাহার ও সংমিশ্রণ শুধু এই মহামানবের জীনাদর্শেই বিদ্যমান। তাঁর অনুসরণ-অনুকরণ করার মধ্যে মানব জীবনের ঐকান্তিক সফলতা নিহিত। রাসুল (সা.) পৃথিবীতে আগমন করেছেন সচ্চরিত্রের বিকাশ সাধনের লক্ষ্যে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমাকে সচ্চরিত্রের পূর্ণতা সাধনের নিমিত্তই প্রেরণ করা হয়েছে।’ (জামেউল আহাদিস : ৬৭২৯)
মানব জাতির আদর্শ রাসুল (সা.) ছিলেন সৃষ্টির সেরা মানুষ। নিরপেক্ষ ঐতিহাসিকরাও অকপটে স্বীকার করেছেন যে মুহাম্মাদ (সা.) সর্ব কালের, সর্ব যুগের শ্রেষ্ঠ মহামানব। রাসুল (সা.)-এর চরিত্র সম্পর্কে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, ‘আপনি অবশ্যই মহান চরিত্রের অধিকারী।’ (সুরা কালাম, আয়াত : ৪)। অর্থাৎ নৈতিক চরিত্রের সর্বোচ্চ মানের ওপর আপনি অধিষ্ঠিত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নৈতিক চরিত্রের মান নিয়ে মক্কার মুশরিকদেরও অভিযোগ ছিল না। তাঁর বিশ্বস্ততা ও উন্নত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে তাদের ছিল না কোনো দ্বিমত। রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর নৈতিক চরিত্রের সর্বোত্তম সংজ্ঞা দিয়ে হজরত আয়েশা (রা.) বলেছেন, ‘কোরআনই ছিলো তাঁর চরিত্র।’ রাসুলুল্লাহ (সা.) দুনিয়ার তাবৎ মানুষের সামনে শুধু কোরআনের শিক্ষাই পেশ করেননি। বরং তিনি নিজেকে কোরআনের জীবন্ত নমুনা হিসেবে উপস্থাপন করেছিলেন। কুরআন মজিদে যে নৈতিক গুণাবলীকে উৎকৃষ্ট কাজ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, সেসব গুণে তিনি ছিলেন পরিপূর্ণ গুণান্বিত।
প্রতিশোধ নেওয়ার সুযোগ ও ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও তিনি চরম শত্রুকেও ক্ষমা করে দিতেন। মক্কা বিজয়ের দিনে রাসুল (সা.) মক্কার লোকদের উদ্দেশ্যে ঐতিহাসিক ভাষণে বলেছিলেন, ‘হে কুরাইশরা! তোমরা আমার কাছ থেকে আজ কেমন ব্যবহার আশা করো?’ তারা বলল, সম্মানিত ভাই ও ভ্রাতুষ্পুত্রের মতো! তিনি বললেন, ‘তোমরা চলে যাও! আজ তোমরা মুক্ত!’ যারা একসময় তাঁকে অনেক অত্যাচার-নির্যাতন, সামাজিকভাবে বয়কট করা এমনকি হত্যার চেষ্টা পর্যন্ত করেছিল, অথচ তিনি তাদের সবাইকে ক্ষমা করে দিলেন! এভাবেই সহনশীলতা তাঁর চরিত্রকে নিয়ে গিয়েছিল এক অনন্য উচ্চতায়। রাসুল (সা.) একবার সাহাবিদের সঙ্গে মসজিদে বসা ছিলেন। এমন সময় একজন বেদুঈন এসে সেখানে পেশাব করা শুরু করলে সাহাবিরা তাকে ধমক দিয়ে থামতে বললেন। রাসুল (সা.) বললেন, ‘তাকে ছেড়ে দাও; বাধার সৃষ্টি করো না।’ তারপর তিনি লোকটিকে ডেকে বললেন, ‘এটা মসজিদ, এ স্থান অপবিত্রতা কিংবা পেশাব পায়খানার জন্য উপযুক্ত নয়।’ অতঃপর রাসুল (সা.) একজনকে বললেন, তুমি পানি ভর্তি একটা বালতি নিয়ে আসো। এরপর এর ওপর ঢেলে দাও। তিনি বালতিতে পানি এনে তার ওপর ঢেলে দিলেন। (মুসনাদে আহমাদ, হাদিস : ১২৯৮৪)
পেশাব আটকে রাখলে বিভিন্ন শারীরিক সমস্যা হতে পারে, এই চিন্তা থেকে রাসুল (সা.) লেকটিকে পেশাবের মাঝে বাঁধা দিতে নিষেধ করেন। এবং মসজিদে পেশাব করার সাময়িক অনুমতি দেন। যারা উগ্র মানসিকতা সম্পন্ন, তাদের জন্য এটি একটি শিক্ষণীয় ঘটনা। ভিন্নমতাবলম্বী মানুষের সঙ্গে ইসলাম কী ধরনের ব্যবহার করতে বলেছে, তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত এখানে বিদ্যমান।
রাসুলে করিম (সা.)-কে সৃষ্টি করা হয়েছে সবার জন্য অনুসরণীয় ও মুক্তির কান্ডারী হিসেবে। আল্লাহর ভালবাসা প্রাপ্তি মহানবীর পরিপূর্ণ আনুগত্য ও অনুসরণের ওপর নির্ভরশীল। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কোরআনে বলেছেন, ‘হে রাসুল! তুমি লোকদের বলে দাও, যদি তোমরা আল্লাহকে ভালবাসো, তাহলে আমার অনুসরণ করো। তাহলে আল্লাহও তোমাদের ভালবাসবেন।’ (সুরা আলে ইমরান, আয়াত : ৩১)। রাসুলকে ভালোবাসার নিদর্শন হচ্ছে তাঁর আনুগত্য ও অনুসরণ করা। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘আমার উম্মতের সব লোকই জান্নাতি হবে অস্বীকারকারী ছাড়া। জিজ্ঞেস করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! অস্বীকারকারী কে? রাসুল (সা.) বললেন, যে আমার অনুসরণ করবে, সে জান্নতে প্রবেশ করবে, আর যে আমার নাফরমানি করবে, সেই অস্বীকারকারী।’ (বুখারি, হাদিস : ৬৮৫১)
আজ এই পবিত্র দিনে আমাদের অঙগীকার হোক “ধর্ম নিয়ে নিয়ে বাড়াবাড়ি না করি, নবী (সঃ) এর দেখানো পথে জীবন গড়ি ।”