08/04/2021
"শাসকের আনুগত্যের হাদীসসমূহঃ তাহলে কি কিছু হাদিস মানব আর কিছু মানব না?
(গুরুত্ব সহকারে পড়ুন)
বর্তমান সময়ে অনেককেই বলতে দেখা যাচ্ছে, শাসকের আনুগত্য করা ইসলামী শারীয়াহর বিধান। এক্ষেত্রে তারা দালীল হিসেবে উপস্থাপন করেন এমন কিছু হাদীস যেখানে রাসূলুল্লাহ ﷺ শাসকের আনুগত্যের নির্দেশ দিয়েছেন। এ হাদীসগুলোর উপর ভিত্তি করে তারা বলতে চান, কোন ভূমির শাসকের আনুগত্য করা সে ভূমিতে অবস্থিত মুসলিমদের জন্য আবশ্যক এবং এটা শারীয়াহর সুস্পষ্ট বিধান। তাদের বক্তব্য মোটামুটি নিম্নরূপ -
“শাসকের আনুগত্য করতে হবে। শাসকের আনুগত্য করার আবশ্যকতা সহিহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যতক্ষণ শাসক সালাত কায়েম রাখবে ততোক্ষণ তার আনুগত্য থেকে হাত গুটিয়ে নেয়া যাবে না। ততক্ষণ আনুগত্য করতে হবে। শাসকের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা যাবে না। এটাই শারীয়াহর বিধান।”
১। কোন শাসকের আনুগত্য করতে হবে?
একথা সত্য রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাদের শাসকের আনুগত্য করতে বলেছেন। এ ব্যাপারে বেশ কিছু হাদীস আছে। যেমন-
১। মুহাম্মাদ ইবনু সাহল ইবনু আসকার তামীমী ও আবদুল্লাহ ইবনু আব্দুর রহমান দারেমী (রহঃ) হুযায়ফা ইবনু ইয়ামান (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ “আমি আরয করলাম, ইয়া রাসুলুল্লাহ! আমরা ছিলাম অমঙ্গলের মধ্যে; তারপর আল্লাহ আমাদের জন্য মঙ্গল নিয়ে আসলেন। আমরা তাতে অবস্থান করছি। এ মঙ্গলের পিছনে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ। আমি বললাম এ মঙ্গলের পিছনে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমি বললাম, এ মঙ্গলের পিছনে কি আবার কোন অমঙ্গল আছে? তিনি বললেনঃ হ্যাঁ, আমি বললাম, তা কিভাবে? তিনি বললেনঃ আমার পরে এমন সব নেতার উদ্ভব হবে, যারা আমার হেদায়েতে হেদায়েতপ্রাপ্ত হবে না এবং সুন্নাতও তারা অবলম্বন করবে না। তাদের মধ্যে এমন সব লোকের উদ্ভব হবে, যাদের অন্তঃকরণ হবে মানব দেহে শয়তানের অন্তঃকরণ। রাবী বলেনঃ তখন আমি বললাম, তখন আমরা কি করবো ইয়া রাসুলুল্লাহ! যদি আমরা সে পরিস্থিতির সম্মুর্খীন হই? বললেনঃ তুমি শুনবে এবং মানবে যদি তোমার পিঠে বেত্রাঘাত করা হয় বা তোমার ধন-সস্পদ কেড়েও নেয়া হয়, তবুও তুমি শুনবে এবং মানবে।” [সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ (ইসলামিক ফাউন্ডেশানের অনুবাদে, “রাষ্ট্রক্ষমতা ও প্রশাসন” অধ্যায়) ৪৬৩২]
২। হাসান ইবনু রাবী (রহঃ) ইবনু আব্বাস (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ “রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ যে ব্যক্তি তার আমীরের মধ্যে এমন কোন ব্যাপার প্রত্যক্ষ করে, যা সে অপছন্দ করে তবে সে যেন ধৈর্যধারণ করে, কেননা যে ব্যক্তি জামায়াত থেকে কিঞ্চিৎ পরিমাণ সরে গেল এবং এ অবস্হায় মৃত্যুবরণ করল সে জাহেলিয়তের মৃত্যুই বরণ করলো।” [সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, ৪৬৩৭]
৩। হাদ্দাব ইবনু খালিদ আযদী (রহঃ) উম্মে সালাম (রাঃ) থেকে বর্ণিত যে, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেনঃ অচিরেই এমন কতক আমীরের উদ্ভব ঘটবে তোমরা তাদের চিনতে পারবে এবং অপছন্দ করবে। যে জন তাদের স্বরুপ চিনল সে মুক্তি পেল এবং যে জন তাদের অপছন্দ করল-নিরাপদ হল। কিন্তু যে জন তাদের পছন্দ করল এবং অনুরসরণ করল (সে ক্ষতিগ্রস্ত হল)। লোকেরা জানতে চাইল আমরা কি তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করব না? রাসুলুল্লাহ ﷺ বললেনঃ না, যতক্ষন তারা সালাত আদায়কারী থাকবে।” [সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, ৪৬৪৭]
সুতরাং দেখা যাচ্ছে আসলেই হাদিস আছে যেখানে বলা হয়েছে শাসকের আনুগত্য করতে, নিজের পছন্দে ও অপছন্দে, ইচ্ছায় ও অনিচ্ছায়, যদি শাসক যালিম হয়, যদি শাসক অত্যাচার করে তবুও, যদি জনগণ ও শাসক পরস্পরকে ঘৃণা করে, তবুও।
তবে একটা প্রশ্ন থেকে যায়। এই আনুগত্য কি সব শাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য? শাসক যদি কাফির, মুশরিক, মুরতাদ হয়? শাসক যা-ই দিয়েই শাসন করুক না কেন, বাইবেল-গীতা-অ্যাব্রাহাম লিঙ্কন কিংবা অন্য কোন মানুষের তৈরি সংবিধান – তার আনুগত্য করতে হবে? সে যদি আল্লাহ্ যা হারাম করেছেন সেটাকে হালাল করে (যেমন সুদ), কিংবা আল্লাহ্ যা হালাল করেছে তা হারাম করে (যেমন জিহাদ, হিজরত) তবুও কি তার আনুগত্য করতে হবে? রাসূলুল্লাহ ﷺ কি আমাদের এই নির্দেশই দিয়ে গেছেন?
এই প্রশ্নগুলোর উত্তর পাবার জন্য আরও কিছু হাদিসের দিকে তাকানো যাক -
১। মুহাম্মদ ইবনু মূসান্না (রহঃ), ইয়াহইয়া ইবনু হুসায়ন (রহঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ “আমি আমার দাদী থেকে শুনেছি, তিনি নাবী ﷺ -এর বিদায় হজ্জের ভাষণদান কালে তাঁকে বলতে শুনেছেনঃ যদি তোমাদের উপর একজন গোলামকেও কর্মকর্তা নিযূক্ত করা হয় আর সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালনা করে, তবে তোমরা তার কথা শুনবে এবং মানবে।” [সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, হাদীস নং ৪৬০৬]
২। সালামা ইবনু শাবীব (রহঃ), ইয়াহইয়া ইবনু হুসায়ন এর দাদী উম্মুল হুসায়ন (রাঃ) থেকে বর্ণিত। রাবী ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন বলেনঃ “আমি তাকে বলতে শুনেছি আমি বিদায় হজ্জে রাসুলুল্লাহ ﷺ এর সাথে হজ্জ আদায় করি। তিনি (রাবী) বলেনঃ রাসুলুল্লাহ ﷺ তখন অনেক কথাই বলেছিলেন। এরপর আমি তাঁকে বলতে শুনলাম, যদি তোমাদের উপর কোন হাত পা কাটা গোলামকেও আমীর নিযূক্ত করা হয় (ইয়াহইয়া ইবনু হুসাইন বলেনঃ) আমার ধারণা হয় তিনি (দাদী আরও) বলেছেনঃ কালো (অর্থাৎ কৃষ্ণকায় হাবশী গোলাম) আর সে তোমাদেরকে আল্লাহর কিতাব অনুসারে পরিচালিত করে তবে তোমরা তার কথা শুনবে এবং মানবে।” [সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, হাদীস নং ৪৬১০]
৩। কুতায়বা ইবনু সাঈদ (রহঃ) ইবনু উমার (রাঃ) এর সুত্রে নাবী সাল্লাল্লাহু ﷺ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেছেনঃ “মুসলিম ব্যক্তির অবশ্য পালনীয় কর্তব্য হচ্ছে শোনা ও মানা তার প্রতিটি প্রিয় ও অপ্রিয় ব্যাপারে- যে যাবৎ না তাকে আল্লাহর অবাধ্যতার আদেশ করা হয়। যদি আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ তাকে দেয়া হয় তা হলে তা শুনতে হবে না, মানতে হবে না।” [মুত্তাফাক্বুন আলাইহ, সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, হাদীস নং ৪৬১১, সহিহ বুখারি কিতাবুল আহকাম]
৪। মুহাম্মাদ ইবনু মূসান্না ও ইবনু বাশশার (রহঃ) আলী (রাঃ) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেনঃ “রাসুলুল্লাহ ﷺ একটি সেনাবাহিনী প্রেরণ করেন এবং এক ব্যক্তিকে তার আমীর নিযুক্ত করে দেন। সে একটা আগুন প্রজ্জলিত করলো এবং তাদেরকে তাতে ঝাঁপ দিতে নির্দেশ দিল। একদল লোক তাতে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হলো এবং অপর একদল বললো, আমরা (ইসলাম গ্রহণের মাধ্যমে তো) আগুন থেকেই আত্মরক্ষা করেছি। (সুতরাং আগুনে ঝাঁপ দেয়ার প্রশ্নই উঠেনা)। যথা সময়ে রাসুলুল্লাহ ﷺ এর দরবারে সে প্রসঙ্গ উত্থাপিত হলো। তখন তিনি যারা আগুনে ঝাঁপ দিতে উদ্যত হয়েছিল তাদেরকে লক্ষ্য করে বললেনঃ তখন তোমরা যদি সত্যি সত্যি আগুনে ঝাঁপ দিতে তবে কিয়ামতের দিন পর্যন্ত তাতেই অবস্হান করতে। পক্ষান্তরে অপরদলকে লক্ষ্য করে তিনি উত্তম কথা বললেন। তিনি বললেনঃ আল্লাহর অবাধ্যতায় আনুগত্য নেই। আনুগত্য কেবলই সৎ কাজে।” [সহিহ মুসলিম, কিতাবুল ইমারাহ, হাদীস নং ৪৬১৩]
৫। উবাদা ইবন সামিত (রাঃ) থেকে বর্ণিতঃ
دَعَانَا رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فَبَايَعْنَاهُ فَكَانَ فِيمَا أَخَذَ عَلَيْنَا أَنْ بَايَعَنَا عَلَى السَّمْعِ وَالطَّاعَةِ فِي مَنْشَطِنَا وَمَكْرَهِنَا وَعُسْرِنَا وَيُسْرِنَا وَأَثَرَةٍ عَلَيْنَا وَأَنْ لَا نُنَازِعَ الْأَمْرَ أَهْلَهُ قَالَ إِلَّا أَنْ تَرَوْا كُفْرًا بَوَاحًا عِنْدَكُمْ مِنْ اللَّهِ فِيهِ بُرْهَانٌ
অর্থাৎ, “রাসুলুল্লাহ ﷺ আমাদেরকে ডাকলেন এবং আমরা বাইয়াত হলাম। তিনি তখন আমাদেরকে যে শপথ গ্রহণ করান তার মধ্যে ছিল – ‘আমরা শুনবো ও মানবো, আমাদের অনুরাগে ও বিরাগে, আমাদের সংকটে ও স্বাচ্ছন্দ্যে এবং আমাদের উপর অন্যকে প্রাধান্য দিলেও যোগ্য ব্যক্তির সাথে আমরা নেতৃত্ব নিয়ে কোন্দল করবো না।’ তিনি বলেন, ‘যে যাবৎ না তোমরা তার মধ্যে প্রকাশ্য কুফর দেখতে পাবে এবং তোমাদের কাছে এ ব্যাপারে তার বিরুদ্ধে আল্লাহর সুস্পষ্ট দলীল থাকবে।’” [মুত্তাফাকুন আলাইহি; সহীহ মুসলিম ইস. ফাউ. হাদীস নং ৪৬১৯]
৬। আল্লাহর নাফরমানীর কাজে কোনরূপ আনুগত্য নেই। আনুগত্য করতে হয় কেবলমাত্র ন্যায়সঙ্গত কাজে। [মুত্তাফাকুন আলাইহি, বুখারি ৭২৫৭, মুসলিম ১৮৪০]
৭। “আল্লাহ্র অবাধ্যতায় কোন মানুষের আনুগত্য নেই।” [মুসনাদে আহমাদ, ১০৯৮]
৮। ‘আলী (রাঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, “রাসূলুল্লাহ্ ﷺ একটি ক্ষুদ্র সেনাদল পাঠালেন এবং এক ব্যক্তিকে তাঁদের ‘আমীর নিযুক্ত করে দিলেন। তিনি (‘আমীর) আগুন জ্বালালেন এবং বললেন, তোমরা এতে প্রবেশ কর। কতক লোক তাতে প্রবেশ করতে যাচ্ছিল। তখন অন্যরা বলল, আমরা তো (মুসলিম হয়ে) আগুন থেকে পালাতে চেয়েছি। অতঃপর তারা এ ঘটনা নাবী সাল্লাল্লাহু ﷺ এর নিকট জানাল। তখন যারা আগুনে প্রবেশ করতে চেয়েছিলেন তাদেরকে বললেনঃ যদি তারা তাতে প্রবেশ করত তাহলে ক্বিয়ামাত পর্যন্তই সেখানে থাকত। আর অন্যদেরকে বললেনঃ আল্লাহর নাফরমানীর কাজে কোনরূপ আনুগত্য নেই। আনুগত্য করতে হয় কেবলমাত্র ন্যায়সঙ্গত কাজে।” [সহীহ বুখারী (তাওহীদ) অধ্যায়ঃ ৯৫/ 'খবরে ওয়াহিদ' গ্রহণযোগ্য হাদিস নম্বরঃ ৭২৫৮ (আধুনিক প্রকাশনী- ৬৭৫০, ইসলামিক ফাউন্ডেশন- ৬৭৬৩]
৯। ইমরান বিন হুসাইন বর্ণনা করেছেন রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন – “আল্লাহ্র অবাধ্যতা করে এমন কারো প্রতি আনুগত্য নেই।” [মুসনাদের আহমাদ (৫/৬৬) এবং শাইখ আল-আলবানী আল-সহিহাহ তে একে সহিহ বলেছেন আল-মুসলিমের শর্তানুযায়ী]
১০। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন – “স্রষ্টার অবাধ্যতা করে সৃষ্টির প্রতি কোন আনুগত্য নেই।” [সহিহ বুখারি হাদীস নং ৪৩৪০, সহিহ মুসলিম হাদীস নং ১৮৪০, সুনান আল-নাসাই, হাদীস নং, ৪২০৫, সুনান আবু দাউদ, হাদীস নং, ২৬২৫, মুসনাদ আহমাদ খন্ড ১, পৃঃ ১৩১]
১১। (বিদায় হজে) প্রথম জামারায় পাথর নিক্ষেপের সময় এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ(ﷺ)কে জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল (ﷺ), কোন জিহাদ সর্বোত্তম?
রাসূলুল্লাহ (ﷺ) তাকে এড়িয়ে গেলেন। অতপর দ্বিতীয় জামারায় গিয়েও তিনি তাঁর উদ্দেশে একই প্রশ্ন করলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু(ﷺ)ও একইভাবে এড়িয়ে গেলেন। অবশেষে তৃতীয় জামারায় বা জামারা ‘আকাবায় গিয়ে যখন রাসূলুল্লাহ (ﷺ) পাথর নিক্ষেপ করলেন এবং উটের রেকাবীতে পা রাখলেন, তিনি জানতে চাইলেন, ‘প্রশ্নকারী ওই ব্যক্তি কোথায়?’ ওই ব্যক্তি বললেন, এই আমি এখানে হে আল্লাহর রাসূল।
তিনি [নবী(ﷺ)] বললেন, ‘সর্বোত্তম জিহাদ ওই ব্যক্তি করে যে অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলে।’
[মুসনাদ আহমাদ : ১৮৮৩০; ইবন মাজাহ, ৪০১২; নাসাঈ : ৪২০৯। অনুরূপ বর্ণনা আরও রয়েছে, তিরমিযী, ২১৭৪, শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন।]
সুতারাং দেখা যাচ্ছে যে সত্যবাদী রাসূল ﷺ আমাদের নির্দেশ দিয়েছেন শাসকের আনুগত্য করার তিনিই ﷺ আনুগত্যের ব্যাপারে বেশ কিছু শর্তও আমাদের জানিয়ে দিয়েছেন, যেমন –
১। আল্লাহ্র কিতাব দ্বারা শাসন করা শাসকের আনুগত্য করতে হবে সে অত্যাচারী হলেও, হাবশী, বিকৃত শরীরের গোলাম হলেও, তাকে আমাদের অপছন্দ হলেও, সে আমাদের প্রহার করলেও
২। আনুগত্য হবে আল্লাহ্র বাধ্যতায়
৩। আল্লাহর অবাধ্যতার ক্ষেত্রে কোন সৃষ্টির আনুগত্য নেই
৪। আনুগত্য করতে হবে যতক্ষণ না শাসকের মধ্যে কোন প্রকাশ্য কুফরী দেখা যাবে এবং সে কাজ কুফরী হবার ব্যাপারে শারীয়াহ থেকে সুস্পষ্ট দালীল থাকবে।
এছাড়া স্বয়ং আল্লাহ ‘আযযা ওয়া জাল আমাদের আনুগত্যের ভিত্তি সম্পর্কে জানিয়ে দিয়েছেন-
“বস্তুতঃ আমি একমাত্র এই উদ্দেশ্যেই রসূল প্রেরণ করেছি, যাতে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা হয়।” [আন-নিসা, ৬৪]
এই আয়াতটি এক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বের দাবি রাখে কারণ ঠিক পরের আয়াতেই আল্লাহ্ কসম করে বলছেন রাসূলুল্লাহ ﷺ কে বিচারক এবং তার আনীত শারীয়াহ দ্বারা শাসন মেনে নেয়ার আগ পর্যন্ত কারো ইমান আসবে না। এখান থেকে সুস্পষ্ট আল্লাহ্ ‘আযযা ওয়া জাল রাসূলের ﷺ প্রতি আনুগত্য ফরয করছেন এবং তা সংযুক্ত করেছেন - “আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী তাঁদের আদেশ-নিষেধ মান্য করা” –র সাথে। যদি খোদ রাসূলের ﷺ ক্ষেত্রে আনুগত্য করা হবে আল্লাহর নির্দেশানুযায়ী বলে আল্লাহ্ আমাদের জানিয়ে দিয়ে থাকেন, তাহলে কিভাবে শাসকের ক্ষেত্রে আল্লাহর বিরোধিতায় আনুগত্য থাকতে পারে?
এ কারণে শাসকের আনুগত্য সম্পর্কিত সকল হাদীস থেকে দুটো জিনিষ স্পষ্টভাবে বোঝা যায় -
১। “শাসকের আনুগত্য করতে হবে” – এ আদেশ ঐ শাসকের ব্যাপারে প্রযোজ্য যে শাসন করে কিতাবুল্লাহ তথা শারীয়াহ দ্বারা
২। “শাসকের আনুগত্য করতে হবে” – এ আদেশ কোন কাফির-মুশরিক-মুরতাদ শাসকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য না
এক্ষেত্রে ইমাম নাওয়াউয়ীর বক্তব্য তুলে ধরা হলঃ
ইমাম আন-নাওয়াউয়ী বলেছেন, “আল-ক্বাদ্বি ‘ইয়াদ্ব বলেছেন, ‘উলামাদের ইজমা হল নেতৃত্ব (ইমামাহ) কখনো কাফিরের উপর অর্পণ করা যাবে না, আর যদি (কোন নেতার) তার পক্ষ থেকে কুফর প্রকাশিত হয় তবে তাকে হটাতে হবে... সুতরাং যদি সে কুফর করে, এবং শারীয়াহ পরিবর্তন করে অথবা তার পক্ষ থেকে গুরুতর কোন বিদ’আ প্রকাশিত হয়, তবে সে নেতৃত্বের মর্যাদা হারিয়ে ফেলবে, এবং তার আনুগত্য পাবার অধিকার বাতিল হয়ে যাবে, এবং মুসলিমদের জন্য আবশ্যক হয়ে যাবে তার বিরোধিতা করা, বিদ্রোহ করা, তার পতন ঘটানো এবং তার স্থলে একজন ন্যায়পরায়ণ ইমামকে বসানো – যদি তারা (মুসলিমরা) সক্ষম হয়। যদি একটি দল (তাইফা) ব্যাতীত অন্যান্য মুসলিমদের পক্ষে এটা করা সম্ভব না হয়, তবে যে দলের (তাইফা) সক্ষমতা আছে তাদের জন্য এই কাফিরের (শাসকের) বিরোধিতা করা, বিদ্রোহ করা এবং তার পতন ঘটানো অবশ্য কর্তব্য। আর যদি শাসক কাফির না হয়ে শুধুমাত্র বিদ’আতী হয় তবে, এটা বাধ্যতামূলক হবে না, যদি তারা (তাইফা) সক্ষম হয় তবে তারা তা করবে। আর যদি কেউই সক্ষম না হয় এ ব্যাপারে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হওয়া যায়, তবে বিদ্রোহ করা আবশ্যক না, তবে তখন মুসলিমদের সেই ভূমি থেকে অন্য কোথাও হিজরত করতে হবে, নিজেদের দ্বীনের সংরক্ষণের জন্য।”[সহিহ মুসলিম বি শারহ আন-নাওয়াউয়ী, ১২/২২৯]
সুতরাং আমরা দেখতে পাই শাসকের আনুগত্যের হাদীসগুলোতে ঐ সব শাসকদের কথা বলা হচ্ছে যারা শারীয়াহ দ্বারা শাসন করে এবং যারা মুসলিম শাসক। মুসলিম শাসক যদি শারীয়াহ দ্বারা শাসন করে, তবে সে যদি ফাসেক হয়, যালিম হয় তথাপি আল্লাহ্র বাধ্যতার ক্ষেত্রে তার আনুগত্য করতে হবে। কিন্তু যে শাসক প্রকাশ্য কুফরী করে, আল্লাহর অবাধ্যতার নির্দেশ দেয় এবং যে কাফির আসলি অথবা কাফিরে পরিণত হয়েছে তার আনুগত্য যে করতে হবে না এটা হাদীস থেকেই প্রমানিত।
যারা কোন রকম বাছবিচার ছাড়াই শাসকের আনুগত্য করার কথা বলেন তারা দালীল হিসেবে একটি আর একটি বিষয় উপস্থাপন করার চেষ্টা করতে পারেন আর তা হল ক্বুর’আনের সূরা নিসার ৫৯ নম্বর আয়াত-
“হে ঈমানদারগণ! আল্লাহর নির্দেশ মান্য কর, নির্দেশ মান্য কর রসূলের এবং তোমাদের মধ্যে যারা বিচারক তাদের।”...
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে এ আয়াত তাদের বিপক্ষে দালীল। ইবন কাসীরর এই আয়াতের তাফসিরে উপরের হাদীসগুলো এনেছেন এবং তারপর স্পষ্টভাবে বলেছেন আনুগত্যের বিষয়টি শুধুমাত্র আল্লাহর বাধ্যতা এবং ওয়াহী অনুযায়ী শাসন-মীমাংসা এবং ফায়সালার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য। এছাড়া আল্লাহ্ এ আয়াতে বলেছে “...ওয়া উলিল আমরি মিনকুম” অর্থাৎ এবং তোমাদের মধ্য থেকে যারা বিচারক ও নেতৃস্থানীয়। আর এতো সুস্পষ্ট সত্য যে কাফির, মুশরিক ও মুরতাদীন কখনোই মুসলিমদের অন্তর্ভুক্ত না।
সুতরাং হাদীস এবং ক্বুর’আন থেকে প্রমাণিত হয় আনুগত্য ঐ মুসলিম শাসকের ক্ষেত্রে আবশ্যক যে শাসন করে শারীয়াহ দিয়ে। যে শাসক শারীয়াহর বদলে মানবরচিত কোন সংবিধান দিয়ে আসন করে তার আনুগত্য করতে মুসলিমদের আদেশ করা হয় নি। বরং আল কাদ্বি ইয়াদের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট মুসলিমদের কর্তব্য হল এমন শাসকের বিরোধিতা ও বিদ্রোহ করা।
হাদিসগুলোর উপর হযরত সাহাবী(রাঃ) এর বুঝঃ
আবূ বকর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহু রাসূলের প্রথম খলীফা মনোনীত হবার পর জনগণের উদ্দেশে বলেন, ‘আমাকে অনুসরণ করো যতক্ষণ আমি আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের অনুসরণ করব। যদি আমি গোমরাহীর পথে পরিচালিত হই তবে তোমরা আমাকে সঠিক পথের দিশা দেবে।’ তৎপরবর্তী খলীফা উমর রাদিয়াল্লাহু ‘আনহুও ক্ষমতায় থাকতে বক্তৃতায় জনগণকে বলেন, ‘আমি যদি ভুল পথে পরিচালিত হই তখন তোমরা কী করবে?’ তাৎক্ষণিকভাবে একজন উত্তর দিলেন, ‘এই তরবারী দিয়ে সোজা পথে নিয়ে আসবো’।
আপনারা আজকের শাসকদের দিকে তাকালে দেখবেন, এরা সবাই শাসন করছে চুক্তি সম্পূর্ণভাবে ভঙ্গ করে। শারীয়াহ দিয়ে আসন না করার কারণে তারা নিজেরাই এই চুক্তিকে বাতিল করে দিয়েছে। তারা কোন বৈধতা ছাড়াই শাসন করছে। তারা হয়ত আমাদের ভাষায় কথা বলে, আমাদের মতই হয়ত গায়ের চামড়া, এমনকি চাপে পড়লে সুবিধা অনুযায়ী কুরআন-সুন্নাহ থেকে হয়ত আমাদের মতই দলীল দেয়। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে যে তাদের ছুরিতে সর্বদা মুসলিমদের রক্তই লেগে থাকে, আর তাদের হাত সর্বদা কুফফারদের মিষ্টি খাওয়াতেই ব্যস্ত। এর পাশপাশি তাদের পক্ষ থেকে কুফফারকে দেয়া আরো অন্যান্য সুবিধা দেয়া তো আছেই, যেমন মুসলিমদের প্রাকৃতিক সম্পদগুলো কুফফারদের হাতে তুলে দেয়া, অথবা মুসলিম নারীদের পণ্য হিসেবে কুফফারদের কাছে বিক্রি করে দেয়া। ইসলামের বিরুদ্ধে এই অনবরত যুদ্ধে এইসব প্রশাসনের কিছু দুনিয়ালোভী দরবারী কিছু শাইখ বা ‘আলিমও আছে, এরা উৎসাহের সাথে যালিমের গুণগান করে বেড়ায়, আনুগত্য করতে বলে, আর শাসকের স্বপক্ষে ব্যালেট বক্সে ভোটও দেয়। এমনকি যদি শাসকরা গলায় ক্রুশ ঝুলিয়ে ঘুরে বেড়ায়, প্রকাশ্যেই কুফরি উচ্চারণ করে এবং কুফরি সংঘটন করে তবুও এসব বেতনভোগী, দুনিয়ালোভি ‘আলিমরা শাসকের দাসত্ব থেকে নিবৃত্ত হবে না।
মূলঃ 'ছয়গ্রাম আলিম মাদ্রাসা' এর পেজ থেকে নিয়ে সংযোজন, বিয়োজন করা হয়েছে।
(Collected)