14/04/2020
নববর্ষ ও উৎসবের ধারা
জিয়াউদ্দীন চৌধুরী (জেড সেলিম) বিশেষ প্রতিনিধি টাইমস ২৪ ডটনেট, ঢাকা :একটি জাতির নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য, আচার অনুষ্ঠান, ধ্যান ধারণা, আশা আকাঙ্খার ভাষা থাকে যা সেই জাতির সংস্কৃতি গড়ে তোলে। সেই সংস্কৃতি জাতির দর্পন। সংস্কৃতির বিভিন্ন উপাদানের মধ্যে নববর্ষ একটি। আমাদের দেশে তিনটি নববর্ষ উলেখ যোগ্য। পহেলা বৈশাখ বা ১৪ই এপ্রিল বাংলা নববর্ষ, ১ মুহররম আবির্ভূত হয় হিজরী নববর্ষ বা খৃষ্ট (ইংরেজী নববর্ষ), নববর্ষ আসে পহেলা জানুয়ারী । বাংলা নববর্ষে আনন্দ বৈভবে গ্রাম ও শহর উজ্জিবীত হয়ে ওঠে। খুশীর আমেজে প্রানবন্ত হয়ে উঠে মানুষ।
ইতিহাসের আলোকে পহেলা বৈশাখ-
বাংলা সনের প্রচলন ১৪১৬ বছর আগে। তিথিক্ষণ-দিন-মাস-বছর গণনার মধ্য দিয়ে। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপনের মধ্য দিয়ে প্রতিবছর বিকশিত হচ্ছে বাংলা বর্ষ বরণের উৎসব। বাংলা নববর্ষকে উপলক্ষ করে প্রকাশিত নানা তথ্য-উপাত্ত ও প্রবন্ধ-নিবন্ধে বাংলা সন বা বঙ্গাঁব্দের উদ্ভাস নিয়ে বেশ মতপার্থক্যও দেখা যায়। মানুষ তার প্রয়োজনে সময় ও কাল গণনার রীতি আবিস্কার করে নিয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক যুগে। এটি মানবজাতির আদিম কালের প্রবৃত্তি এবং মানুষের সহজাত সংস্কৃতির অংশ। পৃথিবীর দেশে দেশে জাতিতে জাতিতে নানা সন গণনার যে ঐতিহ্য গড়ে উঠেছে এর পিছনেও রয়েছে স্বয়ং সৃষ্টিকর্তার বিশ্বজনীন নিয়ম। আকাশ এবং পৃথিবীর সৃষ্টির প্রথম আলোকেই পৃথিবীর দেশে দেশে সন এবং বছর গণনার নানা পন্থা আবিস্কৃত হয়েছে। আর পৃথিবীতে যত দেশে যত সন আছে সবগুলোই ১২ মাসের বছর। অবশ্য সৌর মাস ভিত্তিক এবং চন্দ্রমাস ভিত্তিক গণনার ভিন্নতায় এসব সনের পরিধিগত বেশকমও রয়েছে। সন গণনার যে বিশ্ব প্রবর্তিত হয়েছে। প্রাচীন শব্দ সনের পথ ধরে এখানে প্রবর্তিত হয়েছে সম্বত, সঘীসন, নেপাল সম্বত, ত্রিপুরাব্দ, লক্ষণ সম্বত, পরগনাতি সন, শাহুর সন, হিজরী সন, ঈসায়ী বা সৃষ্টির সন, জালালী সন বাংলা সন ইত্যাদি। এর কোন কোনটা সৌরবর্ষে আবার কোন কোনটা চন্দ্রাবর্ষে গণনা করা হয়ে থাকে। বাংলা সন প্রবর্তিত হয়েছে সম্রাট আকবরের (১৫৫৬-১৬০৫) আমলে। সম্রাট আকবরের সিংহাসনের আরোহনের বছর ৯৬৩ (১৫৫৬ ঈসায়ী) সনকে শুরুর বছর ধরে ফসলী সন নামে যে সন প্রবর্তন করা হয় কালে তা-ই বাংলাদেশে বাংলাসন নামে পরিচিত হয়ে উঠে। মূলত জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থে এসব প্রবর্তন করা হয়। এর আগে এ দেশের দেশীয় সন হিসেবে শকাব্দের প্রচলন থাকলেও রাষ্ট্রীয়ভাবে হিজরী সন চালু ছিল গোটা ভারত বর্ষে। আর এ কারনেই গোটা হিজরী সনকে ভিত্তি করে বছর ধরে এ বাংলা সনেরও প্রবর্তন করা হয়। অন্যদিকে এ সনের মাসের নামগুলো নেয়া হয় শকাব্দ থেকে। এভাবে দেখা যায় এ সনটি প্রবর্তনে এখানকার প্রধান দুটি ধর্ম অর্থাৎ মুসলমান এবং হিন্দু উভয় ধর্মের একটি প্রভাব সনটির উপর পড়েছে। এক্ষেত্রে হিজরী সনকে যদি আমরা বাংলা সনের মায়ের মর্যাদা দেই তাহলে শকাব্দকে দিতে হয় মাসীর মর্যাদা। বাংলা সন ছাড়াও প্রায় সকল সনের ক্ষেত্রেই এ ধর্মীয় প্রভাবের একটি দিক থাকে। বাংলা সনের ক্ষেত্র হিন্দু মুসলমানের এ মিলিত স্রোত সবটিকে একটি অসা¤প্রদায়িক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছে যা উদার ইসলামী সংস্কৃতির পাশাপাশি বাংলাদেশী সংস্কৃতির সাথেও পুরোপুরি সামঞ্জস্যশীল। কৃষকের জমির খাজনা আদায়ের সুবিধার্থেই এ সব প্রবর্তন করা হয়েছিল। ফলে সন প্রবর্তনের সময় থেকেই সাধারন মানুষের সাথে এ সনের পরিচয় ও সম্পর্ক গড়ে উঠে। আজও গ্রামের নিরক্ষর মানুষের কাছে আপনি যদি আজ কত তারিখ জানতে চান তাহলে তিনি হাতের আঙ্গুলে গুনে আপনাকে আজ বাংলা সনের কোন মাস, কত তারিখ তা বলে দেবে। গ্রামের মানুষের কাছে বাংলা সনের পর দ্বিতীয় গুরুত্ব হচ্ছে হিজরী সন বা চন্দ্র মাসের হিসাব। ইংরেজী সন আজও গ্রামের মানুষের মনে স্থান করে নিতে পারেনি। বাংলা সন প্রবর্তনের বছর থেকেই জমির খাজনা পরিশোধ করা হচ্ছে এ সনের হিসাব মতে এবং তা আজ পর্যন্ত এ নিয়মেই চলছে। উপমহাদেশে দীর্ঘদিন মোঘল শাসন থাকায় এখানেও নওরোজ উৎসব হতো। কিন্তু বাংলা সন প্রবর্তনের পর নওরোজ উৎসবের স্থলে স্থান করে নিয়েছে পহেলা বৈশাখের উৎসব।
বাংলা সনের প্রথম মাস হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে শকাব্দের দ্বিতীয় মাস ও বিক্রমাব্দের সপ্তম মাস বৈশাখকে।এই বৈশাখ খৃষ্টীয় বছরে ৪র্থ মাস এপ্রিল থেকে। বাংলা সনের শেস দিন চৈত্র সংক্রান্তি এবং পরের দিনকে বছরের প্রথমদিন অর্থাৎ পহেলা বৈশাখ হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। ডঃ মুসতাসির মামুনের মতে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নববর্ষ শুরু হয় একেক ঋতুতে। কিন্তু বাংল নববর্ষ শুরু হয় ঘোর গ্রীষ্ম ঋতুতে। যদিও অগ্রাহায়ণ ফসল কাটার মাস। কিন্তু নববর্ষ উদ্যাপিত হচ্ছে বৈশাখে। কিন্তু কেন বাংলা সন গণনা শুরু হলো বৈশাখের খর তপ্ত গ্রীষ্মের দাবদাহে। এর রহস্য আজও উম্মোচিত হয়নি নিশ্চিত তথ্যের মাধ্যমে।
বাংলা মাসের নামকরণঃ
বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলা মাসের নামগুলো বিভিন্ন তারকারাজির নাম থেকে নেয়া হয়েছে। যেমনঃ বিশাখা থেকে বৈশাখ, জেষ্ঠ্যা থেকে জ্যৈষ্ঠ, আষাঢ়া থেকে আষাঢ়, শ্রবণা থেকে শ্রাবণ, ভাদ্রপদ থেকে ভাদ্র, কৃত্তিকা থেকে কার্তিক, অগ্রইহনী থেকে অগ্রহায়ণ, পূষ্যা থেকে পৌষ, মঘা থেকে মাঘ, ফল্গুনি থেকে ফাল্গুণ এবং চিত্রা থেকে চৈত্র। আগেকার দিনে অগ্রহায়ণ মাসে ধান কাটা শুরু হত বলে এই মাসকে বছরের প্রথম মাস ধরা হত। তাই এ মাসের নামই রাখা হয় অগ্রহায়ণ। অগ্র অর্থ প্রথম আর হায়ন অর্থ বর্ষ বা ধান। সম্রাট আকবরের সময়ে একটি বিষয় ছিল অত্যন্ত কষ্ট সাধ্য, তা হল মাসের প্রত্যেকটি দিনের জন্য আলাদা আলাদা নাম ছিল। যা কিনা প্রজা সাধারণের মনে রাখা খুবই কষ্ট হত। তাই সম্রাট শাহজাহান ৭ দিনে সপ্তাহ ভিত্তিক বাংলায় দিনের নামকরণের কাজ শুরু করেন। ইংরেজী বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় ইংরেজি ৭ দিনের নামের কিছুটা আদলে বাংলায় ৭ দিনের নামকরণ করা হয়। যেমন : সানডে- রবিবার। সান অর্থ রবি বা সূর্য আর ডে অর্থ দিন। এভাবে বর্ষ গণনার রীতিকে বাংলায় প্রবর্তনের সংস্কার শুরু হয় মোঘল আমলে।
দেশে দেশে বৈশাখী উৎসব
:
ব্রজিলিয়ানদের বিশ্বাস, মসুনদানা সম্পদ আর অর্থবিত্তের জন্য শুভ, এ বিশ্বাস থেকেই তারা বছরের প্রথম দিকে মসুরের স্যুপ খেয়ে থাকেন। নতুন বছর আসার আগের দিন রিওডি জেনিরোর বিখ্যাত ইপেনামা সৈকত থেকে ভাসানো হয় ফুল মোমবাতি আর গয়না-গাটি ভর্ত্তি আস্ত নৌকা। এই নৌকা ভাসানোর কাজটি হয় আদতে জলের দেবতা ইয়ামানজাকে তুষ্ট করার নিয়তে।
থ্যাইল্যান্ড নতুন বছরের প্রথম দিনে সৌভাগ্য লাভের আশায় খাঁচার পাখিদের মুক্ত করে দেয়া হয়। নদীতে ছেড়ে দিয়ে আশা হয় পাত্রে ভাসা জ্যান্ত মাছ। মায়া স¤প্রদায়ের লোকজন প্রতিটি নতুন বছর শুরু করতো তাঁদের হাড়ি পাতিল ভেঙে। প্রতিটি নতুন বছর একেক দেবতার নামে উৎসর্গ করতো তারা।
রাশিয়ায় নববর্ষের সবচেয়ে বড় ধরনের ধুম ধামটা হয় ক্রেমলিনে। এই উৎসবে যোগ দেয় প্রায় ৫০ হাজার মানুষ। সান্তা ক্রজের মতোই রাশিয়ায় আছে গ্র্যান্ডফাদার ফ্রস্ট। বছরের শুরুর দিনে শান্তা ক্রজের মতো দেখতে ফাদার ফ্রস্ট বাচ্চাদের জন্য উপহার নিয়ে আসেন। ফাদার ফ্রস্টের জামার রং থাকে নীল।
কাশ্মিরীর নতুন বছরের উৎসবকে বলে ‘নভরেহ’। এদিনে কাশ্মিরের একাংশের লোকজন পবিত্র ঝরনায় নেমে øান করেন। মনে করা হয় এতে তাদের পরানো বছরের সব পাপ আর অপকিতীর কালিমা ধুয়ে মুছে যাবে।
যুক্তরাষ্ট্রের নববর্ষের সবচেয়ে বড় ঝাক জমকটা হয় টাইমস স্কোয়ারে। রাত ১২টা পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে কানে তালা লেগে যায় গাড়ির হর্নের শব্দে। বাজানো হয় বাঁশি, ছুড়ে ফেলা হয় পুরনো বছরের কাগজপ\ সবাই চুমু খায় একজন আরেকজনকে।
ভিনদেশী ভাষায় নববর্ষের শুভেচ্ছা ঃ (১) আরবী- কুল ইয়ামু আনতাম সালি মউ (২) হিন্দী - নিয়া সাল মুবারক, (৩) হিরু - ল শান্নাহ তোভাহতিকাতেভু (৪) ল্যাতিন - সাবাই ডি পি মেই (৫) ইতালীয় - বুয়োন কাপাদোনা (৬) চীনা - চু সেন তান (৭) রাশিয়ান - স নিভম গডম (৮) সুইডিশ - গটনিট আর (৯) উর্দু - খোশ আমাদেদ নয়া সাল (১০) ফরাসী - বোন্নে আন্নে, (১১) জাপানিজ - আকে মামিতে ওমে ডেতু গোজাই মাসু (১২) ডাচ - গলুমি¡গ নিউ জার (১৩) স্প্যানিশ -ফেলিজ আনো নুভো।১৪) ইরান- নওরোজ ১৫)তিব্বত - লোগসর ১৬)ভিয়েতনাম - তেত ১৭) ইহুদী – রাশ হুসানা ১৮)মুসলমান - আশুরা
(জেড সেলিম),
rns24.net is a web news portal that delivers news in Bengali. It runs in collaboration with SST TECH Limited www.ssttechbd.com