16/10/2024
গল্প : ০৫
নাম : যে জীবন চরম ঘৃণার!
শুভর জীবনটাই যেন এক বিষময় অধ্যায়। চারপাশের মানুষ, সমাজ, এবং পৃথিবীর প্রতি তার এতটা ঘৃণা যে, সে নিজের মধ্যেও শান্তির কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায় না। এই ঘৃণা তার মধ্যে জেগেছে ছোটবেলার কোনো একটি কঠিন ঘটনা থেকে, কিন্তু সেই ঘটনাটি আজ আর তার মনে নেই। যেন কোনো অন্ধকারে তলিয়ে যাওয়া স্মৃতি, যা শুভকে তিলে তিলে গিলে খেয়েছে।
শুভর বাবা একজন কঠোর মানুষ ছিলেন। সবসময় নিয়মকানুনের মধ্যে বেঁধে রাখতে চাইতেন সবাইকে। মা ছিলেন নরম প্রকৃতির, কিন্তু তার দৃষ্টিতে বরাবরই একটা স্থিরতা ছিল। শুভ তাদের থেকে একদম আলাদা হয়ে উঠেছিল—একান্তে থাকা, সবার থেকে বিচ্ছিন্ন, এবং মনেমনে এই সমাজটাকে ঘৃণা করতে করতে বড় হওয়া।
বাল্যকালে শুভ একবার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিল। সেখানে সে প্রথমবার অনুভব করেছিল যে, সমাজের মানুষগুলো কতটা মেকি। মানুষরা সবাই মুখে মিষ্টি কথা বলে, কিন্তু পিছনে বিষ ঢালে। সে বাড়ির সবাই তাকে হাসি দিয়ে স্বাগত জানালেও, কিছুক্ষণ পর তাদের ফিসফিসানি শুনে সে বুঝতে পারল, ওরা তাকে নিজের ঘরের মতো করে গ্রহণ করেনি। তখন থেকেই তার মনে সন্দেহের বীজ বপন হয়—মানুষ কি সত্যিই একে অপরকে ভালোবাসে, নাকি সবটাই ভান?
এরপর যতই বড় হতে লাগল, ততই এই পৃথিবী তার কাছে অপছন্দের হয়ে উঠতে লাগল। বিদ্যার স্কুল, বিশ্ববিদ্যালয়, অফিসের কাজ—সব কিছুতেই মানুষের মিথ্যা মুখোশ শুভকে আরো বিরক্ত করে তুলল। মানুষ একে অপরকে ক্ষতি করে, অর্থলোভে ধ্বংস করে, আবারও মুখোশ পরে ভালো সাজতে থাকে।
শুভর ঘরে একটা আয়না ছিল। প্রতিদিন ঘরে ফিরে শুভ সেই আয়নায় তাকাতো। তার নিজের চেহারাটাও তাকে ধোঁকা দেয় বলে মনে হতো। শুভ তার নিজের আত্মাকে আয়নায় দেখতে চাইতো, কিন্তু সেটা কোথায়? আত্মা কি আর আছে? সে ভাবতো, মানুষ কীভাবে এই মিথ্যা জীবনটা এভাবে চালিয়ে যাচ্ছে? কেন কেউ এই মায়ার খেলা থেকে বেরিয়ে আসে না?
কিন্তু শুভর মনের গভীরে একধরনের শূন্যতা ছিল, যেটা সে কাউকে জানাতে চাইতো না। কারণ সে জানতো, এই শূন্যতার কারণ সমাজ বা পৃথিবী নয়—তার নিজের মধ্যে গড়ে ওঠা সেই অন্ধকারটাই এর জন্য দায়ী।
বহুবার শুভর ইচ্ছে হয়েছিল পালিয়ে যেতে, সমস্ত সম্পর্ক, সমস্ত বন্ধন ছিন্ন করে। কিন্তু সে জানতো, পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় নেই। যতক্ষণ এই পৃথিবীতে আছে, ততক্ষণ তাকে এই সমাজের সাথেই থাকতে হবে।
একদিন শুভ একটি নির্জন নদীর তীরে বসেছিল। মাথার মধ্যে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছিল—কীভাবে এই শূন্যতা পূর্ণ করা যায়? কীভাবে এই ঘৃণা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে? শুভ তখন চোখ বন্ধ করে ধ্যানে বসে যায়। তার মনে হয়েছিল যে, মৃত্যুই একমাত্র মুক্তি। তবে সেখানেও সন্দেহ ছিল—মৃত্যু কি সত্যিই মুক্তি দেবে? নাকি নতুন কোনো যন্ত্রণার দিকেই নিয়ে যাবে?
হঠাৎ, সে শুনতে পেল এক বয়স্ক সন্ন্যাসীর কণ্ঠস্বর। "পুত্র, জীবনটা যেমন, মৃত্যুও তেমনই এক পরীক্ষার মাধ্যম।" শুভ চোখ মেলে দেখল, সন্ন্যাসীটি তার দিকে মিষ্টি হেসে তাকিয়ে আছে। "ঘৃণার ভার সইতে গিয়ে তুমি নিজের আত্মাকে ক্ষতি করছো," সন্ন্যাসী বললেন, "তোমার মুক্তি একমাত্র ক্ষমার মধ্যেই নিহিত।"
শুভ তাচ্ছিল্যের হাসি হেসে বলল, "ক্ষমা? এই ভণ্ড সমাজকে ক্ষমা করব আমি? যারা মিথ্যার ভান করে, তাদের?"
সন্ন্যাসী মৃদু স্বরে উত্তর দিলেন, "ক্ষমা শুধুই অন্যের জন্য নয়, নিজেকেও ক্ষমা করা দরকার। ঘৃণা তোমাকে অন্ধকারে নিমজ্জিত করছে। ক্ষমা একমাত্র আলোক।"
শুভ কিছুক্ষণ নীরব থেকে আবার জিজ্ঞাসা করল, "তবে কি মৃত্যুতে শান্তি আছে?"
সন্ন্যাসী গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে উত্তর দিলেন, "মৃত্যুতে কিছুই নেই। শুধুমাত্র তোমার শূন্যতা পূর্ণ হবে তোমার কর্মে। যদি তোমার কর্ম ভালো না হয়, তাহলে মৃত্যুর পরেও সেই শূন্যতা থেকে মুক্তি পাবে না। তবে এই জীবনেই তুমি শান্তি খুঁজে পেতে পারো, যদি ঘৃণাকে দূর করে ভালোবাসার পথে পা বাড়াও।"
শুভর ভিতরের অগ্নিশিখা কিছুটা কমে গেল। সে অনুভব করল, সন্ন্যাসীর কথায় কিছু একটা আছে, যা তার মনের গভীরে একটা অদ্ভুত প্রভাব ফেলেছে। কিন্তু, সেই প্রভাব স্থায়ী হতে পারেনি। দিন গড়াতে থাকল, এবং শুভ আবার তার সেই ঘৃণার জগতে ফিরে গেল।
সমাজের মানুষগুলো শুভর কাছে আগের মতোই রইল—মিথ্যাবাদী, স্বার্থপর, এবং ভণ্ডামিতে পূর্ণ। শুভ ভাবতে লাগল, যতই সে এই মানুষগুলোর থেকে দূরে যাওয়ার চেষ্টা করে, ততই তার এই ঘৃণা গভীরতর হয়। প্রতিটি দিন যেন একটা অভিশাপ। সে জেগে ওঠে এই পৃথিবীকে ঘৃণা করে, দিন কাটায় এই সমাজকে অপছন্দ করে, আর রাতে ঘুমাতে যায় এই পৃথিবী থেকে মুক্তির আশা নিয়ে।
একদিন, শুভ শয্যায় শুয়ে পড়ল। তার সমস্ত শক্তি ক্ষয় হয়ে গেছে। মনে মনে সে ভেবেছে, হয়তো আর বেশিদিন নেই এই মায়ার পৃথিবীতে। তার মৃত্যুর ঘন্টা যেন বেজে উঠেছে। শুভ তার চোখ বন্ধ করল। সারা জীবন এতটা ঘৃণা নিয়ে বেঁচে থেকেও সে কোনো শান্তি পায়নি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই, তার মন যেন এক অদ্ভুত শান্তির দিকে যেতে লাগল। শুভ বুঝতে পারল, এই ঘৃণা, এই ক্রোধ—সব কিছুই এখন শেষ হতে চলেছে। তার আত্মা যেন ধীরে ধীরে মুক্তির দিকে এগোচ্ছে। এই মুহূর্তে শুভর মনে হঠাৎ একটি চিন্তা এলো—মৃত্যু যদি মুক্তি হয়, তবে জন্মের কী অর্থ ছিল? সে কি শুধুই ঘৃণা করতে জন্মেছিল?
তারপর ধীরে ধীরে শুভ হারিয়ে গেল সেই অন্ধকারের মধ্যে, যেখানে আর ঘৃণার কোনো স্থান নেই।
এই পৃথিবী থেকে শুভর বিদায় নেওয়ার পর, অনেকেই বলেছিল, সে এক অদ্ভুত মানুষ ছিল। কেউ কেউ বলেছিল, সে যেন কোনো এক অজানা কষ্টে ভুগছিল। কিন্তু আসলেই কি শুভ কোনো কষ্টের শিকার ছিল, নাকি সে নিজেই নিজের জীবনটাকে কষ্টে পরিণত করেছিল? সেই প্রশ্নের উত্তর কেউ জানত না।
কিন্তু শুভর জীবনের শেষ মুহূর্তে, তার আত্মার মুক্তি হয়েছিল। তার সমস্ত ঘৃণা, ক্রোধ, এবং পৃথিবীর প্রতি বিদ্বেষ একসময় মিলিয়ে গিয়েছিল। মৃত্যুর পর তার আত্মা হয়তো শান্তি পেয়েছিল, হয়তো পায়নি—তবে এই পৃথিবীতে সে আর কোনো ক্রোধ নিয়ে ফিরে আসেনি।
কিন্তু শুভর মত আরো কত মানুষ এখনো এই সমাজের মেকি মুখোশের মধ্যে নিজেদের হারিয়ে ফেলছে? সেই প্রশ্নের উত্তর কি এই সমাজে লুকিয়ে আছে?