08/12/2021
#যকৃৎ
যকৃৎঃ
(ইংরেজি: Liver) মেরুদণ্ডী ও অন্যান্য কিছু প্রাণীদেহে অবস্থিত একটি অভ্যন্তরীণ অঙ্গ। এটি বক্ষপিঞ্জরে মধ্যচ্ছদার নিচের অংশে অবস্থিত। একে চলতি বাংলায় কলিজা বলে সচরাচর উল্লেখ করা হয়। যকৃৎ দেহের বৃহত্তম গ্রন্থি। এর ওজন দেহের মোট ওজনের (৩-৫%)। এটি ২টি খণ্ডে বিভক্ত: ডান এবং বাম। প্রাণীদেহে বিপাকে ও অন্যান্য কিছু শারীরবৃত্তীয় কাজে যকৃত প্রধান ভূমিকা পালন করে। গ্লাইকোজেনের সঞ্চয়, প্লাজমা প্রোটিন সংশ্লেষণ, ঔষুধ বা অন্যান্য রাসায়নিক নির্বিষকরণে এর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।
ভেড়ার যকৃৎ: (১) ডান লোব, (২) বাম লোব, (৩) কডেট লোব, (৪) কোয়াড্রেট লোব, (৫) পোর্টাল শিরা এবং হেপাটিক ধমনী, (৬) হেপাটিক লিম্ফ নোড, (৭) পিত্তাশয়.
যকৃতে পিত্তরস উৎপন্ন হয়; পিত্তরস একধরনের ক্ষারীয় যৌগ যা পরিপাকে সহায়তা করে। বিশেষত স্নেহজাতীয় খাদ্যের ইমালসিফিকেশন এর জন্য পিত্তরস প্রয়োজন। এছাড়াও যকৃৎ দেহের আরও কিছু জৈব-রাসায়নিক প্রক্রিয়া নিয়ন্ত্রণ করে। যকৃৎ কে রসায়নের গবেষণাগারও বলা হয়।
কোষের ধরনঃ
দুই ধরনের কোষ দিয়ে যকৃৎ গঠিত যথা: প্যারেনকাইমাল এবং নন-প্যারেনকাইমাল। যকৃতের প্যারেনকাইমাল কোষকে হেপাটোসাইট বলে যা আয়তনের ৮০%। নন-প্যারেনকাইমাল কোষের মধ্যে রয়েছে হেপাটিক স্টিলেট কোষ, কাপফার কোষ এবং সাইনুসয়ডাল এন্ডোথেলিয়াল কোষ যা লিভার সাইনুসয়েড এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ। এরা সমস্ত কোষের ৪০% হলেও আয়তনের মাত্র ৬.৫%।
রক্ত প্রবাহঃ
যকৃৎ প্রধানত দুই পথে রক্ত সংবাহিত হয় যথা পোর্টাল শিরা এবং হেপাটিক ধমনী । শতকরা ৭৫ ভাগেরও বেশি রক্ত আসে পোর্টাল শিরা থেকে। অক্সিজেনের সরবরাহ দুই উৎস থেকেই নিশ্চিত হয়।
সংশ্লেষণঃ
এমিনো এসিড সংশ্লেষণ
রক্ত তঞ্চন উপাদান সংশ্লেষণ
পিত্ত সংশ্লেষণ
ইউরিয়া সংশ্লেষণ
যকৃতের কাজঃ
যকৃত থেকে পিত্তরস নিঃসৃত হয় যা খাদ্য পরিপাকের, বিশেষ করে স্নেহজাতীয় খাদ্য পরিপাকের, একটি অতি প্রয়োজনীয় উপাদান৷ যকৃতে ইউরিয়া তৈরি হয়। এছাড়া যকৃতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ জৈব রাসায়নিক বিক্রিয়া সংঘটিত হয়৷ এজন্য যকৃতকে দেহের জৈব রসায়নাগার বলে৷ যকৃত গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি কাজের মধ্যে রয়েছে:
যকৃতে পিত্তরস তৈরী হয় যা যকৃত থেকে নিঃসৃত হয়ে পিত্তথলিতে জমা থাকে। প্রয়োজনানুযায়ী অন্ত্রে পিত্তরসের সরবরাহ ঘটে।
রক্তের অতিরিক্ত গ্লুকোজ যকৃতে গ্লাইকোজেন রূপে সঞ্চিত হয় ৷ প্রয়োজনে লাইকোজেন ভেঙ্গে রক্তের গ্লুকোজের মাত্রা সঠিক রাখে ৷
যকৃতে ভিটামিন (A,D,E,K,B6 ও B12) সঞ্চিত হয়৷
রক্তের প্লাজমা প্রোটিন যকৃতে সংশ্লেষিত হয়৷
যকৃতে লৌহিত রক্তকণিকার হিমোগ্লোবিন ভেঙ্গে বিলিরুবিন ও বিলিভার্ডিন সৃষ্টি হয় ৷
বিভিন্ন শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়ার ফলে মানবদেহে উৎপন্ন বিষ জাতীয় পদার্থ যকৃত কোষের অভ্যন্তরে রাসায়নিক বিক্রিয়ার মাধ্যমে প্রশমিত হয়।
যকৃতের রোগঃ
যকৃতের ওজনের পাঁচ থেকে দশ ভাগের বেশি চর্বি দিয়ে পূরণ হলে যে রোগটি হয় তাকে ফ্যাটি লিভার বলে। পশ্চিমা বিশ্বে সাধারণত মদ্যপানের কারণে ফ্যাটি লিভার হয়ে থাকে। তবে বহুমূত্র, শর্করা জাতীয় খাদ্যের আধিক্য,রক্তে চর্বির আধিক্য, উচ্চ রক্তচাপ, স্থূলতা ইত্যাদি কারণে ফ্যাটি লিভার হয়। লিভারে জমা চর্বি অনেক সময় স্থানীয় প্রদাহ সৃষ্টি করে এবং এ প্রদাহ থেকে কিছুসংখ্যক রোগীর লিভার সিরোসিস, এমনকী কোনো কোনো ক্ষেত্রে লিভার ক্যান্সারও হতে পারে। প্রাথমিক অবস্থায় এই রোগের কোনো উপসর্গ থাকে না, অন্য রোগের পরীক্ষা করার সময় সাধারণত রোগটি ধরা পড়ে। কখনো কখনো পেটের উপরিভাগের ডানদিকে ব্যথা,অবসন্নতা, ক্ষুধামান্দ্য ইত্যাদি উপসর্গ দেখা দিতে পারে।
প্রতিস্থাপনঃ
প্রতি বছর সারা বিশ্বে এক লক্ষ মানুষ শুধুমাত্র লিভারের রোগে মারা যায়। তবে ‘রিজেনারেটিভ’ অঙ্গ হওয়ায় খুব সহজেই এটিকে প্রতিস্থাপন করে মানুষকে মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচানো সম্ভব।
সিরোসিস
যকৃতের রোগঃ
সিরোসিস (ইংরেজি ভাষায় Cirrhosis- (ইংরেজি উচ্চারণ: /sɪˈroʊsɪs/ (অসমর্থিত টেমপ্লেট)) বা লিভার সিরোসিস মানুষের যকৃতের দীর্ঘস্থায়ী রোগের ফল যা দীর্ঘস্থায়ী ক্ষত থেকে সৃষ্টি হতে পারে এবং মারাত্মক পর্যায়ের সিরোসিসে যকৃৎ এর কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে মানুষের মৃত্যু ডেকে আনতে পারে । সিরোসিসের বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এতে যকৃতের সুস্থ-সবল কলা (tissue) ক্ষয়যুক্ত কলা বা নডিউল (nodule) দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়ে যায় ফলে যকৃত আর কাজ করতে পারে না। সিরোসিসের প্রধান কারণগুলোর মধ্যে যকৃতের দীর্ঘস্থায়ী রোগ এবং যকৃতে সংক্রমণ ছাড়াও দীর্ঘদিন যাবৎ অতিরিক্ত মদ্যপান, হেপাটাইটিস বি, হেপাটাইটিস সি, ফ্যাটি লিভার রোগ ইত্যাদি। তবে সিরোসিসের প্রধান কারণ দেশ অনুযায়ী ভিন্ন হয়। যেমন ইউরোপ এবং আমেরিকায় সিরোসিস হয় প্রধানতঃ মদ্যপানের ফলে আর হেপাটাইটিস সি ভাইরাসের আক্রমেন। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে প্রধানতঃ হেপাটাইটিস বি ভাইরাসের আক্রমণ আর ফ্যাটি লিভার লিভার সিরোসিসের পেছনে দায়ী (প্রায় আড়াই হাজার রোগীর উপরে জরীপ চালিয়ে দেখা গেছে। এছাড়াও অজানা কারণে লিভার সিরোসিস হতে পারে।
পিত্ত
পরিপাক সহায়ক রসঃ
পিত্তরস (ইংরেজি: Bile) এক প্রকার দেহাভ্যন্তরীণ ক্ষরণ যা তৈল বা স্নেহ জাতীয় খাদ্যের পরিপাকে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এর বর্ণ পীতাভ-সবুজ এবং স্বাদ তিক্ত। পিত্ত দেহের একটি প্রধান অঙ্গ যকৃতে উৎপন্ন হয়, অতঃপর পিত্তথলীতে ঘনীভূত হয় ও সঞ্চিত থাকে। পিত্তথলি থেকে এটি পিত্তনালীর মধ্য দিয়ে পরিপাকতন্ত্রের ক্ষুদ্রান্তে প্রবেশ করে এবং খাদ্য পরিপাকে সাহায্য করে।
পিত্তের উপাদান হলো (৯৭-৯৮) % জল, ০.৭ % পিত্ত লবণ, ০.২ % বিলিরুবিন, ০.৫১ % চর্বি (কোলেস্টেরল, ফ্যাটি এসিড এবং লেসিথিন),এবং লিটার প্রতি ২০০ মিলি ইকুইভ্যালেন্ট অজৈব লবণ
আয়ুর্বেদে অগ্নির রূপকে পিত্ত সম্ভবতঃ দেহ প্রতিরক্ষা (immune) ব্যবস্হাকে বর্ণনা করে (বায়ু=air/?nervous system,পিত্ত=fire/?immune system, কফ=humor/?endocrine system)। ক্ষুদ্রান্ত্র-তে চর্বি জাতীয় খাদ্যের পরিপাক করতে এটি সাহায্য করে। মানব দেহের যকৃতে অনবরত তৈরি পিত্ত পিত্তথলি নামক অঙ্গে জমা থাকে এবং ঘন হতে থাকে। খাদ্য গ্রহণের পর এটি ক্ষুদ্রান্ত্রের ডিওডেনাম নামক অংশে চলে যায়। পিত্তের শতকরা ৯৭ ভাগ পানি,০.৭ ভাগ।
পিত্তের উপাদানঃ
জল
পিত্তরঙ্গক:
বিলিরুবিন
বিলিভার্ডিন
পিত্তলবণ (কোলেস্টেরল-জাত কোলিক অ্যাসিডের লবণ), মানবের ক্ষেত্রে:
গ্লাইকোকোলিক অ্যাসিড
টরোকোলিক অ্যাসিড
লিথোকোলিক অ্যাসিড
কোলেস্টেরল
লেসিথিন
পিত্তের কাজ ঃ
স্নেহপদার্থকে দ্রবীভূত করে ছোট ছোট বর্তুলাকার মাইসেলি তৈরি করে যা স্নেহপদার্থ পাচনে দরকার।
স্নেহদ্রাব্য পদার্থের যাকৃতিক রেচন।
পিত্ত রসঃ
যকৃত পিত্তরস তৈরি করে। পিত্তরসের মধ্যে পানি, পিত্তলবণ এবং কোলেস্টেরল ও খনিজ লবণ প্রধান। যকৃতের নিচের অংশে পিত্তথলি সংযুক্ত থাকে। এখানে পিত্তরস জমা হয়। পিত্তরস গাঢ় সবুজ বর্ণের এবং তিক্ত স্বাদ বিশিষ্ট।পিত্তরস প্রয়োজনে ডিউডেনামে এসে পরোক্ষভাবে পরিপাকে অংশ নেয়। পিত্তরসে কোন উৎসেচক বা এনজাইম থাকে না। পিত্তরস খাদ্যের অম্লভাব প্রশমিত করে এবং ক্ষারীয় পরিবেশ সৃষ্টি করে। এই পরিবেশ খাদ্য পরিপাকের অনুকূল। পিত্তরস চর্বি জাতীয় খাদ্যকে ক্ষুদ্র দানায় পরিণত করে যা লাইপেজ সহযোগে পরিপাকে সহায়তা করে।
পিত্তনালীঃ
অবরুদ্ধ পিত্তনালী সম্পাদনা
রক্তে অত্যধিক বিলিরুবিনের কারণে জন্ডিস হয়। পিত্তলবণ রক্তের মাধ্যমে চামড়ায় প্রবেশ করলে ভয়ঙ্কর চুলকানি হয়।