02/02/2025
#রং
#পর্বঃ৫৫
Tonni-Tonu
এহেম কথায় শরীর নিস্তেজ হয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে সিনথিয়া। ইভা পাথুরে মূর্তির ন্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হৃদয়ের রক্তগুলো অশ্রুবিন্দু রুপে টুপ টুপ করে ঝড়ে পড়ে। সিনথিয়ার শরীর ক্রমেই রূপান্তরিত হয় হীমবাহে। দুহাতে ধরে থাকা ছোট ট্রে "এর উপর গোল ছোট পিরিচ তার উপরের কাপটা কাত হয়ে ঢেলে পড়ে চা। দেয়াল ঘেঁষে বসে হাঁটু ভাজ করে বসা সিনথিয়ার কোলে চুইয়ে পড়া গরম চায়ের দহনে পুড়তে থাকে উদর। হৃদয়ের দহনের উত্তাপে দুঃচিন্তা আর অদূর ভবিষ্যতে ভাসমান দৃশ্যপট চিন্তা করতে থাকা সিনথিয়া অজান্তেই পেট চেপে ধরে ধীর গলায় অস্ফুট শব্দ করে,-- উফফফ!
এহেম শব্দে অন্য জগতে থেকে সম্বিত ফেরে ইভার। কক্ষের ভেতরে বাবা- সন্তানের কথোপকথন থেমে যায় আকস্মিক মৃদু শব্দে। দরজার পানে তাকায় রিদুয়ানুর রহমান। রিদুয়ানুর রহমানের পায়ের উপরে থাকা ইরফাদ নিজের মাথাটা ধীরে ধীরে তোলে। একপলক তাকায় রিদুয়ানুর রহমানের চোখে। এদিকে চোখ ফিরিয়ে অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনা দেখে ইভা বিস্মিত গলায় বলে,
--এই কি হলো তোমার!! পড়ে গেলে কেনো? শরীর খারাপ লাগছে?
দরজার বাইরের গলার স্বর শুনে ইরফাদ চোখ ফিরিয়ে নেয় রিদুয়ানুর রহমানের দিক থেকে। অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ায় ইরফাদ।বাইরে দরজার সাইডের দেয়াল ঘেঁষে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সিনথিয়া। যার চোখ মুখে নীলচে ব্যাথার ছাপ স্পষ্ট। কোলের মধ্যে থেকে তড়িৎ গতিতে ইভা তুলে নেয় চায়ের কাপ। তবে যা হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। শ্যাওলা রঙের সালোয়ার কামিজের পেটের অংশ জুড়ে ভেজা। সেকেন্ড সময় ভাবে ইভা। চা কি বেশীই গরম ছিলো!! পুড়ে গেলো নাকি!! এরপরেই নৈঃশব্দে ঢুকে যায় রিদুয়ানুর রহমানের কক্ষে। ইরফাদ আর রিদুয়ানুর রহমান কক্ষ থেকে বেড়িয়ে এসেছে ততোক্ষণে। ইরফাদ চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশটা। অতঃপর পুরো বিষয়টা মাথায় সাজিয়ে হিসেব মিলিয়ে নিতেই তড়িৎ গতিতে বসে সিনথিয়ার পাশে। এরমধ্যেই রিদুয়ানুর রহমান আকস্মিক স্বরে বলে,
-- আরে পড়ে গেলে কিভাবে? শরীর খারাপ করছে নাকি!!
তার স্বরে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তিনি গলা উঁচিয়ে বলেন,
--ইভা!! বাইরে কি করছিলি তোরা!! ও এখানে পড়লো কি করে??
চোখ বুজে থাকা সিনথিয়া ফুরিয়ে আসা শক্তিহীন শরীরটা আরেকটু ছেড়ে দিয়ে মাথা ঠেকায় শক্ত দেয়ালে। ইরফাদ উদ্বিগ্ন স্বরে ফুটে ওঠে দুঃশ্চিন্তা,-- পড়ে গেলে কিভাবে সিনথি!! শরীর খারাপ লাগছে!!
দূর্বল শরীরটা ছেড়ে দিয়ে মাথা দু"দিকে দোলায় সিনথিয়া। কাপড়ের কিছু অংশ জুড়ে ভেজা, পাশেই ট্রে এর উপর শূন্য চায়ের কাপ। ইরফাদের কপালে হালকা ভাজ। তাহলে কি চা পড়েছে!! পুড়ে গেছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর তড়িৎ গতিতে বলে ইরফাদ,
-- এই!!পুড়ে গেছে নাকি!!
বন্ধ চোখ খুলে দূর্বল চোখে তাকায় সিনথিয়া। শরীরের হালকা ক্ষত হওয়ায় তার কিচ্ছু আসে যায় না। তার দূর্বল হওয়ার একমাত্র কারণ তো কিছুক্ষণ আগের কথোপকথন!! কি হবে এর পর। সবটা জানার পর তার জীবনে নতুন করে ঝড় উঠবে। জীবনের প্রতিটা ধাপে যে যুদ্ধ করে টিকে রইলো, তবে এই যুদ্ধ লড়ার মতো অবশিষ্ট শক্তিটা তো তার নেই। এই মহাপ্রলয়ের তান্ডবে ইরফাদ থাকবে তো তার পাশে!! পাশে থাকতে দিবে তো পরিস্থিতি!! নাকি তলিয়ে যাবে তার ভালোবাসা বিষাদসিন্ধুতে!
দ্রুত পা চালিয়ে বাইরে আসে ইভা। ইরফাদের দিকে পানিপূর্ণ ঠান্ডা পানির বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে ইভা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,
-- পানি ঢালো পুড়ে গেছে মনে হয়।
ঠান্ডা পানির বোতলটা হাত বাড়িয়ে নেয় ইরফাদ। জামার উপর থেকে পেটের উপর অল্প একটু পানি ঢেলে দেয় ইরফাদ। রিদুয়ানুর রহমান উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,
-- কিভাবে হলো!! জয়, ওকে রুমে নিয়ে যা তো। ইভা দেখ বার্ণ হয়েছে কিনা।
দূর্বল শরীরে সিনথিয়া বলে,
-- বার্ণ হয়নি! চা তেমন গরম ছিলো না। শরীর দূর্বল লাগছে।
রিদুয়ানুর রহমান সাথে সাথে বলেন,
-- ইভা ওকে রুমে নিয়ে যাও তো,চেঞ্জ করাও।
বলেই পিছু ফিরে নিজের কক্ষে যান রিদুয়ানুর রহমান। পানির বোতল পাশে সরিয়ে ইরফাদ তড়িৎ গতিতে পাজাকোলে তুলে নেয় সিনথিয়াকে। ইভা বোতলটা তুলে ইরফাদের পেছনে পেছনে ছোটে। সিনথিয়া জড়সড় হয়ে বলে,
-- বললাম তো চা খুব বেশী গরম ছিলো না।
পুরো ঘটনার আঁচ ইরফাদ কক্ষের বাইরে বেরিয়েই বুঝতে পেরেছে তবে হিসেব তো বাকি। ইরফাদ দাঁতের উপর দাঁত রেখে বলে,
-- চা কার জন্য নিয়ে এসেছিলে।
--বাবা।
--তাহলে চা ঠান্ডা হলো কি করে!! বাইরে দাঁড়িয়ে কথা গিলছিলে?
এহেম কথায় বরফের মতো জমে যায় সিনথিয়া। ইভা পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানেই। একটু পরের দৃশ্যপটে চোখ বুলিয়ে নেয় কিয়ৎক্ষণ, এর মধ্যেই তির্যক গলা। এই গলাটা যে তার ভাইয়ের তা সে ভালো করেই জানে।
-- দাঁড়িয়ে কেনো! রুমে আয়।
দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে কথা শোনার ফলাফল কেমন আজ হারে হারে বোঝাবে যে ইরফাদ সে আঁচ ইভা পেয়ে গেছে। তবে পিছু হটার তো উপায় নেই, পায়ের গতি বাড়ায় ইভা। সিনথিয়াকে ওয়াশরুমে দাঁড় করিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে আসে ইরফাদ। কক্ষের মধ্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ইভা। ইরফাদ বেরিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে ধীর গলায় বলে,
-- পনেরো মিনিট ওকে ভেজাবি।
-- কেনো!! ঠান্ডা লেগে যাবে না।
-- যেখানে বার্ন হয়েছে শুধু ওখানেই।
-- আমাকেই যেতে হবে?
-- তো!!
ইরফাদের মুখাভঙ্গিতে যে আঁচ ইভা পাচ্ছে তাতেই জড়সড়, রাফসানের সত্যিটা তার মনে যে কঠিন, গাঢ় দাগ ফেলেছে তা ধামা চাপা পড়ে যাচ্ছে ইরফাদের শান্ত চাহুনীর পরের দৃশ্যপট কল্পনা করে। ইভা মুখে কথা না বলে চুপচাপ ভেতরে যায়,ঠোঁট উল্টিয়ে দিয়ে বলে,
-- আজ ভিষণ দুঃখ আছে।
ইভার গলার স্বর শুনে পিছু তাকায় সিনথিয়া। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সিনথিয়া ইভার মুখাভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে,
-- কি হয়েছে আপু!!
চোখ গোল গোল করে তাকায় ইভা। অতঃপর তর্জনী ওষ্ঠের মাঝামাঝিতে ঠেকিয়ে ইশারা করে--শশশ!
বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে সিনথিয়া। ইভা কাছাকাছি এসে বলে,
-- দেখি কোথায় লেগেছে!!
লজ্জায় কাচুমাচু করতে থাকা সিনথিয়া বলে ওঠে,
-- তুমি দেখবে!!
-- তো দেখতে হবে না। কতোটুকু বার্ন হলো।
-- বার্ণ হয়নি। চা তেমন গরম ছিলোনা তো।
-- সেইটা কি ভাইয়ার সামনে বলতে হবে?
--কেনো!!
-- আরে গাঁধা মেয়ে। ভাইয়া বুঝে গেলো তো আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলাম।
-- আল্লাহ্!!
এখন কি হবে?
-- পনেরো মিনিট ভেজো আগে। তারপর দেখি কি ঝাড়ি দেয়।
-- আমার এমনিই খুব দূর্বল লাগছে আপু।
-- ওভাবে পড়ে গেলে কেনো তুমি!!
বললে বলতে সিনথিয়ার উদরের কাছের লেপ্টে থাকা পরিধেয় অংশটুকু তুলে ধরে ইভা। উদরের পাশের অংশটুকু লালচে আভায় উদ্দীপ্ত। ইভার স্বরে উদ্বিগ্নতা,
-- আরে!!তুমি বলো চা ঠান্ডা। লাল হয়ে গেছে এমন।
নিজের উদরের দিকে তাকায় সিনথিয়া। টকটকে লাল অংশটুকুতে পানি চুইয়ে পড়ছে। ক্ষতস্থানটা গাঢ় হয়ে উঠছে ক্রমেই।
-- ধোঁয়া ওঠা গরম চা তো ছিলো না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু ঠান্ডা হয়েছিলো তো।
-- ওভাবে পড়লে কেনো বলোতো! এখনো শরীর কাঁপছে।
অকস্মাৎ আবারো একই প্রশ্নে ভড়কে যায় সিনথিয়া। পুরো সত্যিটা লুকানোর চেষ্টায় এই প্রথমবার উতলা হয়ে যায় সে। এতো বড় সত্যি জানলে কেউ তাকে মেনে নিবে না। ভালোবাসার প্রতি দূর্বলতা তাকে ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তোলে। কি উত্তর দিবে সে এখন? সম্রাট শাহজাহান তার বাবা, রাফসান তার ভাই। পুরো পরিবারের শান্তি চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার পেছনে তার পরিবার এই কঠিন সত্যি জানার পরে কেউ কি তাকে মানবে!! ঠিক সে সময়েই ভেসে আসে ইরফাদের গলা,
-- কি অবস্থা!!
সাথে সাথেই পিছু ফিরে তাকায় ইভা। এরপর বলে,
-- ফাস্ট ডিগ্রী বার্ন মনে হচ্ছে!
-- পানি দাও বেশী করে।
-- দিচ্ছি ভাইয়া।
কেবিনেট থেকে ক্যাজুয়াল লেডিস শার্ট আর স্কার্ট বের করে ওয়াশরুমে এগিয়ে দেয় ইরফাদ।
-- চেঞ্জ করে এইগুলো পড়াও।দ্যান বেড়িয়ে আসো।
মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে ইভা," বের হওয়ার পর কি যে বলে ইরফাদ।" ভয়েই তো ভালো লাগছে না। ইভার বিড়বিড় করা দেখেই সিনথিয়া কপাল কুচকে তাকায়। তারপর বলে,
--কি হয়েছে আপু!!
-- কিছুনা।
-- জ্বলছে কি এখনো?
-- পানি দিলে কম কম মনে হয়।
-- চলো চেঞ্জ করো। ওখানে ছোট রুমাল ভিজিয়ে দিয়ে রেখো। রুমে গিয়ে সোজা বিছানায় উঠে যাবে।
-- কেনো?
-- না হলে,দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা শোনার ফল বের করবে তোমার বর। সো, নিজেও বাঁচো আমাকেও বাঁচাও।
মাথা থেকে বেড়িয়ে যাওয়া কথাগুলো অকস্মাৎ একঝাকে আবারো তেড়ে আসে সিনথিয়ার দিকে। সবকিছুর মাঝখানে আসল সত্য পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলো ও। কি হবে? কি হবে সবটা জানলে? এই বাসার যতো হাহাকার, দুঃখ সবটাই তো তার পরিবার এর জন্য। এই চরম সত্য টুকু মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই মনটা ক্রমেই দূর্বল হ য়ে যায়। শরীরের জ্বলতে থাকা অংশ তাকে একটুও দূর্বল করতে পারেনি তবে মনের যন্ত্রণা তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে বারংবার। কি অপেক্ষা করছে?? এর পরে কি হবে?
টাওয়েল এগিয়ে দেয় ইভা। সিনথিয়ার হাতে টাওয়েল দিয়ে পেছন ঘুরে বলে,
--অনেকক্ষণ ভিজেছো। মুছে নাও।শার্ট পড়ো। নিচের বাটন গুলো লাগিয়োনা।
সিনথিয়া চুপচাপ ড্রেস চেঞ্জ করে। ধীর গতিতে একে একে সবগুলো বোতাম লাগায়। দূর্বল শরীরে ধীরে ধীরে ইভার পাশাপাশি হয় সিনথিয়া। ইভা বিরক্তি স্বরে "চ্চ" উচ্চারণ করে।
-- তোমাকে না বললাম নিচের বাটন লাগিয়োনা। এক সাইড উচু করে রাখো। ছোট রুমাল ভিজিয়ে দিচ্ছি ওখানে ধরে রাখবে। কষ্ট কমে যাবে।
-- তোমার মনটা এততো ভালো কেনো আপু!!!
-- তুমি ভালো মনের তাই আমাকে ভালো লাগছে।
-- তোমাকে একটা কথা বলি!!
-- হুম শিউর।
-- পৃথিবীতে সরল,সোজা, কোমল মনের মানুষগুলোই বেশী কষ্ট পায়!!
ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে চাপা কষ্ট। ইভা ধীর গলায় বলে,
--চলো। ভাইয়া ওয়েট করছে।
আর শোনো! খুব সহজে ভাইয়া মন খারাপ করে না। খুব সহজে ভাইয়া ভেঙ্গেও পরে না। তবে আজ কষ্ট পেয়েছে বলেই বাবার কাছে ওভাবে কথাগুলো বলেছে। তুমি তো ভাইয়ার অর্ধাঙ্গী! সো, মন বুঝে চলার চেষ্টা কোরো। আগলে রেখো।
*
*
*
সিনথিয়াকে বিছানায় বসিয়ে ইভা নিঃশব্দে কক্ষের বাইরে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়। তবে তার আগেই বাঁধা পড়ে যায় সে। ইরফাদের শান্ত গলা তাকে বাঁধা দেয়,
-- বাবার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো ছিলে দু"জন!!
ইভা নিরবে শক্ত ঢোক গেলে। এটার অপেক্ষায় ছিলো সে। ইভা মাথা নিচু করে বলে,
-- কিছু শুনতে পাইনি ভাইয়া।
এহেম উত্তরে পিটপিট করে তাকায় সিনথিয়া ইভার দিকে। ইরফাদের গলার স্বর এখন কিছুটা গাঢ়,
-- আমি কি একবারো বলেছি কিছু শুনেছো!!
-- আসলে!
ইরফাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে সিনথিয়ার দিকে। গলার স্বরে নিগূর ভাব,
-- তুমি কি করছিলে!!
চোখ ফিরিয়ে নেয় সিনথিয়া। চোখ নিবদ্ধ করে মেঝের দিকে। দু"জন আগেই জমে গেছে বরফে। ইভা ধীর গলায় বলে,
-- কাল বলি! মেয়েটা খুব দূর্বল। ওর ঘুমের দরকার।
--লুকিয়ে কথা শোনা, লুকিয়ে পারসোনাল কিছু ঘাটা আমার সবচেয়ে অপছন্দ। ইভা জানো তুমি!!
ইভা ধীর গতিতে মাথা নাড়ায়। যেনো এদিক সেদিক হলে ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে।
-- তাহলে রুমের বাইরে কি করছিলে।
শান্ত স্বরটা ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। ইভার ভেতরটা স্বরের দাপটের তালে ভেসে ভেসে কাঁপছে। গলা দিয়ে আর একটুকরো কথাও বের হচ্ছে না, আধখানাও না।
--শান্তি পেয়েছো!!
ইভার দিকে আসা কথাটার কোনো উত্তর নেই তার কাছে। শুধু পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া। ধীর গলায় অস্ফুট স্বরে বলে,
-- সরি ভাইয়া।
-- শান্তি পেয়োছো!!
--সরি!!
--শান্তি লেগেছে!!
--বললাম তো সরি!!
-- শান্তিতে যদি সারারাত নির্ঘুমে কাটাবি এই তো।
-- সরি ভাইয়া। আর হবে না।
-- যা এখন!!
--ভাইয়া সরি!!
--যেতে বলছি না??
-- সরি!! সরি!! সরি!! আর কখনো এমন করবো না।
-- যাও এখন।
পাথুরে মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে এক দমে জপে যায় ইভা, "সরি।"
ইরফাদের দিক থেকে কোনো উত্তর আসে না। ইভা নিজে থেকেই বলা শুরু করে,
-- সত্যি বলছি। সত্যিই ইচ্ছে করে করিন। ট্রাস্ট মি!! এমন সময় কথাটা কানে এসেছে আমি নিজেকে কনট্রোল করতে পারিনি।
--এক্সপ্লেনেশন চেয়েছি!!
--ভাইয়া!! সরি তো।
-- যাও
-- প্লিজ মাফ করো এইবারের মতো।
-- যাও এখন।
-- আমার ঘুম হবে না ভাইয়া।
-- ঘুম এমনিতেও হবে না।
-- এতো কঠিন হয়ো না। অর কখনো এভাবে কিছু শুনবো না।
-- ইউ নো,যদি তোমার ভালোর জন্য কিছু হতো, জানার প্রয়োজন পড়তো আমি নিজে জানাতাম। যা তোমার জন্য হার্মফুল তা থেকে আমি তোমাকে দূরে রাখি। তাহলে কেনো?
-- সরি ভাইয়া!! আর কখনো,কোনোদিন করবো না।
-- ওকে যাও।
--মাফ করে দাও না।
এতোটুকু বলে তড়িৎ গতিতে চোখের পলক ফেলার আগেই ইভা দুহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ইরফাদের পা। এহেম কান্ডে স্তম্ভিত, হতবম্ভ হয়ে তাকায় সিনথিয়া। ইরফাদ নিজেও স্তম্ভিত হয়ে যায়। অপ্রত্যাশিত কান্ডে ইরফাদ নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ দু"হাতে টেনে ছাড়াতে চায় ইভাকে। তবে সে হাতের বন্ধন আরোও গাঢ় হয়। পা জড়িয়ে থাকা মেয়েটা হঠাৎ করেই ঢুকরে ওঠে।
-- এই পৃথিবীতে তোমরা ছাড়া কেউ নেই আমার। পৃথিবীটা এতোই কঠিন, এতই স্বার্থপর যাকে বিশ্বাস করেছি সেই চলে গেছে ভাইয়া। তোমরা আমার ভালো থাকার কারণ! তুমি রাগ করলে আমি পাজেল হয়ে যাই। আমি তো তোমার ছোট বোন!! একটু ভুল করেছি তাই বলে এমন রাগ করছো!! মাফ করতে পারছো না।
-- ইভা পা ছাড়ো। তুমি পা ধরছো কেনো!!
-- তুমি ক্ষমা করেছো!!
-- পা ধরার মতো কিচ্ছু হয়নি ইভা!
-- আমার তো শান্তি লাগছে ভাইয়া। তুমি মাফ করে দাও। আমি একটা সময় তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর এইটুকু কষ্ট আমি দিতে চাই না। এইটুকুও না। এইটুকুও না ভাইয়া!
-- ইভা ওঠো।
-- বলো ক্ষমা করেছো!
-- আমার কাছে তোমার আকাশসম ভুল নগন্য। আমি তোমাকে স্মুথ লাইফ লিডের ডিরেকশন দেই। কখনো রুডলি বলি। দ্যাটস মিন এই নয় তোমাকে পায়ে পড়তে হবে।
-- রাগ করোনা ভাইয়া। যা বলবে তাই শুনবো। আমার সাথে প্লিজ রাগ করোনা। প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ......
--পাগলামি করিস না ইভা। ওঠ!
ইস্পাত কঠিন হাতে ইরফাদ টেনে তোলে ইভাকে। বিছানার কোনে বসিয়ে শান্ত গলায় বলে,
-- ট্রমাটাইজ তুই!! পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।
--কিছু ভালো লাগে না ভাইয়া। এর উপর তুমি রাগ করলে অসহ্য লাগে। তুমি আর বাবা ছাড়া কে আছে আমার!
-- পাজেল হয়ে যাচ্ছো বার বার। স্ট্রং থাকার চেষ্টা করো। এমন পাগলামি আর কোরো না। ওকে!!
--ভাইয়া!! মানুষটা পরিবারের জের ধরে আমাকে ঠকালো!
--ইভা এসব ভাবতে না করছি না!!
--আমার খুব যন্ত্রণা হয়!! সহ্য করতে পারিনা।
--এই জন্য আমি তোমার থেকে হাইড রেখেছিলাম। কিন্তু!!
-- মেয়েটা বাবা কি ঐটাই জানলো না, বুঝলো না।
-- তুমি চাইলে আমি রাফসানের সাথে টুম্পার দেখা করাবো।
-- আর বাচ্চাটা যখন বলবে," সবার বাবা বাইরে থাকে আমার বাবা লোহার খাঁচায় বন্দি কেনো!!"
-- ডোন্ট ওরি!! আমি আছি তো।
-- সত্যিই দেখা করাবে? ওরকম মানুষ বাবা হওয়ার যোগ্যতা রাখে না। হতে পারে ঐটা কোনো নতুন চাল।
-- চোখ দেখে জাজ করার ক্ষমতা তোর ভাইয়ার আছে। অনুতপ্ততার চেয়ে বড় শাস্তি নেই। সো ডোন্ট প্যানিক!! আমি আছি না!
-- ভয় লাগছে।
-- আছি না আমি!!
--ওকে আমি যাই এখন। রাগ করে থেকোনা আর প্লিজ!!
*
*
*
ইভা চলে যাওয়ার পর এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘন কালো আধারে ডুবতে থাকে সিনথিয়া। এই লৌহকঠিন মানুষটার মন বিষণ্ন, তার উপর রেগে আছে, নিজের মনের উপর দিয়ে চলছে একপ্রকার তান্ডব। একদিকে অজানা আশঙ্কা, ভয়ে সে ক্ষণে ক্ষণে ডুবছে চোড়াবালিতে অপর দিকে ইরফাদের রুষ্ঠ, কঠিন চোখে তাকিয়ে নিজেই জড়সড় হয়ে যায়।লৌহকঠিন পাথুরে মানব তখন চারকোনা পাতলা রুমালটা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ায় কোমল শরীরের মানবীর সামনে। মুখে স্কচটেপ এঁটে ইস্পাতকঠিন হাতে তড়িৎ গতিতে উন্মুক্ত করে লেডিস শার্টের দুটো বোতাম, লালচে দাগ পড়া জায়গায় ভেজা,নরম রুমালটা বসিয়ে বালিস টেনে শুইয়ে দেয়। চুপচাপ শুয়ে থাকে সিনথিয়া। ভেতর থেকে হাজারটা কথা উগলে বেড়িয়ে আসতে চাইলেও এক তিক্ত যন্ত্রণা গলা চেপে ধরে। কিচ্ছু বলতে পারে না সে।লৌহকঠিন মানুষটা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় রকিং চেয়ারের দিকে। খুলে দেয় থাই গ্লাস।দমকা বাতাসে ওড়ে কপাল ছোঁয়া চুলগুলো। রকিং চেয়ার দুলিয়ে চোখ বন্ধ করার পূর্বেই উঠে বসে সিনথিয়া। নিগূঢ় কন্ঠস্বরে প্রগাঢ় হয় ধমকের সুর,
-- এই উঠবে না।
বরফের মতো জমে যায় সিনথিয়া। পরের বার কথা বলার সাহস আর হয়ে ওঠে না। তবে কিছুক্ষণ আগে ইভার কথা ভেবে সিনথিয়া বলে,
-- আমি ইচ্ছে করে করিনি। অজানা সত্যি সামনে চলে এসেছে আমি কি করবো!! কি করে উপেক্ষা করবো!!
-- কোনো কথা নয়। ঘুমাও!!
-- আমি জানি আপনি রেগে আছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না আমার ভেতরে....
কথার মাঝেই দেয়াল দাড় করিয়ে দেয় ইরফাদ,
--কি বুঝিনি আমি!! কি!!
বাসার সবাই জানে তুমি অসুস্থ!! তাই ওভাবে পড়ে গেছো। আর আমি জানি, তোমার শরীর নয় তোমার মনের উপরে মহাপ্রলয় চলেছে। এইসব শুনলে তুমি ভেঙ্গে পড়বে এইটা কি আমি জানি না!! কেনো আড়াল করেছি!! তুমি আমাকে নাই বুঝতে পারো তবে তোমাকে পড়তে আমি জানি। ডাউট আছে আর!! আর কোনো কোয়েশ্চেন!!!
আবছা আলোয় ডুবে থাকা কক্ষের মাঝে সিনথিয়ার ছোট্ট হৃদয়জুড়ে মৃদু কম্পন বয়ে যায়। মানুষটা এতোটা বোঝে তাকে!! এই মানুষটার থেকে যদি আলাদা হতে হয়। পরিস্থিতি যদি আলাদা করে। তাহলে!! কি করে বাঁচবে সে!! সিনথিয়ার চোখ জুড়ে নামে ভয়ের আবহ। সেই আবহে কেঁপে কেঁপে ওঠে হদয়। অনেকটা সময় অপেক্ষা করে সিনথিয়া উগলে দেয় হৃদয়ের কথা,
-- আমার পরিবার আপনার সব কেড়ে নিয়েছে। সবটা জানলে আপনার পরিবার আমাকে আপনার সাথে থাকতে দিবে। আপনি কি আমাকে ভালোবাসবেন! আমি যে খুব ভয় পাচ্ছি। দুশ্চিন্তায় পাজেল হয়ে যাচ্ছি!
শূন্য জানালায় দৃষ্টি মেলে সুক্ষ শ্বাস টানে ইরফাদ, চোখ বন্ধ করে নেয় চুপচাপ। রকিং চেয়ারটা হালকা দোল দেয়। অতঃপর নিগূর কন্ঠস্বরে বলে,
-- যদি এমন দিন আসে,
তোমার হৃদয়ের বিভীষিকাময় ভয়াল পাতা আমি মুছে দিবো। এলোমেলো হৃদয়টা গুছিয়ে দিবো ততোবার যতোবার তুমি তুমি এলোমেলো হবে। তোমার হৃদয়ের সকল ব্যথা আমি শুষে নিবো যতোবার তুমি ডুববে বিষাদসিন্ধুতে। ভালোবাসা যদি হয় ভালোরাখার প্রয়াস, তাহলে সকল প্রলয়, মহাপ্রলয়ে সমস্ত কিছু তোলপাড় হলেও আমি ঐ হাত ছাড়বো না। ছাড়বোই না....
চোখ বন্ধ করে রকিং চেয়ারে দোল দেয় ইরফাদ। আকাশ থেকে তারা গুলো যেনো কল্পনায় খসে খসে পড়ে তার কোলে। সিনথিয়ার হৃদয়ে উপচে পড়ে সাগরের উত্তাল ঢেউ, সেই ঢেউয়ে ভাসতে থাকা সিনথিয়া অজান্তেই বলে ফেলে,
-- মাঝ খানের দশ হাত দূরত্ব কমানোর অনুমতি দিন। হৃদয়ের উত্তাল ঝড় আপনার বুকের ওম না পেলে শান্ত হবে না।
রকিং চেয়ার দোলায় ইরফাদ। বন্ধ চোখে প্রগাঢ় কন্ঠে বুলি আউরায়,
-- কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে নেই। অপ্রত্যাশিতভাবে কখনো কখনো বুকে আছড়ে পড়তে হয়।
চলবে??
#নোটঃ লম্বা গ্যাপ আমি জানি রিচ হবে না। মন নষ্ট হবে। তাই পোস্ট দিয়ে দেখবোই না রিচ হয়েছে কি না।