Bindas Life

Bindas Life মনে হয় আপনাদের সাথে আর বেশি দিন থাকতে পারব না ।
(3)

02/02/2025

#রং
#পর্বঃ৫৫
Tonni-Tonu

এহেম কথায় শরীর নিস্তেজ হয়ে দেয়াল ঘেঁষে বসে পড়ে সিনথিয়া। ইভা পাথুরে মূর্তির ন‍্যায় শক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। হৃদয়ের রক্তগুলো অশ্রুবিন্দু রুপে টুপ টুপ করে ঝড়ে পড়ে। সিনথিয়ার শরীর ক্রমেই রূপান্তরিত হয় হীমবাহে। দুহাতে ধরে থাকা ছোট ট্রে "এর উপর গোল ছোট পিরিচ তার উপরের কাপটা কাত হয়ে ঢেলে পড়ে চা। দেয়াল ঘেঁষে বসে হাঁটু ভাজ করে বসা সিনথিয়ার কোলে চুইয়ে পড়া গরম চায়ের দহনে পুড়তে থাকে উদর। হৃদয়ের দহনের উত্তাপে দুঃচিন্তা আর অদূর ভবিষ্যতে ভাসমান দৃশ‍্যপট চিন্তা করতে থাকা সিনথিয়া অজান্তেই পেট চেপে ধরে ধীর গলায় অস্ফুট শব্দ করে,-- উফফফ!

এহেম শব্দে অন‍্য জগতে থেকে সম্বিত ফেরে ইভার। কক্ষের ভেতরে বাবা- সন্তানের কথোপকথন থেমে যায় আকস্মিক মৃদু শব্দে। দরজার পানে তাকায় রিদুয়ানুর রহমান। রিদুয়ানুর রহমানের পায়ের উপরে থাকা ইরফাদ নিজের মাথাটা ধীরে ধীরে তোলে। একপলক তাকায় রিদুয়ানুর রহমানের চোখে। এদিকে চোখ ফিরিয়ে অকস্মাৎ অপ্রত‍্যাশিত ঘটনা দেখে ইভা বিস্মিত গলায় বলে,

--এই কি হলো তোমার!! পড়ে গেলে কেনো? শরীর খারাপ লাগছে?

দরজার বাইরের গলার স্বর শুনে ইরফাদ চোখ ফিরিয়ে নেয় রিদুয়ানুর রহমানের দিক থেকে। অকস্মাৎ উঠে দাঁড়ায় ইরফাদ।বাইরে দরজার সাইডের দেয়াল ঘেঁষে চোখ বন্ধ করে বসে আছে সিনথিয়া। যার চোখ মুখে নীলচে ব‍্যাথার ছাপ স্পষ্ট। কোলের মধ‍্যে থেকে তড়িৎ গতিতে ইভা তুলে নেয় চায়ের কাপ। তবে যা হওয়ার তা আগেই হয়ে গেছে। শ‍্যাওলা রঙের সালোয়ার কামিজের পেটের অংশ জুড়ে ভেজা। সেকেন্ড সময় ভাবে ইভা। চা কি বেশীই গরম ছিলো!! পুড়ে গেলো নাকি!! এরপরেই নৈঃশব্দে ঢুকে যায় রিদুয়ানুর রহমানের কক্ষে। ইরফাদ আর রিদুয়ানুর রহমান কক্ষ থেকে বেড়িয়ে এসেছে ততোক্ষণে। ইরফাদ চোখ বুলিয়ে নেয় চারপাশটা। অতঃপর পুরো বিষয়টা মাথায় সাজিয়ে হিসেব মিলিয়ে নিতেই তড়িৎ গতিতে বসে সিনথিয়ার পাশে। এরমধ‍্যেই রিদুয়ানুর রহমান আকস্মিক স্বরে বলে,

-- আরে পড়ে গেলে কিভাবে? শরীর খারাপ করছে নাকি!!

তার স্বরে চিন্তার ছাপ স্পষ্ট। তিনি গলা উঁচিয়ে বলেন,

--ইভা!! বাইরে কি করছিলি তোরা!! ও এখানে পড়লো কি করে??

চোখ বুজে থাকা সিনথিয়া ফুরিয়ে আসা শক্তিহীন শরীরটা আরেকটু ছেড়ে দিয়ে মাথা ঠেকায় শক্ত দেয়ালে। ইরফাদ উদ্বিগ্ন স্বরে ফুটে ওঠে দুঃশ্চিন্তা,-- পড়ে গেলে কিভাবে সিনথি!! শরীর খারাপ লাগছে!!

দূর্বল শরীরটা ছেড়ে দিয়ে মাথা দু"দিকে দোলায় সিনথিয়া। কাপড়ের কিছু অংশ জুড়ে ভেজা, পাশেই ট্রে এর উপর শূন‍্য চায়ের কাপ। ইরফাদের কপালে হালকা ভাজ। তাহলে কি চা পড়েছে!! পুড়ে গেছে। উদ্বিগ্ন কন্ঠস্বর তড়িৎ গতিতে বলে ইরফাদ,

-- এই!!পুড়ে গেছে নাকি!!

বন্ধ চোখ খুলে দূর্বল চোখে তাকায় সিনথিয়া। শরীরের হালকা ক্ষত হওয়ায় তার কিচ্ছু আসে যায় না। তার দূর্বল হওয়ার একমাত্র কারণ তো কিছুক্ষণ আগের কথোপকথন!! কি হবে এর পর। সবটা জানার পর তার জীবনে নতুন করে ঝড় উঠবে। জীবনের প্রতিটা ধাপে যে যুদ্ধ করে টিকে রইলো, তবে এই যুদ্ধ লড়ার মতো অবশিষ্ট শক্তিটা তো তার নেই। এই মহাপ্রলয়ের তান্ডবে ইরফাদ থাকবে তো তার পাশে!! পাশে থাকতে দিবে তো পরিস্থিতি!! নাকি তলিয়ে যাবে তার ভালোবাসা বিষাদসিন্ধুতে!

দ্রুত পা চালিয়ে বাইরে আসে ইভা। ইরফাদের দিকে পানিপূর্ণ ঠান্ডা পানির বোতলটা বাড়িয়ে দিয়ে ইভা উদ্বিগ্ন হয়ে বলে,

-- পানি ঢালো পুড়ে গেছে মনে হয়।

ঠান্ডা পানির বোতলটা হাত বাড়িয়ে নেয় ইরফাদ। জামার উপর থেকে পেটের উপর অল্প একটু পানি ঢেলে দেয় ইরফাদ। রিদুয়ানুর রহমান উদ্বিগ্ন হয়ে বলেন,

-- কিভাবে হলো!! জয়, ওকে রুমে নিয়ে যা তো। ইভা দেখ বার্ণ হয়েছে কিনা।

দূর্বল শরীরে সিনথিয়া বলে,
-- বার্ণ হয়নি! চা তেমন গরম ছিলো না। শরীর দূর্বল লাগছে।

রিদুয়ানুর রহমান সাথে সাথে বলেন,

-- ইভা ওকে রুমে নিয়ে যাও তো,চেঞ্জ করাও।

বলেই পিছু ফিরে নিজের কক্ষে যান রিদুয়ানুর রহমান। পানির বোতল পাশে সরিয়ে ইরফাদ তড়িৎ গতিতে পাজাকোলে তুলে নেয় সিনথিয়াকে। ইভা বোতলটা তুলে ইরফাদের পেছনে পেছনে ছোটে। সিনথিয়া জড়সড় হয়ে বলে,

-- বললাম তো চা খুব বেশী গরম ছিলো না।

পুরো ঘটনার আঁচ ইরফাদ কক্ষের বাইরে বেরিয়েই বুঝতে পেরেছে তবে হিসেব তো বাকি। ইরফাদ দাঁতের উপর দাঁত রেখে বলে,

-- চা কার জন‍্য নিয়ে এসেছিলে।

--বাবা।

--তাহলে চা ঠান্ডা হলো কি করে!! বাইরে দাঁড়িয়ে কথা গিলছিলে?

এহেম কথায় বরফের মতো জমে যায় সিনথিয়া। ইভা পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে পড়ে সেখানেই। একটু পরের দৃশ‍্যপটে চোখ বুলিয়ে নেয় কিয়ৎক্ষণ, এর মধ‍্যেই তির্যক গলা। এই গলাটা যে তার ভাইয়ের তা সে ভালো করেই জানে।

-- দাঁড়িয়ে কেনো! রুমে আয়।

দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে লুকিয়ে কথা শোনার ফলাফল কেমন আজ হারে হারে বোঝাবে যে ইরফাদ সে আঁচ ইভা পেয়ে গেছে। তবে পিছু হটার তো উপায় নেই, পায়ের গতি বাড়ায় ইভা। সিনথিয়াকে ওয়াশরুমে দাঁড় করিয়ে ঝর্ণা ছেড়ে দিয়ে বেড়িয়ে আসে ইরফাদ। কক্ষের মধ‍্যে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে ইভা। ইরফাদ বেরিয়ে এসে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। এরপর দাঁতের ফাঁক দিয়ে ধীর গলায় বলে,

-- পনেরো মিনিট ওকে ভেজাবি।

-- কেনো!! ঠান্ডা লেগে যাবে না।

-- যেখানে বার্ন হয়েছে শুধু ওখানেই।

-- আমাকেই যেতে হবে?

-- তো!!

ইরফাদের মুখাভঙ্গিতে যে আঁচ ইভা পাচ্ছে তাতেই জড়সড়, রাফসানের সত‍্যিটা তার মনে যে কঠিন, গাঢ় দাগ ফেলেছে তা ধামা চাপা পড়ে যাচ্ছে ইরফাদের শান্ত চাহুনীর পরের দৃশ‍্যপট কল্পনা করে। ইভা মুখে কথা না বলে চুপচাপ ভেতরে যায়,ঠোঁট উল্টিয়ে দিয়ে বলে,

-- আজ ভিষণ দুঃখ আছে।

ইভার গলার স্বর শুনে পিছু তাকায় সিনথিয়া। দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড়ানো সিনথিয়া ইভার মুখাভঙ্গিতে তাকিয়ে বলে,
-- কি হয়েছে আপু!!

চোখ গোল গোল করে তাকায় ইভা। অতঃপর তর্জনী ওষ্ঠের মাঝামাঝিতে ঠেকিয়ে ইশারা করে--শশশ!

বিস্মিত নয়নে তাকিয়ে সিনথিয়া। ইভা কাছাকাছি এসে বলে,

-- দেখি কোথায় লেগেছে!!

লজ্জায় কাচুমাচু করতে থাকা সিনথিয়া বলে ওঠে,

-- তুমি দেখবে!!

-- তো দেখতে হবে না। কতোটুকু বার্ন হলো।

-- বার্ণ হয়নি। চা তেমন গরম ছিলোনা তো।

-- সেইটা কি ভাইয়ার সামনে বলতে হবে?

--কেনো!!

-- আরে গাঁধা মেয়ে। ভাইয়া বুঝে গেলো তো আমরা বাইরে দাঁড়িয়ে কথা শুনছিলাম।

-- আল্লাহ্!!
এখন কি হবে?

-- পনেরো মিনিট ভেজো আগে। তারপর দেখি কি ঝাড়ি দেয়।

-- আমার এমনিই খুব দূর্বল লাগছে আপু।

-- ওভাবে পড়ে গেলে কেনো তুমি!!

বললে বলতে সিনথিয়ার উদরের কাছের লেপ্টে থাকা পরিধেয় অংশটুকু তুলে ধরে ইভা। উদরের পাশের অংশটুকু লালচে আভায় উদ্দীপ্ত। ইভার স্বরে উদ্বিগ্নতা,

-- আরে!!তুমি বলো চা ঠান্ডা। লাল হয়ে গেছে এমন।

নিজের উদরের দিকে তাকায় সিনথিয়া। টকটকে লাল অংশটুকুতে পানি চুইয়ে পড়ছে। ক্ষতস্থানটা গাঢ় হয়ে উঠছে ক্রমেই।
-- ধোঁয়া ওঠা গরম চা তো ছিলো না। দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে একটু ঠান্ডা হয়েছিলো তো।

-- ওভাবে পড়লে কেনো বলোতো! এখনো শরীর কাঁপছে।

অকস্মাৎ আবারো একই প্রশ্নে ভড়কে যায় সিনথিয়া। পুরো সত‍্যিটা লুকানোর চেষ্টায় এই প্রথমবার উতলা হয়ে যায় সে। এতো বড় সত‍্যি জানলে কেউ তাকে মেনে নিবে না। ভালোবাসার প্রতি দূর্বলতা তাকে ক্রমেই উদ্বিগ্ন করে তোলে। কি উত্তর দিবে সে এখন? সম্রাট শাহজাহান তার বাবা, রাফসান তার ভাই। পুরো পরিবারের শান্তি চূর্ণবিচূর্ণ হওয়ার পেছনে তার পরিবার এই কঠিন সত‍্যি জানার পরে কেউ কি তাকে মানবে!! ঠিক সে সময়েই ভেসে আসে ইরফাদের গলা,

-- কি অবস্থা!!

সাথে সাথেই পিছু ফিরে তাকায় ইভা। এরপর বলে,

-- ফাস্ট ডিগ্রী বার্ন মনে হচ্ছে!

-- পানি দাও বেশী করে।

-- দিচ্ছি ভাইয়া।

কেবিনেট থেকে ক‍্যাজুয়াল লেডিস শার্ট আর স্কার্ট বের করে ওয়াশরুমে এগিয়ে দেয় ইরফাদ।

-- চেঞ্জ করে এইগুলো পড়াও।দ‍্যান বেড়িয়ে আসো।

মনে মনে বিড়বিড় করতে থাকে ইভা," বের হওয়ার পর কি যে বলে ইরফাদ।" ভয়েই তো ভালো লাগছে না। ইভার বিড়বিড় করা দেখেই সিনথিয়া কপাল কুচকে তাকায়। তারপর বলে,

--কি হয়েছে আপু!!

-- কিছুনা।

-- জ্বলছে কি এখনো?

-- পানি দিলে কম কম মনে হয়।

-- চলো চেঞ্জ করো। ওখানে ছোট রুমাল ভিজিয়ে দিয়ে রেখো। রুমে গিয়ে সোজা বিছানায় উঠে যাবে।
-- কেনো?

-- না হলে,দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে কথা শোনার ফল বের করবে তোমার বর। সো, নিজেও বাঁচো আমাকেও বাঁচাও।

মাথা থেকে বেড়িয়ে যাওয়া কথাগুলো অকস্মাৎ একঝাকে আবারো তেড়ে আসে সিনথিয়ার দিকে। সবকিছুর মাঝখানে আসল সত‍্য পুরোপুরি ভুলে গিয়েছিলো ও। কি হবে? কি হবে সবটা জানলে? এই বাসার যতো হাহাকার, দুঃখ সবটাই তো তার পরিবার এর জন‍্য। এই চরম সত‍্য টুকু মাথা চাড়া দিয়ে উঠতেই মনটা ক্রমেই দূর্বল হ য়ে যায়। শরীরের জ্বলতে থাকা অংশ তাকে একটুও দূর্বল করতে পারেনি তবে মনের যন্ত্রণা তাকে মাটিতে মিশিয়ে দিচ্ছে বারংবার। কি অপেক্ষা করছে?? এর পরে কি হবে?

টাওয়েল এগিয়ে দেয় ইভা। সিনথিয়ার হাতে টাওয়েল দিয়ে পেছন ঘুরে বলে,
--অনেকক্ষণ ভিজেছো। মুছে নাও।শার্ট পড়ো। নিচের বাটন গুলো লাগিয়োনা।

সিনথিয়া চুপচাপ ড্রেস চেঞ্জ করে। ধীর গতিতে একে একে সবগুলো বোতাম লাগায়। দূর্বল শরীরে ধীরে ধীরে ইভার পাশাপাশি হয় সিনথিয়া। ইভা বিরক্তি স্বরে "চ্চ" উচ্চারণ করে।
-- তোমাকে না বললাম নিচের বাটন লাগিয়োনা। এক সাইড উচু করে রাখো। ছোট রুমাল ভিজিয়ে দিচ্ছি ওখানে ধরে রাখবে। কষ্ট কমে যাবে।

-- তোমার মনটা এততো ভালো কেনো আপু!!!

-- তুমি ভালো মনের তাই আমাকে ভালো লাগছে।

-- তোমাকে একটা কথা বলি!!

-- হুম শিউর।

-- পৃথিবীতে সরল,সোজা, কোমল মনের মানুষগুলোই বেশী কষ্ট পায়!!

ছোট্ট দীর্ঘশ্বাসের সাথে বেরিয়ে আসে চাপা কষ্ট। ইভা ধীর গলায় বলে,

--চলো। ভাইয়া ওয়েট করছে।
আর শোনো! খুব সহজে ভাইয়া মন খারাপ করে না। খুব সহজে ভাইয়া ভেঙ্গেও পরে না। তবে আজ কষ্ট পেয়েছে বলেই বাবার কাছে ওভাবে কথাগুলো বলেছে। তুমি তো ভাইয়ার অর্ধাঙ্গী! সো, মন বুঝে চলার চেষ্টা কোরো। আগলে রেখো।

*
*
*
সিনথিয়াকে বিছানায় বসিয়ে ইভা নিঃশব্দে কক্ষের বাইরে যাওয়ার জন‍্য প্রস্তুত হয়। তবে তার আগেই বাঁধা পড়ে যায় সে। ইরফাদের শান্ত গলা তাকে বাঁধা দেয়,

-- বাবার রুমের বাইরে দাঁড়িয়ে কেনো ছিলে দু"জন!!

ইভা নিরবে শক্ত ঢোক গেলে। এটার অপেক্ষায় ছিলো সে। ইভা মাথা নিচু করে বলে,

-- কিছু শুনতে পাইনি ভাইয়া।

এহেম উত্তরে পিটপিট করে তাকায় সিনথিয়া ইভার দিকে। ইরফাদের গলার স্বর এখন কিছুটা গাঢ়,

-- আমি কি একবারো বলেছি কিছু শুনেছো!!

-- আসলে!

ইরফাদ তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ফেলে সিনথিয়ার দিকে। গলার স্বরে নিগূর ভাব,

-- তুমি কি করছিলে!!

চোখ ফিরিয়ে নেয় সিনথিয়া। চোখ নিবদ্ধ করে মেঝের দিকে। দু"জন আগেই জমে গেছে বরফে। ইভা ধীর গলায় বলে,

-- কাল বলি! মেয়েটা খুব দূর্বল। ওর ঘুমের দরকার।

--লুকিয়ে কথা শোনা, লুকিয়ে পারসোনাল কিছু ঘাটা আমার সবচেয়ে অপছন্দ। ইভা জানো তুমি!!

ইভা ধীর গতিতে মাথা নাড়ায়। যেনো এদিক সেদিক হলে ঘাড় থেকে মাথাটা আলাদা হয়ে যাবে।

-- তাহলে রুমের বাইরে কি করছিলে।

শান্ত স্বরটা ক্রমেই গাঢ় হচ্ছে। ইভার ভেতরটা স্বরের দাপটের তালে ভেসে ভেসে কাঁপছে। গলা দিয়ে আর একটুকরো কথাও বের হচ্ছে না, আধখানাও না।

--শান্তি পেয়েছো!!

ইভার দিকে আসা কথাটার কোনো উত্তর নেই তার কাছে। শুধু পাথুরে মূর্তির মতো দাঁড়িয়ে থাকা ছাড়া। ধীর গলায় অস্ফুট স্বরে বলে,

-- সরি ভাইয়া।

-- শান্তি পেয়োছো!!

--সরি!!

--শান্তি লেগেছে!!

--বললাম তো সরি!!

-- শান্তিতে যদি সারারাত নির্ঘুমে কাটাবি এই তো।

-- সরি ভাইয়া। আর হবে না।

-- যা এখন!!

--ভাইয়া সরি!!

--যেতে বলছি না??

-- সরি!! সরি!! সরি!! আর কখনো এমন করবো না।

-- যাও এখন।

পাথুরে মূর্তির মতো ঠায় দাঁড়িয়ে এক দমে জপে যায় ইভা, "সরি।"

ইরফাদের দিক থেকে কোনো উত্তর আসে না। ইভা নিজে থেকেই বলা শুরু করে,

-- সত‍্যি বলছি। সত‍্যিই ইচ্ছে করে করিন। ট্রাস্ট মি!! এমন সময় কথাটা কানে এসেছে আমি নিজেকে কনট্রোল করতে পারিনি।

--এক্সপ্লেনেশন চেয়েছি!!

--ভাইয়া!! সরি তো।

-- যাও

-- প্লিজ মাফ করো এইবারের মতো।

-- যাও এখন।

-- আমার ঘুম হবে না ভাইয়া।

-- ঘুম এমনিতেও হবে না।

-- এতো কঠিন হয়ো না। অর কখনো এভাবে কিছু শুনবো না।

-- ইউ নো,যদি তোমার ভালোর জন‍্য কিছু হতো, জানার প্রয়োজন পড়তো আমি নিজে জানাতাম। যা তোমার জন‍্য হার্মফুল তা থেকে আমি তোমাকে দূরে রাখি। তাহলে কেনো?

-- সরি ভাইয়া!! আর কখনো,কোনোদিন করবো না।

-- ওকে যাও।

--মাফ করে দাও না।

এতোটুকু বলে তড়িৎ গতিতে চোখের পলক ফেলার আগেই ইভা দুহাতে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে ইরফাদের পা। এহেম কান্ডে স্তম্ভিত, হতবম্ভ হয়ে তাকায় সিনথিয়া। ইরফাদ নিজেও স্তম্ভিত হয়ে যায়। অপ্রত‍্যাশিত কান্ডে ইরফাদ নিজেই স্তব্ধ হয়ে যায়। তৎক্ষণাৎ দু"হাতে টেনে ছাড়াতে চায় ইভাকে। তবে সে হাতের বন্ধন আরোও গাঢ় হয়। পা জড়িয়ে থাকা মেয়েটা হঠাৎ করেই ঢুকরে ওঠে।

-- এই পৃথিবীতে তোমরা ছাড়া কেউ নেই আমার। পৃথিবীটা এতোই কঠিন, এতই স্বার্থপর যাকে বিশ্বাস করেছি সেই চলে গেছে ভাইয়া। তোমরা আমার ভালো থাকার কারণ! তুমি রাগ করলে আমি পাজেল হয়ে যাই। আমি তো তোমার ছোট বোন!! একটু ভুল করেছি তাই বলে এমন রাগ করছো!! মাফ করতে পারছো না।

-- ইভা পা ছাড়ো। তুমি পা ধরছো কেনো!!

-- তুমি ক্ষমা করেছো!!

-- পা ধরার মতো কিচ্ছু হয়নি ইভা!

-- আমার তো শান্তি লাগছে ভাইয়া। তুমি মাফ করে দাও। আমি একটা সময় তোমাদের অনেক কষ্ট দিয়েছি। আর এইটুকু কষ্ট আমি দিতে চাই না। এইটুকুও না। এইটুকুও না ভাইয়া!

-- ইভা ওঠো।

-- বলো ক্ষমা করেছো!
-- আমার কাছে তোমার আকাশসম ভুল নগন‍্য। আমি তোমাকে স্মুথ লাইফ লিডের ডিরেকশন দেই। কখনো রুডলি বলি। দ‍্যাটস মিন এই নয় তোমাকে পায়ে পড়তে হবে।

-- রাগ করোনা ভাইয়া। যা বলবে তাই শুনবো। আমার সাথে প্লিজ রাগ করোনা। প্লিজ, প্লিজ,প্লিজ......

--পাগলামি করিস না ইভা। ওঠ!

ইস্পাত কঠিন হাতে ইরফাদ টেনে তোলে ইভাকে। বিছানার কোনে বসিয়ে শান্ত গলায় বলে,

-- ট্রমাটাইজ তুই!! পাগলের মতো হয়ে যাচ্ছিস দিন দিন।

--কিছু ভালো লাগে না ভাইয়া। এর উপর তুমি রাগ করলে অসহ‍্য লাগে। তুমি আর বাবা ছাড়া কে আছে আমার!

-- পাজেল হয়ে যাচ্ছো বার বার। স্ট্রং থাকার চেষ্টা করো। এমন পাগলামি আর কোরো না। ওকে!!

--ভাইয়া!! মানুষটা পরিবারের জের ধরে আমাকে ঠকালো!

--ইভা এসব ভাবতে না করছি না!!

--আমার খুব যন্ত্রণা হয়!! সহ‍্য করতে পারিনা।

--এই জন‍্য আমি তোমার থেকে হাইড রেখেছিলাম। কিন্তু!!

-- মেয়েটা বাবা কি ঐটাই জানলো না, বুঝলো না।

-- তুমি চাইলে আমি রাফসানের সাথে টুম্পার দেখা করাবো।

-- আর বাচ্চাটা যখন বলবে," সবার বাবা বাইরে থাকে আমার বাবা লোহার খাঁচায় বন্দি কেনো!!"

-- ডোন্ট ওরি!! আমি আছি তো।

-- সত‍্যিই দেখা করাবে? ওরকম মানুষ বাবা হওয়ার যোগ‍্যতা রাখে না। হতে পারে ঐটা কোনো নতুন চাল।

-- চোখ দেখে জাজ করার ক্ষমতা তোর ভাইয়ার আছে। অনুতপ্ততার চেয়ে বড় শাস্তি নেই। সো ডোন্ট প‍্যানিক!! আমি আছি না!

-- ভয় লাগছে।

-- আছি না আমি!!

--ওকে আমি যাই এখন। রাগ করে থেকোনা আর প্লিজ!!

*
*
*
ইভা চলে যাওয়ার পর এক অন্ধকারাচ্ছন্ন ঘন কালো আধারে ডুবতে থাকে সিনথিয়া। এই লৌহকঠিন মানুষটার মন বিষণ্ন, তার উপর রেগে আছে, নিজের মনের উপর দিয়ে চলছে একপ্রকার তান্ডব। একদিকে অজানা আশঙ্কা, ভয়ে সে ক্ষণে ক্ষণে ডুবছে চোড়াবালিতে অপর দিকে ইরফাদের রুষ্ঠ, কঠিন চোখে তাকিয়ে নিজেই জড়সড় হয়ে যায়।লৌহকঠিন পাথুরে মানব তখন চারকোনা পাতলা রুমালটা পানিতে ভিজিয়ে নিয়ে এসে দাঁড়ায় কোমল শরীরের মানবীর সামনে। মুখে স্কচটেপ এঁটে ইস্পাতকঠিন হাতে তড়িৎ গতিতে উন্মুক্ত করে লেডিস শার্টের দুটো বোতাম, লালচে দাগ পড়া জায়গায় ভেজা,নরম রুমালটা বসিয়ে বালিস টেনে শুইয়ে দেয়। চুপচাপ শুয়ে থাকে সিনথিয়া। ভেতর থেকে হাজারটা কথা উগলে বেড়িয়ে আসতে চাইলেও এক তিক্ত যন্ত্রণা গলা চেপে ধরে। কিচ্ছু বলতে পারে না সে।লৌহকঠিন মানুষটা পায়ে পায়ে এগিয়ে যায় রকিং চেয়ারের দিকে। খুলে দেয় থাই গ্লাস।দমকা বাতাসে ওড়ে কপাল ছোঁয়া চুলগুলো। রকিং চেয়ার দুলিয়ে চোখ বন্ধ করার পূর্বেই উঠে বসে সিনথিয়া। নিগূঢ় কন্ঠস্বরে প্রগাঢ় হয় ধমকের সুর,
-- এই উঠবে না।

বরফের মতো জমে যায় সিনথিয়া। পরের বার কথা বলার সাহস আর হয়ে ওঠে না। তবে কিছুক্ষণ আগে ইভার কথা ভেবে সিনথিয়া বলে,

-- আমি ইচ্ছে করে করিনি। অজানা সত‍্যি সামনে চলে এসেছে আমি কি করবো!! কি করে উপেক্ষা করবো!!

-- কোনো কথা নয়। ঘুমাও!!

-- আমি জানি আপনি রেগে আছেন। আপনি বুঝতে পারছেন না আমার ভেতরে....

কথার মাঝেই দেয়াল দাড় করিয়ে দেয় ইরফাদ,

--কি বুঝিনি আমি!! কি!!
বাসার সবাই জানে তুমি অসুস্থ!! তাই ওভাবে পড়ে গেছো। আর আমি জানি, তোমার শরীর নয় তোমার মনের উপরে মহাপ্রলয় চলেছে। এইসব শুনলে তুমি ভেঙ্গে পড়বে এইটা কি আমি জানি না!! কেনো আড়াল করেছি!! তুমি আমাকে নাই বুঝতে পারো তবে তোমাকে পড়তে আমি জানি। ডাউট আছে আর!! আর কোনো কোয়েশ্চেন!!!

আবছা আলোয় ডুবে থাকা কক্ষের মাঝে সিনথিয়ার ছোট্ট হৃদয়জুড়ে মৃদু কম্পন বয়ে যায়। মানুষটা এতোটা বোঝে তাকে!! এই মানুষটার থেকে যদি আলাদা হতে হয়। পরিস্থিতি যদি আলাদা করে। তাহলে!! কি করে বাঁচবে সে!! সিনথিয়ার চোখ জুড়ে নামে ভয়ের আবহ। সেই আবহে কেঁপে কেঁপে ওঠে হদয়। অনেকটা সময় অপেক্ষা করে সিনথিয়া উগলে দেয় হৃদয়ের কথা,

-- আমার পরিবার আপনার সব কেড়ে নিয়েছে। সবটা জানলে আপনার পরিবার আমাকে আপনার সাথে থাকতে দিবে। আপনি কি আমাকে ভালোবাসবেন! আমি যে খুব ভয় পাচ্ছি। দুশ্চিন্তায় পাজেল হয়ে যাচ্ছি!

শূন‍্য জানালায় দৃষ্টি মেলে সুক্ষ শ্বাস টানে ইরফাদ, চোখ বন্ধ করে নেয় চুপচাপ। রকিং চেয়ারটা হালকা দোল দেয়। অতঃপর নিগূর কন্ঠস্বরে বলে,

-- যদি এমন দিন আসে,
তোমার হৃদয়ের বিভীষিকাময় ভয়াল পাতা আমি মুছে দিবো। এলোমেলো হৃদয়টা গুছিয়ে দিবো ততোবার যতোবার তুমি তুমি এলোমেলো হবে। তোমার হৃদয়ের সকল ব‍্যথা আমি শুষে নিবো যতোবার তুমি ডুববে বিষাদসিন্ধুতে। ভালোবাসা যদি হয় ভালোরাখার প্রয়াস, তাহলে সকল প্রলয়, মহাপ্রলয়ে সমস্ত কিছু তোলপাড় হলেও আমি ঐ হাত ছাড়বো না। ছাড়বোই না....

চোখ বন্ধ করে রকিং চেয়ারে দোল দেয় ইরফাদ। আকাশ থেকে তারা গুলো যেনো কল্পনায় খসে খসে পড়ে তার কোলে। সিনথিয়ার হৃদয়ে উপচে পড়ে সাগরের উত্তাল ঢেউ, সেই ঢেউয়ে ভাসতে থাকা সিনথিয়া অজান্তেই বলে ফেলে,

-- মাঝ খানের দশ হাত দূরত্ব কমানোর অনুমতি দিন। হৃদয়ের উত্তাল ঝড় আপনার বুকের ওম না পেলে শান্ত হবে না।

রকিং চেয়ার দোলায় ইরফাদ। বন্ধ চোখে প্রগাঢ় কন্ঠে বুলি আউরায়,

-- কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুমতি নিতে নেই। অপ্রত‍্যাশিতভাবে কখনো কখনো বুকে আছড়ে পড়তে হয়।

চলবে??

#নোটঃ লম্বা গ‍্যাপ আমি জানি রিচ হবে না। মন নষ্ট হবে। তাই পোস্ট দিয়ে দেখবোই না রিচ হয়েছে কি না।

01/02/2025

ভার্সিটি যাবো জন্য সিঁড়ি বেয়ে নামছিলাম । হঠাৎ সায়েম আঙ্কেল পথ আটকে বললেন,
- তোমার নাম কি ?
আমি সহাস্যে উত্তর দিলাম, শুভ ।

- আমার মেয়ে ক্লাস নাইনে পড়ে । পড়াতে পারবে ?
- জ্বি পারবো ।
- ঠিক আছে কাল থেকে এসো ।

কথাটা বলেই উনি চলে যাচ্ছিলেন । আমি বললাম, বেতনের কথাটা ঠিক করে নিলে হয়না ?
উনি আমার কাঁধে হাত রেখে মুচকি হেসে বললেন, ভয় পেয়ো না । আমার স্ত্রী বলেছে তোমার কথা । তোমার সাথে নাকি এর আগে একদিন কথা হয়েছিলো !

আমি বুঝতে পারলাম রেবেকা আন্টি বলেছে । সায়েম আঙ্কেল সরকারি কর্মকর্তা, একই ফ্ল্যাটে থাকি তাই উনি না চিনলেও আমি চিনতাম ।

আজ পড়ানোর প্রথম দিন । আমি রিডিং রুমে বসে আছি । একজন কে নাস্তা আনতে দেখে একটু নড়েচড়ে বসলাম । আন্টি নিজেই নাস্তা নিয়ে এসেছেন ।

- আন্টি আমার স্টুডেন্ট কোথায় ? অনেকক্ষণ হলো বসে আছি ।
- তুমি বসো বাবা । আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি ।

আচ্ছা ঠিক আছে, কথাটা বলেই আমি দেয়ালের পেইন্টিং গুলো দেখছিলাম । কি সুন্দর করে আঁকা ! মনে হচ্ছিল পাবলো পিকাসো একসময় থাকতেন এখানে ।

- আসসালামুয়ালাইকুম ।
- ওয়ালাইকুমুস সালাম, বসো ।
- আপনি কি পেইন্টিং গুলো দেখছিলেন ? ওগুলো আমার আঁকা ।

কথাটা শুনে আমার চক্ষু চড়কগাছ । ক্লাস নাইনে পড়ুয়া একটা মেয়ের হ্যান্ড পেইন্টিং এত কড়া লেভেলের সুন্দর হতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে হয়তো বিশ্বাসই করতাম না ।

আমার স্টুডেন্টের নাম রিয়া । পরিচয় পর্ব শেষ করে সেদিনের মতো চলে আসলাম । আমি ভেবেছিলাম যার পেইন্টিং এত সুন্দর সে নিশ্চয়ই পড়াশোনায় খুব মনোযোগী ।

কিন্তু আমার ভাবনায় তা একদমই ভুল ছিলো । ওকে পড়াতে গিয়ে বুঝলাম পড়াশোনা তার একেবারেই ভাল্লাগে না । পড়াশোনা বাদে পৃথিবীর সকল কাজের কাজি সে । এত চঞ্চল আর বাচাল টাইপের মেয়ে আমি জীবনে খুব কমই দেখেছি ।

একদিন পড়াতে গিয়ে যদি দেখি ও ফুচকা বানাচ্ছে, তো আরেকদিন আইসক্রিমের রেসিপি নিয়ে গবেষণা করছে । আজ পর্যন্ত এমন একটা দিনও পাইনি যেদিন গিয়ে দেখেছি ও পড়াশোনা করছে ।

আমার যেমন খুব বিরক্ত লাগতো, তেমন হাসিও আসতো । যতদূর বুঝতাম পড়াশোনা টা ওর জন্য বাধ্যতামূলক ছিলো তাই মনের বিরুদ্ধেই পড়াশোনা করতে হতো ।

আজ বাইরে খুব বৃষ্টি পড়ছে ।
ভাবলাম পড়াতে যাবোনা, ভিজবো । যেই ভাবা সেই কাজ । একদৌড়ে চলে গেলাম ছাদে । গিয়ে দেখি রিয়া বৃষ্টিতে ভিজছে । ওখানে থাকবো কিনা বুঝতে পারছি না । পরে ভাবলাম স্টুডেন্টের সাথে যদি কেউ বৃষ্টি ভেজা দেখে তাহলে ইজ্জতের ফালুদা হয়ে যাবে ।

পরের দিন পড়াতে গিয়ে শুনি ওর ঠান্ডা জ্বর । সেদিন আর পড়ানো হয়নি ।

এভাবে কেটে গেলো কয়েকটা মাস । আঙ্কেল আমাকে মোটা অঙ্কের বেতন দিতেন, আর বিশ্বাসও করতেন খুব।

একদিন আন্টি ফোন দিয়ে বললেন,

- শুভ তুমি কি ফ্রি আছো ? রিয়াকে নিয়ে একটু মেলায় ঘুরে আসতে পারবে ? এত্ত বায়না ধরে এই মেয়েটা ! যুগ খারাপ, অন্য কারো সাথে গেলে তোমার আঙ্কেল খুব রাগ করবেন ।

- ঠিক আছে আন্টি আমি আসছি ।

ফোনটা রেখে রেডি হতে শুরু করলাম । খুব একটা ইচ্ছে নেই তবুও যেতে হবে । কারণ মাস গেলে খরচের টাকাটা এখান থেকেই আসে ।

কলিংবেল বাজাতেই দরজা খুলে গেলো যেন এই শব্দটার জন্যই কেউ অপেক্ষা করেছিলো । রিয়াকে দেখেই একটা বড় ধরণের শকড্ খেলাম ।

নীল শাড়ি, খোঁপায় ফুল, চোখে কাজল আর হাতের চুড়ি- সব মিলিয়ে ওকে অনেক সুন্দর আর মায়াবী লাগছিলো ।

মেলায় পাশাপাশি হাঁটছি । একটা ছেলে এসে বললো, "ভাই ভাবিকে নিয়ে দাঁড়ান একটা ছবি তুলে দেই ।"

আমি লজ্জায় লাল হয়ে গেলাম । এমন অভিজ্ঞতা আর কারো জীবনে ঘটেছে কি না আমার জানা নেই । রিয়া মুচকি হাসছে ।

একটু পর খেয়াল করলাম ওর দিকে সবাই এমন ভাবে তাকাচ্ছে, আমার কেমন যেন খুব রাগ হচ্ছিলো ওদের উপর ।

রিয়া বললো, শুভদা ফুচকা খাবো ।

কথা টা শুনে আমি থ' হয়ে গেলাম । এই প্রথম ও আমার নাম ধরে বললো । সবসময় স্যার বলে । আর হঠাৎ শুভদা!

ফুচকা খাওয়ানো শেষ হতেই আবদারের ফোয়ারা ছুটলো । চকলেট, আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংকস আর এটা ওটা কেনা । আজ আমার পকেট শেষ ।

বাড়ি ফিরতেই আন্টি ওকে খুব বকা দিলো কেনাকাটা দেখে । আমি বুঝিয়ে রুমে চলে আসলাম ।

আসার পর থেকে বুকের ভেতর কি যেন একটা শূন্যতা অনুভব করতে লাগলাম । কিন্তু আমার ভুলে গেলে চলবে না যে আমি ওর টিচার ।

ঘুম থেকে উঠলাম কলিংবেলের শব্দে । উফফফফ্ কি অসহ্য ! দরজা খুলতেই দেখি গণিত বই হাতে রিয়া ।

- আরে বাহ্ ! কোনদিন তো পড়াশোনার প্রতি এত আগ্রহ দেখিনি । আজ হঠাৎ বই হাতে ?
- ইচ্ছে হলো শুভদা ! আর তো মাত্র দুইদিন । তারপর এ পাড়া থেকে চলে যাবো ।

মুখ গম্ভীর করে উত্তর দিলো রিয়া । আমার নিজের কাছেও খটকা লাগছে কেমন যেন । আন্টি তো আমাকে কিছু বলেননি, তাহলে কি হলো হঠাৎ করে !

- শুভ দা আসি । বিকেলে পড়াতে এসো ।

কথাটা বলে ও এক সেকেন্ডও দেরি করলো না ।
আমি তখনই আন্টিকে ফোন দিলাম কি হয়েছে জানার জন্য । তবে যেটা শুনলাম তা শোনার কোন ইচ্ছে আমার ছিলোনা ।

আন্টি বললেন,
- তোমার আঙ্কেলের ট্রান্সফার হয়েছে । আমরা পরশুদিন এখান থেকে চলে যাবো । তুমি বিকেলে এসে টাকাটা নিয়ে যেও ।

হাত থেকে ফোন টা পড়ে গেলো । আজ সত্যিই খুব শূন্যতা অনুভব করছি । কথাটা শোনার পর মনে হলো সময় আমার সঙ্গে নেই । শেষ দুইদিন পড়াতে গিয়ে বুঝলাম আমার প্রতি রিয়ার অনুভূতিও আসলে অন্য কিছু । কিন্তু আমার তো কোন উপায় ছিলো না ।

ফোনের শব্দে আমার ভাবনায় ছেদ ঘটলো । আমার স্ত্রী রাবেয়া ফোন করেছে ।
- বাসায় ফিরবে কখন ? গেস্ট রা তো সবাই এসে গেছে ।
- আমি আসছি ।

ফোন টা রেখে দিলাম ।
আজ আমার মেয়ে মুনতাহার জন্মদিন । ঘরোয়া পরিবেশে ছোট আয়োজন । অফিসের ইমারজেন্সি একটা মিটিং-এর জন্য আমার দেরি হয়ে গিয়েছে ।

সেদিনের পর রিয়ার সাথে আর দেখা হয়নি, কথা হয়নি । অনেক খুঁজেছি কিন্তু কোথাও পাইনি ।
অন্য ৫-১০ টা ছেলের মতো আমিও পড়াশোনা শেষ করে এখন চাকরি করছি । বিয়েও করেছি, একটা মেয়ে আছে তৃতীয় শ্রেণীতে পড়ে ।

আমার স্ত্রীর মধ্যেও রিয়াকে খোঁজার চেষ্টা করতাম প্রথম প্রথম । কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে এই পৃথিবীতে কেউ কারো মতো হয়না, সবাই যার যার দিক থেকে পারফেক্ট ।

এসব ভাবতে ভাবতেই বাসায় চলে আসলাম । কেক কাটতে কাটতে অনেক দেরি হয়ে গেলো । এতরাত হবে আমি ভাবতে পারিনি ।

গিয়ে দেখি মুনতাহার কয়েকটা বন্ধুও এসেছে । কেউ বাবার সঙ্গে এসেছে, কেউবা মায়ের সঙ্গে ।

একটু অদূরে তাকিয়ে দেখি একটা মেয়ে কাঁচুমাচু হয়ে দাঁড়িয়ে আছে । আমি কাছে গিয়ে বললাম,

- কি হয়েছে মা ? তুমি এত ভয় পাচ্ছো কেন ?
- বাসায় গেলে আম্মু বকা দিবে ।

বাচ্চা মেয়েটার কথা শুনে খুব খারাপ লাগলো । এর মধ্যেই রাবেয়া এসে বললো,
- তুমি বরং ওকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে এসো । এদিকটা আমি সামলে নিচ্ছি ।

গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম । বাসায় পৌঁছে দিতে হবে মেয়েটাকে । আমার জন্যই এতকিছু হলো ।

- ভয় পেয়ো না বাবু । কিছু হবেনা ।
- আম্মু বকা দিবে ।

ওর এই একই কথা শুনতে আমার খুব খারাপ লাগছে । সামান্য দূরত্বে বাসা । কি ভয়টাই না জানি পেয়েছে মেয়েটা ! রাস্তায় ওকে কিছু চকোলেটস্ কিনে দিলাম । দেখতে দেখতে আমরা পৌঁছে গেলাম ।

কলিংবেল চাপতেই দরজা খুলে গেলো । দরজা খুলতেই তো আমি অবাক ! এই দৃশ্যটা দেখার জন্য আমি মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না । যে মানুষটা আমার সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে আর কেউ নয়- রিয়া ।

- রিয়া !
- কেমন আছো শুভ দা ? অনেকদিন পর দেখা তাইনা ? ভেতরে এসে বসো। এত দেরি হলো কেন মুনতাহা ?

আরে এই মেয়েটার নাম মুনতাহা ! আমি বেশ অবাক হয়ে বাচ্চাটার দিকে তাকালাম, ভুল করে আমার মেয়েকে নিয়ে আসিনি তো !

একে তো রিয়াকে দেখে আমার হুঁশ উড়ে গেছে, তার উপর বাচ্চাটার নাম মুনতাহা ।

- তুমি অনেক বদলে গেছো শুভ দা । আগের সাথে কোন মিল নেই তোমার । আচ্ছা বসো চা নিয়ে আসি ।

চায়ে চুমুক দিয়ে বললাম, মেয়েকে আনতে গেলে না কেন ? এত রাত হয়েছে তবুও খোঁজ নিলে না ?

- যদি অন্য কোথাও যেত তবে যেতে দিতাম না । দিলেও সঙ্গে যেতাম । কিন্তু আমি জানি তোমার মেয়ের জন্মদিন । তাই নিশ্চিন্তে ছিলাম যে মেয়ে ফিরে আসবে। অবশ্য একটু আগে থেকে সামান্য টেনশন শুরু হয়েছে ।

আমি চুপ হয়ে চা খেতে লাগলাম । বললাম,

- তুমি তো আগের মতোই আছো । সেরকমই কথার আগুন, সেরকমই বাকপন্ডিতি । মেলায় যাওয়া, ফুচকার বায়না সবকিছুই চলে এখনো ?

- না শুভ দা । প্রিয় মানুষ ছাড়া এসবের কোন দাম নেই বুঝলে তো ! আর মা হলে তো সব ভুলেই যেতে হয় !

- মেয়েটার নাম মুনতাহা রাখলে যে ?

- একজন পড়াতে গিয়ে বলেছিলো এই নাম টা তার খুব পছন্দের । অবশ্য ওর বাবা রাখতে চায়নি, আমিই জোর করে রেখেছি ।

আমি বাকরুদ্ধ হয়ে বসে রইলাম, কথা বলার শক্তি নেই আর । পা বাড়িয়ে দরজায় এসে আরেকবার পিছনে তাকালাম । সবকিছু ঠিকঠাক, শুধু ওর চোখের নিচে কালো দাগ টাই স্পষ্ট হয়ে আছে ।

গল্প : জীবনের এপিঠ-ওপিঠ
#অনুগল্প

01/02/2025

মনোবিজ্ঞানী দের মতে, পরিবারের সবচেয়ে হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি মা বা বাবা নয়, বরং বড় মেয়ে!💔

 #প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ) #সাইয়্যারা_খান #পর্বঃ৭০আকাশে আজ গোল চাঁদ উঠেছে। আশেপাশে কোন তারা নেই। পুকুরের পানিতে জ্বলজ...
31/01/2025

#প্রেমসুধা(দ্বিতীয় পরিচ্ছেদ)
#সাইয়্যারা_খান
#পর্বঃ৭০

আকাশে আজ গোল চাঁদ উঠেছে। আশেপাশে কোন তারা নেই। পুকুরের পানিতে জ্বলজ্বল করছে চাঁদের প্রতিচ্ছবি। তাকাতেই যেন চোখে বিঁধে তীক্ষ্ণ সূচের ন্যায়। এই মাঝরাতে বারান্দার থাই খুলে বসে আছে তৌসিফ। বাইরে কিছুই দেখা যাচ্ছে না তেমন৷ ঘাটে পানি দেয়া হয়েছিলো এই দুই মাস। পৌষ'র খুব পছন্দ। তৌসিফ ভেবেছে বসার জায়গার চারপাশ ঢেকে দিবে। কৃষ্ণচূড়ার জন্য সামনের রাস্তা থেকে সরাসরি কেউ দেখতে পায় না। তবুও তৌসিফ চাইছে না এই সময় কেউ দেখুক পৌষ'কে। যদি নজর লেগে যায়? তৌসিফে'র মনের ভেতর এখন আতঙ্ক ঢুকেছে। তার মস্তিষ্ক তাকে বারংবার খুঁচিয়ে মনে করিয়ে দিচ্ছে ডাক্তারের বলা কথাটা, "বাইশ বছরের গর্ভবতী মেয়ে ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়তে চেয়েছিলো"। তৌসিফে'র বুক কেমন চিলিক দিয়ে উঠে কথাটা ভাবলেই। মুড সুইং কি সত্যি এত তীব্র হয়? পৌষ তো এমনিতেই এলেমেলো ধরণের ছুটন্ত এক মেয়ে। ওর এলোমেলো ভাব শায়েস্তা হয় শুধু মাত্র যখন তৌসিফ কঠিন হয়। এখন তৌসিফ নিজের কলিজা কেটে ফেললেও কঠিন হতে পারবে না৷ সে পারছে না। মনটা আজ সন্ধ্যা থেকে নরম হয়ে আছে। চাইলেও যদি পুরোপুরি ভাবে পিতৃত্ব ভাব বা অনুভূতি জাগ্রত হচ্ছে না যা হচ্ছে তা পৌষ'র আর আগত সন্তানদের জন্য মাথা কিলবিল করা চিন্তা। বলা হয় পুরুষের কোলে যেই পর্যন্ত সন্তানের অস্তিত্ব না আসে সেই পর্যন্ত তাদের পিতৃতান্ত্রিক সত্তা নাকি জাগ্রত হয় না৷ তৌসিফ অবশ্য অনুভূতি গোছাতে পারছে না। মনে হচ্ছে দুই হাতে সবটা আগলাচ্ছে আর এদিক ওদিক দিয়ে জোছনার আলোর মতো তা বেরিয়ে যাচ্ছে। আজ পর্যন্ত এই দশা কখনো হয়েছে তৌসিফে'র? উহু, একদমই না। সে যথেষ্ট শক্তপোক্ত এক পুরুষ। তার ধাঁচে নেই নরম স্বভাব। মা বাদে কখনো নরম হয় নি কারো সামনে। পিয়াসী'কে অতিরিক্ত ভালোবেসে তার কদমে কদমে ফুলের গালিচা বিছাতে রাজি ছিলো তৌসিফ। সে নিজের ভালোবাসা দিয়েছে, ছুটেছে টাকার পিছনে কিন্তু সেই সাথে ছুটেছিলো তার অগাধ আস্হা, নিজের ভালোবাসা প্রতিই তার বিশ্বাস ছিলো না। পিয়াসী থেকে সে বারকয়েক মিনতি করেছিলো সন্তানের। জানা নেই কিন্তু ছোট্ট জান তার খুব ভালো লাগে। এই যে হেমন্তের ছেলেটা দেখলেই বুক জুড়িয়ে যায়। ইনি-মিনি'কে কখনো শালী লাগে না বরং বাচ্চা মনে হয়। কেমন আদর আদর মুখ।
তারও খুব শখ কেউ আসবে তার জন্য হাত ভর্তি করা নরম আদর নিয়ে। মুখ ভরা লালা নিয়ে কেউ ছোট্ট শব্দে ডাকবে। একদম অস্পষ্ট, জড়তায় ভরপুর। মুখের ভাষায় হাজার দূরত্ব থাকলেও তৌসিফ কথা বলবে মনের ভাষায়। বড় বড় চোখে যখন তাকিয়ে থাকবে তৌসিফ তখন নিজেকে দেখবে সেই চোখের মাঝে। ভাবা যায়, নিজের অংশের মধ্যে নিজের প্রতিচ্ছবি দেখা! কত বড় আশ্চর্যের ব্যাপার। তৌসিফে'র তো ভাবতেই গায়ের লোম দাঁড়িয়ে যাচ্ছে।
পৌষটাকে সে পৌষ মাসের মতোই ভালোবাসে। কোনদিন অবশ্য ভাবে নি নিজের থেকে এত ছোট মেয়ের প্রেমে সে পড়বে। বেয়াদব ধাঁচের, বাঁচাল এক মেয়ে। উড়নচণ্ডী অথচ কাঁদুনে। শক্ত অথচ দূর্বল। এ যেন কোন অদ্ভুত মানবী। এমন না সে খুব সুন্দর। না তেমন কোন বিশেষত্ব আছে। যা আছে তার সবটা হলো কাঁচের ন্যায় ফকফকা এক মন। সেই মন দিয়ে সবাইকে সে কাছে টানে। সেভাবেই টেনেছিলো তৌসিফ'কে। তৌসিফ বরাবরই সংসার চেয়েছে। সংসারী বউ সে পেয়েছে। শুরুতে তার মনে ভালোবাসা তো দূর পৌষ'র জন্য ভিন্ন কোন জায়গাও ছিলো না। ফুপির রেখে যাওয়া ছোট্ট একটা আমানত আর বাবা'র মুখের কথা। সবটা রাখতেই যেন হাত বাড়ালো পৌষ'তে। হাতের মুঠোয় আসতেও সময় অবশ্য লাগে নি কিন্তু মন বিনিময়, সে এক জন্ম-জন্মান্তরের কাহিনি। কিভাবে যে তৌসিফে'র মতো মানুষটা প্রেমে পড়লো তা যেন আজও রহস্য।
মাঝেমধ্যে তৌসিফ শক্ত হয়ে যায় নাহয় এই পৌষ বিগড়াবে। তৌসিফ তা হতে দিবে না৷ প্রশ্নই উঠে না৷ চোখে চোখে রাখে সে তার পৌষরাত'কে। বুকের ভেতর খোলা খাঁচায় বন্দী সে পাখি। মন চাইলে উড়াল দেয় আবার সন্ধ্যা হতেই ফেরত আসে। এখন থেকে ডানার নিচে দুটো ছানা নিয়ে সে ফেরত আসবে এই হৃদকুঠুড়িতে। তৌসিফ তখন আগলে নিবে। সামলে নিবে।

-- হয়েছে।

পৌষ'র বলা শব্দে তৌসিফ পেছনে ঘুরলো। ক্ষুধা লাগায় পৌষ একাই উঠেছিলো। তৌসিফ উঠেছে নিজ থেকে। খেতে খেতেই পৌষ বললো তার অস্থির লাগছে তাই বারান্দার থাই খুলতে এসেছিলো তৌসিফ অথচ কিভাবে যেন গভীর ধ্যানে আটকা পরলো।
পা বাড়িয়ে ভেতরে এসেই জিজ্ঞেস করলো,

-- খেলে না যে?

-- বাসি হয়ে গিয়েছে।

তৌসিফ কপাল কুঁচকালো। নাকের সামনে নিয়ে শুঁকে দেখলো। নাহ! ভালোই তো। তৌসিফ জানালো,

-- ইটস টোটালি ফ্রেশ হানি। বুয়া রাতেই রেঁধেছে।

-- টক টক লাগে কেন তাহলে?

তৌসিফ এক চামচ মুখে দিলো। বললো,

-- কোথায়? ঠিকই আছে।

-- ওহ আচ্ছা।

তৌসিফ এবার যেন বেশ অবাক হলো। এত সহজে মেনে নিলো? এত সহজ তো তার পৌষরাত না। তবে কি ওর মুড সুইং হচ্ছে? তৌসিফ ওর গা ঘেঁষে বসলো। গালে হাত রেখে বললো,

-- অন্য কিছু খাবে?

-- কি খাব?

-- যা মন চায় বলো।

পৌষ কিছুক্ষণ ভাবলো। ভাবতে ভাবতেই ঝুমতে লাগলো। তৌসিফে'র কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে চুপ করে রইতেই তৌসিফ ওর মাথায় হাত রাখে। মেয়েটা এত শান্ত হলো কেন? তৌসিফ কখনোই চায় নি পৌষ শান্ত হোক। তার ঘরময় ছড়িয়ে থাকা এক শান্তি এই পৌষ। সে চুপ করে গেলে কিভাবে হবে?

________________

তৌসিফ সাইডে এসেছে কাজে। ঘড়িতে এখন ঠিক তিনটা বেজে দুই মিনিট। বারবার হাত ঘড়ি দেখছে তৌসিফ। ইমু বিষয়টা লক্ষ করলো। ফাইল গুছিয়ে জিজ্ঞেস করলো,

-- স্যার কোন সমস্যা?

-- হ্যাঁ।

ইমু হকচকালো। বললো,

-- কোন ফাইলে? আমি দুইবার চেক করেছিলাম। বাফারিং টাইম তো আছে। আবার দেখব একবার?

তৌসিফ কপাল কুঁচকে তাকালো। ইমু ভ্যাবাচেকা খেয়ে গেলো। বুঝলো না সে ভুল কি হলো। তৌসিফ পানির বোতলটা হাতে নিয়ে ঢকঢক করে পানি গলায় ঢাললো। ফোনটা হাতে নিয়ে বললো,

-- সময় দেখেছো? তিনটা তিন বাজে। বাসায় থাকা দরকার ছিলো আমার এখন। তোমার ম্যাডাম একা আছে। এমনিতেই আজকাল চুপচাপ থাকছে। না জানি কপালে কি আছে আমার।

বলেই তৌসিফ ফোঁস করে শ্বাস ফেললো। ইমু কোন কথা ব্যাক্ত করার অবস্থায় নেই। স্যার কখনোই এভাবে কথা বলে না। বউ নিয়ে কথা তো দূরের বিষয় সেখানে বউ নিয়ে চিন্তা করছে ইমু'র কাছে। ইমু'র কষ্ট লাগলো। সে তৌসিফ'কে দেখেছে বিভিন্ন ধাপে। ভাঙলেও মচকায় না তৌসিফ। শক্ত ধাতুর মনে হয় তাকে কিন্তু এবার তার ভাব ভিন্ন। হয়তো সে বদলাচ্ছে। মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল সেখানে তৌসিফে'র পরিবর্তন তার চোখে পড়ছে।

তৌসিফ দুপুরেও খেলো না। আজ পৌষ'র শেষ পরীক্ষা। সেমিস্টার গ্যাপ থাকবে এখন। তৌসিফ লক্ষ করে দেখেছে এই একটা মাস মেয়েটা পড়ায় মন দিয়েছিলো। প্রথম পরীক্ষা খারাপ হওয়ায় নাকি অন্য কোন কারণ তা তৌসিফ বুঝতে পারে না। তৌসিফ বাসায় ঢুকলে তার বই হাত ছাড়া হয়েছে। এরমধ্যে অবশ্য নতুন এক বুয়া রেখেছে তৌসিফ। তার কাজ শুধু পৌষ'র খেয়াল রাখা যদিও পৌষ মতবিরোধ করেছে। তার পছন্দ হচ্ছে না কেউ সারাক্ষণ চোখে চোখে রাখুক তাকে। তৌসিফ শোনে নি। পৌষ কি জানে তাকে তৌসিফ এমনিতেও চোখে চোখে রাখে?

বাসার রাস্তায় না গিয়ে তৌসিফ সোজা গেলো ডাক্তারের কাছে। ডাক্তারটা ভালো অবশ্য। দুই দিন পরপরই তৌসিফ ছুটে আসে। নানান রং বেরং এর প্রশ্ন তার। পৌষ নতুন কোন আচরণ করলেই তার ছুট হয় হাসপাতালে। ডাক্তার বিরক্ত হন না বরং মুচকি হাসেন প্রতিবার এবারও তৌসিফে'র প্রশ্নে তিনি মৃদু হাসলেন। বললেন,

-- তুমি কি চাইছো তোমার বউ চিৎকার চেঁচামেচি করুক?

তৌসিফ যেন চমকে উঠে। হ্যাঁ। এটাই। হয়তো ও এটাই চাইছে তৌসিফ। শুক্র-শুক্রে আট দিন পৌষ থমথমে মুখ করে থাকে। নাম মাত্র কথা তার। তৌসিফ ঐ দিকে শ্রেয়া'কে দিয়ে ফোন দেয়ালো। পৌষ হু হা বলে রেখে দিলো। সে নাকি ঘুমাবে অথচ তৌসিফ দেখলো ও মিনু'র সাথে বসে আছে। বাড়ীতে গেলেও কথা নেই। আগের মতো হৈ চৈ করে না৷ জ্বালাতন তো দূরের কথা দুষ্টামির দ ও করছে না ও। এমন কেন হবে? কে বলেছে ওকে ম্যাচিউর হতে? তৌসিফ বলেছে? তৌসিফ কি পা'গল? তার তোতাপাখি চুপ, তৌসিফে'র তো মনে হয় তার দুনিয়াই স্তব্ধ হয়ে আছে। কেন সে চুপ থাকবে। সে তো তোতাপাখি। পাখির বুলি কেন থামবে? ডাক্তারের কাছে আজ আসার কারণই হলো দিনদিন পৌষ চুপ করে যাচ্ছে। গত তিনদিন ও ঠিকমতো ত্রিশটা শব্দ বলেছে কি না সন্দেহ।

ডাক্তার তৌসিফে'র দিকে তাকালো। এত সুন্দর উচা লম্বা সিনা টানটান পুরুষটার চেহারায় চিন্তার ছাপ। সে যে সত্যিই কতটা মানুষিক ভাবে চিন্তিত তা বলার অবকাশ রাখে না। তপ্ত শ্বাস ফেলে ডাক্তার বললেন,

-- তৌসিফ, কয় মাস চলছে?

-- পাঁচ মাস দুই দিন।

-- বাহ। ঘন্টাও গুনো নাকি?

-- যদি ঐ দিন সন্ধ্যা ধরি তাহলে পাঁচ মাস দুই দিন উনিশ ঘন্টা।

ডাক্তারের এবার সত্যিই মায়া হলো। লোকরা উদগ্রীব হয়ে আছে। চোখে মুখে প্রশ্ন ছড়িয়ে ছিটিয়ে। ডাক্তার বললো,

-- আমি তোমার কথা বুঝতে পারছি তৌসিফ। চুপচাপ হয়েছে। এটা তেমন কোন ফ্যাক্ট না।

-- একদমই কথা বলছে না। ওর চালচলন দেখেই বুঝি ইচ্ছে করে করছে।

-- ঝগড়া হয়েছে?

-- না। ওর সাথে আমার ঝগড়া হয় না।

-- বেবি প্ল্যান্ড ছিলো না?

-- ছিলো। আমি খুব করে চাইতাম। আমার চাওয়া দেখে ও নিজেও চাইতো।

-- তাহলে শুনো মনোযোগ দিয়ে। এখানে ও দুই কারণে হয়তো চুপ আছে। কারণ দুটো খুবই ছোট এবং স্বাভাবিক। এক হলো, নতুন মা হচ্ছে। এই প্রথম। শারীরিক, মানসিক পরিবর্তন গুলো মানাতে পারছে না৷ দুটো বাচ্চা ক্যারী করছে। ও যথেষ্ট পারফেক্ট এরজন্য। এই যে প্রথম মা হচ্ছে এটা হয়তো রিয়েলাইজ করতে ওর টাইম লাগছে। নিজের ভেতরের অস্তিত্বটাকে মেনে নিচ্ছে ধীরে ধীরে। তুমি বাইরে থেকে যা ফিল করো তা ওর ভেতরে বেড়ে উঠছে। ওর মানুষিক দিকটা দেখতে হবে এখানে। অনেকটা ইমোশনাল ব্যাপারটা।
দ্বিতীয় যেটা সেটা অনেকটা সিলি বুঝলে? ও হয়তো তোমাকে জ্বালাতন করতে চাইছে না। ভাবছে তুমি ওর এলোমেলো কষ্ট বা অনুভূতি দেখে নিজে হয়তো গিল্ট ফিল করবে তাই সবটা লুকিয়ে রাখছে।

ডাক্তার দেখলো তৌসিফ মাথা নিচু করে বসে আছে। তিনি ডাকলেন,

-- তৌসিফ?

-- জ্বি।

-- বুঝেছো?

-- হ্যাঁ কিন্তু...

-- কিন্তু?

-- ও তো চুপ থাকার মানুষ না।

ডাক্তার এবার শব্দ করে হাসলেন। বললেন,

-- বাসায় যাও বাবা। ওকে টাইম দাও। একা সময় কাটাও। বাইরে ঘুরে এসো। বেশি জার্নি না অবশ্য। মাঝেমধ্যে নিজেদের সুবিধা বুঝে এক হও । ও স্ট্রেস ফ্রী মানেই বাচ্চারা সুস্থ। আর হ্যাঁ, এখন বমি হয়?

-- এই দুই মাসে একবারও হয় নি আর।

-- আচ্ছা। তবে এইক্ষেত্রে শেষ দিকে বমি শুরু হতে পারে।

তৌসিফ যেন ভদ্র ছাত্রের মতো সবটা বুঝলো। বাইরে এসে গাড়িতে উঠে আবার নামলো। দুটো ভিক্ষুক দেখেই তাদের কাছে এগিয়ে গিয়ে কিছু দান করলো। নোংরা জামা পরা ছোট্ট বাচ্চাটার গালে হাত দিয়ে আদর দিয়ে কচকচা একটা নোট দিলো। বাচ্চাটা হাসলো। সে টাকা চিনে। তৌসিফ গাড়িতে উঠতে উঠতে চাইলো আকাশপানে। বিরবির করে বললো,

-- এর প্রতিদান আমার স্ত্রী-সন্তানদের দিও আল্লাহ।
বাসায় এসে তৌসিফ ঘুমন্ত অবস্থায় পেলো পৌষ'কে। মুখ হাত ধুতে গিয়ে গোসলই করে ফেললো। পৌষ'র কপালে হাত বুলিয়ে গালে ঠোঁট ছোঁয়ালো। এগিয়ে এসে পেটে হাত রাখলো। দুটো বাবু থাকাতে পাঁচ মাসেই পেটটা বেশ বড় হয়েছে। তৌসিফ পেটে হাত রেখে থম ধরে বসে রইলো। ওর গলা ধরে এলো। আস্তে ধীরে তৌসিফ বললো,

-- তোমারা কি জানো তোমাদের পাপা চিন্তায় আছে?

অপেরপাশ নিশ্চুপ। তৌসিফ আবার বললো,

-- আজকের ডিল ফাইনাল বাবারা কিন্তু পাপা কাজে মন দিতে পারি নি। তোমাদের আম্মু কেমন শক্ত আচরণ করছে আমার সাথে। সে কথাবার্তা বলছে না অথচ শান্তি প্রিয় মানুষ আমি অথচ বছর খানিক সময় ধরে তোমাদের আম্মুর কথা ছাড়া আমি চলতে পারি না। আমার বুকটা খালি খালি লাগে। মনে হয় দম আটকে যাবে আমার। তোমাদের আম্মু এটা কেন করছে? আমার দোষ কোথায়? আমি সাফার করছি।

তৌসিফ চুপ করে গেলো। তার গলা দিয়ে কথা বের হচ্ছে না। মনে হচ্ছে কেউ চেপে ধরেছে। আচ্ছা, বাবা হওয়া এত কষ্ট কেন? পেটে না রেখেও তৌসিফ কেমন দূর্বল হয়ে গেলো। এমন কি কখনো ছিলো তৌসিফ যে কথা বলার আগে চোখে পানি জমা হবে? গলা ধরে আসবে? কেন হচ্ছে? ভালোবাসা নামক মন্ত্রে কি এমন জাদু আছে যা বশবর্তী করে ফেললো শক্ত পুরুষটাকে। তৌসিফ ওখানেই মাথা রাখলো। চোখ বুজলো।
চোখটা তখন হয়তো মাত্র লেগে আসবে তৌসিফ মাথায় কারো হাত টের পায়। ধীরে ধীরে শব্দ আসে কানে,

-- উঠুন। এখানে কেন ঘুমিয়েছেন?

তৌসিফ চোখ খুলে মাথা তুললো। পৌষ আস্তে করে জিজ্ঞেস করলো,

-- খেয়েছেন?

তৌসিফ মাথা নাড়ে। পৌষ উঠতে চাইলেই তৌসিফ আস্তে করে পেছন থেকে সাপোর্ট দিলো। পৌষ নিজে নিজে মুখে পানি দিয়ে এলো। বললো,

-- চলুন। আমারও ক্ষুধা লেগেছে।

-- তুমি খাও নি?

পৌষ মাথা নেড়ে বলে,

-- নামাজ পড়তেই এত ঘুম এলো।

বলেই বেরিয়ে গেলো। তৌসিফে'র রাগ গিয়ে পড়লো নতুন বুয়ার উপর। তার দায়িত্ব ছিলো পৌষ'কে ঠিক সময়ে খাওয়ানো।

#চলবে..

Address

Dhaka
Tangail

Website

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Bindas Life posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Videos

Share