07/01/2025
কিয়ানু চার্লস রিভস। এই ভদ্রলোক পৃথিবীর যে-কোনোকিছুই কেনার ক্ষমতা রাখেন; কিন্তু, প্রতি ভোরে ঘুম থেকে জেগে, তিনি একমাত্র তাই ছুঁতে ছোটেন, যা, কেনা যায় না।
অভিনেতা, চলচ্চিত্র পরিচালক, প্রযোজক, এবং সঙ্গীতশিল্পী কিয়ানু চার্লস রিভস, নিউইয়র্কের একটি ক্লাবে নির্ধারিত সময়ের কুড়ি মিনিট দেরিতে পৌঁছলেন। ক্লাবটিতে যে-পার্টিটা চলছে, সেটি তাঁর নতুন মুভি'র প্রতি উৎসর্গ করা। ক্লাবের বাইরে, অঝোর বৃষ্টির নিচে, দাঁড়িয়ে আছেন তিনি, চুপচাপ। ভিতরে যেতে দেওয়া হচ্ছে না তাঁকে, সিকিউরিটি গার্ডরা চিনতে পারেনি। এর ক'দিন পরে, ক্লাবটির মালিক বলেছিলেন— "আমি জানতামই না কিয়ানু ক্লাবের বাইরে দাঁড়িয়ে আছেন, কবে তাঁকে ভিতরে প্রবেশের অনুমতি দেবে কেউ সে-আশায়! কাউকেই তিনি পরিচয় দেননি।"
কিয়ানু। চিরকাল যাতায়াত করলেন গণপরিবহনে চড়ে, সময়ে ঝুলেঝুলে। রাস্তার ধারে ভিক্ষে করছে ঘরবাড়িহীন কোনো নিঃস্ব, কিয়ানু তার পাশে গিয়ে বসে থেকেছেন, গল্প করেছেন, উঠে আসার আগে দুখী মানুষটির মুঠোয় গুঁজে দিয়েছেন অপ্রত্যাশিত পরিমাণের অর্থের নোট। কেউ জানে না, কে এই লোক? আপনি যদি তাঁকে চিনে থাকেন, প্রায়ই আপনার চোখে পড়বে— পার্কের বেঞ্চিতে বসে হটডগ চিবুচ্ছেন তিনি, অপরিচিত বুড়োবুড়ি-শিশুদের হলাহলের পাশে।
কিয়ানু। দুনিয়ার বিস্ময়কর চলচ্চিত্র 'দ্য ম্যাট্রিক্স'-এর একটি সিক্যুয়েল শেষে, চলচ্চিত্রটির প্রত্যেক স্টান্টম্যানকে একটি করে মোটরবাইক কিনে দিয়েছিলেন। তাঁকে বলতে শুনেছিলাম আমরা— "এঁদের স্কিলই, এই মুভির প্রাণ।"
'দ্য ম্যাট্রিক্স'-এর কস্টিউম ডিজাইনার ও কম্পিউটার সায়েন্টিস্টদের বেতন তাঁর কাছে মনে হয়েছিলো— চলচ্চিত্রটির উত্তুঙ্গ জনপ্রিয়তা এবং এর নেপথ্যে ওই উল্লিখিত ব্যক্তিদের মেধা ও শ্রমের তুলনায় যথার্থ নয়। অতএব, সেই মুভি থেকে প্রাপ্ত তাঁর পারিশ্রমিকের সিংহভাগ তিনি তুলে দিয়েছিলেন এঁদের হাতে।
তাঁর মুভি 'দ্য ডেভিল'স অ্যাডভোকেট'-এ কিংবদন্তী অভিনেতা আল পাচিনোকে আমন্ত্রণের খরচ যোগাতে, তিনি কমিয়ে ফেলেছিলেন নিজের বেতন।
'দ্য লেক হাউজ' চলচ্চিত্রটায় অভিনয়ের সময়, দু'জন কস্টিউম সহকারীর আলাপ তাঁর কানে এসেছিলো ফিসফাসে, যাদের একজন কাঁদছিলো হুহু করে, পরদিন কুড়ি হাজার ডলার শোধ করতে না-পারলে ঋণের ঘরটি হারিয়ে পরিবার নিয়ে পথে বসতে হবে বলে। সেই পরদিন, লোকটির ব্যাংক অ্যাকাউন্টে টাকাটি জমা হয়ে গিয়েছিলো। হ্যাঁ, কিয়ানু রিভস।
প্রত্যেকেই মানুষ হিসেবে জন্মায়, কিন্তু মানুষ হয়ে বেঁচে থাকতে পারে— অল্প ক'জন।
১৯৬৪'র সেপ্টেম্বরের ২ তারিখ জন্মেছিলো শিশুটি। বয়স যখন তিন বছর, বাবা পরিত্যাগ করলো তাকে। এরপর, ছেলেটি বড়ো হয়েছিলো তিনজন সৎপিতার ভিন্ন তিন বাড়িতে। ছেলেটির ডিসলেক্সিয়া। তার স্বপ্ন ছিল হকি প্লেয়ার হওয়ার, যে-স্বপ্ন চুরমার হয়ে যায় মারাত্মক একটি দুর্ঘটনায় প্রায় মৃত্যুর মুখোমুখি পড়ে যাওয়ার ফলস্বরূপ। জন্মমুহূর্তেই তাঁর কন্যাশিশু মারা যায়। ক'দিন পরেই মারা যান সেই কন্যার মা, গাড়ি-অ্যাক্সিডেন্টে। প্রায় একই সময়ে মারা যান তাঁর প্রাণের বান্ধব, সুখদুঃখের সাথী— রিভার ফিনিক্স। তাঁর বোনের শরীরে ধরা পড়ে লিউকেমিয়া।
ভেঙ্গে পড়েননি কিয়ানু। বোনের চিকিৎসা চলাকালীন ওই দীর্ঘ সময়ে, কোনো চলচ্চিত্রেই অভিনয় করলেন না তিনি, বসে থাকতেন বোনের বিছানার পাশে। একদিন, বিখ্যাত 'দ্য লিউকেমিয়া ফাউন্ডেশন' গড়ে তুললেন কিয়ানু, বোনের চোখের ভিতরের বেদনা বুকের ভিতরে বয়ে; যে-ফাউন্ডেশনে নিয়মিত অর্থ যোগান দেওয়ার প্রয়োজনে আজও অভিনয় করে চলেন লোকটি। শুধুমাত্র 'দ্য ম্যাট্রিক্স' মুভির আয় থেকেই, সাড়ে সাত কোটি মার্কিন ডলার দান করেছেন কিয়ানু, বিভিন্ন হাসপাতালে, এবং অন্যান্য চ্যারিটিতে, মানুষের জন্য।
বডিগার্ড? নেই। বিলাসবহুল একটি বাড়ি? না, নেই। নিউইয়র্ক শহরের রাস্তায়, সাবওয়েতে, গণপরিবহনে, আজও আপনি দেখতে পাবেন, দুনিয়ার দুর্ধর্ষ এক চলচ্চিত্র অভিনেতাকে, মিলিয়োনিয়ার, তীব্র প্রতিভাধর, ঝুলছেন গাড়ির ভিতরে দাঁড়িয়ে, হাঁটছেন ফুটপাত ধরে, পৃথিবীর মানুষকে দেখছেন তিনি, দেখছেন মানুষের বিচিত্র জীবনগুলোকে, অবাক দৃষ্টিতে, জলভরা চোখে। হ্যাঁ, তিনি কিয়ানু রিভস। ইচ্ছে করলেই যিনি জগতের সবচেয়ে দামী প্লেনটি কিনে পৃথিবী ঘুরতে পারেন।
২০১০ সাল। কিয়ানু'র জন্মদিন। ফুটপাত ধরে হাঁটতে-হাঁটতে, একটি ছোট্ট বেকারির সামনে এসে, ঢুকে পড়লেন তিনি। কিনলেন ছোট্ট একটি পেস্ট্রি-বান, এবং একটি মোমবাতি। মোমবাতিটি বানের উপরে বসিয়ে, বেকারি থেকে বেরিয়ে, সামনের ফুটপাতে দাঁড়িয়ে তৃপ্তি নিয়ে খেলেন। এবং, তাঁকে চিনতে পেরে যে-ই দাঁড়িয়ে হাত বাড়ালো করমর্দনের কিংবা সামান্য হাই-হ্যালোর ইচ্ছেয়, প্রত্যেককেই এক কাপ করে কফি পানের অনুরোধ করলেন তিনি। অথচ, সেদিন দুনিয়ার সব মিডিয়া জুড়ে তাঁর জন্মদিন পালিত হচ্ছে হইহল্লায়, তাঁর ঘরে গণমাধ্যমকর্মীদের ভিড়। তিনি নেই। ফুটপাত ধরে হাঁটছেন, মানুষের বুকের ধার ঘেঁষে।
১৯৯৭ সালের এক সকালে, লস এঞ্জেলেসের একজন ফটোসাংবাদিক একটি আকস্মিক ছবি তুলে হইচই ফেলে দিয়েছিলো— দুনিয়া-কাঁপানো অভিনেতা কিয়ানু রিভস মাফলারে মুখটি ঢেকে রেখে একজন গৃহহীন লোকের পাশে বসে খাচ্ছেনদাচ্ছেন, গল্প করছেন, হাসিঠাট্টায় মেতে রয়েছেন, ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে!
মাঝেমাঝে, খুব ভাগ্যবান হোন যদি, আপনি সেইসব মানুষের সাক্ষাৎ পাবেন, যাঁরা বুকের ভিতরে তীব্র ভাঙন নিয়ে বেঁচে আছেন, এবং বেঁচে আছেন দুনিয়ার অন্য কাউকেই অমন ভাঙনের মুখে পড়তে না-দেওয়ার তীব্র বাসনায়। তাঁরা ভাঙাচোরা মানুষ, তাঁরা মানুষের জন্য ছুটতে থাকা মানুষ।
কিয়ানু চার্লস রিভস। এই ভদ্রলোক পৃথিবীর যে-কোনোকিছুই কেনার ক্ষমতা রাখেন; কিন্তু, প্রতি ভোরে ঘুম থেকে জেগে, তিনি একমাত্র তা-ই ছুঁতে ছোটেন, যা, কেনা যায় না।
পোষ্টটি ভাল লাগলে পেজে ফলো দিবেন আশাকরি।