Shaik Usman bin Rashid

Shaik Usman bin Rashid আকিদায় আশ'আরি, মাতুরিদী।
মাযহাব "ফিক্বহে হানাফি" অনুসারি।

কুরআন কারীমে তাক্বলীদের বৈধতা: শায়খ আব্দুর রহমান বিন মুআল্লা (হাফিঃ)-এর ব্যাখ্যা👨‍🏫তাক্বলীদের বৈধতা নিয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ আ...
01/02/2025

কুরআন কারীমে তাক্বলীদের বৈধতা: শায়খ আব্দুর রহমান বিন মুআল্লা (হাফিঃ)-এর ব্যাখ্যা👨‍🏫

তাক্বলীদের বৈধতা নিয়ে কোনো বিশেষজ্ঞ আলিমগণ কখনোই দ্বিমত পোষণ করেননি। কেবলমাত্র কিছু অজ্ঞ ব্যক্তিরা—যারা মাযহাবের প্রতি বিদ্বেষী মনোভাব ধারণ করেন—তাঁরাই তাক্বলীদকে অস্বীকার করেছেন। অথচ আরব বিশ্বের বড় বড় ওলামাগণ কুরআন কারিমের আয়াতের মাধ্যমে তাক্বলীদের বৈধতা প্রমাণ করেছেন।

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা ইরশাদ করেন:

فَاسْأَلُوا أَهْلَ الذِّكْرِ إِنْ كُنْتُمْ لَا تَعْلَمُونَ

যদি তোমরা না জানো, তাহলে যারা জানে তাদের কাছে জিজ্ঞাসা করো।
(সুরা নাহল: ৪৩)

অত্র আয়াতের ব্যাখ্যায় শায়খ আব্দুর রহমান বিন মুআল্লা আল-লুওয়াইহিক (যিনি ১৩৮৪ হিজরিতে সৌদি আরবের রিয়াদে জন্মগ্রহণ করেন) তিনি বলেন—

لم تختلف العلماء ان العامة عليها تقليد علمائها. و انهم المرادون بقول الله عزوجل: {فأسئلوا اهل الذكر ان كنتم لا تعلمون

সর্বসাধারণের জন্য তাদের আলেমদের তাক্বলীদ করা আবশ্যক—এ বিষয়ে ওলামাগণের মধ্যে কোনো দ্বীমত নেই। আর তারা নিশ্চিতভাবেই আল্লাহর এই বাণী: 'তোমরা জ্ঞানীদের কাছ থেকে জেনে নাও যদি না জানো'—এর আওতাভুক্ত।
(ক্বাওয়ায়েদ ফিত-তা'আমিল মা'আল উলামা: ৪৬)

তাক্বলীদের প্রকৃত অর্থ🎙️

তাক্বলীদ মানে এই নয় যে, কোনো প্রমাণ ছাড়া অন্ধভাবে কারো কথা মেনে নেওয়া। বরং, এটি এমন ব্যক্তির অনুসরণ করা, যিনি হকপন্থী—এমন প্রবল ধারণা অথবা ইজমার ভিত্তিতে, যদিও দলিল স্বতন্ত্রভাবে দেখা হয়নি। তবে এটি কোনো প্রমাণবিহীন বক্তব্যের অনুসরণকে নির্দেশ করে না, কারণ প্রমাণহীন বক্তব্যের বক্তা কখনো হকের ওপর থাকতে পারে না।

ইসলাম প্রমাণবিহীনভাবে অজ্ঞাত কোনো ব্যক্তির অন্ধ অনুসরণকে সমর্থন করে না। বরং, তাক্বলীদ হলো- যোগ্য ও বিশ্বস্ত আলিমদের অনুসরণ করা, যাদের ইসলাম সম্পর্কে গভীর জ্ঞান রয়েছে। যারা কুরআন ও হাদিসের ব্যাখ্যায় দক্ষ এবং ইজতিহাদের যোগ্যতা অর্জন করেছেন। অপরদিকে যারা ইজতিহাদ করার সক্ষমতা রাখেন না এবং শরীয়তের গভীর মাসআলা নির্ধারণে স্বতন্ত্রভাবে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, তাদের জন্য অভিজ্ঞ আলিমদের ব্যাখ্যা অনুসরণ করা আবশ্যক। এই প্রক্রিয়াকেই তাক্বলীদ বলা হয়।
(হুসামী ফি শারহিন নামী ১৯০)

কুরআন কারীমে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা বান্দাদেরকে তাক্বলীদ করার নির্দেশ দিয়েছেন। এ প্রসঙ্গে তিনি ইরশাদ করেন:

وَ اِذَا جَآءَهُمۡ اَمۡرٌ مِّنَ الۡاَمۡنِ اَوِ الۡخَوۡفِ اَذَاعُوۡا بِهٖ ؕ وَ لَوۡ رَدُّوۡهُ اِلَی الرَّسُوۡلِ وَ اِلٰۤی اُولِی الۡاَمۡرِ مِنۡهُمۡ لَعَلِمَهُ الَّذِیۡنَ یَسۡتَنۡۢبِطُوۡنَهٗ مِنۡهُمۡ ؕ وَ لَوۡ لَا فَضۡلُ اللّٰهِ عَلَیۡكُمۡ وَ رَحۡمَتُهٗ لَاتَّبَعۡتُمُ الشَّیۡطٰنَ اِلَّا قَلِیۡلًا

আর যখন তাদের কাছে শান্তি বা ভীতিকর কোনো সংবাদ পৌঁছায়, তখন তারা তা প্রচার করে। অথচ, যদি তারা সেটি রাসূল (সা.) এবং তাদের মধ্যে কর্তৃত্বের অধিকারী (উলুল আমর)দের কাছে পৌঁছে দিত, তবে অবশ্যই তাদের মধ্যে যারা ইজতিহাদের সক্ষমতা রাখে, তারা সেটির সত্যতা অনুধাবন করত। আর যদি আল্লাহর অনুগ্রহ ও দয়া তোমাদের উপর না থাকত, তবে তোমরা অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই শয়তানের অনুসরণ করতে। (সুরা নিসা: ৮৩)

এই আয়াত থেকে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শরীয়তের গভীর জ্ঞান যাদের নেই, তাদের জন্য অভিজ্ঞ আলিমদের তাক্বলীদ করা আবশ্যক। তাক্বলীদ কুরআন ও সুন্নাহ-সমর্থিত একটি সুপ্রতিষ্ঠিত প্রক্রিয়া, যা মুসলিম উম্মাহর ফিক্বহী শিক্ষার ভিত্তি। প্রকৃত আলিমদের অনুসরণ ছাড়া শরীয়তের সঠিক অনুসরণ সম্ভব নয়। সুতরাং, যারা তাক্বলীদের অস্বীকার করে, তারা মূলত ইসলামের প্রাচীন জ্ঞানচর্চার ধারাকে প্রত্যাখ্যান করে, যা বিভ্রান্তির পথে পরিচালিত করে।

আল্লাহর হাত তো হাতই, প্রকৃত হাত কি?এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের সহীহ আকিদা বর্ননা করতে গিয়ে ইমাম আবূ হানীফা রহ. তাঁ...
31/01/2025

আল্লাহর হাত তো হাতই, প্রকৃত হাত কি?

এ বিষয়ে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামআতের সহীহ আকিদা বর্ননা করতে গিয়ে ইমাম আবূ হানীফা রহ. তাঁর 'ফিকহুল আকবার' কিতাবে বলেন,
وصفاته كلها بخلاف صفات المخلوقين ،يعلم لا كعلمنا ،يقدر لا كقدرتنا ، يرى لا كرؤيتنا ، يتكلم لا ككلامنا ،ويسمع لا كسمعنا ، نحن نتكلم بالآلآت والحروف ، والله تعالى يتكلم بلا حروف ولا آلة . والحروف مخلوقة ، وكلام الله تعالى غير مخلوق. وهو شئ لا كالأشياء ، ومعنى الشئ : إثباته بلا جسم ولا جوهر ولا عرض ، ولا حد له ، ولا ضد له ،ولا ند له ، ولا مثل له.

'তাঁর সকল সিফাত সৃষ্টির যেকোনো গুনাবলী থেকে মুক্ত। তিনি জানেন তবে আমাদের মত নয়। তিনি ক্ষমতাবান তবে আমাদের মত নয়। তাকে দেখা যাবে তবে আমাদের যেভাবে দেখা যায় সেভাবে নয়। তিনি কথা বলেন তবে আমাদের মত কথা বলেন না। তিনি শ্রবণ করেন তবে আমাদের শ্রবণ করেননা। আমরা বাকযন্ত্র ও অক্ষরের সাহায্যে কথা বলি, কিন্তু আল্লাহ তাআলা বাকযন্ত্র ও অক্ষরের সাহায্য ব্যতীতই কথা বলেন। কেননা হরফ হচ্ছে মাখলুক তথা সৃষ্টি। অথচ আল্লাহর তাআলার কালাম তথা কথা সৃষ্ট নয়।

তিনি আল্লাহ অস্তিত্বশীল বিদ্যমান সত্ত্বা তবে অন্য কোন জিনিস বা বস্তুর মত তিনি অস্তিত্বশীল নন। আল্লাহ তা'আলার বিদ্যমান অস্তিত্বের কোনো দেহ, কোন জাওহার (মৌল উপাদান), কোন আরায (অমৌল উপাদান), কোন সীমা, কোন বিপরীত, কোন সমকক্ষ নেই। আর তাঁর মত কিছুই নেই।'

তিনি রহ. আরও বলেন,

يد الله فوق أيديهم ليست كأيدي خلقه ليست بجارحةٍ وهو خالق الأيدي ووجهه ليس كوجوه خلقه وهو خالق كل الوجوه ، ونفسه ليست كنفس خلقه وهو خالق النفوس
'তাঁর সৃষ্টির মত তাঁর হাত নয়। এবং তাঁর হাত কোন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গও নয়। তাঁর চেহারাও কোন সৃষ্টির মত নয়। অথচ তিনিই সমস্ত চেহারার স্রষ্টা।'

[ইশারাতুল মারাম মিন ইবারাতিল ইমাম, বিয়াজি পৃ.৯৩]

ইমাম আবু হানিফা রাঃ আরও বলেনঃ

وكلُّ ما ذكرَهُ العلماءُ بالفارسيَةِ منْ صفاتِ اللهِ تعالى عزتْ أسماؤُهُ وتعالتْ صفاتُهُ فجائزٌ القولُ بهِ، سوَى اليدِ بالفارِسِيّةِ، ويجوزُ أنْ يقالَ ( بُرُوْى خُدَا) بلا تشبيهٍ ولا كيفيةٍ.

ফারসী ভাষায় আলিমগণ আল্লাহর যেসব গুণের কথা উল্লেখ করেছেন, সেগুলো ফারসীতে বলা জায়েজ। তবে ‘ইয়াদ’ (হাত) শব্দটি ফারসীতে বলা যাবে না। তবে ‘বুরুয়ে খোদা’ (আল্লাহর চেহারার শপথ) শব্দটি বলা যাবে। তবে সকল ক্ষেত্রেই এগুলোর কোন সাদৃশ্য নেই, কোন কাইফ বা ধরণ নেই।
(আল ফিকহুল আকবার ৬৫)
https://al-maktaba.org/book/6388/62

ইমাম সাহেব রহ.-এর এসব বক্তব্য থেকে বুঝা যাচ্ছে যে, কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত এসব শব্দের শাব্দিক অর্থ, এসবের হাকিকি মা'না তথা প্রকৃত অর্থে আকীদাহ পোষণ করা যাবেনা। কেননা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের বিশুদ্ধ আকীদাহ মুতাবেক আল্লাহ আযযা ওয়া জাল্লার ক্ষেত্রে দেহ, আকার-আকৃতি, সীমা-পরিসীমা, দৈর্ঘ্য-প্রস্থ সাব্যস্ত করা জায়েয নেই। আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে এসবকিছুই মুসতাহীল তথা অসম্ভব। এছাড়াও মুশাব্বিহা, মুজাসসিমা, হাশাবিয়া ও কাররামিয়াদের মত ভ্রান্ত ফিরকাহ ও বিদআতিরা মূলত এধরনের আকীদাহ পোষণ করে থাকে।

ইমাম আবুল ইসুর বাজদাবী রহ: তার তার ‘উসুলুদ্দীন’ কিতাবে লিখেছেন,
وهل يجوز اطلاق هذه الصفات بلسان سوي لسان العرب؟ بعض اهل السنة و الجماعة قالو: يجوز ذلك ولكن بشرط ان لا يعتقد انه جارحة ٬ و بعضهم احتاطوا، و قالوا: لا يجوز و هو الصحيح

অর্থ: ‘ইয়াদ’, ‘আইন’ ইত্যাদি সিফাতকে আরবী ভাষা ছাড়া অন্য কোন ভাষায় আল্লাহর জন্য সাব্যস্ত করা কি বৈধ?
আহলে সুন্নতের কিছু কিছু আলিম বলেন, এটি বৈধ। তবে শর্ত হল, এগুলো থেকে কখনও অঙ্গ বা অংশের অর্থ বিশ্বাস করবে না। আহলে সুন্নতের কেউ কেউ সতর্কতা অবলম্বন করে বলেছেন, এটি বৈধ নয়। আর এটিই বিশুদ্ধ মত।
[ উসুলুদ্দীন, আবুল ইসুর বাজদাবী রহ:, পৃ: ৩৯]

ইমাম বাজদাবী রহ: অন্য ভাষায় এজাতীয় সিফাত সাব্যস্ত করাকে নাজায়েজ বলেছেন। এবং এই মতকে তিনি প্রাধান্য দিয়েছেন।

ইমাম বাযদাবী রহ. অন্যত্র বলেন,
إثبات اليد والوجه حق عندنا معلوم بأصله متشابه بوصفه، ولا يجوز إبطال الأصل بالعجز عن إدراك الوصف بالكيف، وإنما ضلت المعتزلة من هذا الوجه.

'আল্লাহর হাত ও চেহারা সাব্যস্ত করা আমাদের নিকট মূল শব্দে জানা বিষয় কিন্তু গুণগত দিক থেকে অবোধগম্য বিষয়। গুণ ও ধরণ বুঝে না আসার কারণে মূল শব্দকে(অর্থাৎ আরবি শব্দটি) বাতিল করা জায়েয নেই। আর মু'তাযিলারা এই কারণেই পথভ্রষ্ট হয়েছিল।[উসূলুল বাযদাবী ১/১০৩- দারুল বাশায়িরিল ইসলামিয়াহ (সায়েদ বাকদাশের তাহকীক করা)]

ইমাম বাযদাবীর এই বক্তব্যের ব্যাখ্যায় ইমাম আলাউদ্দিন আব্দুল আযীয আল বুখারী আল হানাফী (৭৭৯-৮৪১) রহ. বলেন,
بل الله تعالى يوصف بصفة الوجه واليد مع تنزيهه جل جلاله عن الصورة والجارحة; لأن الوجه واليد من صفات الكمال في الشاهد; لأن من لا وجه له أو لا يد يعد ناقصا, وهو تعالى موصوف بصفات الكمال فيوصف بهما أيضا إلا أن إثبات الصورة والجارحة مستحيل, وكذا إثبات الكيفية ......

'বরং আল্লাহ তাআলা নিজের গুণ বর্ণনা করতে গিয়ে আকার-আকৃতি ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গের তানযীহ তথা নাকোচ করার সাথে চেহারা ও হাতের আলোচনা করেছেন। কেননা বাহ্যত চেহারা ও হাত পূর্ণাঙ্গ বৈশিষ্ট্য ও গুণের অন্তর্ভুক্ত। কারণ যার চেহারা ও হাত থাকেনা তাকে অপূর্ণাঙ্গ হিসেবে ধরা হয়, আর আল্লাহ তাআলা পূর্ণ গুণের অধিকারী সত্ত্বা। এই কারণে তিনি তাঁর এই দু'টি গুণের বর্ণনা দিয়েছেন। তবে এক্ষেত্রে এই উভয়ের আকার-আকৃতি ও অঙ্গ প্রত্যঙ্গ সাব্যস্ত করা (আল্লাহর গুণের ক্ষেত্রে) অসম্ভব। অনুরূপভাবে এসবের ধরণ ও প্রকৃতি সাব্যস্ত করাও অসম্ভব।[কাশফুল আসরার আন উসূলি ফখরুল ইসলাম আল বাযদাবী, আলাউদ্দীন বুখারী ১/৯৩- দারুল কুতুবিল ইলমিয়াহ, বাইরুত ]

উভয় হাত প্রশস্ত, লম্বা, দীর্ঘ ব্যবহার হয় দানশীলতা অর্থে।এখানে হাত লম্বা মানে হাতই লম্বা এটা বুঝে থাকে মানুষরুপি কিছু ব্যাক্কল চতুষ্পদ শ্রেনির নামধারী সালাফীরা।
আল্লাহ তাআলা বলেনঃ

وَقَالَتِ الۡیَہُوۡدُ یَدُ اللّٰہِ مَغۡلُوۡلَۃٌ ؕ غُلَّتۡ اَیۡدِیۡہِمۡ وَلُعِنُوۡا بِمَا قَالُوۡا ۘ بَلۡ یَدٰہُ مَبۡسُوۡطَتٰنِ ۙ یُنۡفِقُ کَیۡفَ یَشَآءُ ؕ
‘‘আর ইহুদীরা বলেঃ আল্লাহর হাত বাঁধা হয়ে গেছে। তাদের হাতই বাঁধা হয়ে গেছে। এ কথা বলার কারণে তাদের উপর অভিসম্পাত করা হয়েছে; প্রকৃতপক্ষে আল্লাহর উভয় হাত প্রসারিত। তিনি যেভাবে চান ব্যয় করেন’’। —আল মায়িদাহ - ৬৪

এখানে হাত প্রকৃত প্রসারিত সরাসরি হাত নয়। বরং দানশীলতা বুঝানো হয়েছে।
যেমনটি হাদিসে হাত শব্দের ব্যবহার বর্ণিত হয়েছে,
حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ إِسْمَاعِيلَ حَدَّثَنَا أَبُو عَوَانَةَ عَنْ فِرَاسٍ عَنْ الشَّعْبِيِّ عَنْ مَسْرُوقٍ عَنْ عَائِشَةَ أَنَّ بَعْضَ أَزْوَاجِ النَّبِيِّ قُلْنَ لِلنَّبِيِّ أَيُّنَا أَسْرَعُ بِكَ لُحُوقًا قَالَ أَطْوَلُكُنَّ يَدًا فَأَخَذُوا قَصَبَةً يَذْرَعُونَهَا فَكَانَتْ سَوْدَةُ أَطْوَلَهُنَّ يَدًا فَعَلِمْنَا بَعْدُ أَنَّمَا كَانَتْ طُولَ يَدِهَا الصَّدَقَةُ وَكَانَتْ أَسْرَعَنَا لُحُوقًا بِهِ وَكَانَتْ تُحِبُّ الصَّدَقَةَ
আয়িশাহ্ (রাযি.) হতে বর্ণিত যে, কোন নবী সহধর্মিনী নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -কে বললেনঃ আমাদের মধ্য হতে সবার পূর্বে (মৃত্যুর পর) আপনার সাথে কে মিলিত হবে?

তিনি বললেনঃ তোমাদের মধ্যে যার হাত সবচেয়ে লম্বা।
তাঁরা একটি বাঁশের কাঠির মাধ্যমে হাত মেপে দেখতে লাগলেন। সওদার হাত সকলের হাতের চেয়ে লম্বা বলে প্রমাণিত হল। পরে [সবার আগে যায়নাব (রাঃ)-এর মৃত্যু হলে]
আমরা বুঝলাম হাতের দীর্ঘতার অর্থ **দানশীলতা। **
তিনি [যায়নাব (রাঃ)] আমাদের মধ্যে সবার আগে তাঁর (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) সাথে মিলিত হন এবং তিনি দান করতে ভালবাসতেন।
(মুসলিম ৪৪/১৭, হাঃ ২৪৫২) (আধুনিক প্রকাশনীঃ ১৩২৮, ইসলামিক ফাউন্ডেশনঃ ১৩৩৪)

ইমাম ইসমাইলী (মৃত: ৩৭১ হি:) রহঃ বলেন,

وخلق ادم بيده، و يداه مبسوطتان ينفق كيف شاء بلا اعتقاد كيف يداه، اذ لم ينطق كتاب الله تعالى فيه بكيف. ولا يعتقد فيه الاعضاء و الجوارح و لا الطول ولا العرض ولا الغلظ و الدقة ونحو هذا مما يكون مثله في خلق، و انه ليس كمثله شيء

অর্থ: আল্লাহ তা’য়ালা তার ‘ইয়াদ’ দ্বারা আদম আদম আ: কে সৃষ্টি করেছেন। আল্লার উভয় হাত প্রশস্ত। তিনি যেভাবে ইচ্ছা দান করেন। আল্লাহর হাতের ব্যাপারে কোন কাইফিয়ত বিশ্বাস করা যাবে না। হাতের কাইফ বা ধরণ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে কিছু বলা হয়নি। তবে আল্লাহর হাতের ক্ষেত্রে কখনও এটা বিশ্বাস করা যাবে না যে, এটি কোন অঙ্গ। হাতের ক্ষেত্রে দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, পুরুত্ব, গভীরতা মোটকথা দেহজাতীয় কোন কিছুই সাব্যস্ত করা যাবে না। আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে সৃষ্টির কোন বৈশিষ্ট্য সাব্যস্ত করা যাবে না। মহান আল্লাহর সাথে তুলনীয় কিছুই নেই।

(ই’তিকাদু আহলিল হাদীস, পৃ:৫১)

অর্থাৎ কুরআন ও সুন্নাহয় হাত দীর্ঘ,লম্বা, প্রসারিত শব্দটি ব্যবহৃহ হয়েছে দয়া, ভালোবাসা এবং দানশীলতা অর্থে।

এইজন্য, কুরআন-সুন্নাহ বোঝার জন্য আরবী ভাষা-জ্ঞান ও সাহিত্যের সাধারণ রুচি অতিপ্রয়োজন।কুরআনুল কারীম আল্লাহর কোনো নিষ্প্রাণ ‘আইন-গ্রন্থ’ মাত্র নয়, এ হচ্ছে ‘কিতাবুল হিদায়াহ’ হিদায়াতের কিতাব। এতে যেমন আইন আছে, তেমনি উপদেশও আছে। আসমানী ফরমান যেমন আছে তেমনি পূর্বের জাতিসমূহের কর্ম ও পরিণামের বিবরণও আছে। এ কিতাব যেমন মস্তিষ্ককে সম্বোধন করে তেমনি হৃদয়কেও সম্বোধন করে। এতে যেমন আছে বিধান ও ফরমানের প্রতাপ, তেমনি আছে উপমা-উদাহরণের মাধুর্য। এ কারণে কুরআনকে বোঝার জন্য যেমন প্রয়োজন জ্ঞান ও প্রজ্ঞা তেমনি প্রয়োজন ভাষার রুচি ও সংবেদন। এ জিনিসের অভাব হলে শুধু যে কুরআনের বর্ণনা-মাধুর্য থেকেই বঞ্চিত হতে হয় তা-ই নয়, ছোট-বড় বিভ্রান্তিও ঘটে থাকে এবং ঘটেছে।

যেমন,বাইয়াতে রিজওয়ানের ঘটনা আমরা সকলেই জানি। সকলেই রাসূল স: এর হাতে হাত রেখে বাইয়াত হলেন। আল্লাহ তায়ালা ওহী পাঠালেন,সাহাবায়ে কেরামের হাতের উপর ‘আল্লাহর হাত’।
اِنَّ الَّذِیۡنَ یُبَایِعُوۡنَكَ اِنَّمَا یُبَایِعُوۡنَ اللّٰهَ ؕ یَدُ اللّٰهِ فَوۡقَ اَیۡدِیۡهِمۡ ۚ ﴿۱۰﴾
[সূরা আল ফাতহ আয়াত ১০]

এখানে ‘ইয়াদ’ শব্দটি আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করার কারণে এটাকে আল্লাহর হাত থাকার প্রমাণ বানিয়েছে। শুধু শব্দের সরল ব্যবহার থেকে যদি এভাবে আকিদা সাব্যস্ত করা যায়, তাহলে পুরো বাক্য থেকে কেন আকিদা প্রমাণ করা হবে না? একথা কেন বলা হবে না যে, বাইয়াতে রিজওয়ানের সময় বাস্তবেই আল্লাহর হাত সাহাবায়ে কেরামের হাতের উপর ছিলো? (নাউজুবিল্লাহ)।

আল্লাহর সিফাতের ক্ষেত্রে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাতের আকিদার স্বীকৃত দুটি ধারা রয়েছে। একটি হলো, ‘তাফওয়িয’ এবং অপরটি হলো তাবিল। তাবিলের মর্ম হলো, আল্লাহর শান অনুযায়ী আরবী ভাষারীতি অনুযায়ী বিশুদ্ধ কোন ব্যাখ্যা করা।আকিদার এ ধারা সাহাবায়ে কেরাম থেকে প্রমাণিত। আবদুল্লাহ বিন আব্বাস রাযি. কুরআন বিশেষজ্ঞ বিখ্যাত সাহাবি। রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর আপন চাচাতো ভাই। বিখ্যাত এ সাহাবি থেকে সিফাতের ক্ষেত্রে তাবিল সহিহ সনদে প্রমাণিত।
আল্লাহ তাআমা বলেন:
وَالسَّمَاءَ بَنَيْنَاهَا بِأَيْدٍ وَإِنَّا لَمُوسِعُونَ
অর্থ, আমি আইদ (ইয়াদ এর বহুবচন, শাব্দিক অর্থ হাত) দ্বারা আসমান নির্মাণ করেছি।
সূরা যারিয়াত: ৪৭।

এ আয়াতের শাব্দিক অর্থ হিসেবে হাতের সম্বন্ধ আল্লাহর দিকে করা হয়েছে। অথচ আল্লাহ তাআলা সব ধরণের অঙ্গ, প্রত্যঙ্গ থেকে পবিত্র। তাহলে এ আয়াতের উদ্দেশ্য কী? এ আয়াতের তাফসির করতে গিয়ে ইবনে জারির তাবারি রাহি. লিখেছেন:
حدثني علي، قال: ثنا أبو صالح، قال: ثني معاوية، عن علي، عن ابن عباس، قوله: والسماء بنيناها بأيد يقول: بقوة.
অর্থাৎ ইবনে জারির তাবারি রাহি. বর্ণনা করেছেন আলী থেকে, তিনি আবু সালিহ থেকে, তিনি মুআবিয়া থেকে, তিনি আলী থেকে, তিনি ইবনে আব্বাস রাযি. থেকে বর্ণনা করেন, এখাতে হাত দ্বারা উদ্দশ্য হলো, শক্তি।
তাফসিরে তাবারি: ২৪৯৬২।

এখানে হাতের ব্যাখ্যা করেছেন ইবনে আব্বাস রাযি. শক্তি দ্বারা। আকিদার পরিভাষায় এটাকে ‘তাবিল’ বলে। শুধু ইবনে আব্বাস রাযি. না, প্রসিদ্ধ তাবেয়ী মুজাহিদ এবং কাতাদা থেকেও এ ‘তাবিল’ বর্ণিত হয়েছে। ইবনে জারির তাবারি বর্ণনা করেন:
حدثني محمد بن عمرو، قال: ثنا أبو عاصم، قال: ثنا عيسى وحدثني الحارث، قال: ثنا الحسن، قال: ثنا ورقاء جميعا، عن ابنأبي نجيح، عن مجاهد، قوله: بأيد قال: بقوة.
– حدثنا بشر،قال: ثنا يزيد، قال: ثنا سعيد، عن قتادة والسماء بنيناها بأيد: أي بقوة
অর্থাৎ মুজাহিদ এবং কাতাদা রাহি. এখানে দ্বারা উদ্দেশ্য নিয়েছেন শক্তি।
তাফসিরে তাবারি: ২৪৯৬৩, ২৪৯৬৪।

আরবি ইয়াত শব্দের অর্থ শুধু হাত প্রকৃতই হাত এটা পাগলামি দেহবাদীদের শয়তানী কথাবার্তা।ইবনে হাজার আসকালানী রহঃ তার ফাতহুল বারীতে ইয়াদের অর্থ করেছেন পনেরোটি।সাধারণত যারা আল্লাহর দৈহিক অঙ্গ প্রতঙ্গে বিশ্বাসী তারা আল্লাহর সাথে সম্পৃক্ত يد শব্দ পেলেই আল্লাহর (দৈহিক অঙ্গ হিসেবে) হাত আছে বলে দলিল দেয়। কিন্তু আরবি يد শব্দের অর্থ শুধু (দৈহিক অঙ্গ) হাত নয়।একই ভাবে ইংরেজি Hand শব্দের অর্থও শুধু হাত নয়। এমনকি বাংলা 'হাত' শব্দের অর্থও শুধু দৈহিক অঙ্গ হিসেবে হাত নয়।বরং يد Hand 'হাত' এর হাত ছাড়াও একাধিক অর্থ রয়েছে।যা উপরের আলোচনা থেকে আপনারা কিছুটা নিশ্চিত হতে পেরেছেন।

এখানে আরও কিছু উদাহরণ লক্ষ্য করুন।

উদাহরণঃ ১. আমরা অনেক সময় বলে থাকি বা শুনে থাকি যে, "আইনের হাত অনেক লম্বা।" এর অর্থ এটা নয় যে, আইনের দৈহিক অঙ্গ হিসেবে হাত আছে। বরং এর অর্থ শক্তি বা ক্ষমতা।

উদাহরণঃ ২. কখনো কোথাও কোনো দূর্ঘটনা ঘটলে বা ঘটালে মাঝে মধ্যে কেউ কেউ বলে থাকে যে, "এ দূর্ঘটনার পিছনে অমুকের হাত রয়েছে। অর্থাৎ অমুকের প্রভাব আছে।

উদাহরণঃ ৩. পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে-
تَبَارَكَ الَّذِي بِيَدِهِ الْمُلْكُ وَهُوَ عَلَىٰ كُلِّ شَيْءٍ قَدِيرٌ.
"অতি মহান ও শ্রেষ্ঠ তিনি যার হাতে রয়েছে সমগ্র বিশ্ব জাহানের কর্তৃত্ব। আর তিনি সব কিছুর উপর সর্বশক্তিমান।" (সূরা মুলক ৬৭/০১)
তাঁর হাতে ক্ষমতা থাকার অর্থ এটা নয় যে, দৈহিক অঙ্গ হিসাবে তাঁর কোন হাত আছে এবং বিশ্ব জাহানের কর্তৃক তিনি হাতে করে নিয়ে আছেন। বরং বাকরীতি অনুসারে শব্দটি অধিকার অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। আরবী ভাষার মত আমাদের ভাষাতেও বলি যে, দেশের শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর হাতে'। এর মানে এ নয় যে, প্রধানমন্ত্রী ক্ষমতা হাতে নিয়ে বসে আছে। বরং এর অর্থ শাসন ক্ষমতা প্রধানমন্ত্রীর আয়ত্তে বা নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, অধিকারে রয়েছে।

উদাহরণঃ ৪. ইবনু উমার (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেনঃ
إِنَّ اللَّهَ لَا يَجْمَعُ أُمَّتِي أَوْ قَالَ أُمَّةَ مُحَمَّدٍ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ عَلَى ضَلَالَةٍ وَيَدُ اللَّهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ وَمَنْ شَذَّ شَذَّ إِلَى النَّارِ .
আল্লাহ তা'আলা আমার উম্মাতকে অপর বর্ণনায় তিনি বলেন, মুহাম্মাদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উন্মাতকে কখনোও গোমরাহীর উপর একত্রিত করবেন না। আর জামা'আতের উপর আল্লাহ তা'আলার হাত (রহমত, অনুগ্রহ, সাহায্য) রয়েছে। যে লোক (মুসলিম সমাজ হতে) আলাদা হয়ে গেছে, সে বিচ্ছিন্নভাবেই জাহান্নামে যাবে। (জামে তিরমিযী হাঃ ২১৬৭; মিশকাত হাঃ ১৭৩)
হাদীসে বর্ণিত وَيَدُ اللَّهِ مَعَ الْجَمَاعَةِ এর অর্থ এটা নয় যে, জামায়াতের উপর বা সাথে আল্লাহ তাঁর হাত রেখেছেন।বরং এর অর্থ হল, জামায়াত বদ্ধভাবে জীবন- যাপনকারীদের উপর আল্লাহর রহমত, অনুগ্রহ ও সাহায্য রয়েছে। এখানে يَدُ اللَّهِ অর্থ আল্লাহর অনুগ্রহ ও সাহায্য।

উদাহরণঃ ৫. আল্লাহ তা'আলা মদীনার ইয়াহুদীদেরকে বিত্তশালী ও স্বাচ্ছন্দ্যশীল করেছিলেন, কিন্তু যখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদীনায় আগমন করেন এবং তাদের কাছে ইসলামের আহবান পৌছে, তখন পাষণ্ডরা সামাজিক মোড়লি ও কুপ্রথার মাধ্যমে প্রাপ্ত নযর-নিয়াযের খাতিরে এ আহবান থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বিরুদ্ধাচরণ করে। ফলে তাতের উপর আল্লাহ তা'য়ালা অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন। এতে বলতে থাকে যে, 'আল্লাহর হাত বাঁধা' অর্থাৎ আল্লাহর ধনভাণ্ডার ফুরিয়ে গেছে অথবা আল্লাহ কৃপণ হয়ে গেছেন। তখন আল্লাহ্ তা’আলা এ আয়াত নাযিল করেন।
وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ ۚ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا ۘ بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنْفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ.
আর ইয়াহূদীরা বলে, ‘আল্লাহর হাত বাঁধা’। তাদের হাতই বেঁধে দেয়া হয়েছে এবং তারা যা বলেছে, তার জন্য তারা লা‘নতগ্রস্ত হয়েছে। বরং তার (দানের) হাত প্রসারিত। যেভাবে ইচ্ছা তিনি দান করেন (সূরা মায়িদাঃ ৫/৬৪)

এখানে 'হাত' বলতে শারীরিক হাত নয় বরং দান'কে এবং 'হাত বাঁধা' বলে কৃপণতা বোঝানো হয়েছে। সূরা আল-ইসরার ২৯ নং আয়াতেও এ শব্দটি উক্ত অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং এর অর্থ এটা নয় যে, আল্লাহর হাত বেঁধে রাখা হয়েছে। আল্লাহর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, হাত তো তাদেরই বাঁধা। এর অর্থ এটা নয় যে, ইয়াহুদীদের হাত বাঁধা রয়েছে। বরং এর অর্থ হল, তাদের প্রতি অভিসম্পাত হবে, যার ফলে আখেরাতে আযাব এবং দুনিয়াতে লাঞ্ছনা ও অবমাননা ভোগ করতে হবে। আল্লাহ তা’আলার দানের হাত সব সময়ই উন্মুক্ত রয়েছে। তাঁর দান চিরকাল অব্যাহত রয়েছে এবং থাকবে। কিন্তু তিনি যেমন ধনবান ও বিত্তশালী, তেমনি সুবিজ্ঞও বটে। তিনি বিজ্ঞতা অনুযায়ী ব্যয় করেন; যাকে উপযুক্ত মনে করেন, বিত্তশালী করে দেন এবং যার ঘাড়ে উপযুক্ত মনে করেন, অভাব-অনটন ও দারিদ্র্য চাপিয়ে দেন।

উদাহরণঃ ৬. পবিত্র কুরআন সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন,
لَا يَأْتِيهِ الْبَاطِلُ مِنْ بَيْنِ يَدَيْهِ وَلَا مِنْ خَلْفِهِ ۖ تَنْزِيلٌ مِنْ حَكِيمٍ حَمِيدٍ.
"বাতিল এতে (কুরআনে) অনুপ্রবেশ করতে পারে না; না এর উভয় হাতের মাঝ (সামনে) থেকে, না এর পিছন থেকে। এটি (কুরআন) প্রজ্ঞাময়, সপ্রশংসিতের পক্ষ থেকে নাযিলকৃত।" (সূরা ফুসসিলাত: ৪১/৪২)
এখানে বলা হয়েছে يَدَيْهِ এর অর্থ এটা নয় যে,
কুরআনের উভয় হাত বা দুই হাত আছে। বরং بَيْنِ يَدَيْهِ অর্থ হল 'সামনে'। আবার এ আয়াত দ্বারা এটিও প্রমাণ করা যাবে না যে, মানুষের মত কুরআনের সামনে ও পিছন আছে। বরং এর ব্যাখ্যা হল, কোনো ভাবেই কুরআনে বাতিল অনুপ্রবেশ করতে পারবে না।

সুতরাং يد মানে শুধু হাত নয় বরং يد এর 'অধিকার, আয়ত্তি (নিয়ন্ত্রণ) শক্তি, ক্ষমতা, প্রভাব, অনুগ্রহ, সাহায্য, দান' সহ বিভিন্ন অর্থ রয়েছে।

ইয়াদ' শব্দটি দ্বিবচন হয়ে কুদরাত/আল্লাহর সাহায্য অর্থেও ব্যবহার হয়েছে সহীহুল মুসলিমে।

সহীহুল মুসলিমে দাজ্জাল বিষয়ে নাওয়াস ইবনে সাম‌আন রা. এর সুদীর্ঘ হাদিসে এসেছে,
إِنِّي قَدْ أَخْرَجْتُ عِبَادًا لِي، لَا يَدَانِ لِأَحَدٍ بِقِتَالِهِمْ، فَحَرِّزْ عِبَادِي إِلَى الطُّورِ.
তখন আল্লাহ তায়ালা ঈসা আ. এর কাছে ওহী পাঠাবেন: আমি আমার এমন একদল বান্দা প্রেরণ করব যাদের সাথে যুদ্ধ করার ক্ষমতা (ইয়াদান) কারো নেই।
[মুসলিম-২৯৩৭, তিরমিজি-২২৪০, ইবনে মাজাহ-৪০৭৫, আল মুসতাদরাক আলাস-সহীহাইন-৮৫০৮, শারহুস-সুন্নাহ লিল বাগাভী-৪২৬১, আল ঈমান লি ইবনি মানদাহ-১০২৭]

অথচ,ইবনে তাইমিয়া বলেন,

"إن لفظ اليدين بصيغة التثنية لم يستعمل في النعمة ولا في القدرة"
নিশ্চয়ই ইয়াদাইন শব্দটি দ্বিবচন হিসেবে নিয়ামাত কিংবা সামর্থ্য বা কুদরাত অর্থে কখনো‌ ব্যবহৃত হয়নি। (মাজমূউল ফাতাওয়া-৬/৩৬৫)

আমরা দেখলাম অত্র হাদিসে أحد তথা ব্যাক্তির ক্ষেত্রে يدان শব্দটি কুদরাত তথা সামর্থ্য অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে। সুতরাং ইবনে তাইমিয়ার দাবি ভ্রান্ত বলে প্রমাণিত হলো।

"ইয়াদ"-এর ব্যাখায় দেহবাদীদের
গালে কুরআনী চপেটাঘাত:
-----------------------------------------

দেহবাদীরা ইয়াদের হাকীকী অর্থ অঙ্গ সাব্যস্ত করে সেটার কাইফ তথা সঠিক সাইজের জ্ঞানকে আল্লাহর দিকে সোপর্দ করে। তাদের মতে কুরআন-সুন্নাহর যেখানেই আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত হয়ে "ইয়াদ" শব্দ এসেছে কোথাও এটাকে তার হাকীকী অর্থ "অঙ্গ" ছাড়া অন্য কোনো রূপকার্থে ব্যবহার করা যাবে না।

১ নং চপেটাঘাত: অথচ আল্লাহ তায়ালা বলেন,
وَقَالَتِ الْيَهُودُ يَدُ اللَّهِ مَغْلُولَةٌ غُلَّتْ أَيْدِيهِمْ وَلُعِنُوا بِمَا قَالُوا بَلْ يَدَاهُ مَبْسُوطَتَانِ يُنفِقُ كَيْفَ يَشَاءُ
আর ইহুদীরা বলে, ||আল্লাহর হাত ঘাড়ের পিছনে বেড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা|| হয়েছে। তাদের ||হাতগুলোই ঘাড়ের পিছনে বেড়ি দিয়ে বেঁধে ফেলা হোক||। একথা বলার জন্যে তাদের প্রতি অভিসম্পাত। বরং তাঁর উভয় হাত বিস্তৃত। তিনি যেরূপ ইচ্ছা ব্যয় করেন। (মায়েদা:৬৪)

এ হলো আয়াতের শাব্দিক অনুবাদ। সালাফীদের দাবী অনুযায়ী সিফাতের ক্ষেত্রে কোন মাজায বা রূপকার্থ নেই। তাই আমরা আক্ষরিক অনুবাদ দিলাম‌। যার মাথায় বিন্দু পরিমাণ বুদ্ধি রয়েছে সে বুঝতে সক্ষম হবে যে, এখানে আক্ষরিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়, বরং রূপকার্থ উদ্দেশ্য।

অত্র আয়াতে বলা হয়েছে তার দুই ইয়াদ مبسوطتان তথা ممدودتان (প্রসারিত, বিস্তৃত)।‌ এখানে অবশ্যই বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য নয়। যদি বাহ্যিক অর্থ উদ্দেশ্য হয়, তাহলে ঐ "হাতদ্বয় প্রসারিত বা আবদ্ধ নয়" বলার সাথে বান্দাদের জন্য "যেভাবে চান সেভাবে ব্যায় করা"-র কোন‌ বাহ্যিক সম্পর্ক‌ই থাকতে পারে না। কারণ আমরা দেখি আমাদের ও অন্যান্য সৃষ্টির রিযিক আল্লাহর হুকুমেই হচ্ছে। এমনটা কেউ বিশ্বাস করে না যে, প্রতিটি মানুষের জন্য ফল-ফসল, গবাদিপশু, খাবার-পানি ইত্যাদি আল্লাহ তায়ালা নিজে দুটি হাত দ্বারা বানিয়ে রেখে যান। বরং তিনি সৃষ্টির ক্ষেত্রে কোন অঙ্গের মুখাপেক্ষী নন। তিনি তো চাইলেই হয়ে যায়। তিনি বলেন,
إِنَّمَا أَمْرُهُ إِذَا أَرَادَ شَيْئًا أَن يَقُولَ لَهُ كُن فَيَكُونُ
তিনি যখন কোন কিছু করতে ইচ্ছা করেন, তখন তাকে কেবল বলে দেন, ‘হও’ তখনই তা হয়ে যায়। (ইয়াসীন: ৮২)

এছাড়া অন্য আয়াতে এসেছে,
ولا تَجْعَلْ يَدَكَ مَغْلُولَةً إِلَىٰ عُنُقِكَ وَلَا تَبْسُطْهَا كُلَّ الْبَسْطِ فَتَقْعُدَ مَلُومًا مَحْسُورًا
"তোমার হাতকে তোমার গলায় বাঁধা অবস্থায় রেখো না (অর্থাৎ কৃপণতা করো না), এবং এটিকে পুরোপুরি প্রসারিত করো না (অর্থাৎ অপব্যয় করো না), ফলে তুমি নিন্দিত ও অভাবগ্রস্ত হয়ে পড়বে।" (ইসরা: ২৯)

বাস্তবে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর হাত মুবারককে কখনো কাঁধে বাঁধেননি। এখানে বেঁধে রাখা দ্বারা কৃপণতাকে ইঙ্গিত করা হয়েছে, বাহ্যিক অর্থে হাত নয়। সুতরাং এই আয়াতও নিশ্চিতভাবে আগের আয়াতে রুপকার্থ হ‌ওয়াকে সমর্থন করছে।

২নং চপেটাঘাত: তিনি বলেন,
إِنَّ مَثَلَ عِيسَىٰ عِندَ اللَّهِ كَمَثَلِ آدَمَ خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ
নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট ঈসার দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদমেরই মতো। তাকে মাটি দিয়ে তৈরী করেছিলেন এবং তারপর তাঁকে বলেছিলেন হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলেন। (আলে ইমরান: ৫৯)

সালাফীরা বলে, আদম আলাইহিস সালামকে আল্লাহ তায়ালা তাঁর দুই হাত (অঙ্গ) দিয়ে সরাসরি তৈরি করেছেন এতে ফেরেশতার কোন মধ্যস্থতা ছিল না। তাদের দলিল হল, কোরআন এবং হাদিসের ওই ভাষ্যগুলো যেখানে দুই ইয়াদ দ্বারা আদমকে সৃষ্টির কথা এসেছে। আহলুস-সুন্নাহর বক্তব্য হলো, "এ সকল আয়াত ও হাদিসের উদ্দেশ্য হল, আদম আ.-কে আল্লাহর দিকে সম্পৃক্ত করে তাঁর মর্যাদা বুঝানো‌। যেমন বলা হয় "বাইতুল্লাহ", "নাক্বাতুল্লাহ" ইত্যাদি।"

আহলে সুন্নাহর বক্তব্য যে সঠিক এর প্রমাণ হল একটু আগে উল্লেখিত সূরা আলে ইমরানের ৫৯ নং আয়াত। এখানে বলা হয়েছে, আদম আ.-এর সৃষ্টি ঈসা আ.-এর মত বাবাহীনভাবে ছিল। এরপর আদম আ.-এর সৃষ্টি পদ্ধতি কেমন ছিল তা উল্লেখ করে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন,
خَلَقَهُ مِن تُرَابٍ ثُمَّ قَالَ لَهُ كُن فَيَكُونُ
"তারপর তাঁকে বলেছিলেন হয়ে যাও, সঙ্গে সঙ্গে হয়ে গেলেন।"

অর্থাৎ আল্লাহ তায়ালার "হ‌ও" বলার দ্বারাই তিনি হয়ে গেলেন, এখানে অঙ্গপ্রত্যঙ্গের কোন উল্লেখ নেই আর তার প্রয়োজন‌ও নেই।

৩নং চপেটাঘাত:

আল্লাহ তাআলা বলেন,
أَوَلَمْ يَرَوْا أَنَّا خَلَقْنَا لَهُم مِّمَّا عَمِلَتْ أَيْدِينَا أَنْعَامًا فَهُمْ لَهَا مَالِكُونَ
তারা কি দেখে না, তাদের জন্যে আমি আমার নিজ হাতের তৈরী বস্তুর দ্বারা চতুস্পদ জন্তু সৃষ্টি করেছি, অতঃপর তারাই এগুলোর মালিক। (ইয়াসিন:৭১)

সালাফীদের দাবি ছিল, নিজ "ইয়াদ" দ্বারা সৃষ্টি করেছেন বলায় আদম আ. সরাসরি আল্লাহর হাত দ্বারা সৃষ্টি বিশ্বাস করতে হবে। এটা আদমের বিশেষ সম্মান। শুধু তাই নয় সালাফীদের দাবী হচ্ছে, আল্লাহ তাআলা নিজ হস্তে মাখামাখি করে "চারটি "জিনিস সৃষ্টি করেছেন। নাউযুবিল্লাহ

অথচ আমরা দেখছি অত্র আয়াতে চতুষ্পদ জন্তুর ক্ষেত্রে সরাসরি ইয়াদ দ্বারা সৃষ্টির কথা উল্লেখ রয়েছে। এই আয়াতে "কুন,"শব্দটি ব্যবহৃত হয়নি।
এরপরও দেহবাদী মোজাসসিয়া সালাফীরা কি বলবে যে, এটা চতুষ্পদ জন্তুগুলোর বলার বিশেষ সম্মান??

এখন কি তারা বলবে পৃথিবীর প্রতিটি চতুষ্পদ জন্তু স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা (তাদের দাবি মোতাবেক হাত নামক অঙ্গ দিয়ে) তৈরি করেছেন??

নাকি আহলুস-সুন্নাহর মত বৈধ তাবীল করবে??

সূতরাং প্রমাণিত হল, কুরআনে ইয়াদ ও এজাতীয় অন্যান্য শব্দের রপকার্থে ব্যবহার রয়েছে। এগুলো দ্বারা কখনই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বা দেহ উদ্দেশ্য নয়, যেমনটা দেহবাদী ইহুদিপন্থী সালাফীরা বলে থাকে। আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে দেহবাদের শয়তানি আকিদা থেকে হেফাজত করুন।আমিন।।।

আহলে হাদিসের মাযহাব ও তাকলিদ বিষয়ক দাবি: বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা- নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যখন ছিলেন, তখন সাহাবাগণ নবীজির মাযহাব...
27/01/2025

আহলে হাদিসের মাযহাব ও তাকলিদ বিষয়ক দাবি: বিশ্লেষণ ও পর্যালোচনা-

নবী মুহাম্মদ (সাঃ) যখন ছিলেন, তখন সাহাবাগণ নবীজির মাযহাব বা তাকলিদের মাধ্যমেই সব সমস্যার সমাধান নিতেন। আর দুরবর্তী সাহাবাগন যারা ছিলেন তাদের মধ্যে কিছু সাহাবা ছিলো মুজতাহিদ, তারা অন্যদের সমস্যার সমাধান দিতেন। পরবর্তী সময়ে ইসলামি শিক্ষার বিস্তার ও জটিলতার ফলে বিভিন্ন মাযহাবের উত্থান হয়, যেমন হানাফি, শাফেয়ী, মালেকি, হাম্বলি ইত্যাদি।

এসব মাযহাবের অনুসরণ ইসলামি উলামা সমাজে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। কারণ কুরআন হাদিসের এবং সাহাবাদের কওল বা আমল ইত্যাদি সবকিছু এই চার মাযহাবে সংকলিত হয়েছে। তারা উসূল তৈরি করে সব সমস্যা সমাধান দিতেন। পরবর্তীতে এই চার মাযহাব উম্মতের নিকট গ্রহনযোগ্য হয়ে উঠে। যা আজ পর্যন্ত বহাল আছে, কেয়ামত পর্যন্ত থাকবে ইনশা আল্লাহ।

তবে, বর্তমান সময়ে একটা গ্রুপ তাদের মতবাদে দাবি করেছে যে, কোনো মাযহাবের অনুসরণ বা তাকলিদ করা যাবে না এবং মুসলিমরা কেবল সরাসরি কোরআন ও হাদিস থেকে শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে। এই গ্রুপের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে "আহলে হাদিস" গোষ্ঠী।

আহলে হাদিসদের মাযহাব ও তাকলিদ বিরোধিতা:

আহলে হাদিসদের প্রধান দাবির মধ্যে একটি হলো, মুসলিমদের মাযহাব অনুসরণ করা বা তাকলিদ করা যাবে না। তারা বলেন, প্রত্যেক মুসলিমের উচিত সরাসরি কোরআন এবং সঠিক হাদিসের আলোকে জীবন পরিচালনা করা। তাদের মতে, মাযহাবের অনুসরণ বা আলেমদের দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ একটি অযাচিত কৃত্রিম বাধা সৃষ্টি করে এবং ইসলামের মূল শিক্ষা থেকে সরে যাওয়ার কারণ হয়।

তারা আরও দাবি করেন যে, ইসলামের কোনো নির্দিষ্ট মাযহাবের ধারাবাহিক অনুসরণ করা উচিত নয়, কারণ প্রতিটি মাযহাবই তার সময় ও পরিস্থিতির আলোকে তৈরি হয়েছে। তাদের মতে, কোরআন ও হাদিসের সরাসরি অনুসরণই সঠিক পথ, এবং তাই তাকলিদ বা মাযহাব অনুসরণ ইসলামের শুদ্ধতা ও মৌলিকত্বের বিরুদ্ধে।

কথিত আহলে হাদিসের সদস্যরা দাবি করে থাকেন, আমরা শুধু কোরআন এবং হাদিস মানি, অন্য কিছু না।
মজার বিষয় হলো তারা যখন কোন প্রশ্নের ফতোয়া দেওয়া শুরু করে তখন স্পষ্ট ভাবে কুরআন হাদিস থেকে দলিল দেয় না, তখন তারা জবাব দেওয়ার সময় বলে ওমুকে এটা বলেছে, তমুকে ওটা বলেছে ইত্যাদি। ঘুরেফিরে তাকলিদের ছায়াতলে আসতে হয়। তাদের দাবি আর কাজে কোন মিল নাই।

মাযহাবের প্রয়োজনীয়তা:

মাযহাবের মূল উদ্দেশ্য হল ইসলামী আইন এবং শিক্ষা বিষয়ক গভীরতা ও সুষম ব্যাখ্যা প্রদান করা। ইসলামের বিভিন্ন দিক—বিশেষত, আইন, নৈতিকতা, এবং সমাজের কাঠামো—অত্যন্ত জটিল। মাযহাবগুলির উত্থান তাই একটি প্রয়োজনীয় প্রক্রিয়া ছিল, যার মাধ্যমে উলামারা জনগণের জন্য সহজ, গ্রহণযোগ্য এবং শুদ্ধ ব্যাখ্যা প্রদান করতে সক্ষম হয়েছেন। মাযহাব ছাড়া ইসলামের অনেক বিষয় অনিশ্চিত এবং বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে পারে, যা সামাজিক ও ধর্মীয় অস্থিরতার কারণ হতে পারে।

তাদের তর্কের সীমাবদ্ধতা:

আহলে হাদিসরা নিজেদের মতবাদকে পুরোপুরি বৈধ দাবি করলেও, তারা কখনোই নিখুঁতভাবে প্রমাণ করতে পারেননি যে, তাদের মতামত কোরআন ও হাদিসের সঠিক ব্যাখ্যা। মাযহাবের অনুসরণ বা তাকলিদ না করার তাদের দাবি মূলত একটি শক্তিশালী দর্শন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেও, বাস্তবে তারা নিজেকে অন্য মাযহাব বা আলেমদের থেকে কোনোভাবে পৃথক করতে পারেনি। তারা কখনো সরাসরি কোরআন বা হাদিসের নির্দিষ্ট দলিল উপস্থাপন করতে পারেননি, যা তাদের অবস্থানকে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবে।

সুতারাং মাযহাবের অনুসরণ ইসলামী সমাজের জন্য একটি ঐতিহ্যগত ভিত্তি এবং তা ইসলামী বিধান এবং আইনগত সমস্যা সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। আহলে হাদিসদের এই দাবি যে, মাযহাব বা তাকলিদ গ্রহণ করা যাবে না, তা শুধু শুদ্ধ দৃষ্টিভঙ্গি নয়, বরং এটি সমাজে বিভ্রান্তি ও ফেতনা সৃষ্টি করতে পারে। কেননা, ইসলামের মৌলিকতা এবং ঐতিহ্য থেকে বিচ্যুতি সৃষ্টির চেয়ে মাযহাবের ভিত্তিতে চলা এবং আলেমদের সমর্থিত ব্যাখ্যা গ্রহণ করা অধিক উপকারী এবং গ্রহণযোগ্য।

এটি মনে রাখা উচিত যে, ইসলামের মূল উদ্দেশ্য হলো শান্তি, ঐক্য এবং আধ্যাত্মিক উন্নতি—যা সমাজে বিভাজন সৃষ্টি না করে বরং পরস্পরের মধ্যে ঐক্য স্থাপন করে।

ইমাম মুহাদ্দিস শাইখ আব্দুল্লাহ আল-হাররী (রহ.) তার গ্রন্থ আল-মাকালাত আস-সুনিয়্যাহ-তে লিখেছেন, الإمام المحدث الشيخ عبد ال...
26/01/2025

ইমাম মুহাদ্দিস শাইখ আব্দুল্লাহ আল-হাররী (রহ.) তার গ্রন্থ আল-মাকালাত আস-সুনিয়্যাহ-তে লিখেছেন,
الإمام المحدث الشيخ عبد الله الهرري في كتابه المقالات السنية: “وهذا دليل على أن الإمام أحمد رضي الله عنه ما كان يحمل ءايات الصفات وأحاديث الصفات التي توهم أنَّ الله متحيّـز في مكان أو أنّ له حركةً وسكونًا وانتقالا من علو إلى سفل على ظواهرها كما يحملها ابن تيمية وأتباعه فيثبون اعتقادا التحيز لله في المكان والجسمية ويقولون لفظا ما يموهون به على الناس ليظن بهم أنـهم منزهون لله عن مشابهة المخلوق فتارة يقولون: بلا كيف، كما قالت الأئمة، وتارة يقولون: على ما يليق بالله، نقول: لو كان الإمام أحمد يعتقد في الله الحركة والسكون والانتقال لترك الآية على ظاهرها وحملها على المجيء بمعنى التنقل من علو وسفل كمجيء الملائكة، وما فاه بهذا التأويل”.انتهى بحروفه. (المقالات السنية في كشف ضلالات أحمد بن تيمية - ص/194)،
“এটি প্রমাণ করে যে, ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (রহ.) কুরআনের আয়াত ও হাদিসে বর্ণিত সিফাত-সম্পর্কিত বিষয়গুলো, যা আল্লাহর জন্য স্থান নির্ধারণ, গতি, স্থিরতা কিংবা উচ্চ স্থান থেকে নিচে নেমে আসার ধারণা দেয়, তিনি সেগুলোকে কখনোই তাদের যাহির অর্থে গ্রহণ করেননি। তিনি এগুলোর গভীরে গিয়ে প্রকৃত অর্থ অনুধাবন করতেন। কিন্তু ইবনে তাইমিয়াহ ও তার অনুসারীরা এসব বিষয়কে তাদের বাহ্যিক অর্থে গ্রহণ করে আল্লাহর জন্য স্থান ও দেহত্ব আরোপ করেছেন।
তারা এমন ভাষা ও শব্দ ব্যবহার করেন, যা সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করে। তাদের কথা শুনে মানুষ মনে করে, তারা যেন আল্লাহকে সৃষ্টির মতো হওয়া থেকে মুক্ত রাখার চেষ্টা করছেন। তারা কখনো বলেন, ‘বেলা কাইফ’ (কিভাবে তা জানা সম্ভব নয়), যেমন পূর্ববর্তী ইমামগণ বলেছেন। আবার কখনো বলেন, ‘এটি আল্লাহর জন্য উপযুক্ত।’
আমরা বলি, যদি ইমাম আহমদ (রহ.) আল্লাহর জন্য গতি, স্থিরতা বা স্থানান্তরের ধারণা পোষণ করতেন, তবে তিনি আয়াতের (আল্লাহর جيء বা আগমনের) বাহ্যিক অর্থ গ্রহণ করতেন এবং এটিকে ফেরেশতাদের মতো স্থানান্তরের অর্থে ব্যাখ্যা করতেন। কিন্তু তিনি কখনো এমনটি করেননি। বরং তিনি এ ধরনের ব্যাখ্যা থেকে বিরত থেকেছেন।” (আল-মাকালাত আস-সুনিয়্যাহ ফি কাশফি দোলালাত আহমদ ইবনে তাইমিয়াহ- ১৯৪ পৃষ্টা)

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন, (قَدِيمٌ بِلَا ابْتِدَاءٍ دَائِمٌ بِلَا انْتِهَاءٍ) তিনি কাদীম (অনাদি, অবিনশ্বর), তার কো...
26/01/2025

ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ বলেন,
(قَدِيمٌ بِلَا ابْتِدَاءٍ دَائِمٌ بِلَا انْتِهَاءٍ)
তিনি কাদীম (অনাদি, অবিনশ্বর), তার কোনো শুরু নেই। তিনি অনন্ত-চিরন্তন, তার কোনো অন্ত নেই।[আকিদাতুত ত্বহাবী]

আল্লাহ তা‘আলা বলেন,

هُوَ الْأَوَّلُ وَالْآخِرُ وَالظَّاهِرُ وَالْبَاطِنُ وَهُوَ بِكُلِّ شَيْءٍ عَلِيمٌ

তিনিই الأَوَّلُ (প্রথম), তিনিই الآخِرُ (সর্বশেষ), তিনিই الظَّاهِرُ (সবকিছুর উপরে), তিনিই الْبَاطِنُ (মাখলুকের অতি নিকটে), আর তিনি সর্ব বিষয়ে عَلِيم (মহাজ্ঞানী)। (সূরা হাদীদ: ৩)।

নাবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তার দু‘আয় বলেছেন,
اللَّهُمَّ أَنْتَ الأَوَّلُ فَلَيْسَ قَبْلَكَ شَيْءٌ وَأَنْتَ الآخِرُ فَلَيْسَ بَعْدَكَ شَيْءٌ
‘‘হে আল্লাহ! তুমিই সর্বপ্রথম, তোমার পূর্বে কেউ ছিল না। তুমিই সর্বশেষ, তোমার পর কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না’’

আল্লাহ তা‘আলার অতি সুন্দর নামসমূহের অন্যতম আল-আওয়াল এবং আল-আখের নামের অর্থেই ইমাম ত্বহাবী রহিমাহুল্লাহ قَدِيمٌ بِلَا ابْتِدَاءٍ، دَائِمٌ بِلَا انْتِهَاءٍ ‘‘অনাদি, অবিনশ্বর, প্রাক্তন, যার কোনো শুরু নেই এবং তিনি অনন্ত-চিরন্তন, যার কোনো অন্ত নেই’’ এ অংশটি ব্যবহার করেছেন।

আল্লাহ তা‘আলার সিফাতসমূহ থেকে এ দু’টি বিশেষণ মানুষের ফিতরাত তথা সৃষ্টিগত স্বভাবের মধ্যেই বদ্ধমূল রয়েছে। কেননা এ বিশ্বাস করা আবশ্যক যে, সমস্ত সৃষ্টিই এমন এক সত্তা পর্যন্ত গিয়ে শেষ হয়, যিনি নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল। এ বিশ্বাস অতীতে সূচনাহীন সৃষ্টির অস্তিত্ব এবং ভবিষ্যতে সৃষ্টির পরিসমাপ্তি বিহীন সৃষ্টির ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকার ধারণাকে বাতিল সাব্যস্ত করে।

আমরা প্রাণী, জীবজন্তু, গাছপালা, উদ্ভিদ, খনিজদ্রব্য, মহাশূন্যের বিভিন্ন ঘটনা যেমন মেঘ, বৃষ্টি, বজ্রপাত ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয় প্রত্যক্ষ করি। এসব জিনিস এবং এ রকম অন্যান্য বস্তু সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব নয়। কেননা অসম্ভব জিনিসের কোনো অস্তিত্ব নেই। আর যা সৃষ্টি হওয়া সম্ভব, তা নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল হয় না। কেননা যে নিজে নিজেই অস্তিত্বশীল হয়, সে কখনো অস্তিত্বহীন হয় না। সৃষ্টিজগতের এ জিনিসগুলো ছিল না। অতঃপর অস্তিত্ব ধারণ করেছে। এগুলোর অস্তিত্ব না থাকা অস্তিত্ব থাকার পরিপন্থী। আর অস্তিত্ব থাকা অস্তিত্ব ধারণ করা অসম্ভব হওয়ার ধারণার পরিপন্থী। আর যে বস্তু অস্তিত্ব গ্রহণ করা কিংবা না করার সম্ভাবনা রাখে সে নিজে নিজেই অস্তিত্ব গ্রহণ করতে পারে না।

আল্লাহ তা‘আলা আরো বলেন,
أَمْ خُلِقُوا مِنْ غَيْرِ شَيْءٍ أَمْ هُمْ الْخَالِقُونَ أَمْ خَلَقُوا السَّمَوَاتِ وَالأَرْضَ بَل لاَ يُوقِنُونَ
‘‘তারা কি কোন কিছু ব্যতীতই সৃষ্টি হয়েছে? না তারা নিজেরাই স্রষ্টা? না কি তারা আকাশমন্ডলী ও পৃথিবী সৃষ্টি করেছে? বরং তারা বিশ্বাস করে না’’। (সূরা তূর: ৩৫-৩৬)

আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা‘আলা এখানে বলছেন, তারা কোন জিনিস ছাড়াই সৃষ্টি হয়েছে না কি তারা নিজেরাই নিজেদেরকে সৃষ্টি করেছে?

এটি জানা কথা যে, কোনো সৃষ্টিই নিজে নিজেকে সৃষ্টি করেনি। সুতরাং যে সৃষ্টি নিজেকে সৃষ্টি করতে পারে না এবং নিজেকে নিজেই অস্তিত্বহীন করতে পারে না, নিজে নিজেই অস্তিত্বে আসা তার পক্ষে অসম্ভব। বরং কেউ তাকে সৃষ্টি করেছে বলেই সে অস্তিত্বে এসেছে। অথচ তার আগে তা ছিল অস্তিত্বহীন। যে বস্তুর অস্তিত্বশীলতা তার অস্তিত্বহীনতার স্থলাভিষিক্ত হয় এবং অস্তিত্বহীনতা এর অস্তিত্বশীলতার স্থলাভিষিক্ত হয়, তার পক্ষে নিজে নিজেই অস্তিত্বে আসা সম্ভব নয় এবং তার অস্তিত্বহীন হওয়া আবশ্যক নয়।

অধিকন্তু, Yasin Hosen Shishir.এর মতো নাস্তিকরা আগেও ছিলো এখনও আছে। তারা আল্লাহর অস্তিত্ব আগেও অস্বীকার করতো এখনও করছে। এবং এটা এখন ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে।আল্লাহ তাআলার মহান সত্তার অনন্যতা ও সাদৃশ্যহীনতা সম্পর্কে এজমালী আকীদা সাধারণত সকলেরই আছে। সকলেই বিশ্বাস করে এবং বলে, আল্লাহর সত্তা ও গুণ কোনো মাখলূকের মতো নয়; তিনি মাখলূকের সাদৃশ্য থেকে সর্বোতভাবে মুক্ত ও পবিত্র। কিন্তু প্রায়োগিক ক্ষেত্রে দেখা যায়, অনেকেই কোনো গুণ সাব্যস্ত করার ক্ষেত্রে বা গুণ সম্পর্কে আলোচনার ক্ষেত্রে সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবে মাখলূকের সাথে সাদৃশ্য সাব্যস্ত করে। এমনকি আলোচনার শুরুতে বা শেষে সাদৃশ্যহীনতার কথা স্বীকার করলেও মাঝখানে ব্যাখ্যা ও তফসীল বয়ানের সময় কার্যত মাখলূকের সাথে সাদৃশ্যায়ন করে থাকে।

অনেকেই আছেন, এজমালীভাবে মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তার অনন্যতা ও সাদৃশ্যহীনতা বিশ্বাস করা সত্ত্বেও সিফাত সম্পর্কে তফসীলী আলোচনার সময় তফসীলীভাবে তাঁর অনন্যতা ও সাদৃশ্যমুক্ত হওয়ার কথা বলতে চান না; বরং তফসীলীভাবে মহান সত্তার অনন্যতা বয়ান করাকে অস্বীকার করেন, অপছন্দ করেন এবং এটাকে বিদআত মনে করেন। আর তাই তাদেরকে বলতে শোনা যায়, আল্লাহ তাআলাকে ‘নিরাকার-নিরাধার’ বলা যাবে না। কিংবা বলেন, অল্লাহকে সাকারও বলা যাবে না, নিরাকারও বলা যাবে না। এসব দাবি ও ধারণা আসলে অজ্ঞতাপ্রসূত এবং কূটতর্কের অন্তর্ভুক্ত। তারা ধরে নিয়েছে, দ্বীনুল ইসলামে সৃষ্টিকর্তা সম্পর্কে যে পবিত্রতা এবং সাদৃশ্যহীনতা ও অনন্যতার বিশ্বাস, তা এক মুজমাল ও অস্পষ্ট ধারণা। নাউযুবিল্লাহ। অথচ আল্লাহ তাআলার সাদৃশ্যহীনতা সম্পর্কে কুরআন কারীমের বক্তব্য মুহকাম ও দ্ব্যর্থহীন এবং আম ও ব্যাপক-

وَ لَمْ يَكُنْ لَّهٗ كُفُوًا اَحَدٌ.

(তাঁর সদৃশ কেউই নেই।)

এবং-

لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ

(তাঁর অনুরূপ বলতে কিছুই নেই।)

কুরআন কারীমের এসব বক্তব্য দ্ব্যর্থহীন ও ব্যাপক অর্থবোধক। ভাষাগত বিচারে এতে কোনো দ্ব্যর্থতা ও অস্পষ্টতা নেই। আরবী ভাষার উসলূব ও বাকরীতি সম্পর্কে সচেতন যে কেউ বুঝবেন, পূর্বোক্ত আয়াতদুটির নফী সর্বব্যাপী। অর্থাৎ কেউই বা কোনো কিছুই কোনো দিক থেকেই তাঁর সদৃশ নয়, তাঁর মতো বলতে কিছুই নেই, থাকতে পারে না। তাই এর দ্ব্যর্থহীনতা ও ব্যাপকতার বিষয়ে সলফের যামানা থেকে অজ পর্যন্ত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সকল ইমামের ইজমা ও ঐকমত্য রয়েছে। কেউই এর ব্যাপকতাকে অস্বীকার করেননি। আয়াতের এধরনের উমূম ও ব্যাপকতা কতয়ী ও অকাট্য। আয়াতের এধরনের ব্যাপকতাকে অস্বীকার করা গোমরাহী।

এখন একটু ভাবুন, মাখলূকের যেকোনো কিছুর সাথে খালিকের সাদৃশ্যহীনতার এই সর্বব্যাপী বক্তব্যের ওপর আপনি কীভাবে আমল করবেন? এর প্রায়োগিক রূপ কী?

একথা স্পষ্ট যে, এই সর্বব্যাপী বক্তব্য সর্বক্ষেত্রে প্রযোজ্য; তাঁর অস্তিত্বের ক্ষেত্রে, স্থিতির ক্ষেত্রে, প্রতিটি গুণের ক্ষেত্রে এবং তাঁর প্রতিটি ক্রিয়ার ক্ষেত্রে। এখন এই সর্বব্যাপী নীতি সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগের সময় প্রত্যেক ক্ষেত্রের জন্য বিশেষ কোনো নস থাকা আবশ্যক নয়; বরং আকলে সলীম তথা সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির মাধ্যমে এই সর্বব্যাপী নীতির প্রয়োগ করা জরুরি। আকীদার কথা বলুন কিংবা ফিকহী বিধানের কথা বা আখলাকের কথা- সর্বক্ষেত্রেই তো ইসলামের এধরনের মৌলিক ও সর্বব্যাপী শিক্ষা রয়েছে, যেগুলোকে আকলে সালীমের মাধ্যমে সর্বক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে হয়। যদিও এই সাদৃশ্যহীনতার অনেক দিক ও ক্ষেত্র সম্পর্কে খাস আয়াত ও হাদীস এবং আছারে সাহাবাও পাওয়া যায়। কিন্তু আমরা দেখতে পাই, যখনই কোনো ব্যক্তি বিদআত ও গোমরাহীর শিকার হয়ে আল্লাহ সম্পর্কে কোনো ভুল ধারণা বা ভুল কথা উদ্ভাবন করেছে তখনই আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর মুজতাহিদ ইমামগণ তার খণ্ডনে এধরনের ব্যাপক অর্থবোধক আয়াত ও হাদীস প্রয়োগ করেছেন।

সর্বোপরি বিভ্রান্তি ও ভুল বোঝাবুঝি নিরসনের জন্য একটি বিষয় আমাদেরকে অবশ্যই মনে রাখতে হবে, তাশবীহ বা সাদৃশ্য নফী করার অর্থ কখনোই সিফাত ও গুণাবলিকে নফী করা নয়। অতীতে এমন গোমরাহ ফেরকা ছিল এবং বর্তমানেও এমন ভ্রান্ত ধর্ম ও মতবাদে বিশ্বাসী রয়েছে, যারা মনে করে, সৃষ্টিকর্তার যে কোনো গুণ বর্ণনা করার মানেই হল সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টির সাথে তুলনা করা, তাই তারা স্রষ্টাকে নির্গূণ সত্তারূপে ধারণা করে এবং তাঁর জন্য গুণবাচক যে কোনো শব্দ ও অভিধা ব্যবহার করাকে পরিহার করে। নাউযুবিল্লাহ।

সঠিক কথা হল, আল্লাহ তাআলা যেমন সকল উৎকৃষ্ট গুণের অধিকারী, তদ্রূপ তিনি গুণাবলির ক্ষেত্রে মাখলূকের সাদৃশ্য হতেও চিরপবিত্র। কুরআন মাজীদের বিখ্যাত এই আয়াতটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করুন-

فَاطِرُ السَّمٰوٰتِ وَ الْاَرْضِ جَعَلَ لَكُمْ مِّنْ اَنْفُسِكُمْ اَزْوَاجًا وَّ مِنَ الْاَنْعَامِ اَزْوَاجًا يَذْرَؤُكُمْ فِيْهِ لَيْسَ كَمِثْلِهٖ شَيْءٌ وَ هُوَ السَّمِيْعُ الْبَصِيْرُ.

তিনি আকাশমণ্ডলী ও পৃথিবীর সৃষ্টিকর্তা। তিনি তোমাদেরই মধ্য থেকে তোমাদের জন্য জোড়া সৃষ্টি করেছেন এবং চতুষ্পদ জন্তুর মধ্যেও সৃষ্টি করেছেন জোড়া। এর মাধ্যমে তিনি তোমাদের বংশ বিস্তার করেন। তাঁর অনুরূপ বলতে কিছু নেই। তিনিই সব কথা শোনেন, সবকিছু দেখেন। -সূরা শূরা (৪২) : ১১

লক্ষ করুন, এতে শুরুতে ও শেষে আল্লাহ তাআলার গুণাবলি বর্ণিত হয়েছে। আর মাঝখানে মাখলূকের সাথে তাঁর সাদৃশ্য সম্পূর্ণরূপে নাকচ করা হয়েছে। সুতরাং কুরআন ও হাদীসে বর্ণিত শব্দে আল্লাহর সিফাত সাব্যস্ত করার পাশাপাশি সেসব সিফাতের অর্থ ও মর্মের ক্ষেত্রে মাখলূকের সাদৃশ্য হতে তাঁর পবিত্রতা ঘোষণা করাও জরুরি। এ দুয়ের মাঝে কোনো বৈপরীত্য নেই।

তাই তো প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম আবু জাফর তহাবী রাহ. (ওফাত : ৩২১ হি.) এব্যাপারে সতর্ক করে বলেন-

ومن لم يتوقَّ النفيَ والتشبيهَ زلَّ ولم يُصِب التنزيهَ، فإن ربَّنا جل وعلا موصوفٌ بصفات الوحدانية، منعوتٌ بنُعوت الفردانية، ليس في معناه أحدٌ من البرية .

যারা সিফাতের ক্ষেত্রে যুগপৎভাবে অস্বীকৃতি এবং সাদৃশ্যায়ন থেকে পরহেয করে না, তারা সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত হয় এবং যথার্থভাবে রবের পবিত্রতা বর্ণনায় এবং পবিত্রতা রক্ষায় ব্যর্থ হয়। কেননা আমাদের মহামহিম রব অনন্য সব গুণে গুণান্বিত এবং অনুপম সব বিশেষণে বিশেষিত। সৃষ্টিজগতের কেউই তাঁর সমার্থক নয়। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৬৩, হিন্দুস্তানী নুসখা

ইমাম তহাবী রাহ. তাঁর বর্ণিত উপরোক্ত নীতিটি যথাযথ প্রয়োগও করেছেন।

যেমন তিনি আল্লাহ তাআলার কালাম গুণ সম্পর্কে বলেন-

وإن القرآن كلامُ الله، منه بدا بلا كيفية قولاً، وأنزله على رسوله وَحيًا.

নিশ্চয়ই কুরআন হল আল্লাহর কালাম; যা সবধরনের কাইফিয়্যাত ও ধরন-ধারণমুক্ত বাণী হিসেবে তাঁর থেকে প্রকাশিত হয়েছে এবং ওহী মারফত তিনি তা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ওপর নাযিল করেছেন। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫৪-৫৫, হিন্দুস্তানী নুসখা

গযব ও ক্রোধ এবং রিযা ও সন্তুষ্টি- এই দুই গুণ প্রসঙ্গে তিনি বলেন-

والله يغضب ويرضى لا كأحد من الورى.

তিনি ক্রোধান্বিত হন এবং সন্তুষ্ট হন, কিন্তু সেই ক্রোধ ও সন্তুষ্টি কোনো মাখলূকের মতো নয়। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ১৩৫-১৩৬ হিন্দুস্তানী নুসখা

এমনিভাবে জান্নাতে মুমিন বান্দাগণ আল্লাহ তাআলার দর্শন লাভে ধন্য হবে- এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন-

والرؤية حق لأهل الجنة بغير إحاطة ولا كيفية.

জান্নাতবাসীরা আল্লাহর দর্শন লাভ করবে- একথা সত্য, কিন্তু সেই দর্শন হবে দৃষ্টিসীমা দ্বারা পরিবেষ্টন করা ছাড়া এবং কোনো কাইফিয়্যাত ও ধরন-ধারণ ছাড়া। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫৮-৫৯, হিন্দুস্তানী নুসখা

এতক্ষণের আলোচনার সারসংক্ষেপ হল, আল্লাহ তাআলার অস্তিত্বের এবং তাঁর গুণাবলির অনন্যতা সম্পর্কে আকীদা রাখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য জরুরি। তবে সেই আকীদা সাধারণত এজমালীভাবে থাকাই যথেষ্ঠ, যতক্ষণ না কোনো ব্যক্তির মনে কোনো বিষয়ে এর বিপরীত কোনো ধারণা ও কথার জন্ম হয়। তখন সেই ব্যক্তির উপর আকীদা বিশুদ্ধ করার জন্য ঐ বিষয়ে আল্লাহ তাআলার পবিত্রতা ও অনন্যতার তফসীলী আকীদা জানা ও আকীদা রাখা জরুরি হয়ে যায়। এমনিভাবে যখন কোনো ব্যক্তির কাছে আল্লাহ তাআলার যাত বা সিফাত সম্বন্ধে বিদআতী ও বাতিলপন্থীদের কোনো ভ্রান্ত ধারণা ও কথাবার্তা পৌঁছে, তখন ঈমানের হেফাজতের জন্য তফসীলীভাবে তাঁর যাত ও সিফাতের অনন্যতার আকীদা সম্পর্কে জানা জরুরি হয়ে পড়ে।

মহান আল্লাহ তাআলার অস্তিত্ব আমাদের দৃষ্টিগোচর ও দৃষ্টির অগোচর যত অস্তিÍত্ব আছে সব অস্তিত্বের অতীত। তাঁর অস্তিত্ব অন্য কোনো অস্তিত্বের মতো নয়। তাঁর অস্তিত্ব সর্বোতভাবে অনন্য। তাই তাঁর অস্তিত্বের অনন্যতা সম্পর্কে আকীদা রাখা প্রত্যেক মুমিনের জন্য জরুরি। আমরা এখন তাঁর সত্তাগত অনন্যতার আলোচনার শুরতেই এ সংক্রান্ত একটি গুরুত্বপূর্ণ মূলনীতি সম্পর্কে জানব।

প্রখ্যাত মুহাদ্দিস ও ফকীহ ইমাম আবু জাফর তহাবী রাহ. (ওফাত : ৩২১ হি.) তাঁর বিখ্যাত আকীদা গ্রন্থে মহান আল্লাহ তাআলার পবিত্র সত্তার অনন্যতা সম্পর্কে অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত ও সমৃদ্ধ ভাষায় সর্বব্যাপী মূলনীতি উল্লেখ করেছেন-

لا تَبْلُغُه الأَوهامُ ولا تُدْرِكُه الأفهامُ، ولا يُشبِهُ الأنامَ.

কারও কল্পনা তাঁর পর্যন্ত পৌঁছতে পারে না, মানুষের সমঝ-বুঝ তাঁকে বেষ্টন করতে পারে না এবং তিনি জগতের অন্য কোনো কিছুর মতো নন -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৩৫-৩৬, হিন্দুস্তানী নুসখা

লক্ষ করুন, ইমাম তহাবী রাহ. উপরোক্ত মূলনীতিটিতে মাখলূকের সাথে আল্লাহ তাআলার সাদৃশ্য কত ব্যাপকভাবে ও সূক্ষ্মভাবে নাকচ করেছেন! যার সারমর্ম হল, আমরা দুচোখ দিয়ে যা কিছু দেখি, কান দিয়ে যা কিছু শুনি, নাক দিয়ে যত ঘ্রাণ অনুভব করি, জিহ্বা দিয়ে যত স্বাদ অনুভব করি, ত্বক দিয়ে যা কিছু উপলব্ধি করি, অন্তর দিয়ে যা কিছু কল্পনা করি, তিনি সেরকম কিছু নন; তিনি এসবের ঊর্ধ্বে।

অথচ কল্পনার পরিধি পঞ্চেন্দ্রিয়ের চেয়ে অনেক বেশি ব্যাপক। কারণ যেসব বস্তু ও বিষয়কে বাস্তবে পঞ্চেন্দ্রিয় দিয়ে অনুভব করা যায় না, কল্পনাশক্তি দিয়ে সেসব অনুমান করা যায়। এই কল্পনা শক্তি দিয়ে মানুষ কত অবাস্তব বিষয়ের ছবি আঁকে, অনুমান করে এবং পরিকল্পনা করে। কিন্তু মহামহিম আল্লাহর সত্তার হাকীকত এতটাই অনন্য যে, কল্পনা দিয়ে তাঁকে অনুমান করা যায় না। করা সম্ভবও নয়। কেননা তিনি তো অন্য কিছুর মতো নন, যে তার সাথে তুলনা করে তাঁকে অনুমান করা যাবে। তিনি তো দেহধারী কোনো সত্তা নন, যে তাঁর কোনো রূপ বা আকৃতি অনুমান করা যাবে; বরং তিনি হলেন নিরাকার-নিরাধার অনুপম সত্তা।

আল্লাহ তাআলা তাঁর মুমিন বান্দাদের জন্য যে জান্নাত প্রস্তুত করে রেখেছেন তা কেমন- সে সম্পর্কে হাদীস শরীফে ইরশাদ হয়েছে-

مَا لَا عَيْنٌ رَأَتْ، وَلَا أُذُنٌ سَمِعَتْ، وَلَا خَطَرَ عَلَى قَلْبِ بَشَرٍ.

যা কোনো চোখ কখনো দেখেনি, কোনো কান কখনো শোনেনি এবং যা কোনো মানুষের অন্তর কখনো কল্পনাও করেনি। -সহীহ বুখারী, হাদীস ৩২৪৪; সহীহ মুসলিম, হাদীস ২৮২৪

একটু ভাবুন, গায়েবের জগতের জান্নাত, যা আল্লাহ তাআলার সৃষ্টি, তা যখন এত বেমিছাল, তখন মহান আল্লাহ তাআলা, যিনি সব গায়েবের চেয়ে বেশি গায়েব, তিনি কত বেমেছাল, তিনি মানুষের কল্পনার কত ঊর্ধ্বে।

মনে রাখতে হবে, উপরোক্ত মূলনীতিটি আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর সর্বজন স্বীকৃত মূলনীতি। আল্লাহ তাআলার সত্তাগত যেকোনো সিফাতের মর্ম বোঝার ক্ষেত্রে এটি প্রয়োগ করা জরুরি। তাঁর যেকোনো সিফাতের এমন ব্যাখ্যা পরিহার করা জরুরি, যা মানুষের কল্পনাযোগ্য এবং কোনো মাখলূকের সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।

এরপর দেখুন, ইমাম তহাবী রাহ. আল্লাহ তাআলার ওপর মানবীয় গুণ আরোপের ভয়াবহতা সম্পর্কে সতর্ক করে বলেছেন-

ومن وَصَفَ الله بمعنى من معاني البشر فقد كفر، فمن أبصر هذا اعتبر، وعن مثل قول الكفار انزجر، وعلم أنه بصفاته ليس كالبشر.

যারা আল্লাহ তাআলাকে মানবীয় কোনো বৈশিষ্ট্যে বিশেষিত করে তারা মূলত কুফরে লিপ্ত হয়। সুতরাং যারা এবিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হয় তারা সঠিক শিক্ষা লাভ করে, তারা কাফেরদের মতো কথা বলা থেকে বিরত থাকে এবং তারা বুঝতে পারে যে, আল্লাহ তাআলা তাঁর গুণাবলির ক্ষেত্রে মানুষের মতো নন। -আলআকীদাতুত তহাবিয়্যাহ, পৃ. ৫৭-৫৮, হিন্দুস্তানী নুসখা

আল্লাহ তাআলার সত্তাগত অনন্যতার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, তিনি দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতি থেকে চিরপবিত্র। কেননা দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং আকার-আকৃতি থাকা মাখলূকের বৈশিষ্ট্য এবং তার মুখাপেক্ষিতা, সীমাবদ্ধতা ও নশ্বরতার প্রকাশ। বরং এসব হল সাদৃশ্যের প্রকাশ্য দিক এবং কল্পনার সবচেয়ে বড় ক্ষেত্র। তাই কুরআন ও হাদীসের এবং অকাট্য যুক্তি-বুদ্ধির যেসব দলীল-প্রমাণ দ্বারা তাঁর সাদৃশ্যহীনতা, অমুখাপেক্ষিতা, অকল্পনীয়তা, অসীমতা ও চিরন্তনতা প্রমাণিত, সেসব দলীল-প্রমাণ দ্বারা একথাও প্রমাণিত যে, তিনি দেহ, অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ ও আকার-আকৃতি থেকে চিরপবিত্র।

আমরা জানি, জগতে যত মাখলূক ও সৃষ্টি রয়েছে তার অন্যতম প্রকার হচ্ছে পদার্থ বা বস্তু এবং এই পদার্থের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল দেহধারী হওয়া। দেহ বলা হয় অংশবিশিষ্ট বা অঙ্গবিশিষ্ট এমন যেকোনো বস্তুকে, যা কোনো স্থান দখল করে অবস্থান করে এবং যার বিস্তৃতি রয়েছে অর্থাৎ দৈর্ঘ্য, প্রস্থ ও গভীরতা রয়েছে। জগতে বিভিন্ন ধরনের পদার্থ রয়েছে; কঠিন, তরল, বায়বীয় ইত্যাদি। কিছু পদার্থ রয়েছে, যা স্থূলদেহী, যেমন মানুষসহ সকল দৃশ্যমান প্রাণী, উদ্ভিদ ও অন্যান্য জড়পদার্থ। আর কিছু আছে সূক্ষ্মদেহী, যেমন আলো, বাতাস, রূহ ও আত্মা এবং আগুনের তৈরি জিন ও নূরের তৈরি ফিরিশতা ইত্যাদি।

তো দেহধারী হওয়া যেহেতু একশ্রেণির মাখলূকের বৈশিষ্ট্য, তাই আল্লাহ তাআলকে যদি দেহধারী বলা হয় তবে তা হবে আল্লাহকে মাখলূকের সমশ্রেণি বিশ্বাস করার নামান্তর। এমনিভাবে আল্লাহকে যদি সাকার বলা হয় তবে তা হবে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য সদৃশ ও সমশ্রেণি সাব্যস্তের নামান্তর, যা ওহীর শিক্ষা ও সুস্থ বিবেক-বুদ্ধির সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাছাড়া দেহত্ব হল সীমাবদ্ধতা এবং নশ্বরত্বের প্রমাণ। সুতরাং আল্লাহ তাআলা দেহধারী হওয়া কিংবা সাকার হওয়া অসম্ভব। তাই তিনি দেহধারী নন; স্থূলদেহীও নন, সূক্ষ্মদেহীও নন, তিনি এসবের ঊর্ধ্বে।

এমনিভাবে আল্লাহ তাআলা যেহেতু দেহধারী নন তাই দেহগত যত বৈশিষ্ট্য আছে, তা থেকে তিনি চিরপবিত্র। আমরা জানি, দেহের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হচ্ছে অংশবিশিষ্ট হওয়া, বিভাজ্য হওয়া, স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ হওয়া এবং আকার-আকৃতিবিশিষ্ট হওয়া। সুতরাং আল্লাহ তাআলা অংশ বা অঙ্গবিশিষ্ট নন, স্থানের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন এবং আকার-আকৃতিবিশিষ্টও নন; বরং তিনি নিরাকার- নিরাধার বেমেছাল সত্তা।

বস্তুত দ্বীনুল ইসলাম হল শিরকমুক্ত খালেস তাওহীদের ধর্ম। এতে স্রষ্টার বৈশিষ্ট্যে সৃষ্টিকে শরীক করার যেমন অবকাশ নেই, তেমনি সৃষ্টির বৈশিষ্ট্যে স্রষ্টাকে শরীক করারও কোনো অবকাশ নেই। সর্বোপরি ইসলামে মূর্তিপূজা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ও হারাম। তাই বাস্তবে ইলাহ ও ঈশ্বরের মূর্তি বানানো যেমন হারাম, তেমনি অন্তরে তাঁর মূর্তি কল্পনা করাও হারাম। কেউ মাটি বা পাথর দিয়ে মূর্তি বানিয়ে পূজা করলে তা যেমন শিরক, তেমনি মনের মধ্যে ভাবমূর্তি তৈরি করে তার পূজা করাও শিরক। আর তাই ইসলামে স্রষ্টাকে সাকার ও মূর্তিরূপে কল্পনা করার কোনো সুযোগ নেই।

সুতরাং কেউ যখন স্রষ্টাকে মাখলূকের মতো সাকার ও দেহধারী মনে করেন, মানুষের মতো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অধিকারী মনে করেন তখন সে মূলত স্রষ্টাকে মূর্তিরূপেই কল্পনা করেন। এখন সে যত ক্ষুদ্র মূর্তিই কল্পনা করুক, যেমন সরিষাদানার মতো আর যত বৃহৎ মূর্তিই কল্পনা করুক, যেমন পাহাড়ের সমান বা আসমানের সমান; মূর্তিকে সে যমীনে স্থাপন করুক বা সপ্ত আসমানের ওপরে স্থাপন করুক- সর্বাবস্থায় তা মূর্তিপূজারূপেই বিবেচিত হবে। এ বিষয়টি বিশদভাবে ব্যাখ্যা করেছেন ইমাম গাযালী রাহ.। তিনি বলেছেন-

فإِنَّ مَنْ خَطَر ببَالِه أنَّ اللهَ جِسمٌ مُرَكَّبٌ من أَعضاءٍ، فهو عابدُ صَنَمٍ، وأنَّ كلَّ جِسمٍ مخلوقٌ، وعبادةُ الصنمِ كفرٌ، لأنَّه مخلوقٌ، وكان مخلوقاً، لأنه جسمٌ، فمن عَبَدَ جسماً فهو كافرٌ بإجماعِ الأئمةِ؛ السلفِ منهم والخلفِ.

سواءٌ كان ذلك الجسمُ كَثِيفاً كالجِبالِ الصُمِّ الصلابِ، أو لَطِيفاً كالهَواءِ والمَاءِ، وسواءٌ كان مُظْلَماً كالأرضِ،
أو مُشْرِقاً كالشمسِ والقمرِ والكواكبِ، أو مُشِفًّا لا لونَ له كالهواءِ، أو عظيماً كالعرشِ والكرسيِ والسماءِ،
أو صَغِيراً كالذَّرَّةِ والهَباءِ، أو جَمَاداً كالحِجارةِ، أو حَيْواناً كالإنسانِ، فالجِسْمُ صَنَمٌ، فَبِأَن يُقدَّرَ حُسْنُه وجَمالُه،
أو عِظَمُه أو صِغَرُه، أو صَلابتُه ونَقَاؤُه...، لا يَخْرُجُ عن كونِه صنماً.

যার অন্তরে এই ধারণা হয় যে, ‘আল্লাহ হলেন বিভিন্ন অঙ্গযুক্ত দেহধারী সত্তা’ সে মূলত মূর্তিপূজারী। কেননা প্রত্যেক দেহধারীই হল মাখলূক এবং যেকোনো মূর্তির ইবাদত কুফর হওয়ার কারণ এটাই যে, মূর্তি হল মাখলূক। আর যেকোনো মূর্তিই মাখলূক হওয়ার প্রমাণ এটাই যে, সে দেহধারী। তাই যে ব্যক্তি দেহধারী বস্তুর ইবাদত করে সে সকল ইমামদের মতে কাফের; অর্থাৎ সালাফ ও খালাফ সকল ইমামদের মতেই সে কাফের।

এখন সেই ধারণাকৃত দেহধারী মাবূদ শক্ত কঠিন পাহাড়সম স্থূলদেহী হোক কিংবা বায়ু বা বাতাসের মতো নরম ও সূক্ষ্মদেহী হোক। ভূমি ও মাটির মতো অন্ধকার বস্তু হোক কিংবা চাঁদ-সুরুজ-তারকার মতো আলোকিত বস্তু হোক কিংবা বাতাসের মতো বর্ণহীন স্বচ্ছ পাতলা বস্তু হোক। আসমান-আরশ-কুরসীর মতো বৃহৎ বস্তু হোক কিংবা যাররা ও অণু-পরমাণুর মতো ক্ষুদ্র বস্তু হোক। পাথরের মতো নিষ্প্রাণ জড়পদার্থ হোক কিংবা মানুষের মতো কোনো প্রাণী হোক। মোটকথা, প্রত্যেক দেহধারী বস্তুকেই ‘সনাম’ বা মূর্তি বলা হয়; এখন সেই দেহধারী বস্তুর সৌন্দর্য যা-ই হোক, তার কলেবর যত ছোট বা বড় হোক এবং তা যত স্বচ্ছ বা অস্বচ্ছ হোক সর্ব অবস্থায় তা মূর্তি বা মূর্ত বস্তু। -ইলজামুল আওয়াম আন ইলমিল কালাম, ইমাম গাযালী, পৃ. ৫২, (দারুল মিনহাজ)

এটা শুধু ইমাম গাযালীর বক্তব্য নয়, বরং এর আগে ও পরে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর আরও অনেক আলেম এমন কথা বলেছেন। কোনো কোনো সালাফ সংক্ষেপে বলতেন-

المُمَثِّل يَعْبُدُ صَنَماً.

(দেহবাদী মূলত মূর্তিপূজা করে।)

আর তাই সাহাবায়ে কেরাম থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমামদের মুজমা আলাইহি ও মুতাওয়ারাছ আকীদা হল, আল্লাহ তাআলা মাখলূকের মতো সব ধরনের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ এবং সীমা ও পরিসীমা থেকে চিরপবিত্র।

পরিশেষে জানতে চাই,দেহবাদী, আকার আকৃতি, সীমাবদ্ধ তা আকিদাপন্থী মুর্তিপুজারী নাস্তিক কি এই যামানায় নেই?

Address

Sylhet

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Shaik Usman bin Rashid posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Videos

Share

Category