14/02/2025
সুন্দরবন, বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন, বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলের জন্য প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ের সময় এই বন তার ঘন বৃক্ষরাজি ও জটিল শিকড়ের কাঠামো দিয়ে ঝড়ের গতি ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা কমিয়ে উপকূলবাসীকে রক্ষা করে। কিন্তু প্রতিবারই ঝড়ের বিরুদ্ধে লড়াই করে সুন্দরবন ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এটি শুধু একটি বন নয়, এটি আমাদের উপকূলের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বরের ভোলা ঘূর্ণিঝড়, যা 'দ্য গ্রেট ভোলা সাইক্লোন' নামেও পরিচিত, বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) উপকূলীয় অঞ্চলে ঘণ্টায় প্রায় ১৮৫ কিলোমিটার বেগে আঘাত হানে, যার ফলে ১০ থেকে ৩৩ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাস সৃষ্টি হয়। এতে প্রায় ৫ লাখ মানুষ প্রাণ হারায়, বিশেষ করে ভোলা জেলার তজুমদ্দিন উপজেলায়, যেখানে ১,৬৭,০০০ জন অধিবাসীর মধ্যে ৭৭,০০০ জনই (প্রায় ৪৬%) মৃত্যুবরণ করেন। জলোচ্ছ্বাসের কারণে উপকূলীয় এলাকার গ্রাম, ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত এবং অবকাঠামো সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়, যা স্থানীয় অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে। তবে, বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে অবস্থিত সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে কাজ করে ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতা কমাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এর ঘন বৃক্ষরাজি ও জটিল শিকড়ের কাঠামো বাতাসের গতি কমিয়ে দেয় এবং জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা হ্রাস করে, ফলে উপকূলীয় অঞ্চলগুলোতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসে। সুন্দরবন না থাকলে ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের ক্ষয়ক্ষতি আরও ব্যাপক হতে পারত।
১৯৯১ সালের ২৯-৩০ এপ্রিলের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড়টি বাংলাদেশের উপকূলে প্রায় ২৫০ কিমি/ঘণ্টা বেগে আঘাত করে। এই দুর্যোগে প্রায় ১,৩৮,০০০ মানুষ প্রাণ হারায় এবং প্রায় ১ কোটি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, ভোলা ও নোয়াখালীতে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ হয়, যার ফলে আনুমানিক ১.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের ক্ষতি হয়। তবে, এই ভয়াবহতার মধ্যেও সুন্দরবন প্রাকৃতিক ঢাল হিসেবে দাঁড়ায়। সুন্দরবন সমুদ্রের প্রবল জলোচ্ছ্বাস ও ঝোড়ো বাতাসের গতি অনেকটাই কমিয়ে দেয়, যার ফলে উপকূলীয় অঞ্চলে ধ্বংসের মাত্রা তুলনামূলকভাবে কম হয়।
২০০৭ সালের ১৫ নভেম্বর, ঘূর্ণিঝড় সিডর বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে, যার ফলে কমপক্ষে ৩,৪৪৭ জন মানুষ প্রাণ হারান এবং গৃহহীন হয় ৮৯,৭৮৫টি পরিবার। সরকারি হিসাব অনুযায়ী, সিডরের কারণে মোট ক্ষতির পরিমাণ ছিল প্রায় ১.৭ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে, সুন্দরবন এবারও ঝড়ের গতি ও তীব্রতা কমিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলকে বড় ধরনের বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। ম্যানগ্রোভের জটিল শিকড়ের কাঠামো ঢেউয়ের শক্তি শোষণ করে এবং ভূমিক্ষয় রোধ করে, যা জলোচ্ছ্বাসের প্রভাব কমাতে সহায়তা করে। এ ঝড়ে সুন্দরবনের পশুর নদীতে বেশ কিছু হরিণের মৃতদেহ ভাসতে দেখা যায় এবং বিভিন্ন প্রাণীর মৃত্যু হয়।
২০০৯ সালের ২৫ মে, ঘূর্ণিঝড় আইলা বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকায় আঘাত হানে, যার ফলে আনুমানিক ১৯৩ জন নিহত হন, কমপক্ষে ৭,০০০ জন আহত হয়েছেন, এবং প্রায় ৬,০০,০০০ খড়ের বাড়ি, ৮,৮০০ কি.মি. রাস্তা, ১,০০০ কি.মি. বাঁধ এবং ১,২৩,০০০ হেক্টর জমির ক্ষতি হয়েছে। তবে সুন্দরবন বাংলাদেশের ঢাল হিসেবে থাকায় ক্ষয়ক্ষতি অনেকটাই কম হয়েছে। প্রকৃতির এই ঢাল যে কেবল মানুষকে রক্ষা করে তা নয়, এটি অসংখ্য প্রাণীর আশ্রয়স্থল, যা ঝড়ের তাণ্ডবে প্রতিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে ঘূর্ণিঝড় বুলবুল বাংলাদেশের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে, যার ফলে প্রায় ১০ লাখ ৭০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ২২,৮৩৬ হেক্টর জমির ফসল নষ্ট হয়, এবং চার থেকে পাঁচ হাজার ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তবে, সুন্দরবন তার ঘন ম্যানগ্রোভ বনাঞ্চল দিয়ে ঝড়ের গতি ও তীব্রতা কমিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলকে আরও ভয়াবহ ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা করে।
২০২০ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় আম্পান বাংলাদেশ ও ভারতের উপকূলীয় অঞ্চলে আঘাত হানে। ঘূর্ণিঝড় আম্পানে ২৬ জেলার ১ হাজার ১০০ কোটি টাকারও বেশি ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। তবে, সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ বন প্রাকৃতিক প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে, ঝড়ের গতি ও শক্তি কমিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলকে আরও বড় ক্ষতি থেকে রক্ষা করে। আম্পান প্রমাণ করে দিল, প্রকৃতি আমাদের জন্য লড়াই করছে, কিন্তু আমরা কি প্রকৃতির জন্য কিছু করছি? ২০২১ সালের মে মাসে ঘূর্ণিঝড় ইয়াসের প্রভাবে বাংলাদেশের উপকূলীয় নয় জেলার ২৭টি উপজেলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জলোচ্ছ্বাস ও প্রবল বাতাসের কারণে সুন্দরবনের বিভিন্ন অবকাঠামো, যেমন জলযান, ওয়াচ টাওয়ার, গোলঘর এবং ফুটরেল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সুন্দরবন তার প্রাকৃতিক প্রতিরোধ ক্ষমতা দিয়ে উপকূলীয় অঞ্চলকে রক্ষা করে, তবে নিজেও ক্ষতির সম্মুখীন হয়।
ঘূর্ণিঝড় রেমাল ২৬ মে ২০২৪ তারিখে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, খুলনা, বাগেরহাট ও মংলাসহ কয়েকটি জেলায় আঘাত হানে। ঝড়ের সময় বাতাসের গতিবেগ ঘণ্টায় ১২০ কিলোমিটার পর্যন্ত পৌঁছায়। সুন্দরবনের ঘন ম্যানগ্রোভ বন ঝড়ের তীব্রতা কমিয়ে দেয়, ফলে লোকালয়ে পৌঁছানোর আগে ঝড়ের গতি ও জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস পায়। এতে উপকূলীয় এলাকায় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে যায়।
সুন্দরবন আমাদের প্রাকৃতিক রক্ষাকবচ হিসেবে প্রতিনিয়ত ছোট-বড় নানা দুর্যোগ থেকে আমাদের সুরক্ষা দিয়ে আসছে। এর ঘন ম্যানগ্রোভ বনপ্রান্তর ঝড়ের গতি কমিয়ে এবং জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতা হ্রাস করে উপকূলীয় অঞ্চলকে বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা করে। তবে, প্রতিটি দুর্যোগের সময় সুন্দরবন নিজেই ক্ষতির সম্মুখীন হয়, যা তার জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
সুন্দরবনের এই অপরিসীম অবদানের প্রতি সম্মান জানাতে প্রতি বছর ১৪ ফেব্রুয়ারি 'সুন্দরবন দিবস' পালন করা হয়। এই দিবসের মূল উদ্দেশ্য হলো সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা। আমাদের উচিত এই বিশেষ দিনে সুন্দরবনকে ভালোবাসা ও সুরক্ষার প্রতিজ্ঞা করা। সুন্দরবন কেবল গাছগাছালির বন নয়, এটি আমাদের অস্তিত্বের রক্ষাকবচ, আমাদের ভবিষ্যতের নিশ্চয়তা।