09/12/2024
এদেশের অধিকাংশ বৌদ্ধদের বদ্ধমূল ধারণা হল, ভিক্ষু হলে আজীবন থাকতে হবে । টিকতে না-পারলে জীবনটা উৎসন্নে যাবে, বরবাদ হয়ে যাবে । তারা মনে করে ভিক্ষু হয়ে অর্ধপদ থেকে ঝড়ে পড়া মানে একূল-ওকূল হারিয়ে ফেলা । এদেশের বৌদ্ধদের এটা একটা মস্তবড় ভুল ধারণা । এ ধারণাটি বিশেষ করে চাকমা সমাজে বেশি প্রচলন আছে । ভিক্ষু হয়ে যাবজ্জীবন টিকতে না-পারলে জীবনটা বরবাদ হয়ে যাবে—এই ভয়ে অনেকে ভিক্ষু হতে চাই না । ঝুঁকি নিতে চাই না । ভিক্ষু হওয়া নিয়ে তাদের মনের ভেতরে একধরণের চাপা ভীতি কাজ করে । অন্ধ অশিক্ষিত বৌদ্ধ সমাজই তাদের মনে সেই ভীতি, ভ্রান্ত ধারণাগুলো ঢুকিয়ে দিয়েছে ।
ভিক্ষু হলে আজীবন থাকতে হবে এমন কোন বিধিবিধান নেই- বৌদ্ধধর্মে । আর আজীবন টিকতে না-পারলে জীবনটা বৃথা যাবে এমনটা ভাবারও কারণ নেই । যে যত মাস, যত বৎসর পরিশুদ্ধভাবে থাকতে পারেন, তার ততই লাভ, ততই মঙ্গল । আমরণকাল থাকতে পারলে তো কথায় নেই । একজন ভিক্ষু বৌদ্ধশাসনে এসে কয়েক বছর অবস্থান করে যে জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জন করে, একটি নামজাদা কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে স্টাডি করলেও সেই জ্ঞান, অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারবে না । আর একজন গৃহী সারাজীবন পুণ্যকর্ম করলেও তার পুণ্যরাশি সেই ভিক্ষুর পুণ্যরাশি হতে অর্ধাংশ হবে না— যে ভিক্ষু দুই-তিন বর্ষা পরিশুদ্ধভাবে ব্রহ্মচর্য জীবন কাটিয়ে গৃহী ঘরে ফিরে গেছে ।
খুদ্দক নিকায়ের অন্তর্গত অপদান গ্রন্থে "পর্ণদায়ক বর্গে" একজন ভিক্ষুর কথা উল্লেখ আছে । সে ভিক্ষুটি নাকি অতীতে কেবল সাতদিন পরিশুদ্ধ ভিক্ষু জীবন কাটিয়ে চীবর ত্যাগ করে গৃহী জীবনে ফিরে গেছে । সাতদিন ব্রহ্মচর্যা পালনের পুণ্য ফলে সে একবার চক্রবর্তী রাজা হয়েছেন, বহুবার স্বর্গ সুখ ভোগ করেছেন, এবং তার নাকি কোনো কালে চারি অপায়ে যেতে হয় নি । শেষ জন্মে গৌতম বুদ্ধকে সাক্ষাৎ পেয়ে প্রব্রজিত হয়ে অর্হত্ব মার্গফল লাভ করেছেন । সে ভিক্ষুটি যদি সাতদিন ব্রহ্মচর্যা পালন করে এত সুখ লাভ করতে পারে, তাহলে যারা কয়েক বর্ষা ভিক্ষু জীবন কাটিয়ে গৃহী জীবনে ফিরে গেছে, তারা কত পুণ্য সঞ্চয় করে নিয়ে গেছেন। ভেবে দেখুন ।
আসলেই ব্রহ্মচর্য পালনে কী যে পুণ্য হয়, কী যে মহত্ব লুকিয়ে আছে, আমার মনে হয়, এতদঞ্চলের সিংহভাগ বৌদ্ধ সে সুফল, মহত্বের ব্যাপারে অবিদিত । আজকে তারা ব্রহ্মচর্যার পালন সুফল, মহত্বতা জানে না বলে তো ভিক্ষু হয় না, তাদের ছেলেদের ভিক্ষু হওয়ার উৎসাহিত করে না । আর যারা কয়েক বর্ষা ভিক্ষু জীবন কাটিয়ে ঘরে ফিরে যায়, তাদেরকে নানা অদ্ভুত অদ্ভুত অসংলগ্ন কথাবার্তা বলে থাকেন । সমাজে তাদের হেয় করা হয়, বিভিন্ন অকথ্য ভাষায় নিন্দা, সমালোচনা, ঠাট্টা মশকারী করেন ।
ভিক্ষু জীবন ত্যাগ করে যারা গৃহী জীবনে চলে গেছে, তারা প্রায় কমবেশি সমাজের লোকদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে নানারকম অসৌজন্যমূলক কথা-বার্তা, ঠাট্টা মশকারি, নিন্দা বাক্য শুনতে হয়েছে । সেই ধর্মজ্ঞানহীন নিন্দুকদের ভাষ্য হল, আজীবন টিকতে না-পারলে কেন মুখ বড় করে ভিক্ষু হয়েছে । কত মানুষকে বড়ো বড়ো, লম্বা লম্বা লেকচার দিয়েছে, এখন আবার নির্লজ্জ হয়ে ঘরে ফিরে এসেছে । কত মানুষ কত কি বলে থাকে তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই । এভাবে নানা তিক্ত কথায় তিরস্কার, সমালোচনা করে প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের মানসিক নির্যাতন করা হয় । সহজ কথায় বলতে গেলে এতদঞ্চলের বৌদ্ধরা প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের অপাঙক্তেয় মনে করে । বেশির ভাগ মানুষ তাদের ভালো চোখে চাই না । আর সে যদি গরীব মানুষের ছেলে হয় কিংবা অর্ধশিক্ষিত হয়ে থাকে, তাহলে তো আর কথায় নেই । সেজন্য প্রব্রজ্যা ত্যাগীরা অধিকাংশই ঘরে না-গিয়ে শহরে অথবা বিদেশে চলে যায় সমাজের লোকনিন্দা, সমালোচনার ভয়ে । আর যারা ঘরে চলে যায় তারাও ঘর থেকে খুুব কম সময়ও বের হয় মানুষের নিন্দা ও টিটকারীর ভয়ে ।
আমার একজন সুপরিচিত ভিক্ষু ছিল । সেও কয়েক বর্ষা পরিশুদ্ধভাবে ভিক্ষু জীবন কাটিয়ে চিত্ত রমিত না হওয়ার কারণে গৃহী জীবনে ফিরে যায় । কিন্তু, ঘরে গিয়ে তার হয় এক মহা বিপদ । যেদিন বাড়িতে ফিরে গেছে সেদিন হতে গ্রামের লোকেরা নাকি তাকে নানা অসৌজন্যমূলক কথায় অপমান, নিন্দা, সমোলোচনা করা শুরু করেছে । এদিকে তাদের সাথে না-পারছে তর্ক করতে, না-পারছে ঝগড়ায় জড়িয়ে পড়তে, না-পারছে এড়িয়ে চলতে । শেষমেষ সমাজের লোকদের সমালোচনা, নিন্দা, অপমান সহ্য করতে না পেরে অগত্যা সে শহরে চলে যায় । অথচ তার কারণে কত মানুষ পুণ্য কর্ম করতে পেরেছে, কত মানুষকে পাপ-অকুশল কর্ম থেকে নিবৃত্ত করেছেন, কত উপাসক-উপাসিকাদের ধর্ম দেশনা দিয়ে উপকার করেছেন ।
মানুষ এখন তার সেইসব উপকারের কথা বেমালুম ভুলে গেছে- তিনি গৃহী হয়েছেন বলে । অকৃতজ্ঞ ও নোংরা সমাজে উপকারী লোকদের এভাবে অপ্রত্যাশিত অপ্রীতিকর পরিস্থিতির স্বীকার হতে হয় । এই হলো, প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের প্রতি আমাদের অন্ধ বৌদ্ধ সমাজের আচার-ব্যবহার, দৃষ্টিভঙ্গি, মন-মানসিকতা । সেই কারণে অনেকে ভিক্ষু হবার একটু আধটু মন থাকলেও সেই সমালোচনার ভয়ে ভিক্ষুও হতে চায় না । কারণ, আজীবন টিকতে না পারলে তারাও পরবর্তীতে সমালোচনার মুখোমুখী ও নিন্দার পাত্র হবেন ।
বহু জ্ঞানী-গুণী ভান্তের কাছ থেকে শুনেছি এবং অনেক ধর্মীয় গ্রন্থেও পড়েছি যে, প্রতিরূপ দেশ নামে খ্যাত মিয়ানমার, শ্রীলংকায়, থাইল্যান্ডে নাকি যে যতদিন, যত মাস, যত বৎসর বুদ্ধ শাসনে প্রব্রজ্যা অবস্থায় থাকতে পেরেছেন, চীবর ছাড়লেও তাদের সে দেশের লোকেরা সমাজে সাদরে গ্রহণ করে । তারা কখনো সমালোচনা করেন না । প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের তারা নাকি এই কারণে সাধুবাদ দিয়ে থাকে, "তুমি ভিক্ষু হয়েছো বলে, আমরা আপনার মাধ্যমে বহু দান-পুণ্যকর্ম সম্পাদন করতে পেরেছি, বুদ্ধের অমৃতবাণী অনেক শুনতে পেয়েছি । আপনি বুদ্ধশাসনে অনেক উপকার করেছেন ।" এভাবে তারা প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে । সেই দেশের সমাজ প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের আলাদা সম্মানের চোখে দেখে । তারা তাদেরকে সমাজে পুণ্যবান ও গুণী ব্যক্তি হিসেবে মূল্যায়ন করে, এবং আবাহ-বিবাহ ব্যাপারেও নাকি জিজ্ঞেস করে, ছেলেটি কতবার ভিক্ষু বা শ্রামণ হয়েছেন।
কারণ, তারা জানে— যে মানুষটি ভিক্ষু হয়েছেন, সে কম-বেশি ধর্মজ্ঞান অর্জন করেছেন, নানা অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন । ফলে সে কখনো আর মদ,গাজা,আফিম-হিরোইন সেবন করবে না, নানা অনৈতিক, অসামাজিক পাপ কর্ম করবে না, স্ত্রী-পুত্রের সহিত ঝগড়াঝাটি করবে না । সেই ধারণা থেকে তারা বিয়ের আগে জিজ্ঞেস করে পাত্র কতবার শ্রামণ বা ভিক্ষু হয়েছেন । আর এতদঞ্চলের বৌদ্ধরা কোনো ভিক্ষু চীবর ত্যাগ করে গৃহী হয়ে গেলে সমাজের লোকেরা সবচেয়ে নিকৃষ্ট মনে করে । সে ভিক্ষু থাকা অবস্থায় যা জ্ঞান, অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছেন, সেই জ্ঞান, অভিজ্ঞতাটুকুও সমাজে কাজে লাগানোর সুযোগ দেন না—এই নোংরা অশিক্ষিত বৌদ্ধ সমাজ । দেখুন, প্রতিরূপ দেশের বৌদ্ধদের দৃষ্টিভঙ্গি আর এইদেশের বৌদ্ধদের দৃষ্টিভঙ্গি কতটা আকাশ-পাতাল তফাৎ ।
যারা ভিক্ষুদের সমালোচনা করে, প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের নিন্দা করে, আমি তাদের উদ্দেশ্য বলি, আজীবন থাকতে না পারলেও এক বছরের জন্য ভিক্ষু হয়ে প্রব্রজ্যা জীবনকে পরীক্ষা করে দেখুন । ভিক্ষু হলে বুঝতে পারবেন, ভান্তেরা কীভাবে সতত একটা নিয়ম, সংযম ও শৃংখলার মধ্যে জীবনযাপন করে থাকেন । জানতে পারবে তাদের জীবনশৈলী সম্পর্কে । আন্দাজে উপরে উপরে দেখে, অপরের কাছ থেকে শুনে কিংবা বই পড়ে কখনো ভিক্ষু জীবনকে উপলব্ধি করা যায় না । ভিক্ষু জীবন উপলব্ধি করতে হলে প্রব্রজ্যার ভূমিতে আসতে হবে, তার আগে নয় । সেজন্য যারা ভিক্ষু জীবন ত্যাগ করে গৃহী হয়েছে, তারা কখনো আর ভিক্ষুদের নিন্দা, সমালোচনা, বদনাম করেন না । কারণ, তারা জেনেছেন, ভিক্ষু জীবন কত কঠিন, কত সংগ্রামের ।
পৃথিবীতে যদি কোনো কঠিনতম কাজ থাকে, সেই কঠিনতম কাজটি হচ্ছে-সংসার কিংবা দশবন্ধন ছিন্ন করে ভিক্ষু হওয়া । তার চেয়ে বহুগুণে আরও কঠিন ভিক্ষু জীবন লাভ করার পর আজীবন টিকে থাকা । ভিক্ষু জীবন মানে কঠিন সংগ্রামী জীবন । এখানে সবসময় নিজের সাথে ও বিভিন্ন প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সহিত সংগ্রাম করে টিকে থাকতে হয় । মহাসমুদ্রে বিশাল বিশাল জাহাজ চালাতে গিয়ে নাবিকেরা যেমন, ভয়ংকর উত্তাল উর্মি, বড় বড় কুমির ও তিমিগুলোর সাথে সম্মুখীন হয় এবং সেগুলো মোকাবেলা করে বীর-বিক্রমে গন্তব্য স্থলের দিকে অগ্রসর হন । অনুরূপভাবে বুদ্ধশাসনে ভিক্ষুরাও মহাসাগরে জাহাজ চালনারত সাহসী নাবিকের ন্যায় নিজের মনের সাথে ও নানা প্রতিকূল পরিবেশ-পরিস্থিতির সাথে যুদ্ধ করে বুদ্ধশাসন টিকে করে থাকে । যারা এই কঠিন যুদ্ধে টিকতে না-পারেন তারা ভিক্ষু জীবন থেকে ছিটকে পড়েন ।
ভিক্ষুজীবন নামক পুণ্যভূমিটা খুবই মহৎ এবং সংগ্রামের । এই মহৎ পবিত্র ভূমিতে আজীবন নিজের সাথে যুদ্ধ করে টিকে থাকা অত্যন্ত কঠিন ব্যাপার । এই ভিক্ষু ভূমিতে থাকতে হলে অনেক ত্যাগ-তীতিক্ষা, ধৈর্য্য-সহ্য ও বহু প্রকার প্রজ্ঞার গুণ দরকার । তার সাথে প্রয়োজন দৃঢ় মনোবল, পূর্বজন্মের প্রবল পারমী এবং ইহজীবনে সৎকল্যাণ মিত্র সংশ্রব বা উপদেশ । উক্ত গুণগুলো একটি কম হলে ভিক্ষু জীবনে টিকে থাকা কঠিন হয়ে পড়ে ।
যদিও উপরে উপরে দেখা যায় ভান্তেদের কোনো অভাব নেই । এদিক-ওদিক ঘুরছে, ফাং-এ যাচ্ছে । তাদের নেই কোনো টাকা-পয়সা, ঘর-বাড়ী, খাওয়া-দাওয়ার চিন্তা । নেই জীবন-জীবিকা, স্ত্রী-পুত্র ভরন-পোষনের চিন্তা । এক কথায় বলতে গেলে দায়ক-দায়িকারা সব সুযোগ-সুবিধা ব্যবস্থা করে দেন । এত সুযোগ-সুবিধা থাকা সত্ত্বেও কেন মানুষ এই পথে আসতে চাই না ? তবু কেন ভিক্ষুরা আজীবন থাকতে পারে না ? কেন বা সন্ন্যাসী বেশ ত্যাগ করে গৃহী হয়ে যান ? নিশ্চয় চিন্তা ও কৌতূহলের বিয়ষ, নয় কি ? তথাগত বুদ্ধ এমনি এমনি বলেন নি, প্রব্রজ্যা লাভ করা অতিশয় দুর্লব, কষ্টসাধ্য ।
সাধারণ পৃথগজন মানুষের চিত্ত স্বভাবতই চঞ্চল, অস্থির । নিরন্তর পঞ্চকামগুণে ও নানা বিষয়-বস্তুর প্রতি মন আবর্তিত হয় । জন্মে-জন্মান্তর, কল্প-কল্পান্তর রূপ, শব্দ, গন্ধ, রস ও স্পর্শ— এই পঞ্চকামগুণ মন-চিত্ত ভোগ করে আসতেছে অনাদি কাল থেকে আজ অবধি । সেই পঞ্চকামগুণ শক্ত বলয় থেকে নিজেকে নিবৃত্ত রাখা, চঞ্চল চিত্তকে স্থির করা, বুদ্ধ শাসনে মনকে অভিরমিত করা, সহজ কথা নয় । নিতান্তই বীরত্বের ব্যাপার ।
আমরা জানি, ভগবান গৌতম বুদ্ধ লক্ষাধিক চারি অসংখ্য কল্পকাল বুদ্ধত্ব পারমী পূরণ করেছেন । এই চারি অসংখ্য কল্পে চব্বিশ জন সম্যক সম্বুদ্ধের সাক্ষাৎ পেয়েছেন এবং লক্ষ লক্ষ, কোটি কোটি ও অগণিতবার জন্ম গ্রহণ করেছেন । সেই অসংখ্য জন্মের মধ্যে কেবলমাত্র বুদ্ধশাসনে নয়বার আমাদের মত ভিক্ষু জীবন লাভ করতে পেরেছেন । ঋষি প্রব্রজ্যা পাঁচবার গ্রহণ করে নৈষ্ক্রম্য পারমী পূর্ণ করেছেন । বোধিসত্ত্ব জীবনী জাতকগুলো অধ্যায়ন করে দেখা গেছে, তিনিও অনেকবার ব্রহ্মচর্য জীবন থেকে চ্যুত হয়েছেন । এত বড় মহাপুরুষ বোধিসত্ত্বও শুধুমাত্র নয়বার বুদ্ধশাসনে ভিক্ষু, পাঁচবার ঋষি প্রব্রজ্যা লাভ করতে সক্ষম হয়েছিলেন । তাও কয়েকবার নাকি ব্রহ্মচর্য জীবন ত্যাগও করেছেন ।
তাহলে চিন্তা করে দেখুন, প্রব্রজ্যা জীবন লাভ করা কতটুকু কঠিন ও দুর্লভ হবে । ভিক্ষু জীবন যদি এত সহজ ও সুলভ হতো তাহলে সবাই প্রব্রজ্যা লাভ করতে পারতো । অত্যন্ত কঠিন ও দুর্লভ বলে মানুষ এখানে আসতে পারে না এবং যারা আসেন তারাও অধিকাংশই আজীবন থাকতে পারে না । কেউ থাকে এক বর্ষা, কেউ দুই বর্ষা, কেউ পাঁচ বর্ষা, কেউ দশ বর্ষা । কেউ কেউ মহাস্থবির হয়েও চলে যেতে দেখা যায় । যে যতদিন, যত মাস, যত বৎসর থাকতে পারেন তার ততই লাভ, ততই মঙ্গল । যে যতদিন থাকতে পেরেছেন, ভবিষ্যতে তার সেটা বিরাট সুখের কারণ হয়, এবং দুঃখমুক্তি নির্বাণ লাভের হেতু হয়ে থাকে ।
আমি অনেক ভিক্ষু-শ্রামণকে দেখেছি কত শ্রদ্ধা নিয়ে বুদ্ধ শাসনে চলে আসে, আজীবন থাকবে বলে । অথচ দু'এক বৎসরও থাকতে পারে না । মন রমিত না হওয়ার কারণে বাড়িতে চলে যায় । আরও অনেক শ্রামণ দেখেছি, যে দিন রংবস্ত্র পরিধান করে, সেদিন হতে তাদের শরীরে চুলকানি শুরু হয় । অনেকের ফোঁড়া, এলার্জি ওঠে, অনেকের জ্বর আসে । তাদের চিকিৎসা করলেও আরোগ্য হয় না । উপায়ন্তর না দেখে শেষমেশ বাধ্য হয়ে প্রব্রজ্যা ত্যাগ করে বাড়িতে চলে যেতে হয় । দেখা গেছে চীবর ত্যাগ করার পর পরই সেই চুলকানি, এলার্জি, ফোড়া, জ্বর এমনিতে বিনা চিকিৎসায় উপশম হয়ে গেছে । আমি প্রব্রজিত জীবনে এই ধরনের অলৌকিক ঘটনা স্ব-চক্ষে বহুবার দেখেছি । আমার মতো হয়তো অনেকে দেখেছেন ।
অতএব, আপনাদের ভিক্ষু জীবন আসলে কী জিনিস উপলব্ধি করতে হবে । ব্রহ্মচর্য পালন করলে কী যে পুণ্য লাভ হয়, জানতে হবে । সেই সুফল জেনে নিজের ছেলেদের মন নিরুৎসাহিত না-করে প্রব্রজ্যা জীবনে আসার অনুপ্রাণিত করা উচিত । প্রব্রজ্যা ত্যাগীদের প্রতিও আমাদের মন-মানসিক, দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে । তাদের হেয় করলে, বাঁকা চোখে দেখলে, অহেতুক নিন্দা-সমালোচনা করলে ভবিষ্যতে কেউ ভিক্ষু হতে চাইবে না । মনে রাখবেন, যেখানে ভিক্ষুসংঘ নেই, সেখানে বুদ্ধশাসন বিলুপ্তি হয় । এই বিষয়গুলো জানতে হলে আমাদের প্রচুর পরিমাণ ত্রিপিটক স্টাডি করতে হবে।