01/12/2024
মিগার মাতা বিশাখা: পিতা কর্তৃক ১০টি উপদেশ।
সাত বছর বয়সে বিশাখা প্রথম বারের মত তথাগত বুদ্ধের সাক্ষাত পেয়েছিলেন রাজগীরে তাঁর স্বীয় পিতামহের সঙ্গে। প্রথম দর্শনেই তিনি বুদ্ধের অমৃত ধর্মোপদেশ শুনে স্রোতাপন্ন বা স্রোতাপত্তি ফল লাভ করেছিলেন। স্রোতাপত্তি মানে হল, যাঁর চিত্ত ধর্মের স্রোতে পতিত হয়েছে। ইহা উচ্চতর আধ্যাত্মিক ফলের প্রথম স্তর।
এরকম উত্তরোত্তর আট শ্রেষ্ঠ আধ্যাত্মিক অবস্থার কথা বুদ্ধ বর্ণনা করেছেন। সে গুলিকে বলা হয় ‘অট্ঠ পুরিস পুগ্গলা’ পুদ্গল বা মানুষের অষ্ট প্রকার মার্গ ও ফল।
সেটিহল:
১) স্রোতাপত্তি মার্গারোহণ,
২) স্রোতাপত্তি ফল প্রাপ্ত।
৩) সকৃদাগামী মার্গারোহণ,
৪) সকৃদাগামী ফল প্রাপ্ত।
৫) অনাগামী মার্গারোহণ,
৬) অনাগামী ফল প্রাপ্ত।
৭)অরহত্ব মার্গারোহণ,
৮) অরহত্ব ফল প্রাপ্ত।
বিশাখা সাত বছর বয়সে স্রোতাপত্তি ফল প্রাপ্ত হয়েছিলেন। অর্থাৎ অসংশয়ারূপে ধর্মের স্রোতে পতিত হয়েছিলেন। এ স্রোতে পতিত হলে অরহত্ব অবস্থায় পৌঁছতে কোন বাঁধাই আর আটকাতে পারেনা।
বিশাখার পিতার নাম ছিল ধনন্জয় শ্রেষ্ঠী। বিশাখার পিতাকে কোশল নরেশ প্রসেনজিত মগধ হতে আহ্বান করে কোশলের অন্তর্গত সাকেতে নিয়ে বসবাস করিয়েছিলেন। এ সাকেতই বর্তমানের বিবাদিত স্থান অযোধ্যা। বিশাখা সেখানেই বেড়ে উঠেছিলেন। যথাসময়ে কোশলের রাজধানী শ্রাবস্তী নগরের মিগার শ্রেষ্ঠীর সুপুত্র পুণ্যবর্ধনের সাথে বিশাখার বিয়ে দেন পিতা ধনন্জয় শ্রেষ্ঠী।
বিয়ের সময় শ্বশুরবাডীতে যাওয়ার প্রাক্কালে পিতা ধনন্জয় শ্রেষ্ঠী প্রাণপ্রিয় মেয়ে বিশাখাকে দশটি সাংকেতিক উপদেশ প্রদান করেন। যার অনুকরণ প্রত্যেক নারীর জন্য সৌভাগ্য এবং মঙ্গলের কারণ হয়।
সে দশ সাংকেতিক উপদেশ হল:
১) ঘরের আগুন বাহিরে আনবেনা।
২) বাহিরের আগুন ঘরে আনবেনা।
৩) যে দেয়, তাকে দেবে।
৪) যে দেয়না, তাকে দেবে না।
৫) যে দেয় তাকেও এবং যে দেয়না তাকেও দেবে।
৬) সুখে বসবে বা উপবেশন করবে।
৭) সুখে খাবে বা আহার করবে।
৮) সুখে নিদ্রা যাবে বা শুতে যাবে।
৯) অগ্নির সেবা বা পরিচর্যা করবে এবং।
১০) কুল দেব-দেবীকে পূজা করবে।
জন্মদাতা পিতার উপদেশ সমূহকে মনে গেঁথে নিয়ে বিশাখা স্বীয় শ্বশুরালয় শ্রাবস্তীতে চলে আসলেন শ্রেষ্ঠী মিগারের পুত্রবধু হয়ে। মিগার শ্রেষ্ঠী ছিলেন নিগণ্ঠ নাথপুত্র বা মহাবীরের অনুসারী। বুদ্ধের প্রতি তাঁর কোন আস্থা ছিলনা। তিনি মহাবীরের শিক্ষা অনুসরণ করতেন। ইতিমধ্যে এক ঘটনা ঘটে গেল মিগার শ্রেষ্ঠী এবং পুত্রবধু বিশাখার সাথে। বিশাখা স্বীয় শ্বশুর মিগার শ্রেষ্ঠীর জন্য নিজের হাতে খাবার রান্না করে তাজা গরম গরম খাবার নিজেই পরিবেশন করে শ্বশুর মশাইকে খাওয়াচ্ছিলেন। মিগার শ্রেষ্ঠী স্বর্ণ-রৌপ্যের থালা-বাটিতে খাবার খাচ্ছিলেন। তাঁর ভোজনের সময়েই এক বৌদ্ধ ভিক্ষু ভোজন সংগ্রহ করতে মিগার শ্রেষ্ঠীর দ্বার সম্মুখে এসে হাজির হলেন। বাল্যকাল হতে বুদ্ধ ও ভিক্ষু সংঘের প্রতি বিশাখার মনে অপার শ্রদ্ধা জাগ্রত ছিল। কিন্তু এমন পরিবারে তাঁর বিয়ে হল, যাঁদের নিকট বুদ্ধ, ধর্ম এবং সংঘের প্রতি কোন বিশ্বাস বা আস্থাই ছিলনা। ভিক্ষুকে দরজায় ভিক্ষাপাত্র নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও মিগার শ্রেষ্ঠী তাঁকে না দেখার মত করে ভোজন করছিলেন। এ অবস্থায় বিশাখা ভাবতে লাগলেন, হয়তো শ্বশুরের নজর ভিক্ষুর উপর পড়েনি, তাই শ্বশুর ভিক্ষুকে দেখে মত তিনি সামান্য পাশে গিয়ে দাঁড়িয়ে শ্বশুর মশাইকে পাখা দিয়ে বাতাস করছিলেন। শ্বশুর মশাই ভিক্ষুকে দেখলেন। কিন্তু তারপরেও পাশ পরিবর্তন করে না দেখার মত হয়ে চুপচাপ ভোজন করছিলেন। নতুন পুত্রবধুরূপে শ্বশুর বাড়ীতে শ্বশুরের বিনা অনুমতিতে দান দেওয়াও শ্বশুরালয়ের অবমাননা হবে। অতএব, বিশাখা অতীব ভারাক্রান্ত মনে দরজার দিকে মুখ করে ভিক্ষুকে বললেন-‘ ভন্তে! আপনি আগে যান। আমার পিতা অর্থাৎ শ্বশুর বাসী খাবার খাচ্ছেন।’ এ কথা শুনতেই মিগার শ্রেষ্ঠী ক্রোধে ফেটে পড়লেন। তিনি ভোজনের থালা সরিয়ে রাখলেন এবং পুত্রবধু বিশাখাকে ঘর হতে বের করে দেওয়ার নির্ণয় নিলেন। তিনি বললেন,-‘ এক্ষুনি তুমি আমার ঘর হতে বের হয়ে যাও। তুমি এ ঘরে থাকার উপযুক্ত বধু নও।’
তখন বিশাখা শ্বশুর মশাইকে বললেন-‘ পিতাজী, আপনি আমাকে রাস্তা হতে তুলে আনেনি যে, আপনি বললেই আমি বের হয়ে যাব। আমার পিতৃপক্ষের এবং আপনার পক্ষের গণ্যমান্য লোকদের সাক্ষী রেখে আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে এনেছেন। আপনি তাঁদেরকে ডেকে বিচার দিন। তাঁদের বিচারে যদি আমি দোষী সাব্যস্থ হই, তাহলে নিশ্চয় আমি চলে যাব। না হয় যাব কেন।’
অত:পর মিগার শ্রেষ্ঠী উভয় পক্ষের প্রামাণ্য লোকদের নিয়ে পন্চায়েতের মত সালিসী বৈঠক করলেন। বৈঠকে শ্বশুর মিগার শ্রেষ্ঠী সবার সামনে স্বীয় নির্ণয় শুনিয়ে বললেন যে, এ পুত্রবধু আমার সাথে এরকম ব্যবহার করেছে, আমার এ প্রতিষ্ঠিত পরিবারে সে থাকার উপযুক্ত নয়। সে এক ভিক্ষুর সামনে আমাকে অপমান করেছে। স্বয়ং নিজের হাতে তাজা গরম ভোজন রান্না করে আমাকে খাওয়াচ্ছিল। কিন্তু ভিক্ষুকে বলছিল, আমার পিতাজী বাসী খাবার খাচ্ছেন।’
উপস্থিত বিজ্ঞ বিচারকগণ বিশাখার কাছ হতে জানতে চাইলেন-‘ বিশাখা! তোমার শ্বশুর মশাই যে অভিযোগ করছেন, তা কি সত্যি?’
উত্তরে বিশাখা বললেন-‘ আমার শ্বশুর মশাই সত্য বলছেন। কিন্তু আমার বলার অর্থকে ভুল ব্যাখ্যা করছেন।’
আবার মিগার শ্রেষ্ঠী মাঝখানে বলতে লাগলেন-‘ আমার ক্রোধ আসার কারণ ইহাই একমাত্র নয়। বরং আরও কিছু কথা আছে। যখন পুত্রবধু তার পিত্রালয় হতে এখানে আসার জন্য বিদায় নিচ্ছিল, সে সময় তার পিতা ধনন্জয় শ্রেষ্ঠী তাকে কু-মন্ত্রনা দিয়ে কানভারি করে পাঠিয়েছে। তার পিতা তাকে দশটি বাক্য বা কথা শুনিয়েছে। সেগুলি আমি পাশে থেকে চুপিসারে শুনে ফেলেছি। আমি পর্দার অন্তরালে ছিলাম, যখন তার পিতা কান ভারি করার জন্য তাকে কথাগুলো বলছিল। তার পিতা বলছিল-‘ ঘরের আগুন বাহিরে নেবে না।’ এখন আপনারা বলুন যে, যদি কেহ চুলা জ্বালানোর জন্য আগুন চাইতে আসে, তাকে কি আগুন দেবনা?’ এগুলো কি পাড়া – প্রতিবেশীর সাথে শত্রুতা বাড়ানোর শিক্ষা হল না!’
বিজ্ঞ জেষ্ঠ বিচারকগণ বিশাখা হতে জিজ্ঞাসা করলেন-‘ তোমার পিতা কি তোমাকে সত্যিই এ সমস্ত কথা বলেছিল?’
বিশাখা সত্য ও ধর্মবল মনে রেখে সম্পূর্ণ আত্ম বিশ্বাসের সাথে বলেছিল-‘ হাঁ, আমার পিতা আমাকে কথাগুলো বলেছিলেন। কিন্তু তার অর্থ সেরকম নয়, যা আমার শ্বশুর মশাই আপনাদেরকে বলছেন। আমার পিতাজীর বলার তাৎপর্য ইহাই ছিল যে, যদি নিজের শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, দেবর-ননদ, পতির যে কারো কেহ নিন্দা বা অপ্রশংসা করলে, বা পরস্পর নিজেদের মধ্যে ঝগড়া করলে, তা যেন আমি বাহিরে গিয়ে না বলি। ঘরে নিজেদের মধ্যে যদি কেহ কারো বিরুদ্ধে বলে থাকে, তাও যেন বাহিরে প্রকাশ না করি। তাই হল ঘরের আগুন বাহিরে না নেওয়ার তাৎপর্য।
নিজের পুত্রবধুর মুখ হতে তার পিতার জ্ঞানগর্ভ উপদেশের ব্যাখ্যা শুনে মিগার শ্রেষ্ঠী হতচকিত হয়ে গেলেন। এর পর বিশাখা দ্বিতীয় উপদেশের ব্যাখ্যা করলেন-
২। ‘বাহিরের আগুন ঘরে আনিওনা’
আমার পিতার ইহা বলার তাৎপর্য হল- আমার শ্বশুর-শ্বাশুড়ি, দেবর-ননদ বা পতি অর্থাৎ শ্বশুরবাড়ীর যে কোন পরিজনের যদি বাহিরের কেউ নিন্দা করে, বা কোন অপবাদ বলে তা শুনে আমি যেন শ্বশুরালয়ে এসে না বলি। ইহার চেয়ে বড় আগুন আর নাই। তাতে দু’পক্ষে ঝগড়া বিবাদ লেগে যাবে। এ কারণে পিতাজী বলেছিলেন, বাহিরের আগুন ঘরে আনিওনা।
৩। ‘যে দেয় তাকে দেবে’ তৃতীয় উপদেশ–
পিতাজী এ কথা বলার মানে ইহাই যে, পাড়া-প্রতিবেশী ও আশে-পাশের আত্মীয়-স্বজন যদি কেহ কোন বস্তু বা কিছু অর্থ ধার-উধার চায়, তাকেই দিতে বলেছেন, যিনি যথা সময়ে সেগুলি ফেরত দিয়ে থাকেন। যে দেয়, তাকে দেওয়ার ইহাই হল তাৎপর্য।
৪। ‘যে দেয়না, তাকে দিওনা’ চতুর্থ উপদেশ-
পিতাজী বলেছিলেন-‘ কখনও আশে-পাশের পাড়া -প্রতিবেশী বা আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধব যদি কোন বস্তু বা কোন অর্থ ধার-উধার নিয়ে সামর্থ থেকেও যথাসময়ে ফেরত দেয় না, তাকে দেবে না। যে দেয়না, তাকে দেবেনা বলার ইহাই তাৎপর্য।
৫। ‘যে দেয় তাঁকেও দেবে এবং যে দেয়না তাঁকেও দেবে’ পন্চম উপদেশ:-
পিতাজী এ কথা বলার অর্থ হল যে, জীবনে কিছু কিছু আত্মীয়-স্বজন বা পাড়া -প্রতিবেশী এমন থাকেন যে, যাঁদের কেবল দেওয়াই হল কর্তব্য। যাঁরা গরীব ও ফেরত দেওয়ার সামর্থ্য নাই। তাঁরা ছাড়াও আরও কিছু লোক আছেন, যাঁদের কাছ হতে ফেরত পাওয়া প্রত্যাশা করা যায় না। যেমন, ছেলে-মেয়ে, জামাই, দেবর-ননদ, ভাবী, ভাগ্নে, ভাগ্নী, ভিক্ষু-শ্রামণ, সাধু-সন্ন্যাসী। তাঁদেরকে দেওয়ার সময় আবার ফেরত পাওয়ার আশায় দেওয়া উচিত নয়। তাঁরা ফেরত দিলেও ভাল, না দিলেও অসন্তুষ্ট হতে নেই। এ জন্য পিতা বলেছেন-‘ যে দেয়, তাঁকেও দেবে, না দিলেও তাঁকে দেবে।
৬। ‘সুখে উপবেশন বা বসা’ ষষ্ট উপদেশ
এ উপদেশে পিতাজী বুঝাতে চেয়েছেন-‘ ঘরে কাজ-কর্ম সেরে যখনই বসবে, এমন স্থানে বসবে যাতে শ্বশুর-শ্বাশুড়ী, ভিক্ষু-শ্রামণ, প্রভৃতি গুরুজন বর্গ হঠাৎ আসলে তাড়াহুড়া করে যেন উঠতে না হয়। তাঁদের দৃশ্য পথে গিয়ে বসতে নেই। সুখে বসার তাৎপর্য হল ইহাই।
৭। ‘সুখে খাওয়া’ সপ্তম উপদেশ
পিতাজী এ উপদেশে শিক্ষা দিয়েছেন যে, শ্বশুর-শাশুড়ী, পতি, বাচ্চা, বড় গুরুজন, ঘরের কাজ-কর্মের লোক, গৃহপালিত পশু ইত্যাদিকে খাওয়ানোর পরে নিজেকে আহার করতে বলেছেন। সুখে আহারের ইহাই হল মাহাত্য।
৮। ‘সুখে নিদ্রা যাওয়া’ অষ্টম উপদেশ
সুখে নিদ্রা যাওয়ার উপদেশে পিতাজী শিক্ষা দিয়েছেন যে, প্রতিদিন রাত্রে শয্যা গ্রহণের পূর্বে শ্বশুর-শাশুড়ী, বড়জনদের আহার হয়েছে কিনা, কারো ঔষধ-পথ্যাদি নেওয়ার থাকলে, তা নেওয়া হয়েছে কিনা, ছোট জন বা বাচ্চারা শুয়েছে কিনা, ঘরের দরজা-জানালা যে গুলো বন্ধ করার সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে কিনা, আলমিরা, সিন্ধুক যেখানে মুল্যবান অলঙ্কার বা ধন-সম্পদ গচ্ছিত থাকে সেগুলো বন্ধ করা হয়েছে কিনা, তা সব যাচাই করে শুতে বলেছেন। সুখে নিদ্রা যাওয়ার ইহাই হল গূঢ়ার্থ।
৯। ‘অগ্নির পরিচর্যা করবে’ নবম উপদেশ:
শ্বশুর-শাশুড়ি প্রভৃতি বড়জন, সাধু-সন্ন্যাসী, ভিক্ষু-শ্রামণ এসকল গুরুজনের সবাইকে অগ্নির মত জানবে। তাঁদের কাছ হতে নিজেকে সবসময় উচিত দূরত্বে অবস্থান করবে। তাঁদের সাথে এমন আচরণ করবেনা, যাতে অসম্মান ও অশ্রদ্ধা হয়। তাঁদের কাছ হতে অতি দূরত্বেও থাকবে না, আবার অতি নিকটেও যাবেনা। শ্রদ্ধা, সম্মান ও আদব-কায়দা বজায় থাকে মত অবস্থান করবে। যে রকম খাদ্য রান্না করার সময় আগুনের উচিত দূরত্বে অবস্থান করে রান্না করা হয়, সে রকম গুরুজনদেরকে বা পতির সাথে উচিত ব্যবহার হয় মত জানবে।
১০। ‘কুল দেবী-দেবতাদের পূজা করবে’ দশম উপদেশ:
আমার পিতার এ উপদেশের সারমর্ম হল- মাতা-পিতা, শ্বশুর-শাশুড়ী, জেষ্ঠজন, সাধু-সন্ন্যাসী, ভিক্ষু-শ্রামণ, প্রভৃতিকে দেব-দেবী মনে করে পূজা ও শ্রদ্ধা করতে হবে। তাঁদের আবশ্যক বিষয়কে অগ্রাধিকার দিয়ে পুরা করতে হবে। তাঁদের সাথে কখনো মুখে মুখে তর্ক করতে নেই। তাঁদের অমর্যাদা ও অপমান হয় এ রকম কোন আচরণ করতে নেই। ইহাই হল কুল দেব-দেবীকে পূজা করার তাৎপর্য।
এ দশ কূট কথার ব্যাখ্যা শুনে মিগার শ্রেষ্ঠী আশ্চর্যান্বিত হয়ে নিজেকে হারিয়ে ফেললেন। তিনি পুত্রবধুর সাথে যে অন্যায় আচরণ করেছেন, তজ্জন্য তাঁর অনুতাপ-অনুশোচনা আসতে লাগল।
শ্বশুর আবার বলতে লাগলেন, আপনারা জিজ্ঞাসা করুন যে, আমার পুত্রবধু একজন ভিক্ষুর সামনে আমি বাসী খাবার খাচ্ছি, এরকম মিথ্যা ভাষণ কেন করেছে?’
বিচারকগণ জিজ্ঞাসা করলেন-‘ পুত্রী! তুমি তো দেখছি বড়ই বুদ্ধিমতী ও জ্ঞানী। কিন্তু তোমার শ্বশুরকে বাসী খাচ্ছে বলে মিথ্যা আরোপ করেছ কেন?’
তখন বিশাখা সম্পূর্ণ ধর্ম ও সত্যবলে বলীয়ান হয়ে সাহসের সাথে বলতে লাগলেন-‘ আমার এ কথার তাৎপর্যও আমার শ্বশুর মশাই বুঝতে পারেননি। সেজন্য ভুল ধারণা পোষণ করে আছেন। আমার এ কথা বলার তাৎপর্য হল যে, শ্বশুর মশাই সোনা-রূপার থালায় খাবার খেয়ে থাকেন। তিনি এতই ধনাঢ্য যে, শ্রাবস্তীতে তাঁর তুলনা অন্যদের সাথে হতেই পারেনা। তাঁর যে কত দাস-দাসী অনুচর পরিচারিকা রয়েছে, যা তাঁকে সম্ভ্রান্তের আসনে বসিয়েছে। তাঁর অনেক যশ-কীর্তিও রয়েছে। কিন্তু এত কিছু থাকার পরেও তিনি কোন দান-ধর্ম করেননা। এজন্মে তাঁকে দান -ধর্ম করতে দেখছিনা। তিনি যে অর্থ-বিত্ত, ধন-সম্পদ, সুখ-সমৃদ্ধি লাভ করেছেন, তা পুন্য কর্মের ফলেই অর্জন সম্ভব হয়েছে। আমি মনে করি যে, নিশ্চিত তিনি পূর্বজন্মে অনেক পুন্য কর্ম করেছেন, যার কারণে এ জন্মে পুর্ণ বিত্ত-বৈভবে অট্টালিকায় জীবন-যাপন করছেন। এজন্য আমি বলেছি যে, পিতাজী অর্থাৎ শ্বশুর মশাই বাসী খাবার খাচ্ছেন।’
এপর্যন্ত শুনার পর মিগার শ্রেষ্ঠী পূর্ণরূপে পুত্রবধুর নিকট আত্ম-সমর্পণ করে দিলেন। এবং বলতে লাগলেন-
‘ ইহাও আমার কোন জন্মের পুণ্যকর্মই হবে যে, এরকম ধর্মজ্ঞ ও জ্ঞানী পুত্রবধু লাভ করেছি। আজ হতে সে আমার পুত্রবধু নয়, বরং সে আমার জ্ঞানের মাতা হয়েছে। তখন হতে বিশাখা মিগার মাতা নামে পরিচিতা হয়েছিলেন।
বর্তমানে শ্রাবস্তীতে যখন আমাদের কদম পড়ে তখন বিশাখা মাতার পুন্যস্মৃতির কথা মনে যায়। তিনি তৎকালীন সময়ে সাতকোটি টাকা ব্যয় করে পূর্বারাম বিহার তৈরী করিয়ে বুদ্ধকে এবং সংঘকে দান করেছিলেন। সে বিহারে বুদ্ধ ছয়টি বর্ষাবাস যাপন করেছিলেন। তিনি বুদ্ধ প্রমুখ সকল-ভিক্ষু-শ্রামণের মাতা সদৃশ ছিলেন। যে কোন সময়-যে কোন সহযোগিতা তিনি ধর্মের প্রচার-প্রসারে অকৃপণভাবে করে গিয়েছেন। তাঁর প্রভাবে মিগার শ্রেষ্ঠী ও তাঁর পরিবার সদ্ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলেন। মাতা তথা মহাউপাসিকা বিশাখার দানের কোন তুলনা নাই। দান পারমীতে ধনী বিশাখা মিগারমাতা নামে বৌদ্ধ বাগ্ময়ে অমর হয়ে আছে অদ্যাবধি।