12/10/2019
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর অবদান
ইসলাম পূর্ব জাহেলী তথা অন্ধকার যুগে অল্প সংখ্যক লোকই লেখা-পড়া জানতেন। হাতেগণা যে কয়েক জন লেখা-পড়া, শিক্ষা-দীক্ষা ও সভ্যতায় বিশেষভাবে পরিচিত এবং প্রসিদ্ধ ছিলেন, তাদের অন্যতম হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)। তিনি কবিতা আবৃতি ও পশু চিকিৎসায় পারদর্শী ছিলেন। জ্ঞান ও অভিজ্ঞতার জন্য তিনি তৎকালীন আরব সমাজে অত্যন্ত প্রভাবশালী ও মর্যাদাবান ছিলেন। এ জন্যেই নবী করিম( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) অহী অবতীর্ণ হওয়ার পর ইসলামের দাওয়াত দেয়ার জন্য সর্বপ্রথম হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)কে নির্বাচন করলেন। যেহেতু এ অদৃশ্য সংবাদ বুঝার এবং বিশ্বাসের জন্য জ্ঞান ও যোগ্যতার প্রয়োজন আছে। ফলে নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) তাঁকে অহী অবতীর্ণের ঘটনা বর্ণনা পূর্বক ইসলামের দাওয়াত দেয়ার সাথে সাথে তিনি বিনাদ্বিধায় গ্রহণ করে নেন।
ইসলাম গ্রহণ করা মাত্রই শুরু হলো তার অপূরনীয় ঋণ প্রদানের পালা । জান-মাল , চিন্তা-ভাবনা, বিবেক-বুদ্ধি এবং শেষ নি:শ্বাস পর্যন্ত মূল্যবান জীবনের প্রতিটি মূহূর্ত ইসলামের জন্য উৎর্সগ করার মাধ্যমে ত্যাগ এবং অবদানের যে স্বাক্ষর রেখেছেন, তার উপমা বিশ্বের ইতিহাসে সৃষ্টি হয়নি, আর হবেওনা। তাই নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) প্রায় বলতেন ,“যে ব্যক্তি তার ধন-সম্পদ দিয়ে, তার সাহচর্য দিয়ে আমার উপর সর্বাধিক ইহসান করেছে যে ব্যক্তি হলো আবু বকর (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) । ”(বুখারি শরীফ)
হযরত আবু বকর সিদ্দিক (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ছিলেন তৎকালিন আরবের সুপ্রসিদ্ধ ও প্রতিষ্ঠিত আর্ন্তজাতিক ব্যবসায়ী । সিরিয়া, ইয়ামান সহ বিভিন্ন দিশে তার ব্যবাসা বিস্তৃত ছিলো । ইসলাম গ্রহনের সময় তার পকেটে থাকা চল্লিশক হাজার দিনার রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র হাতে ইসলমের জন্য অর্পন পূর্বক তিনি এ অনুমতি দিয়ে দিলেন যে, হুযুর ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম )’র যখন যা প্রয়োজন হবে তখন তা তাঁর (আবু বকর) সম্পদ থেকে নেবেন। সে ব্যাপারে তাঁর থেকে অনুমতি নেয়ার কোন প্রয়োজন নাই। হযরত সায়িদ ইবনে মুসাইয়াব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) বলেন- হুযুর করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র সম্পদ নিজের সম্পদের মতো ব্যয় করতেন। এভাবে স্থাবর অস্থাবর যবতীয় সম্পদ একের পর এক তিনি ইসলামের জন্য উৎর্সগ করায় ইন্তেকালের পর কাফন দেয়ার মতো সার্মথ না থাকাতে পরিধেয় দুটি নি¤œমানের কাপড় দিয়ে তাঁকে কাফন দেয়া হয়। নবী করিম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) একদিন তাঁকে বলেছিলেন, হে আবু বকর! তুমিতো পরিবারের জন্য কিছুই অবশিষ্ট রাখনি । তিনি বললেন, আল্লাহ- রাসূলকেতো রেখেছি।
তাঁর ইসলাম গ্রহণের ফলে সমগ্র মক্কা শহরে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র ‘নবুয়ত’ নিয়ে আলোচনা-পর্যালোচনা শুরু হয়ে যায়। সবাই চিন্তা করতে লাগলো, আবু বকরের ন্যায় একজন বুদ্ধিমান দূরদর্শী রাজনীতিবীদ, সচেতন, জ্ঞানী ও প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি কোন ধরণের সংশয় ও উচ্চবাক্য ছাড়া মুহাম্মদ ইবনে আব্দুল্লাহকে ‘রাসূল’ এবং ইসলামকে ‘আল্লাহর মনোনীত ধর্ম’ হিসেবে গ্রহণ করে নেয়া রাসূল ও ইসলামের সত্যতার জন্য এক বড় দলিল। তাঁর বন্ধু-বান্ধব এবং পরিচিতদের অনেকে তাঁর ইসলাম গ্রহণকে অবিশ্বাস্য মনে করে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে তাঁর বাড়িতে ভিড় করতে লাগলো। এভাবে ইসলাম নিয়ে চতুর্দিকে এক আলোড়ন সৃষ্টি হয়ে গেলো। ইসলাম প্রচারের প্রথম পর্যায়ে এ আলোচনা এক বিরাট কার্যকর ভূমিকা রেখেছিলো। পূর্বপুরুষদের অনুসৃত রীতি হিসেবে দীর্ঘকাল ধরে তাদের অন্তরে পৌত্তলিকতার যে বিশ্বাস জমাট বেঁধে আসছিলো তার উপর ইহাকে প্রথম আঘাত হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র বড় মেয়ে হযরত আসমা (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা) বর্ণনা করেন- আমার সম্মানিত পিতা হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ইসলাম গ্রহণের পর ঘরে এসে আমাদের সবাইকে একত্রিত করে ইসলামের দাওয়াত দেন। ইসলামের সত্যতার উপর দীর্ঘ আলোচনা করেন। কাউকে ইসলাম গ্রহণ করার জন্য বাধ্য করেন নি। সে মজলিসেই হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র পরিবারের সদস্যদের মধ্যে কয়েকজন ইসলাম গ্রহণ করেন। তার মধ্যে তাঁর স্ত্রী হযরত উম্মে রূমান বিনতে আমির (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা), (যিনি উম্মুল মুমিনীন হযরত আয়েশা রাদ্বিয়াল্লাহু আনহা’র মাতা) আমি আসমা এবং আমার সহোদর ভাই হযরত আব্দুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) প্রমূখ ছিলাম। আমার পিতার খাদেম আমের ইবনে ফুহাইরাহ্ও আমাদের সাথে ইসলাম গ্রহণ করে নেন। পরবর্তীতে তাঁর (আবু বকর রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) মা সালমা বিনতে সাখর, পিতা আবু কোহাফা এবং তাঁর বড় ছেলে আব্দুর রহমান (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) ইসলাম গ্রহণ করেন। তিনি ব্যবসা এবং অন্যান্য কর্ম-কান্ড অনেকাংশে সংকুচিত করে রাসূলুল্লাহ্ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)’র একান্ত সহযোগী হিসেবে ইসলাম প্রচারে নিজকে সম্পৃক্ত করেনেন। আরবের নেতৃত্বস্থানীয় থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ সকলের সাথে তাঁর বন্ধুত্বের কিংবা ব্যবসায়িক সম্পর্ক ছিলো। তিনি ব্যবসায়িক ক্ষতি এবং কাফেরদের অত্যাচার-নির্যাতন ইত্যাদির প্রতি কোন রকমের ভ্রƒক্ষেপ না করে সকলের নিকট ইসলাম প্রচার শুরু করেন। ঘরে বাহিরে, ব্যবসা-বাণিজ্যে, রাস্তা-ঘাটে এমন কি অনেকের বাড়িতে বাড়িতে গিয়েও তিনি ইসলামের দাওয়াত দিতে লাগলেন। প্রথমে ইসলামের সত্যতার উপর অত্যন্ত যুক্তি নির্ভর আলোচনা পেশ করতেন। তাঁর প্রচেষ্টায় প্রথম দিকেই ইসলাম গ্রহণ করে নেন হযরত ওসমান ইবনে আফ্ফান , হযরত যুবাইর ইবনে আওয়াম, হযরত সা‘দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস, হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ এবং তালহা ইবনে ওবাইদুল্লাহ (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। এঁরা পাঁচজনই তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধু, নিজ নিজ গোত্রে প্রভাবশালী এবং বেহেস্তের সুসংবাদপ্রাপ্ত দশজন সাহাবী ‘আশারায়ে মুবাশ্শারাহ্’ এর অর্ন্তভূক্ত। তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিয়ে আরো যাঁরা ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন- তাঁদের মধ্যে হযরত বেলাল হাবশী, আমের ইবনে ফুহাইরা,, যিন্নিরাহ, নাহাদিয়া, হিন্দিয়াহ, জারিয়াহ, আমর ইবনে আনসিয়া, ওয়াইমিয়া, আবু ওবাইদাহ ইবনে র্জারাহ, আরকাম ইবনে আবুল আরকাম, আবু সালামা ইবনে আব্দুল আসাদ, উসমান ইবনে মায্উন ও তাঁর ভাই কুদামাহ্ ইবনে মায্উন ও আব্দুল্লাহ ইবনে মায্উন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমূখ উল্লেখযোগ্য।
‘সিরাতে ইবনে হিসাম’ নামক কিতাবে উল্লেখ আছে, হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু) ইতিপূর্বে ইসলাম গ্রহণকারী বিশিষ্ট কয়েকজন সাহাবায়ে কেরামকে নিয়ে ইসলাম প্রচারের জন্য একটি সম্মিলিত উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। তাঁর সঙ্গে এ উদ্যোগে অন্তর্ভূক্ত ছিলেন- হযরত আবু উবাইদাহ ইবনে আব্দুল আসাদ, হযরত আরকাম ইবনে আবুল আরকাম, হযরত উসমান ইবনে মাযউন, হযরত কুদামা ইবনে মাযউন এবং হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাযউন (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম)। তিনি তাঁদেরকে সাথে নিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সহিত গোপনীয়তা রক্ষা করে সুকৌশলে মুসলমানদের সংখ্যা বাড়ানোর চেষ্টা করতে থাকেন। তাঁর এ উদ্যোগ সবার কাছে প্রশংসিত এবং খুব সফল হয়েছে। তাঁদের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রথম পর্যায়েই অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ইসলাম গ্রহণ করেন। যেমন হযরত উবাইদা ইবনে হারস, হযরত সাঈদ ইবনে যায়েদ ও তাঁর স্ত্রী ফাতেমা বিনতে খাত্তাব, হযরত খাব্বাব ইবনে আরাত, হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মাসউদ এবং হযরত উমাইর ইবনে আবী ওয়াক্কাস(রাদ্বিয়াল্লাহু আনহুম) প্রমূখ।
ইসলাম, মুসলমান ও ইসলামী রাষ্ট্রের ক্ষতি সাধন ও ধংস করার নিমিত্তে কাফের-মুশরিক এবং ইহুদী-নাসরা তথা অমুসলিম কর্তৃক অত্যাচার-নির্যাতন, ষড়যন্ত্র ও আক্রমণ প্রতিরোধ কল্পে পরিচালিত যুদ্বাভিযানই হলো ইসলামী জিহাদ। জিহাদের গুরুত্ব যদিও সর্বকালে অনস্বীকার্য, তবে ইসলামের প্রাথমিক যুগে জিহাদই ছিলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় এবং সর্বশ্রেষ্ঠ ইবাদত। যেহেতু জিহাদের মাধ্যমে কাফেরদের আক্রমণ যদি প্রতিহত করা না হতো, তাহলে এ সর্বশ্রেষ্ঠ জীবন-ব্যবস্থা ইসলাম বিশ্ববাসী উপহার পেতো না। অন্যান্য বিষয়ের মতো এ গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তথা যুদ্ধে অংশগ্রহনেও হযরত আবু বকর সিদ্দিক্ব (রাদ্বিয়াল্লাহু আনহু)’র অবদান সবার অগ্রভাগে। বদর, উহুদ, খন্দক, বনি মুসতালাক্ব, হুদাইবিয়া, খায়বর, ফতেহ মক্কা, হুনাইন এবং তাবুকসহ সকল যুদ্ধে তিনি অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ অংশগ্রহন এবং জান-মাল উৎর্সগ করার মাধ্যমে যুদ্ধ বিজয়ে অবিস্মরণীয় অবদান রেখেছেন।
শত শত বছরের জাহেলি বা ঘনঅন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ মোস্তফা ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) আরবের ধর্মীয়, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবনের ক্ষেত্রে এক অপূর্ব বিপ্লব ও পরিবর্তন ঘটিয়ে বিশ্ববাসীর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ দ্বীন, সর্বোৎকৃষ্ট সমাজ ও রাষ্ট্র ব্যবস্থা দিয়েছিলেন। তবে হুযুর আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম) এর ওফাত শরীফের সাথে সাথে ইসলাম ও ইসলামী রাষ্ট্রে বিভিন্ন দিক দিয়ে অসংখ্য জটিল সমস্যা দেখা দিয়েছিলো। নবী করিম ( সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ) এর ওফাত মেনে না নেয়া, ভন্ড নবীদের আতœপ্রকাশ, ধর্মত্যাগীদের বিদ্রোহ, যাকাত অস্বীকার কারীদের তৎপরতা, অভ্যন্তরীণ বিদ্রোহসমূহ,বহি:শত্রæদের চক্রান্ত,পবিত্র কুরআন মজিদ সংরক্ষণ এবং ইসলামী রাষ্ট্রকে একটি স্থিতিশীল অবস্থার একটি মজবুত কল্যাণকর কাঠামোর উপর দাঁড় করানো ইত্যাদি।