15/02/2024
বিবাহের দিন কনের বাড়িতে খাবারের আয়োজন করার বিধান
প্রশ্নঃ ❓
আস সালামু আলাইকুম।
সুন্নত তরিকায় বিবাহ সম্পর্কে জানতে চাই ।ছেলের বাড়িতে আয়োজন করা আর মেয়ের বাড়িতে আয়োজন করার শরীয়তী হুকুম কি।
📚উত্তরঃ
وعليكم السلام ورحمة الله وبركاته
بسم الله الرحمن الرحيم
⬛ আজ মুসলিম পরিবারগুলোতে বিয়ে হয় বিধর্মীদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতির রূপরেখায়। কেমন যেন মুসলিম সমাজও মরণব্যাধী এ অপসংস্কৃতিকে এক প্রকার নিজেদের সঙ্গে মানিয়েও নিয়েছে।
যার ফলে আজ প্রাপ্তবয়স্ক ছেলেমেয়েকে সঠিক সময় বিয়ে দিতে পারছেন না তার পরিববার। দম্পত্য জীবনেও নেই সুখের দেখা। এসব আযাব থেকে কেবল মুক্তি পেতে পারি সুন্নাতের সংস্কৃতিকে গ্রহণ করার মাধ্যমে।
◼আসুন দেখে নেই বিয়ে-শাদীতে পালনীয় সুন্নাতসমূহ।
🌳১.প্রয়োজন হলে এবং সামর্থ্য থাকলে বিবাহ করা উচিত। যদি প্রয়োজন থাকা সত্ত্বেও সামর্থ্য না থাকে তাহলে রোজা রাখতে থাকবে। এ অবস্থায় রোজা রাখলে কামরিপু দমন থাকবে।
(তবে এ রোজায় খানা পিনা খুব সর্তকতার সাথে করতে হয় যাতে কামরিপু
দমন থাকে)
📋-বুখারী শরীফ-২/৭৫৮
🌳২. মাসনূন বিবাহ সাদাসিধে ও অনাড়ম্বর হবে। যা অপচয়, অপব্যয়, বেপর্দা ও বিজাতীয় সংস্কৃতি, গানবাদ্য, ভিডিও-অডিওমুক্ত হবে এবং তাতে যৌতুকের শর্ত বা সামর্থ্যের অধিক মহরানার শর্ত থাকবে না।
📋-তাবরানী আউসাত, হাদীস নং- ৩৬১২
🌳৩. সৎ ও খােদাভীরু পাত্র-পাত্রীর সন্ধান করে বিয়ের পয়গাম পাঠানাে। কোন সুযােগে পাত্রী দেখা সম্ভব হলে, দেখে নেয়া মুস্তাহাব। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে ঘটা করে পাত্রী দেখানাের যে প্রথা আমাদের সমাজে প্রচলিত, তা সুন্নাতের পরিপন্থী ও পরিত্যাজ্য।
📋-ইমদাদুল ফাতাওয়া, ৪ : ২০০
📋-বুখারী হাদীস নং- ৫০৯০
🌳৪. শাওয়াল মাসে এবং জুমআর দিনে মসজিদে বিবাহ সম্পাদন করা। উল্লেখ্য, সকল মাসের যে কোন দিন বিবাহ করা জায়েয আছে।
📋-মুসলিম শরীফ, হাদীস নং- ১৪২৩
📋-বাইহাকী, হাদীস নং- ১৪৬৯৯
🌳৫. বিবাহের খবর ব্যাপকভাবে প্রচার করে বিবাহ করা এবং বিবাহের পরে আকদ অনুষ্ঠানে উপস্থিত লােকদের মাঝে খেজুর বন্টন করা।
📋-বুখারী শরীফ, হাদীস নং- ৫১৪৭
🌳৬. সামর্থ্যানুযায়ী মহর ধার্য করা।
📋-আবু দাউদ: হাদীস নং২১০
🌳৭.যে বিবাহে খরচ কম হয় এবং মহর হালকা হয় সে বিবাহে বরকত বেশী হয়।
📋-মিশকাত শরীফ-২/২৬৮
🌳৮. কোন মেয়ে বা ছেলের যদি কোথাও বিবাহের আলোচনা চলতে থাকে তখন কোন এক পক্ষ থেকে উত্তর না দেওয়ার আগ পর্যন্ত সেখানে প্রস্তাব দেওয়া
জায়েয নেই।
📋-বুখারী শরীফ-২/৭৭২
🌳৯. বাসর রাতে স্ত্রীর কপালের উপরের চুল হাতে নিয়ে এই দু’আ পড়া; اللهم إني أسألك من خيرها وخير ما جبلت عليه . وأعوذ بك من شرها وشر ما جبلت عليه
📋-আবু দাউদ, হাদীস নং- ২১৬০
🌳১০.স্ত্রীর সঙ্গে প্রথমে অন্তরঙ্গতা সৃষ্টি করবে, তারপর যখনই সহবাস-এর ইচ্ছা হয়, তখন প্রথমে নিম্নোক্ত দুআ পড়ে নেবে ;
بسم الله اللهم جنبنا الشيطان وجنب الشيطان ما رزقتنا
📋-মুসলিম, হাদীস নং-১৪৩৪
🎆 বি.দ্র. উপরােক্ত দোয়া না পড়লে শয়তানের তাছীরে বাচ্চার ওপর কু-প্রভাব পড়ে। যেকারণে সন্তান বড় হলে তার মধ্যে ধীরে ধীরে তা প্রকাশ পেতে থাকে। একসময় সে বাচ্চা নাফরমান ও অবাধ্য হয়। সুতরাং পিতা-মাতাকে খুবই সতর্ক থাকা জরুরী।
🌳১১.স্বামী, স্ত্রীকে কোন কারণে প্রহার করলে সে জন্য অন্য লোকে জিজ্ঞাসা করা উচিৎ নয়।
📋-আবু দাউদ শরীফ-১/২৯৩
🌳১২.বীর্যপাত হওয়ার সময় এ দোয়া পাঠ করা সুন্নাত।
📋-মুসনাদে ইবনে আবী
শায়বা
ﺍَﻟﻠّٰﻬُﻢَّ ﻟَﺎ ﺗَﺠْﻌَﻞْ ﻟِﻠﺸَّﻴْﻄَﺎﻥِ ﻓِﻴْﻤَﺎ ﺭَﺯَﻗْﺘَﻨِﻲْ ﻧَﺼِﻴْﺒًﺎ
অর্থ, হে আল্লাহ! আমাদের যে সন্তান দান করবেন তাতে শয়তানের কোন অংশ রাখবেন না।
🌳১৩.বাসর রাতের পর দু’হাতে আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ও গরীব-মিসকিনদের সাধ্যনুযায়ী ওলীমা খাওয়ানাের আয়ােজন করা।
📋-মুসলিম, হাদীস নং- ১৪২৭
🌳১৪.দুই বা ততোধিক স্ত্রী থাকলে সকলকে সমানভাবে রাখতে হবে অন্যথায় হাশরের ময়দানে অর্ধাঙ্গ অবস্থায় উঠতে হবে।
📋-ইবনে মাজাহ শরীফ-১/১৪১
🌀🌀🌀বিবাহ পড়ানোর সুন্নাত তরীকা।🌀🌀🌀
🍃১। ইজাব কবুল বিবাহের জন্য আবশ্যক। এদু‘টি দ্বারা বিবাহ হয়ে যায়। অর্থাৎ বিবাহের আগে মেয়ের থেকে মেয়ের ওলী বা অভিভাবক অনুমতি আনবেন। অনুমতি আনার সময় মেয়েকে ছেলের বিস্তারিত পরিচয় দিতে হবে এবং মহরের টাকার পরিমাণ উল্লেখ করে সে রাজি আছে কিনা সেটা জানতে হবে। মেয়ে যদি কুমারী হয় তাহলে চুপ থাকলে বা কাদলে অনুমতি হয়ে যাবে। আর যদি বিবাহিতা হয় তাহলে স্পষ্টভাবে বলতে হবে। এভাবে অনুমতি এনে তিনি নিজে বা অন্য কাউকে ওকীল বানিয়ে ছেলে থেকে কবুল গ্রহণ করবেন।
🍃২। বিবাহের জন্য খুৎবা পড়া সুন্নাত।
🍃৩। যখন বিয়ে হয়ে যাবে তখন বর ও কনের
জন্য এ দোয়া পড়া সুন্নাত।
📋-মুসনাদে আহমাদ, হাদীস নং-৮৫৯৯
ﺑَﺎﺭَﻙَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻟَﻚَ ﻭَﺑَﺎﺭَﻙَ ﺍﻟﻠﻪُ ﻋَﻠَﻴْﻚَ ﻭَ ﺟَﻤَﻊَ ﺑَﻴْﻨَﻜُﻤَﺎ ﻓِﻲْ
ﺧَﻴْﺮٍ
🌾 অর্থ, আল্লাহ পাক আপনার জন্য বরকত
দান করুন এবং আপনার উপরে বরকত
অবতীর্ণ করুন এবং আপনাদেরকে মঙ্গলময়
দাম্পত্য জীবন দান করুন।
🔵🔵 ওয়ালিমা 🔵🔵
⬛ বিয়ের পর ছেলের পক্ষে আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভাকাঙ্ক্ষী ও গরিব-মিসকিনদের তৌফিক অনুযায়ী আপ্যায়ন করাকে ‘ওয়ালিমা’ বলে। বাংলায় ওয়ালিমাকে বউভাত বলা হয়ে থাকে। বিয়ের পরদিন বা পরবর্তী সময়ে সুবিধামতো নিকটতম সময়ের মধ্যে ওয়ালিমা করা বিধেয়। তবে তিন দিনের মধ্যে করা উত্তম। যেকোনো প্রকার খাদ্যদ্রব্য দিয়ে ওয়ালিমা করা যায়। ওয়ালিমা একটি ইবাদত। এক দিন ওয়ালিমা করা সুন্নত, দুই দিন ওয়ালিমা করা মুস্তাহাব, তিন দিন ওয়ালিমা করা জায়েজ।
📋-মুসলিম: ১৪২৭
🍂ওয়ালিমা করা এক গুরুত্বপূর্ণ সুন্নত। রাসুলুল্লাহ (সা.) নিজে ওয়ালিমা করেছেন এবং সাহাবিদের করতে বলেছেন। রাসুলুল্লাহ (সা.) জয়নব বিনতে জাহাশ (রা.)-কে বিয়ে করার পরদিন ওয়ালিমা করেছিলেন। (বুখারি, হাদিস নম্বর-৫১৭০)। রাসুলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়াহ (রা.)-কে বিয়ের পর তিন দিন যাবৎ ওয়ালিমা খাইয়েছিলেন।
📋-মুসনাদে আবু ইয়ালা, হাদিস নম্বর-৩৮৩৪)।
🍂হজরত আনাস (রা.) বলেন, নবী (সা.) আবদুর রহমান ইবনে আওফের গায়ে হলুদ রঙের চিহ্ন দেখে জিজ্ঞেস করলেন, এটা কী? তিনি বললেন, আমি এক খেজুর আঁটির ওজন স্বর্ণ দিয়ে একজন মহিলাকে বিবাহ করেছি। রাসুল (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ তোমার বিবাহে বরকত দান করুক। একটি ছাগল দ্বারা হলেও তুমি ওয়ালিমা করো।’
📋-বুখারি: ৫১৫৫
📋-মুসলিম ও মিশকাত, হাদিস নম্বর-৩২১০
🍂হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) জয়নব (রা.)-কে বিয়ে করার পর যত বড় ওয়ালিমা করেছিলেন, তত বড় ওয়ালিমা তিনি তাঁর অন্য কোনো স্ত্রীর বেলায় করেননি।
📋-বুখারি: ৫১৬৮
📋-মুসলিম: ২৫৬৯
📋-মিশকাত, হাদিস নম্বর-৩২১১
🍂হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন জয়নব বিনতে জাহাশকে বিবাহ করলেন, তখন ওয়ালিমা করলেন এবং মানুষকে রুটি-গোশত দিয়ে তৃপ্তিসহকারে খাওয়ালেন।
📋-বুখারি: ৪৭৯৪
📋-মিশকাত, খণ্ড: ২, হাদিস নম্বর-৩২১১
🍂হজরত আনাস (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) ছাফিয়াহ (রা.)-কে মুক্ত করে বিবাহ করলেন এবং তাঁর মোহর নির্ধারণ করলেন তাঁর মুক্তিপণ। তিনি তাঁর বিবাহের ওয়ালিমা করেছিলেন ‘হায়স’ নামক খাদ্য দিয়ে, যা খেজুর, পনির ও ঘি দ্বারা তৈরি ছিল।
📋-বুখারি: ৫১৬৯
📋-মুসলিম: ২৫৬২
📋-মিশকাত, খণ্ড: ২, হাদিস নম্বর-৩২১৩
◼ওয়ালিমায় অতিরিক্ত ব্যয় করা কিংবা খুব উঁচু মানের খানার ব্যবস্থা করা জরুরি নয়। বরং সামর্থ্য অনুযায়ী খরচ করাই সুন্নত আদায়ের জন্য যথেষ্ট। যে ওয়ালিমায় শুধু ধনী ও দুনিয়াদার লোকদের দাওয়াত দেওয়া হয়, দ্বীনদার ও গরিব-মিসকিনদের দাওয়াত দেওয়া হয় না, সেই ওয়ালিমাকে হাদিসে নিকৃষ্টতম ওয়ালিমা বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
📋-আবু দাউদ: ৩৭৫৪
🍂হজরত আনাস (রা.) বলেন, খায়বার থেকে ফিরে আসার সময় নবী (সা.) খায়বার ও মদিনার মধ্যবর্তী স্থলে তিন দিন অবস্থান করলেন এবং সেখানে ছাফিয়্যা (রা.)-কে নিয়ে যাওয়া হলো। তিনি ওয়ালিমার ব্যবস্থা করলেন আর আমি মুসলিমদের তাঁর ওয়ালিমার জন্য দাওয়াত করলাম। এই ওয়ালিমায় রুটি বা গোশত কিছুই হলো না। এই ওয়ালিমার জন্য রাসুলুল্লাহ (সা.) চামড়ার দস্তরখান বিছানোর আদেশ করলেন। অতঃপর এই দস্তরখানের ওপর খেজুর, পনির ও ঘি ঢেলে দেওয়া হলো।
📋-বুখারি: ৫৩৮৭
📋-মিশকাত, হাদিস নম্বর-৩২১৪
🍂ছাফিয়্যা বিনতে শায়বা (রা.) বলেন, নবীজি (সা.) তাঁর এক স্ত্রীর ওয়ালিমা করেছিলেন মাত্র দুই ‘মুদ’ (বা এক ‘সা’, অর্থাৎ সাড়ে তিন কেজি) যব দ্বারা।
📋-বুখারি: ৫১৭২
📋-মিশকাত, হাদিস নম্বর-৩২১৫
◾বিবাহের ক্ষেত্রে ছেলের জন্য ওয়ালিমা করা সুন্নত। আজকাল মেয়ের বাড়িতে যে ভোজের আয়োজন করা হয়, তা শরিয়তসম্মত নয়। বিয়েতে মেয়েপক্ষের কোনোরূপ খরচ করার কথা নয়। এরপরও যেটা করা হয়, সেটা সৌজন্যমূলক আপ্যায়নমাত্র।
📋-বুখারি, হাদিস নম্বর-৬০১৮
◾অথচ বর্তমান যুগে ওয়ালিমার এই সুন্নত বর্জনের প্রবণতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা বাঞ্ছনীয় নয়। বিশেষত মেয়েপক্ষের ওপর আপ্যায়নের যে চাপ সৃষ্টি করা হয়, তা সম্পূর্ণ হারাম। সর্বোপরি শর্ত আরোপ করে বরযাত্রীর নামে বরের সঙ্গে অধিকসংখ্যক লোক নিয়ে যাওয়া এবং কনের বাড়িতে মেহমান হয়ে কনের পিতার ওপর বোঝা সৃষ্টি করা আজকের সমাজের একটি জঘন্য কুপ্রথা, যা সম্পূর্ণরূপে পরিত্যাগ করা আবশ্যক। 📋-মুসনাদে আহমাদ: ২০৭২২
📋-বুখারি: ২৬৯৭
♻ কনেপক্ষের অনিচ্ছাকৃত বা চাপের মুখে বাধ্যতামূলক আপ্যায়ন ও মেহমানদারি সম্পূর্ণ নাজায়েজ। এতে অংশগ্রহণ করাও গুনাহের কাজ। কারও ওপর জোর প্রয়োগ করে কোনো খাবার গ্রহণ করা জুলুমের শামিল।
📋-আল দায়েউস সানায়ে, কিতাবুন নিকাহ; দুররুল মুখতার, রদ্দুল মুহতার।
🌷والله اعلم بالصواب🌷