01/04/2024
ব্যাংক ও সুদী লেনদেন সংক্রান্ত নিত্য প্রয়োজনীয় মাসাইলঃ
-------------------------------------------------------------
সুদী ব্যাংকে চাকুরী করার হুকুমঃ
প্রশ্নঃ সুদী ব্যাংকে চাকুরী করা কি জায়েয?
উত্তরঃ প্রচলিত ধারার ব্যাংকের চাকরি সুদী কাজে সরাসরি সহযোগিতার শামিল। এতে চাকরি করলে শ্রমও হারাম এবং আয়ও হারাম হবে। মুসলমানদের জন্য এ ধরনের চাকরি থেকে বিরত থাকা আবশ্যক।
[সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮, আলআশবাহ ওয়ান-নাযায়ের ৩/২৩৪]
সুদী ব্যাংকে চাকরির আবেদন ফরম পূরণ করার হুকুমঃ
প্রশ্ন : আমি একটি ফটোকপি ও কম্পিউটার কম্পোজের দোকান দিয়েছি। এতে আমি নির্দিষ্ট টাকার বিনিময়ে অনলাইনের মাধ্যমে বিভিন্ন চাকরির আবেদন ফরম পূরণ করে দিই। আমার জন্য কি কোনো সুদী ব্যাংকে চাকরির আবেদন ফরম পূরণ করা জায়েয হবে?
উত্তর : প্রচলিত ধারার ব্যাংকে চাকরি করা নাজায়েয। কেননা এ ব্যাংকগুলোর প্রধান ও মূল কাজই হলো সুদের আদান-প্রদান। সুতরাং ব্যাংকের চাকরির জন্য আবেদন ফরম পূরণ করে দেওয়া নাজায়েয কাজে সহযোগিতা করার অন্তর্ভুক্ত। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা গুনাহের কাজে সহযোগিতা করতে নিষেধ করেছেন। তিনি ইরশাদ করেছেন-
وَ تَعَاوَنُوْا عَلَی الْبِرِّ وَ التَّقْوٰی ۪ وَ لَا تَعَاوَنُوْا عَلَی الْاِثْمِ وَ الْعُدْوَانِ ۪ .
‘এবং নেকি ও তাকওয়ায় পরস্পর সহযোগিতা কর এবং গুনাহের কাজ ও সীমালঙ্ঘনে একে অন্যের সহযোগিতা করো না।’ [সূরা মায়েদা (৫) : ২]
অতএব সুদী ব্যাংকে চাকরির আবেদন ফরম পূরণ করে দেওয়া বৈধ হবে না।
কোন্ ব্যাংকে টাকা জমা রাখা যাবে?
প্রশ্ন : বর্তমানে অনেকের ইচ্ছা না থাকলেও একরকম বাধ্য হয়েই ব্যাংকে টাকা জমা রাখতে হয় এবং লেনদেন করতে হয়। তাই কোন্ ব্যাংকে টাকা জমা রাখা এবং লেনদেন করা জায়েয ও অপেক্ষাকৃত নিরাপদ?
উত্তর : বিশেষ প্রয়োজনের ক্ষেত্রে প্রচলিত ধারার ব্যাংকসমূহে কারেন্ট একাউন্ট (চলতি হিসাব) তথা সুদবিহীন হিসাব খুলে লেনদেন করা জায়েয। তবে এসব ব্যাংকে কোনো ধরনের সঞ্চয়ী হিসাব খোলা জায়েয হবে না। প্রাপ্ত সুদ নিজে ভোগ না করলেও এসব সুদী একাউন্ট খোলাই জায়েয নয়। কেননা সুদী ব্যাংকে যে কোনো ধরনের সঞ্চয়ী হিসাব খোলাই মূলত সুদী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া।
আর এদেশে প্রচলিত ইসলামী ব্যাংকগুলোতে নিজে মুনাফা গ্রহণ না করার প্রত্যয় নিয়ে সঞ্চয়ী হিসাব খোলা যাবে। কেননা এসব ব্যাংকের সঞ্চয়ী হিসাবগুলো মুদারাবা ভিত্তিতে হয়ে থাকে। তাই এক্ষেত্রে সুদী চুক্তি হয় না। তবে যেহেতু এই ধারার ব্যাংকগুলোর যথাযথভাবে শরীয়া পালনের বিষয়টি এখনো প্রশ্নবিদ্ধ রয়েছে তাই এ ধরনের হিসাব থেকে প্রাপ্ত মুনাফা সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দেওয়াই নিরাপদ।
[সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮, ১৫৯৯; তাফসীরে কুরতুবী ৩/২২৫ (সূরা বাকারা : ২৭৫); তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ১/৬১৯]
সুদী ব্যাংকে ট্রাঞ্জেকশন বা কারবার করা যাবে কি?
প্রশ্ন : প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলোতে ট্রাঞ্জেকশন করা যাবে কি না? আর এসব ব্যাংকে চাকরি করা বৈধ হবে কি না?
উত্তর : প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো সুদী অর্থনীতির উপর প্রতিষ্ঠিত। সুদ আদানপ্রদানই এসব ব্যাংকের মূল ও প্রধান কাজ। বর্তমান পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় এসব ব্যাংকই হচ্ছে সুদের প্রচার ও প্রসারের প্রধান মাধ্যম। আর ব্যাংকে কর্তব্যরত ব্যক্তি বিভিন্ন উপায়ে সুদী কারবারের সাথে সরাসরি জড়িত। সুদ দেওয়া-নেওয়া যেমন হারাম তেমনি অন্যের সুদী কারবারে জড়িত হওয়াও হারাম। আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম শুধু সুদদাতা ও গ্রহীতাকে লানত করেননি; বরং এর লেখক (অর্থাৎ সুদের হিসাব-কিতাবকারী) ও সাক্ষীগণকেও অভিসম্পাত করেছেন।
হযরত জাবির রা. বলেন, আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহণকারী ও সুদ প্রদানকারী এবং সুদের লেখক ও সাক্ষীদ্বয়ের উপর লানত করেছেন।
[সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮]
সুতরাং একজন মুসলমানের জন্য প্রচলিত ধারার ব্যাংকে চাকরি করা এবং এর বেতনাদি ভোগ করা বৈধ নয়।
আর সুদভিত্তিক হওয়ায় এসব ব্যাংকে সাধারণ সঞ্চয়ী হিসাব বা বিভিন্ন মেয়াদের সঞ্চয়ী হিসাব খোলা কিংবা সুদের ভিত্তিতে যে কোনো ধরনের ঋণ গ্রহণ করা হারাম। কেউ এমন হিসাব খুলে ফেললে তা দ্রুত বন্ধ করে দিতে হবে এবং এ থেকে প্রাপ্ত সুদ সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দিতে হবে।
অবশ্য প্রয়োজনের ক্ষেত্রে এসব ব্যাংকে চলতি হিসাব খোলা, টিটি, পে-অর্ডার ইত্যাদি সুদবিহীন লেনদেন করা জায়েয।
[তাফসীরে কুরতুবী ৩/২২৫ (সূরা বাকারা : ২৭৫); তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ১/২১৯]
সুদী ব্যাংকের বেতন দিয়ে নির্মিত বাড়ি-গাড়ির হুকুম :
প্রশ্ন : আমি একটি সুদী ব্যাংকে ১৫ বছর কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেছি। এ সময় ব্যাংক থেকে পাওয়া বেতন দিয়ে জমি, বাড়ি-গাড়ি করেছি। এখন আমি সুদী কারবারে জড়িত থাকার কারণে অনুতপ্ত হয়ে ভিন্ন চাকুরীতে যোগদান করেছি। কিন্তু আগের চাকুরীর বেতন দিয়ে আমি যে সম্পত্তির মালিক হয়েছি তা কি আমার জন্য বৈধ হবে? বৈধ না হলে আমি এখন কী করতে পারি?
উত্তর : সুদী ব্যাংকে চাকুরী করে যা উপার্জন করেছেন তা হারাম। এ টাকা দিয়ে খরিদকৃত জমি ও বাড়ি-গাড়ি ব্যবহার করা ও তা দ্বারা উপকৃত হওয়া নাজায়েয। এখন আপনি যদি এগুলো থেকে বৈধভাবে উপকৃত হতে চান তবে যে পরিমাণ টাকা দ্বারা জমি কিনেছেন ও বাড়ি-গাড়ি করেছেন সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সে পরিমাণ টাকা গরীব-মিসকীনদের মাঝে সদকা করে দিলে আপনি এ সম্পদের মালিক হয়ে যাবেন। তখন এগুলো থেকে উপকৃত হওয়া জায়েয হবে। ক্রয়মূল্য সদকা করার আগ পর্যন্ত ঐ সম্পদ হালাল হবে না এবং এর থেকে কোনো প্রকার উপকৃত হওয়াও আপনার জন্য বৈধ হবে না।
তাই ক্রয়মূল্য সদকা করার পূর্বে বাড়িভাড়া বা জমি থেকে যা আয় হবে তাও সদকা করে দিতে হবে। আর পিছনের জীবনে হারাম উপার্জন ও তার ভোগব্যবহারের কারণে আল্লাহ তাআলার নিকট তাওবা-ইস্তিগফারও করতে হবে।
[তাকমিলাতু ফাতহিল মুলহিম ১/৬১৯; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৬/৩২২; বাদায়েউস সানায়ে ৬/১৫০; হেদায়া, ফাতহুল কাদীর ৮/২৫৮]
সুদী ব্যাংকের বেতন দিয়ে নির্মিত বাড়ির ভাড়া ভোগ করার বিধান :
প্রশ্ন : আমি একটি জেনারেল (সুদী) ব্যাংকে প্রায় ৯ বছর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা হিসাবে কাজ করেছি। এ সময়ে প্রাপ্ত বেতন-বোনাস দিয়ে গাড়ি-বাড়ি করেছি। পরবর্তীতে একসময় ‘সুদী ব্যাংকে চাকরি করা বৈধ নয়’ এ মাসআলা জানার পর সুদী কারবারের সাথে জড়িত থাকার কারণে নিজের মাঝে অনুশোচনা জাগে। ফলে ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়ে এখন অন্য একটি চাকরিতে যোগদান করেছি। এখন আমি জানতে চাই, আগের চাকরির বেতন-বোনাস দিয়ে যে গাড়ি-বাড়ি করেছি তা আমার জন্য বৈধ কি না? যদি বৈধ না হয়ে থাকে তাহলে আমার এখন করণীয় কী?
উত্তর : সুদী প্রতিষ্ঠানে কাজ করে যে আয় দিয়ে গাড়ি-বাড়ি বা অন্য যে সম্পদ গড়েছেন, তা ভোগ করা জায়েয হবে না। এখন আপনি যদি এ গাড়ি-বাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ থেকে বৈধভাবে উপকৃত হতে চান, তাহলে যে পরিমাণ টাকা দিয়ে এ গাড়ি-বাড়ি ও অন্যান্য সম্পদ করেছেন, সে পরিমাণ টাকা সওয়াবের নিয়ত ব্যতীত গরিব-মিসকিনদের মাঝে সদকা করে দিতে হবে। এভাবে যতটুকু সদকা করবেন ততটুকু সম্পদ আপনার জন্য হালাল বলে বিবেচিত হবে।
উল্লেখ্য, গাড়ি-বাড়ি করার পর এগুলো ভাড়ায় দিয়ে থাকলে তা থেকে উপার্জিত টাকাও সদকা করে দিতে হবে এবং পিছনের জীবনে হারাম উপার্জন ও হারাম ভোগ-ব্যবহারের কারণে আল্লাহ তাআলার কাছে তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে।
[সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮; বাদায়েউস সানায়ে ৬/১৪৫; ফাতহুল কাদীর ৮/২৫৮; আলবাহরুর রায়েক ৮/১১৪]
সুদী ব্যাংকে চাকরিজীবীর দেয়া হাদিয়া নেয়া যাবে কি?
প্রশ্ন : যারা সুদী ব্যাংকে চাকুরি করে তাদের বেতনের টাকা হালাল কি না? আর তারা কিছু হাদিয়া দিলে তা ব্যবহার করা যাবে কি না?
উত্তর : সুদী ব্যাংক বা শরীয়তের বিধিনিষেধ মেনে লেনদেন করে না-এমন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করা নাজায়েয। এ থেকে প্রাপ্ত বেতন-ভাতা হালাল নয়। এবং এর পেছনে শ্রম ব্যয় করাও জায়েয নয়। হাদীস শরীফে সুদখোর, সুদদাতা, সুদের হিসাব-কিতাবকারী ও সাক্ষ্যদাতা সকলের উপর অভিশম্পাত এসেছে। তাই এসব প্রতিষ্ঠানে চাকুরিরত ব্যক্তির কর্তব্য হল, বৈধ কোনো উপার্জনের ব্যবস্থা করা এবং দ্রুত ঐ চাকুরি ছেড়ে দেওয়া। আর তাদের চাকুরির টাকা যেহেতু হালাল নয় তাই এ থেকে কাউকে কোনো কিছু হাদিয়া দিলে জেনেশুনে তা গ্রহণ করা জায়েয হবে না। অবশ্য তাদের কোনো বৈধ উপার্জন থেকে হাদিয়া দিলে তা গ্রহণ করা জায়েয হবে।
[সহীহ মুসলিম, হাদীস : ১৫৯৮; তাকমিলা ফাতহিল মুলহিম ১/৬১৯; আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৭৩]
ব্যাংকের চার্জ সুদ দ্বারা আদায় করা যাবে কি?
প্রশ্ন: কোনো ব্যক্তি ব্যাংকে তার জমাকৃত টাকার উপর বছরে ২০০০ টাকা সুদ/মুনাফা পেল। ব্যাংক তার বিভিন্ন চার্জ বাবদ বছরে ১০০০ টাকা কেটে রাখল। এখন গরীবদেরকে দেওয়ার সময় মোট ২০০০ টাকা দিতে হবে নাকি ১০০০ টাকা দিতে হবে।
উত্তর: ব্যাংকে যে সুদ/মুনাফা জমা হয় সে টাকা থেকে তৎক্ষণাৎ ১০% বা ১৫% সরকারি কর হিসাবে কেটে নেওয়া হয়। কর কেটে নেওয়ার পর যে নীট সুদ/মুনাফা একাউন্ট হোল্ডারদের একাউন্টে জমা থাকবে তার সবটুকুই সওয়াবের নিয়ত ছাড়া গরীবদের দিয়ে দিতে হবে। অন্যান্য চার্জ বাবদ ব্যাংক যে টাকা কেটে রাখে অথবা সরকার এক্সেস ডিউটি বাবদ আলাদাভাবে যে টাকা একাউন্ট থেকে নিয়ে থাকে তা সুদের টাকা দ্বারা আদায় করা যাবে না; বরং তা একাউন্ট হোল্ডারদের জমাকৃত মূল টাকা থেকেই নেওয়া হয়েছে বলে বিবেচিত হবে। কেননা ব্যাংক একাউন্ট হোল্ডারদেরকে বিভিন্ন সুবিধা প্রদানের বিনিময় হিসাবেই বিভিন্ন চার্জ নিয়ে থাকে। তাই সুদ থেকে ব্যাংকের চার্জ আদায় করা সুদ দ্বারা ফায়দা গ্রহণেরই অন্তর্ভুক্ত। তাই তা জায়েয হবে না।
[সুনানে কুবরা, বাইহাকী ৫/৩৫০; বাদায়েউস সানায়ে ৬/৫১৮]
ইসলামী ব্যাংকে চাকরি করা এবং তাতে হজ্ব একাউন্ট করা যাবে কি?
প্রশ্ন: বর্তমানে বাংলাদেশে যেসব ইসলামী ব্যাংক রয়েছে সেখানে চাকরি করা জায়েয কি না? আর ঐ সব ব্যাংকে হজ্ব একাউন্ট করা জায়েয হবে কি না?
উত্তর: ইসলামী ব্যাংকগুলোর কারবার পর্যবেক্ষণ করে এবং সংশ্লিষ্টদের সাথে কথা বলে জানা যায় যে, তারা নিজেদের বিনিয়োগ ইত্যাদিতে যথাযথ পন্থায় শরীয়ার অনুসরণ করে না। এই ব্যাংকগুলো সম্পর্কে এ অভিযোগটি অনেকেরই রয়েছে। তাই তাকওয়ার উপর চলতে চায় এমন ব্যক্তিদেরকে আমরা এসব ব্যাংকে চাকুরির বিষয়ে নিরুৎসাহিত করে থাকি।
আর হজ্ব করা দরকার নিরঙ্কুশ হালাল সম্পদ খরচ করে। এতে সন্দেহযুক্ত কোনো অর্থ যোগ করা ঠিক নয়।
ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রাপ্ত মুনাফা মসজিদের কাজে ব্যয় করা যাবে কি?
প্রশ্ন : আমি একটি জামে মসজিদের ক্যাশিয়ার। আমাদের মসজিদ ফান্ডের উদ্বৃত্ত টাকা ইসলামী ব্যাংকের সেভিং একাউন্টে রাখা হয়েছে। তাতে মূল জমাকৃত টাকার উপর কিছু মুনাফাও যোগ হয়েছে। এখন উক্ত মুনাফার টাকা মসজিদের নির্মাণ কাজে ব্যয় করা শরীয়তসম্মত হবে কি না?
উত্তর : ইসলামী ব্যাংকগুলোর অনেক বিনিয়োগ পদ্ধতি এবং সেগুলোর প্রয়োগ এখনো পরিপূর্ণ শরীয়ত সম্মত হয় না। তাই তাদের থেকে প্রাপ্ত মুনাফা মসজিদে ব্যয় করা ঠিক হবে না।
ইন্সুরেন্স কোম্পানি ব্যাংকের লোন পরিশোধ করলে লোন গ্রহীতা দায়মুক্ত হবে কি?
প্রশ্ন : বিদেশে অনেকে ব্যাংক থেকে লোন নেয়। নেওয়ার সময় ব্যাংক কিছু টাকা কেটে রাখে ইন্সুরেন্স বাবদ। যাতে লোন গ্রহীতা মারা গেলে বা কোনো কারণে দেশে চলে গেলে লোনের টাকা ইন্সুরেন্স পরিশোধ করতে পারে। এখন ইন্সুরেন্স কোম্পানি যেহেতু লোন গ্রহীতার অনুপস্থিতিতে লোনের টাকা পরিশোধ করার শর্তে ব্যাংকের সাথে চুক্তিবদ্ধ হয় এবং ব্যাংক ইন্সুরেন্স বাবদ একটা নির্দিষ্ট অংকের টাকা লোন গ্রহীতার নিকট থেকে প্রথমেই কেটে রাখে তাই লোন গ্রহীতা লোনের টাকা পরিশোধ না করে যদি দেশে চলে যায় আর চুক্তি অনুযায়ী ইন্সুরেন্স তা পরিশোধ করে তবে কি লোন গ্রহীতা এই ঋণ থেকে দায়মুক্ত হয়ে যাবে? নাকি আখিরাতে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হক নষ্টের কারণে জবাবদিহি করতে হবে?
উত্তর : প্রশ্নের বর্ণনা অনুযায়ী ব্যাংকের লোনের উপর ইন্সুরেন্স করা থাকলেও এবং লোন গ্রহীতা টাকা না দিলে ইন্সুরেন্স কোম্পানি তা পরিশোধ করে দিবে- এমন ব্যবস্থা থাকলেও লোন গ্রহীতার জন্য কোনো অবস্থায়ই লোনের টাকা ফেরত না দেওয়া জায়েয হবে না। সর্বাবস্থায় লোনের টাকা ফেরত দেওয়া তার জন্য জরুরি। এ টাকা ফেরত না দিলে অন্যের হক আত্মসাৎ করার গুনাহ হবে।
প্রকাশ থাকে যে, সুদি লোন যেমন হারাম তেমনি ইন্সুরেন্সও হারাম। এতে সুদ ও জুয়া দুটিই রয়েছে। কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফে সুদ ও জুয়ার বিষয়ে কঠোর ধমকি এসেছে। আর সুদের মধ্যে বাহ্যিক দৃষ্টিতে অর্থনৈতিক কিছু সাময়িক ফায়েদা দেখা গেলেও এতে রয়েছে চরম বেবরকতি ও খোদায়ী অভিশাপ। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন, (তরজমা) আল্লাহ সুদকে নিশ্চিহ্ন করেন এবং সদকা বৃদ্ধি করেন। (সূরা : বাকারা : ২৭৬)
তাই অনতিবিলম্বে সকল সুদি কারবার নিষ্পত্তি করা এবং এ থেকে খালেস দিলে তাওবা করা জরুরি।
[জামে তিরমিযী, হাদীস: ১২৬৫; মুসনাদে আহমাদ, হাদীস: ২০০৪৬]
পেনশনার সঞ্চয়পত্র ক্রয় এবং তার মুনাফা গ্রহণের হুকুম কী?
প্রশ্ন : আমার বাবা একজন রিটায়ার্ড অফিসার। তিনি বিশ লাখ টাকা পেনশন স্কীমে সঞ্চয়পত্র কিনে রেখেছেন। এর ফলে গভঃমেন্ট তাকে তিন মাসে ৬২,৫০০/- টাকা দেয়। এটা কি সুদ? আমার বাবা বলেন যে, এটা রিটায়ার্ড লোকদের জন্য করা হয়েছে। অন্যরা এটা করতে পারে না। এটাকে ‘‘গভঃমেন্ট পেনশন স্কীম’’ নাম দেওয়া হয়েছে। আসলেই কি এটা পেনশনের মতো হালাল, নাকি সুদ?
উত্তর : ‘গভঃমেন্ট পেনশন স্কীম’ যদিও সরকারি ব্যবস্থাপনায় রিটায়ার্ড অফিসারদের জন্য করা হয়েছে, কিন্তু এটি সম্পূর্ণ সুদি স্কীম। কারণ সরকার মেয়াদী সঞ্চয়পত্রের মাধ্যমে গৃহিত টাকার উপর নির্দিষ্ট অংকে সুদ দিয়ে থাকে। তাই পেনশন নাম দেওয়ার কারণে তা হালাল হয়ে যাবে না। বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সুদভিত্তিক মেয়াদী জমা হিসাবকেও তো ডি.পি.এস বা ডিপোজিট পেনশন স্কীম বলা হয়ে থাকে। অথচ সেটিও হারাম।
সুতরাং আপনার পিতার সঞ্চয়পত্র কেনা সম্পূর্ণ নাজায়েয হয়েছে এবং এ স্কীম থেকে তিনি অতিরিক্ত যে অর্থ গ্রহণ করেছেন তা সুদ হয়েছে। ক্রয়কৃত সঞ্চয়পত্র জমা দিয়ে এ স্কীম প্রত্যাহার করা জরুরি। অতপর মূল টাকার অতিরিক্ত অংশ ফকীর-মিসকীনকে সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দেওয়া আবশ্যক। আর কৃত গুনাহের জন্য আল্লাহ তাআলার দরবারে তাওবা-ইস্তিগফার করতে হবে।
[সূরা বাকারা : ২৭৫; আহকামুল কুরআন, জাসসাস ১/৪৬৫; তাফসীরে তবারী ৩/১০৪; শরহুল মাজাল্লা ২/৪৫৫; বুহুস ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছিরা ২/১১০, ২৩৩]
সুদ গ্রহণ না করার নিয়তে সুদী ব্যাংকে একাউন্ট খোলা কি বৈধ?
প্রশ্ন : বর্তমানে টাকা-পয়সা হেফাযতের জন্য কী করণীয় আছে? সুদী ব্যাংকে আমার একটি একাউন্ট আছে। তার সুদ সওয়াবের নিয়ত ছাড়া সদকা করে দিলে একাউন্টটি ব্যবহার করা যাবে কি? বা এ উদ্দেশ্যে একাউন্ট খোলা যাবে কি?
উত্তর : সুদী ব্যাংকে জমাকৃত টাকার অতিরিক্ত অংশ গ্রহণ না করলেও তাতে সেভিংস একাউন্ট খোলা মানেই সুদী চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া। পরবর্তীতে সুদ গ্রহণ না করলেও সুদী চুক্তির গুনাহ হবে। আর পরে অতিরিক্ত গ্রহণ করলে তাতে সুদ গ্রহণ ও ভোগ করার গুনাহ হবে ভিন্নভাবে। তাই সুদী ব্যাংকে একাউন্ট খোলা আবশ্যক হলে কারেন্ট একাউন্ট তথা চলতি হিসাব খোলা যাবে।
অবশ্য আজকাল কোনো কোনো ব্যাংকে কারেন্ট একাউন্টেও কিছু সুদ দেওয়া হয়, যাকে এস.টি.ডি. বলে। কোনো কোনো ব্যাংকে ভিন্ন নামও আছে। এ ধরনের কারেন্ট একাউন্ট খোলার হুকুম সুদী ব্যাংকের সেভিংস একাউন্টের মতোই। একাউন্ট করলেই সুদী চুক্তির গুনাহ হবে। তাই সুদী ব্যাংকে একাউন্ট করতে চাইলে অতিরিক্ত দেয় না শুধু এমন কারেন্ট একাউন্টই করতে পারবে।
ব্যাংকের চাকরিজীবী থেকে বেতন নেয়ার হুকুম :
প্রশ্ন: সুদী ব্যাংকের একজন এমডির কয়েক সন্তানকে আমি পড়াই। এতে আমার মাসে ২০ হাজার টাকা ইনকাম হয়। যা দ্বারা আমার সংসার চলে। এছাড়া ইনকামের আমার আর কোনো ব্যবস্থা নেই। আমার জানা মতে তার ঐ সুদী চাকরি ছাড়া ইনকামের আর কোনো বিকল্প ব্যবস্থা নেই। আমার জন্য কি ঐ টিউশনির টাকা বৈধ হবে?
উত্তর: প্রশ্নের বর্ণনা অনুযায়ী ঐ ব্যক্তির আয় যেহেতু হারাম, আর আপনি সে সম্পর্কে অবগত তাই তার হারাম উপার্জন থেকে দেওয়া বেতন আপনার জন্য গ্রহণ করা বৈধ হবে না। ঐ ব্যক্তির কর্তব্য, হালাল সম্পদ দ্বারা আপনার বেতন আদায় করা। যদি এ ব্যবস্থা না হয় তাহলে আপনি অন্য চাকরি খোঁজ করতে থাকেন এবং আল্লাহর কাছে ইস্তিগফার করতে থাকেন। মোটামুটি চলার ব্যবস্থা হলেই এটা ছেড়ে দিতে হবে।
[আহকামুল মালিল হারাম পৃ. ৩১৫; আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৬৩; আযযাখীরা ১৩/৩১৭; আলবায়ান ওয়াত তাহসীল ১৮/৫১৪; বুহুছ ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছিরা পৃ. ৪২৯; খুলাসাতুল ফাতাওয়া ৪/৩৫২; আলবাহরুর রায়েক ৮/২০১; রদ্দুল মুহতার ৪/১৯৩]
সুদী ব্যাংকের ম্যানেজারের সন্তানকে পড়িয়ে বেতন নেয়ার হুকুম :
প্রশ্ন: আমি এক ব্যক্তির ছেলেকে প্রাইভেট পড়াতে চাই। সে এ বাবদ আমাকে মাসে পাঁচ হাজার টাকা দিবে বলেছে। কিন্তু লোকটি সোনালী ব্যাংকের ম্যানেজার। এই চাকুরিই তার আয়ের একমাত্র উৎস। আমি তার ছেলেকে পড়ালে তার ঐ আয় থেকে বেতন নিতে পারব কি না?
উত্তর: প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে বাস্তবেই যদি ঐ ব্যক্তির অন্য কোনো হালাল উপার্জন না থাকে তবে তার ছেলেকে পড়ানোর বিনিময়েও তার থেকে বেতন গ্রহণ করা জায়েয হবে না। কেননা ছাত্র পড়ানোর পেশা যদিও বৈধ কিন্তু এক্ষেত্রে বেতন যে টাকা থেকে দেওয়া হচ্ছে তা হারাম হওয়ার বিষয়টি আপনার জানা আছে। সুতরাং জেনেশুনে হারাম অর্থ থেকে পারিশ্রমিক গ্রহণ করা বৈধ হবে না।
[আলআশবাহ ওয়ান নাযাইর ৩/২৩৪; আদ্দুররুল মুখতার ৫/৯৮; ফাতাওয়া খানিয়া ৩/৪০০; ফাতাওয়া বাযযাযিয়া ৬/৩৬০; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৪২; ইতরুল হিদায়া ৬৮]
সুদী আয়ের লোকের চাকরি করে বেতন নেওয়ার হুকুম :
প্রশ্ন: আমি এক বাড়ির কেয়ারটেকারের চাকুরি নিয়েছি। আমার মালিক একজন উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তা। আমি অবগত হয়েছি যে, তার আয়ের একটি অংশ হচ্ছে সুদ-ঘুষ। এ অবস্থায় উক্ত মালিকের চাকুরি করার কী হুকুম হবে?
উত্তর: আপনার কর্তা যেহেতু একজন উচ্চপদস্থ অফিসার। তাই তার বেতনও বেশি হবে। যা থেকে আপনার বেতন দেওয়া সহজেই সম্ভব। এ হিসাবে সেখানে চাকুরি করা এবং তার দেওয়া বেতন গ্রহণ করা অবৈধ হবে না। হ্যাঁ, কখনো হারাম উপার্জন থেকে দেওয়া হচ্ছে এটা নিশ্চিত হলে তা গ্রহণ করা বৈধ হবে না। সেক্ষেত্রে হালাল উপার্জন থেকে আপনার প্রাপ্য দেওয়ার আবেদন জানাতে পারেন।
[আদ্দুররুল মুখতার ৬/৩৮৫; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৪২; ফাতাওয়া ইবনে তাইমিয়া ২৯/২৪২; হাশিয়া শরহে বেকায়া, ফাতাহ লখনভী ৪/৫৬]
এনজিওতে সুদী ঋণ আদানপ্রদানের চাকরি করার বিধান :
প্রশ্ন: আমি একটি এনজিওতে কর্মসূচি সংগঠক পদে চাকরি করছি। এই চাকরির উপর আমার পরিবার নির্ভরশীল। আমার কাজ হলো, মানুষের মাঝে টাকা ঋণ দেওয়া এবং সে টাকা কিছু বেশিতে আদায় করা। যেমন কাউকে ৫,০০০/-টাকা ঋণ দিলে তার কাছ থেকে কিস্তির মাধ্যমে ৬,০০০/- টাকা আদায় করা হয়। আর এ কাজের জন্য আমাকে মাসিক ৭,০০০/-টাকা বেতন দেওয়া হয়। এ চাকরি ও তার বেতন কি বৈধ হবে? এ টাকা দিয়ে জীবন ধারণ করে ইবাদত করলে তা কি গ্রহণযোগ্য হবে?
উত্তর: আপনি যে পন্থায় লেনদেন করে থাকেন তা সুদেরই একটি প্রকার। আর সুদ হচ্ছে নিকৃষ্টতম হারাম। তাই এ পদে চাকরি করা জায়েয হবে না এবং এর বেতন ভোগ করাও নাজায়েয। অতএব যত দ্রুত সম্ভব আপনাকে উপার্জনের কোনো বৈধ পন্থা খুঁজে বের করতে হবে এবং আল্লাহ তাআলার দরবারে তওবা-ইস্তিগফার করতে হবে।
[সূরা বাকারা : ২৭৫; সহীহ বুখারী ১/২৮০; সুনানে আবু দাউদ ২/১১৭; আলবাহরুর রায়েক ৬/১২২; আদ্দুররুল মুখতার ৫/১৬৬; তাকমিলা ফাতহুল মুলহিম ১/৬১৯; বুহুছ ফী কাযায়া ফিকহিয়্যাহ মুআছিরা ১/৩৩৯]
ব্যাংকের বেতন দিয়ে গড়া জায়গা-জমি ব্যবহারের বৈধ উপায়:
প্রশ্ন: এক ব্যক্তি একটি বিদেশী ব্যাংকে চাকরি নেন। ঐ চাকরি অবস্থায় তিনি বেতনের টাকা দিয়ে জায়গা-জমি খরিদ করেন, বাড়ি-ঘর নির্মাণ করেন। নিজের ভাই-বোনকেও সেসকল জায়গা-জমিতে অংশীদার করেন। তাদের বিয়ে-শাদীতেও খরচ করেন। মা-বাবার অনেক খেদমত করেন। এখন তার ব্যাপারে শরীয়তের হুকুম কী? কীভাবে তিনি আখেরাতে মুক্তি পেতে পারেন? আর যারা তার দান গ্রহণ করেছেন বিশেষ করে ভাই-বোন তাদের এখন করণীয় কী? তাদের দায়মুক্ত ও বৈধ অধিকারী হওয়ারই বা কী উপায়?
উত্তর: প্রশ্নোক্ত ব্যক্তিকে এখন দুটি কাজ করতে হবে। এক. সুদি ব্যাংকে চাকরি করা এবং এর বেতন-ভাতা ভোগ করার জন্য খালেস মনে আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা-ইসতেগফার করতে হবে। দুই. ব্যাংকের বেতন-ভাতা দিয়ে যে জমি-বাড়ি করেছেন তা থেকে বৈধভাবে উপকৃত হতে চাইলে মূল টাকা সদকা করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে পুরো টাকা একত্রে সদকা করা সম্ভব না হলে তিনি বা তার ওয়ারিশরা ধীরে ধীরে অল্প অল্প করে তা আদায় করবেন। অনুরূপ যারা তার থেকে দান-সহায়তা নিয়ে স্থায়ী সম্পদ গড়েছেন তারা ঐ সম্পত্তি থেকে বৈধভাবে উপকৃত হতে চাইলে এর মূল্য সমপরিমাণ টাকা সদকা করে দিবেন। আর যে পরিমাণ টাকা ভোগ করেছেন অনুমান করে সে পরিমাণ টাকাও সদকা করে দেওয়ার চেষ্টা করবেন।
[ফাতাওয়া বায্যাযিয়াহ ৬/২৬০; আলবাহরুর রায়েক ৮/২০১; ফাতাওয়া হিন্দিয়া ৫/৩৪৯]
সুদের লেনদেনকারী কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানে চাকরি করার বিধান:
প্রশ্ন: অনেকে বলে থাকেন, বর্তমানে তো সকল চাকরিতেই ঘুষ দিতে হয়। আর কোনো কোম্পানি বা প্রতিষ্ঠানই সুদী লেনদেন থেকে মুক্ত নয়। তাহলে কি কারো জন্য সবধরনের প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যাংক-বীমায়ও চাকরি করা বৈধ হবে?
উত্তর: বর্তমানে দ্বীন ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজে সুদ ও ঘুষের ব্যাপকতা ঘটেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সুদ-ঘুষ ছাড়া কোনো চাকরি বা অন্য কোনো হালাল উপায়ে জীবন নির্বাহ করা যায় না। আর হালাল পণ্য বিক্রি বা উৎপাদনকারী কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে লোন নিলেও সেখানে চাকরি করা বৈধ। এক্ষেত্রে সুদী লোন গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম হলেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে চাকরি আর ব্যাংকের চাকরির হুকুম এক নয়। দুটির হুকুমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ব্যাংক-বীমা সুদী কোম্পানী এবং তাদের মূল কাজ সুদভিত্তিক। বিধায় সেখানে চাকরি করা নাজায়েয।
মোটকথা, সব চাকরিতেই সুদ-ঘুষ রয়েছে- ঢালাওভাবে এমন কথা বলে ব্যাংক-বীমা বা একেবারে হারাম চাকরিতে থাকার ওজর দাঁড় করানো যাবে না। একজন মুমিন হিসাবে হালাল রুজির সন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ তাআলা যখন হালাল রুজির নির্দেশ দিয়েছেন তখন এর সুযোগও থাকবে অবশ্যই।
আর চাকরি সংক্রান্ত মাসআলা জানতে হলে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেম থেকে জেনে নিতে হবে। তাহলে হালালভাবে চলা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
সুদের টাকা দিয়ে মাদরাসা-মসজিদের টয়লেট নির্মাণের হুকুম:
প্রশ্ন: সুদের টাকা দিয়ে মাদরাসা বা মসজিদের টয়লেট নির্মাণ বা পুননির্মাণ করা জায়েয হবে কি?
উত্তর: সুদের টাকা মূল মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া আবশ্যক। যদি মালিক জানা না থাকে বা মালিককে ফিরিয়ে দেওয়া সম্ভব না হয় তাহলে ঐ টাকা সদকা করা ওয়াজিব। সেক্ষেত্রে ঐ টাকা কোনো গরীব-মিসকীনকে সদকা করে দিতে হবে। এ টাকা মসজিদ-মাদরাসার টয়লেটের কাজেও না লাগানো উচিত।
[শরহুল মাজাল্লাহ, মাদ্দাহ : ৯৭; রদ্দুল মুহতার ৬/৩৮৫; তাবয়ীনুল হাকায়েক ৪/১৭১]
সুদি ব্যাংক থেকে প্রদত্ত শিক্ষাবৃত্তি নেওয়ার হুকুম:
প্রশ্ন: সুদি ব্যাংক থেকে যে বৃত্তি দেওয়া হয় তা নেওয়া কি জায়েয?
উত্তর: সুদি ব্যাংক থেকে প্রদত্ত বৃত্তি নেওয়া জায়েয নয়। কারণ ব্যাংকগুলোর অধিকাংশ আয় সুদ। তাই তাদের বৃত্তির মাঝে সুদের আশঙ্কাই বেশি। অতএব এ টাকা যে নামেই দেওয়া হোক তা গ্রহণ করা জায়েয হবে না।
[রদ্দুল মুহতার ২/২৯২; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৮/১৭৪]
সুদী লোনের টাকায় নির্মিত বাড়ি ও প্রতিষ্ঠিত ব্যবসার মুনাফার হুকুম :
প্রশ্ন : আমার এক আত্মীয়ের বাবা ব্যাংক থেকে সুদী ঋণ নিয়ে বাড়ি করেছে। যেটা ভাড়া দেওয়া হবে। ঐ আত্মীয় তার বাবাকে সুদী ঋণ নিতে নিষেধ করেও বিরত রাখতে পারেনি। আবার বাবা বাড়ি তৈরি করার সময় তার থেকে বেশ কিছু টাকা ঋণ নিয়েছে। যা ঐ বাড়িতে কাজে লাগিয়েছে। এখন তার প্রশ্ন হল, ঐ বাড়ি থেকে প্রাপ্ত ভাড়া সে গ্রহণ করতে পারবে কি না? সে কি ঐ বাড়িতে থাকতে পারবে? আর তার বাবার মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে সে বাড়ি থেকে অংশ পেলে তা কি সে গ্রহণ করতে পারবে?
উত্তর : সুদের ভিত্তিতে ঋণ নেওয়া-দেওয়া সম্পূর্ণ হারাম। কুরআন মাজীদে আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
وَ اَحَلَّ اللهُ الْبَیْعَ وَ حَرَّمَ الرِّبٰوا ؕ.
আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল করেছেন এবং সুদকে করেছেন হারাম। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৫
অপর এক আয়াতে আল্লাহ তাআলা বলেছেন,
یٰۤاَیُّهَا الَّذِیْنَ اٰمَنُوا اتَّقُوا اللهَ وَ ذَرُوْا مَا بَقِیَ مِنَ الرِّبٰۤوا اِنْ كُنْتُمْ مُّؤْمِنِیْنَ فَاِنْ لَّمْ تَفْعَلُوْا فَاْذَنُوْا بِحَرْبٍ مِّنَ اللهِ وَ رَسُوْلِهٖ.
হে ঈমানদারগণ! তোমরা আল্লাহকে ভয় করো এবং সুদের যা কিছু অবশিষ্ট আছে তা পরিত্যাগ করো। যদি তোমরা মুমিন হও। যদি তা না কর তবে আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের পক্ষ থেকে যুদ্ধের সংবাদ জেনে নাও। -সূরা বাকারা (২) : ২৭৮-২৭৯
হাদীস শরীফে এসেছে, জাবের রা. বলেন,
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ آكِلَ الرِّبَا، وَمُؤْكِلَهُ، وَكَاتِبَهُ، وَشَاهِدَيْهِ، وَقَالَ: هُمْ سَوَاءٌ.
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ ভক্ষণকারী, সুদ প্রদানকারী, সুদের লেখক এবং সাক্ষীগণকে অভিসম্পাত করেছেন এবং বলেছেন, (গুনাহের ক্ষেত্রে) তারা সবাই বরাবর।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮
সুতরাং প্রশ্নোক্ত ক্ষেত্রে আপনার ঐ আত্মীয়ের বাবার সুদী ঋণ নেওয়া হারাম হয়েছে। এখন তার কর্তব্য হল, অবিলম্বে ব্যাংকের সকল ঋণ পরিশোধ করে দেওয়া এবং আল্লাহ তাআলার কাছে তাওবা-ইস্তেগফার করা।
আর ঐ বাড়ি তৈরিতে যেহেতু তার ছেলের টাকা আছে এবং সে বাবাকে সুদী লোন নিতে নিষেধও করেছে তাই সুদী লোনের গুনাহ ঐ ছেলের উপর বর্তাবে না এবং ঐ বাড়ি থেকে প্রাপ্ত অংশে বসবাস করা এবং এর আয় গ্রহণ করা তার জন্য জায়েয হবে।
সুদী ব্যাংকের বেতন শ্রমার্জিত হওয়ার যুক্তিতে বৈধ বলার সুযোগ আছে কি?
প্রশ্ন : আমি এবং আমার স্ত্রী উভয়ে গ্রামীণ ব্যাংকে চাকুরী করি। আমরা সবাই জানি যে, ব্যাংকিং লেনদেন সুদমুক্ত নয়। তো পরিশ্রমের বিনিময়ে আমাদেরকে বেতন দেওয়া হচ্ছে এবং অবসরের পর কয়েক লক্ষ টাকা পেনশন দেওয়া হবে। আমার প্রশ্ন হলো, পরিশ্রমের মাধ্যমে উক্ত বেতন এবং পেনশন-এর টাকা আমাদের জন্য হালাল হচ্ছে কি না?
উত্তর : প্রচলিত ধারার ব্যাংকগুলো সুদী নিয়মে পরিচালিত। তাই ব্যাংকের চাকুরীর বেতন হালাল নয়। কেননা ব্যাংকের চাকুরী সুদী কারবারে সরাসরি সহযোগিতা। শরীয়তে সুদের কঠোরতা ও নিষেধাজ্ঞা অনেক দৃঢ়। হাদীসে শুধু সুদ লেন-দেনকেই হারাম বলা হয়নি। বরং এর লেখক ও সাক্ষীগণের উপরও অভিসম্পাত করা হয়েছে। হযরত জাবের রাযি. থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন-
لَعَنَ رَسُولُ اللهِ صَلَى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَمَ آكِلَ الرِّبَا وَمُؤْكِلَهُ وَكَاتِبَهُ وَشَاهِدَيْهِ، وَقَالَ: هُمْ سَوَاءٌ.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুদ গ্রহণকারী, সুদদাতা, সুদী কারবারের লেখক এবং তার সাক্ষীদ্বয়ের উপর অভিসম্পাত করেছেন। এবং তিনি বলেছেন, তারা (সকলে) সমান। -সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮
উল্লেখ্য, শ্রমার্জিত টাকা হলেই তা হালাল হয়ে যায় না। বরং শ্রমার্জিত টাকা তখনই হালাল হবে যখন কাজটি বৈধ হবে। আর কাজ বৈধ না হলে উপার্জনও হালাল হবে না। এটি শরীয়তের স্বীকৃত কথা, যা বহু দলীল দ্বারা প্রমাণিত।
-সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৮; জামেউল বায়ান, তাবারী ৩/১০৩; ফাতহুল বারী ৪/৩৬৭
সুদী ব্যাংকে ডিপিএস করার হুকুম :
প্রশ্ন : বাংলাদেশ ব্যাংকে টাকা রেখে মাসে মাসে পেনশন আকারে উঠালে জায়েয হবে কি না?
উত্তর : আপনার প্রশ্নটি অস্পষ্ট। যদি ব্যাংকে টাকা রেখে তাদের থেকে প্রাপ্ত সুদ গ্রহণের কথা জিজ্ঞেস করে থাকেন তবে শরীয়তের দৃষ্টিতে এমনটি করার সুযোগ নেই। ইসলামে সুদ গ্রহণ ও প্রদান করা সুস্পষ্টভাবে হারাম ও মারাত্মক কবীরা গুনাহ।
ব্যাংকের চাকরি ও তার বেতন-ভাতা বৈধ না হওয়ার কারণ :
প্রশ্ন : আমি জানতে পারলাম যে, সুদী ব্যাংকে চাকরির উপার্জিত টাকা হারাম। ছেলে ব্যাংকে চাকরি করে। তাই তার উপার্জন দ্বারা মা-বাবা হজ্ব করতে পারবেন না। এখন আমার জানার বিষয় হলো, ব্যাংকে চাকরি করা এবং তা থেকে প্রাপ্ত বেতন-ভাতা মূলত কী কারণে বৈধ নয়?
উত্তর : ব্যাংকে চাকরি বাবদ প্রাপ্ত অর্থ হারাম হওয়ার কারণ হলো, ব্যাংকে চাকরির অর্থই হচ্ছে, সুদী কারবারে সহায়তা করা এবং সুদী লেনদেন, সুদী চুক্তি লেখা বা তা সম্পাদনের ক্ষেত্রে কোনো না কোনো পর্যায়ে সরাসরি অংশগ্রহণ করা। আর এগুলোর সবই হারাম। এছাড়া ব্যাংকের উপার্জনের মূল অংশই আসে সুদ থেকে। তাই তা থেকে প্রদত্ত পারিশ্রমিকও হারাম হবে।
-আলমুহীতুল বুরহানী ৮/৭৩; ফাতাওয়া তাতারখানিয়া ১৮/১৭৫, ১৫/১৩২; ফাতাওয়া হিন্দয়া ৪/৪১০; ফাতাওয়া খানিয়া ২/৩২৪
কোনো বৈধ কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে লোন নিলেও সেখানে চাকরি করা অবৈধ নয় :
প্রশ্ন : অনেকে বলে থাকেন, এখন তো সকল চাকরিতেই ঘুষ দিতে হয় এবং কোনো প্রতিষ্ঠান বা কারবারই সুদমুক্ত নয়। এ অবস্থায় একজন মুসলমানের জন্য সবধরনের প্রতিষ্ঠান এমনকি ব্যাংক-বীমারও চাকরি করা বৈধ হবে?
উত্তর : বর্তমানে দ্বীন ও নৈতিকতার অবক্ষয়ের কারণে সমাজে সুদ ও ঘুষের ব্যাপকতা ঘটেছে। তবে এর অর্থ এই নয় যে, সুদ-ঘুষ ছাড়া কোনো চাকরি বা অন্য কোনো হালাল উপায়ে জীবন নির্বাহ করা যায় না। আর হালাল পণ্য বিক্রি বা উৎপাদনকারী কোম্পানী বা প্রতিষ্ঠান ব্যাংক থেকে লোন নিলেও সেখানে চাকরি করা বৈধ। এক্ষেত্রে সুদী লোন গ্রহণ সম্পূর্ণ হারাম হলেও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানে চাকরি আর ব্যাংকের চাকরির হুকুম এক নয়। দুটির হুকুমের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। ব্যাংক-বীমা সুদী কোম্পানী এবং তাদের মূল কাজ সুদভিত্তিক। বিধায় সেখানে চাকরি করা নাজায়েয।
মোটকথা, সব চাকরিতেই সুদ-ঘুষ রয়েছে- ঢালাওভাবে এমন কথা বলে ব্যাংক-বীমা বা একেবারে হারাম চাকরিতে থাকার ওজর দাঁড় করানো যাবে না। একজন মুমিন হিসাবে হালাল রুজির সন্ধান চালিয়ে যেতে হবে। আল্লাহ তাআলা যখন হালাল রুজির নির্দেশ দিয়েছেন তখন এর সুযোগও থাকবে অবশ্যই।
আর চাকরি সংক্রান্ত মাসআলা জানতে হলে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেম থেকে জেনে নিতে হবে। তাহলে হালালভাবে চলা সহজ হবে ইনশাআল্লাহ।
[সূত্র : মাসিক আল-কাউসার]
হানাফী ফিকহ (Hanafi Fiqh)