13/07/2024
🔴 ইমাম হোসেন (আ.)-এর শেষ ভাষণ প্রসঙ্গে
কারবালার মাঠে একে একে যখন সবাই শাহাদাত বরণ করেছেন এবং হজরত ইমাম হোসেন যখন কেবল একা দাঁড়িয়ে ছিলেন তখন তাঁর শেষ কয়টি কথার কিছু অংশ অনুবাদ করলাম:
'কেন আমাকে হত্যা করতে চাও? আমি কি কোনো পাপ অথবা অপরাধ করেছি?' এজিদের সৈন্যবাহিনী বোবার মত দাঁড়িয়ে রইলো। পুনরায় ইমাম হোসেন বললেন, "আমাকে হত্যা করলে আল্লাহর কাছে কী জবাব দেবে? কী জবাব দেবে বিচার দিবসে মহানবীর কাছে?"
এজিদের সৈন্যবাহিনী পাথরের মত দাঁড়িয়ে আছে। আবার ইমাম হোসেন বলেন, 'হাল মিন নাসরিন ইয়ানসুরুনা?' 'আমাদের সাহায্য করার মত কি তোমাদের মধ্যে একজনও নেই?'
তারপরের আহ্হ্বানটি সাংঘাতিক মারাত্মক। ঐতিহাসিকদের মতে এটাই ইমাম হোসেনের শেষ আহ্বান।
'আলাম তাসমাও? আলাইসা ফিকুম মুসলিমু?'
'আমার কথা কি শুনতে পাও না? তোমাদের মাঝে কি মাত্র একটি মুসলমানও নেই?'
ইমাম হোসেনের এই শেষ ভাষণটি মাত্র একটি ছোট্ট বাক্য। অথচ এর ব্যাখ্যা যদি কাঁচ ভাঙার মত টুকরো টুকরো করে দেখাতে চাই তাহলে সেই বাক্যটি হবে খুবই বেদনাদায়ক। তাই বেশি কথা না বলে শেষ বাক্যটির সামান্য ব্যাখ্যা দিয়েই শেষ করতে চাই। খাজা বাবা যেমন বলেছেন, 'ইমাম হোসেন আসল এবং নকলের ভাগটি পরিষ্কার করে দেখিয়ে গেলেন', সে রকমই অর্থ বহন করছে ইমাম হোসেনের শেষ ভাষণটিতে। কারণ, এজিদের সৈন্যবাহিনীতে একজন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান অথবা অন্য কোনো ধর্মের কেউ ছিল না। সবাই ছিল মুসলমান। অথচ কী সাংঘাতিক এবং ভয়ঙ্কর ভাষণ- 'তোমাদের মাঝে কি একটি মুসলমানও নেই?' এজিদের সৈন্যবাহিনীর সবাই মুসলমান, এটা অধম লেখকের কথা নয় বরং যে কোন বিজ্ঞ আলেমকে প্রশ্ন করে দেখুন। অথচ ইমাম হোসেন এ কী তাক লাগানো কথা বলছেন, 'তোমাদের মাঝে কি মাত্র একটি মুসলমানও নেই?' না, একটিও সত্যিকার আসল মুসলমান ছিল না বলেই ইমাম হোসেন এই আহ্হ্বান জানিয়ে পৃথিবীকে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন। তিনি বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন যে, যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা সবাই নকল মুসলমান। বাজারের চালু আসল মালকে যেমন হুবহু নকল করে জনতাকে ধোঁকা দেয় সে রকম এরা নকল মুসলমান হয়ে সরল জনতাকে ধোঁকা দিয়ে যায় এবং এই ধোঁকার ফাঁদে অনেক বিজ্ঞাজনও মনের অজান্তে পা-খানা বাড়িয়ে দেন। বাজারে গিয়ে অনেক বিজ্ঞজনও নকল মাল কেনার ফাঁদে পড়ে যান, সে রকম অবস্থার শিকারও বলতে পারেন। আসল আর নকল চেনবার বিদ্যা রপ্ত করতে হয়, যদিও বিদ্যার প্রশ্নে তা সামান্য। যেমন বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সবচাইতে বড় অধ্যাপককে জায়গাজমি কেনার দলিল লিখতে বললে অক্ষমতা প্রকাশ করবেন, অথচ সেই দলিল লিখছে নবম কিংবা তার নিচের শ্রেণীতে পাঠ করা দলিল লেখক। তাই আসল আর নকলকে চিনতে হলে একটা বিশেষ জ্ঞানের প্রয়োজন হয় অনেক ক্ষেত্রে। তবে সবার জন্য অবশ্যই নয়।
এখন মূল বিষয়টির দিকে আমরা ফিরে আসছি। সেই মূল বিষয়টি হল, হজরত ওয়ায়েস করনি কিন্তু মহানবীকে কোন প্রকার সাহায্য সহযোগিতা করা তো দূরে থাক জীবনে একবার জাহেরি চোখে দেখার ভাগ্যও হয়নি। তাই তাঁকে সাহাবার খেতাব হতে বাদ দেওয়া হয়, অথচ কোন কারণ নেই, কোন যুক্তি নেই, কোন প্রশ্ন আর সংশয়ের দোলা নেই, কেবলমাত্র মহানবীর প্রতি ভালবাসার দরুন তিনি একে একে সব কটি দাঁত পাথরের আঘাতে ভেঙে ফেললেন। কেন ভাঙলেন? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা বৃথা। কারণ যুক্তির ব্যাখ্যা দেওয়া যায়, কিন্তু ভালোবাসা আর বিশ্বাসের ব্যাখ্যা দেওয়া যায় না এবং এর ব্যাখ্যা নেই। হজরত ওয়ায়েস করনির মনপ্রাণ জুড়ে মহানবীর প্রতি কতটুকু ভালবাসা থাকলে দাঁত ভেঙে রক্ত ঝরাতে পারেন। হয়তো যুক্তিতর্কের মানদন্ডে এই ভালবাসার মূল্যায়ন কতটুকু তা বলতে পারবো না তবে এটুকু অন্তত বলতে চাই যে, ভালবাসাকে ভালবাসা দিয়েই মাপতে হয়। অনেকে হয়তো বলতে চাইবেন যে, এ রকম দাঁত ভেঙে ফেলার ভালবাসার কী মূল্য থাকতে পারে? এর উত্তর দিতে চাই না এ জন্যই যে, এ রকম প্রশ্ন তোলার কিছু মানুষ না থাকলে ভালবাসার রূপটি একঘেয়েমিতে পরিণত হয়। বিচিত্রতার ঝাঁকুনি থাকে না। তাই মহানবী তাঁর নিজের জুব্বা মোবারক দিয়ে এই ভালবাসার মূল্যায়ন করেছেন। এখন আর একটি বিরাট প্রশ্ন তুলতে চাই যে, মহানবী যে ইমাম হোসেনকে কতটুকু ভালবাসতেন তার সামান্য নমুনা আগেই তুলে ধরেছি। তবু একটি কথা আবার মনে করিয়ে দিতে চাই যে, মহানবী বলেছেন যে, বেহেস্তের দুইজন সরদার হলেন হাসান এবং হোসায়েন এবং তিনি অন্য আর একটি হাদিসে বলেছেন যে, হোসায়েনকে যারা ভালবাসে তারা হোসায়েনের সঙ্গে থাকবে তথা বেহেস্তে থাকবে। এখন একটি প্রশ্ন আসতে পারে তা হল, ইমাম হোসেনের কারবালার মাঠে সবচেয়ে বেদনাদায়ক শাহাদাত বরণের শোকে ইমাম হোসেনের জন্য শোকের মাতম তুলে, বুক চাপড়িয়ে, ছোট ছোট চাকুর ছড়া দিয়ে পিঠে আঘাত করে 'হায় হোসেন', 'হায় হোসেন' বলে রক্ত ঝরায়, তাহলে ইমাম হোসেন এই ভালবাসার জন্য কি কিছুই দেবেন না? কারণ নিরেট ভালবাসা এবং এই ভালবাসার ব্যাখ্যা ও যুক্তি উভয়ই সম্পূর্ণরূপে বেকার। ইমাম হোসেনের ভালবাসায় কেউ মাতম না করলেও বলার কিছু থাকে না। কারণ এটা ব্যক্তিগত ব্যাপার। তা ছাড়া ভালবাসা তৈরি করা যায় না। আর যারা ইমাম হোসেনের ভালবাসায় মাতম করে, রক্ত ঝরায় তাদেরকেও বলার কিছুই থাকে না। কারণ, যুক্তি ও ব্যাখ্যার যেখানে কবর বা শেষ, ভালবাসা সেখান থেকেই আরম্ভ হয়। এটা হৃদয় দিয়ে বুঝতে হয় মাথা দিয়ে নয়। যুগে যুগে সব সময়ে এই মর্ত্যে একশ্রেণীর মানুষ বুঝে মাথা দিয়ে, আর একশ্রেণী বুঝে হৃদয় দিয়ে। কাউকেই তুচ্ছ করা যায় না। কারণ এই দ্বান্দ্বিক পদ্ধতিতেই সব কিছুর রহস্য লুকিয়ে আছে। কেউ বুঝে, কেউ বুঝে না। তাই কাউকেই দোষারোপ না করে এটা যার যার তকদিরের লিখন বললেই সুন্দর মানায়।
📚গ্রন্থ: আলে বায়েত এবং কারবালার করুণ দৃশ্য (পৃষ্ঠা: ১৫-১৭)
✍🏻চেরাগে জান শরিফ বিনয়ের সম্রাট ডা. কালান্দার বাবা জাহাঙ্গীর বা-ঈমান আল সুরেশ্বরী 🥀