06/05/2023
♦️প্রশ্ন: অসৎ ব্যক্তিগণ যখন মূর্তি ভেঙে ফেলে তখন ভগবান নিজের প্রভাব ও চমৎকারিত্ব কেন প্রদর্শন করেন না⁉⁉️
উত্তর : মূর্তির উপর যার কোন ভালবাসা নেই, যার মূর্তিপূজনকারী ব্যক্তিদের উপর হিংসাভাব থাকে, সেই হিংসাভার সহকারে যারা মূর্তি ভেঙ্গে ফেলে থাকে, তাদের জন্য ভগবান তাঁর প্রভাব এবং মহত্ব কেনই বা প্রকাশিত করবেন? ভগবানের মহত্ব শ্রদ্ধাভাবের ক্ষেত্রেই প্রকাশিত হয় । যারা মূর্তিপূজা করেন তাঁদের “মূর্তিতে ভগবান আছেন”, এই বিশ্বাস পূর্ণভাব না থাকার জন্যই অধার্মিক ব্যক্তি মূর্তি ভাঙ্গতে চায় এবং ভগবানও তাঁর প্রভাব তাদের কাছে প্রকাশিত করেন না। আবার যে সব তক “মূর্তিতে ভগবান আছেন” এ কথা দৃঢ়ভাবে শ্রদ্ধা-বিশ্বাস করেন, সেখানে ভগবান নিজ প্রভাব বিস্তার করেন। যেমন, গুজরাটে সুরাটের কাছে এক শিবের মন্দির আছে। তাতে যে শিবলিঙ্গ আছে, তাঁর গাত্রে অসংখ্য ছিদ্র। তার কারণ যখন মুসলমানেরা সেই শিবলিঙ্গটি ভাঙ্গতে এসেছিল তখন, সেই লিঙ্গ থেকে অসংখ্য বড় বড় ভ্রমর বেরিয়েছিল এবং দুর্বৃত্তদের তাড়িয়ে দিয়েছিল ।যে ব্যক্তি পরীক্ষায় পাস করতে চায়, সে-ই পরীক্ষককে সম্মান জানায়, তাঁর অধীনস্থ হয় ; কারণ পরীক্ষক যদি উত্তীর্ণ করান তবে সে উত্তীর্ণ হবে আর যাকে তিনি অযোগ্য মনে করেন সে অনুত্তীর্ণ থেকে যায়। কিন্তু ভগবানের কোন পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার দরকার নেই; কারণ তাতে তাঁর মহত্ব কিছু বাড়বে না। আবার উত্তীর্ণ না হলেও তাঁর মহত্ব কিছুমাত্র কমবে না। রাবণ যখন ভগবান রামের পরীক্ষা নেবার জন্য মায়াবী মারীচকে স্বর্ণমৃগ করে পাঠিয়েছিলেন এবং ভগবান রাম স্বর্ণমৃগের পিছনে দৌড়েছিলেন ; অর্থাৎ রাবণের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হয়েছিলেন, তাতে দুষ্ট রাবণের পরীক্ষাতে উত্তীর্ণ হয়ে ভগবানের কোন অভিজ্ঞান পত্রের প্রয়োজন ছিল কি? সেই ভাবেই অসৎ লোকেরা ভগবানের পরীক্ষা নেয়ার জন্য মন্দির ভাঙ্গেন এবং ভগবান তাদের পরীক্ষায় অনুত্তীর্ণ হন, তাঁদের সামনে নিজ প্রভাব প্রকাশিত করেন না; কারণ অসৎ লোকেরা এই অসৎ ভাব দ্বারা তাঁর সম্মুখীন হয়ে থাকে।একটিকে বস্তুগুণ এবং অপরটিকে ভাবগুণ বলা হয়। এই দুটি গুণ পৃথক পৃথক। যেমন স্ত্রী, মা এবং বোন এদের তিন জনের শরীর একই প্রকার ; অর্থাৎ স্ত্রীর শরীর যেমন, মায়েরও তেমন এবং বোনেরও সেই একই রকম ভাবে গঠিত। অতএব এই তিনেতেই বস্তুগুণ একই প্রকার। কিন্তু স্ত্রীর সঙ্গে এক ভাব, মায়ের সঙ্গে আরেক ভাব এবং বোনের সঙ্গে অন্যপ্রকার ভাব থাকে। সুতরাং বস্তুগুণ একপ্রকার হলেও ভাবগুণ পৃথক পৃথক । জগতে বিভিন্ন স্বভাবের ব্যক্তি, বস্তু ইত্যাদি আছে, অতএব তাদের বস্তুগুণ পৃথক পৃথক ভাবে থাকলেও যেহেতু সবার মধ্যেই ভগবান পূর্ণরূপে আছেন তাই ভাবগুণে সব এক। এইরূপে মূর্তিতে যার শ্রদ্ধা আছে তিনি, “মূর্তিতে ভগবান বিরাজ করেন, “এই ভাবগুণ সম্পন্ন হন । মূর্তিতে যাঁর শ্রদ্ধা নেই, তিনি, “মূর্তি পাথর, পিতল, রূপা ইত্যাদির তৈরি"-- এই বস্তুগুণ সম্পন্ন হন। এর বিশেষত্ব এই যে, পূজকের যদি মূর্তিতে ভগবদ্ভাব থাকে তাহলে তাঁর জন্য মূর্তি সাক্ষাৎ ভগবানই স্বয়ং। যদি পূজকের ভাব এই হয় যে, মূর্তি পিতলের, পাথরের বা রূপার তাহলে তার জন্য সেই মূর্তি কেবলমাত্র পাথর বা পিতল ইত্যাদির হয়েই প্রতিভাত হয়। কারণ ভগবান ভাবেই বিরাজিত-
“ন কাষ্ঠে বিদ্যতে দেবো ন শিলায়াং ন মৃত্যু চ । ভাবে হী বিদ্যতে দেবস্তস্মাদ্ ভাবং সমাচরেৎ ॥
(গরুড়ঃ উত্তরঃ ৩/১)
অনুবাদ:দেবতা কাঠেও থাকেন না বা পাথর এবং মাটিতেও না, ভাবেই দেবতার বাস, সেই জন্য ভাবকেই প্রধানরূপে মানা উচিত ।
এক বৈরাগী বাৰাজী ছিলেন। তাঁর কাছে দুটি স্বর্ণ নির্মিত মূর্তি ছিল। একটি গণেশের অপরটি ইঁদুরের। দুটিই সম ওজনের ছিল। বাবাজী রামেশ্বর যাওয়া স্থির করলেন। সেই জন্য তিনি এক স্বর্ণকারের কাছে গিয়ে বললেন, “ভাই। এই মূর্তি দুটির বদলে কত টাকা দেবে?” স্বর্ণকার সে দুটি ওজন করে দুটিরই পাঁচ পাঁচশত টাকা করে দাম ; অর্থাৎ দুটিই সমমূল্যের বলে জানালেন। বাবাজী বললেন, “আরে! তুমি দেখতে পাচ্ছ না, একজন প্রভু, অপর জন তাঁর সওয়ারী? যা দাম গণেশের সেই একই দাম ইঁদুরের? তা কেমন করে হয়?” স্বর্ণকার উত্তর দিলেন, “বাবা, আমি গণেশজী আর তাঁর ইঁদুরের দাম বলিনি, আমিতো সোনার দাম বলেছি।” এর বিশেষত্ব হল যে বাবার দৃষ্টি ছিল গণেশ এবং ইঁদুরের উপর আর স্বর্ণকারের দৃষ্টি ছিল সোনার উপর ; অর্থাৎ বাবাজী ভাবগুণ দেখছেন, আর স্বর্ণকার বস্তুগুণ বিচার করছেন। তেমনি যাঁরা মূর্তি ভাঙ্গে তারা বস্তুগুণ দেখে ; অর্থাৎ সেটি পাথরের না পিতলের তাই বিচার করে। ভগবানও তাদের ধারণা অনুযায়ী পাথর ইত্যাদি হয়েই থাকেন।বাস্তবে দেখতে গেলে স্থাবর-জঙ্গম ইত্যাদি সবকিছু ভগবৎস্বরূপই। যাঁর মধ্যে ভারগুণ অর্থাৎ ভগবানের ভাবনা আছে তিনি সব কিছুতে ভগবৎ স্বরূপ দেখতে পান। কিন্তু যাতে বক্তৃগুণ ; অর্থাৎ সংসারের ভাবনা-চিন্তা থাকে, তিনি স্থাবর-জঙ্গম ইত্যাদি সবকিছুকে পৃথক পৃথক ভাবে দেখেন । এই কথাই মূর্তির বিষয়েও বুঝে নিতে হবে।মানুষ শ্রদ্ধাভাব দ্বারা মূর্তির পূজা করে, স্তুতি ও প্রার্থনা করে। কারণ সে মূর্তির মধ্যে বিশেষ ভাব দেখতে পায়। যে ব্যক্তি মূর্তি ভাঙ্গে, সেও মূর্তির মধ্যে বিশেষরূপ অবলোকন করে। যদি বিশেষরূপ না দেখবে, তবে সে মূর্তিগুলো ভাঙ্গবেই বা কেন? অন্য পাথর ইত্যাদি ভাঙ্গে না কেন? সুতরাং সেই ব্যক্তিও মূর্তিতে বিশেষরূপ আছে বলেই মানে। শুধু মূর্তিতে যাঁরা শ্রদ্ধা ও বিশ্বাস রাখেন তাঁদের উপর ঈর্ষাবশতঃ, তাঁদের দুঃখ দেবার জন্য এরা মূর্তি ভাঙ্গে ।যে সব ব্যক্তি শাস্ত্র মর্যাদা অনুসারে নির্মিত মন্দির এবং প্রাণ প্রতিষ্ঠা করে স্থাপিত মূর্তিগুলো ভগ্ন করে তারা নিজেদের স্বার্থ-সিদ্ধি করার জন্য, হিন্দুদের মর্যাদা ভঙ্গ করার জন্য, নিজ অহঙ্কার ও নাম স্থায়ী করার জন্য এবং মূর্তিগুলোর ভগ্নাবশেষ দেখে হিন্দুদের পীড়িত হৃদয়কে দণ্ড করার জন্য হিংসাবশতঃ মূর্তিগুলো ভগ্ন করে, তারা ঘোর নরকে পতিত হয় ; কেন না তাদের নীতিই হচ্ছে অন্যকে দুঃখ দেয়া, অন্যকে নাশ করা। খারাপ উদ্দেশ্যের ফলও খারাপই হয়।