26/02/2024
জয়নুল আবেদিনের জন্ম ১৯১৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়াতে। বাবা তমিজউদ্দিন আহমেদ ছিলেন পুলিশের সাব ইন্সপেক্টর, আর মা জয়নবুন্নেসা গৃহিণী। তাদের পৈত্রিক বাড়ি ছিল ময়মনসিংহ শহরের পাশে কাঁচিঝুলি গ্রামে। বাবার চাকরির সুবাদে জয়নুল আবেদিনের ছোটবেলা কেটেছিল নানা প্রান্তে, নানা অঞ্চলে। কিশোরগঞ্জের কেন্দুয়াম, শেরপুর, নেত্রকোণাসহ নানা জায়গায়।
বাবা পুলিশের দারোগা, কতো টাকা আর বেতন! টানাটানির সংসার। মাসিক মাইনেতে ১১ জনের সংসার চালাতে যেন তমিজ উদ্দিন আহমেদ চোখে সর্ষে ফুল দেখেন।
কিন্তু ছেলে জয়নুলের খুব ছোটবেলা থেকেই ছবি আঁকতে ভীষণ পছন্দ। পাখির বাসা, পাখি, মাছ, গরু-ছাগল, ফুল-ফল এঁকে মাকে দেখাত সে। অবশ্য শৈশবে জয়নুল ছিলেন শান্ত, কম কথা বলা ছেলে। পাড়ার লোকেরা বলতো ঠান্ডার বাপ। ডাকনাম টুনু। জয়নুল বেশ মেধাবী, পড়তে বসলে অল্পক্ষণেই পড়া হয়ে যেতো, দারুণ মনোযোগী ছাত্র।
জয়নুলের প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার সূচনা হয় ১৯২২ সালে শেরপুরের রামবঙ্গিনী এম-ই স্কুলে। সেখানে চতুর্থ শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছিল জয়নুল। তারপর ময়মনসিংহ স্কুলে পঞ্চম শ্রেণিতে ভর্তি করা হলো তাকে। সেখানে পঞ্চম শ্রেণি থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়া। সেখান থেকে একবার বোম্বে ক্রনিক্যাল পত্রিকায় গলফ খেলা বিষয়ে ছবি আঁকার প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হয়েছিল। আবার তাও নির্দিষ্ট একজন খেলোয়াড় গলফবলে আঘাত করার জন্য ক্লাব উঁচু করেছে, এমন ছবি। জয়নুল খবরটা দেখেই কিছুক্ষণের মধ্যেই আঁকলেন। এরপর তার জায়গা হলো বিছানার তলায়। ওই ছবি পাঠাতে হলে তো ডাকের খরচ ছ আনা। শেষমেশ ছ আনা জোগাড় করে পাঠালো জয়নুল সেই ছবি। কদিন পর খবর এলো জয়নুলের ছবিই প্রথম হয়ে নির্বাচিত হয়েছে। সেবার আলোড়ন পড়ে গিয়েছিলো গোটা এলাকায়। খবর পৌঁছে গিয়েছিল তাদের স্কুলের প্রধানশিক্ষকের কাছে।
কিন্তু আর্ট কলেজের স্বপ্নে কিছুতেই মন বসে না জয়নুলের। ওখানেই পড়া চাই। এর মধ্যে ধর্মতলায় চড় খাওয়ার ঘটনা বেমালুম গেল ভুলে। কোনো কিছুই দমাতে পারলো না তাকে। বাবার প্রথমে কঠোর রাগ, বিধি নিষেধ, মায়ের সাংসারিক অবস্থার বর্ণনা, মায়ের প্রবোধ কিছুই হলো না। বাবা বলেছিল, আমার নয় সন্তানের মধ্যে বড় সন্তান তুমি। তুমি যদি গোল্লায় যাও আর বাকিগুলোও গোল্লায় যাবে। অন্যদিকে সবচেয়ে বড় বিষয় টানাটানির সংসারে আর্ট কলেজে পড়াটাই তো বিলাসিতা। কারণ আর্ট কলেজে তখন পড়তো উচ্চবিত্ত নয়তো উচ্চ মধ্যবিত্ত পরিবারের সন্তানেরা। আর্ট কলেজে পড়ারও বেশ খরচ, আবার এতো দূরে কলকাতায় যাওয়া। কই ময়মনসিংহ আর কোথায় কলকাতা। কিন্তু জয়নুলের জেদ সে আর্ট স্কুলেই পড়বে। শেষমেশ ছেলের জেদ দেখে নিজের গলার হার বিক্রি করলেন জয়নাবুন্নেছা। অতঃপর সেই হার বিক্রির টাকা ছেলের হাতে তুলে দিলেন, সঙ্গে বাঁশের খোড়লে জমানো কিছু খুচরা পয়সা। গন্তব্য এবার কলকাতা।
সেই টাকা নিয়ে কলকাতার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিলো জয়নুল। প্রথমে ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনে নারায়ণগঞ্জ। সেখান থেকে স্টিমারে গোয়ালন্দ ঘাট, গোয়ালন্দ থেকে ট্রেনে চেপে শিয়ালদহ স্টেশন।
কলকাতায় জয়নুল এলো বটে রাত্রি নামতেই ঘোর দুশ্চিন্তা। থাকবে কোথায়? পরদিন ভর্তি হবে ঠিক কিন্তু আজকের রাতটা তো থাকতে হবে। শেষমেশ আশ্রয় জুটলো ওয়েলেসলি স্কয়ারে পার্কের বেঞ্চিতে। সেখানেই শতরঞ্জি বিছিয়ে রাত্রিযাপন। পরদিন সোজা আর্ট স্কুল। ভর্তি পরীক্ষায় দারুণ ফলাফলের পর ভর্তি হলো জয়নুল অবশেষে। এ যে সাত সমুদ্র তেরো নদী জয়ের মতো।
বহু পরে এক সাক্ষাৎকারে জয়নুল বলেছিলেন সে কথা, ‘পার্কে থাকতে হতো। কিন্তু সবচেয়ে কষ্টকর ছিল পার্কে ভোর হওয়ার পর শতরঞ্জি বাঁধা তোশকটা বগলে নিয়ে কোথায় রাখব কোথায় রাখব করে নিত্যনতুন জায়গার সন্ধান।’ কিন্তু এরই মধ্যে জয়নুল আবিষ্কার করে ফেললেন দারুণ এক বুদ্ধি। এক-একটি করে মসজিদের বারান্দায় কয়েকটি করে রাত অনায়াসে কাটিয়ে দেওয়া যায়। এভাবেই চলতে লাগলো। কিন্তু আর্থিক সংকট। তখন আর্ট স্কুল থেকে বৃত্তি দেয়া হতো। আর্ট স্কুল থেকে প্রথম বর্ষের ফলাফলের উপর বৃত্তি দেয়া হতো। কিন্তু এক বছর যে অপেক্ষা করবে জয়নুল সেই সংগতি ছিল না তার। অন্যদিকে ভর্তি পরীক্ষার ফলাফলে দারুণ ফল। মুকুল দে তখন আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ। মুকুল দে বিশেষ বিবেচনায় নিয়ম ভেঙে অনুমোদন দিয়েছিলেন। তাই ময়মনসিংহ জেলা বোর্ড থেকে মিলেছিল ১৫ টাকার মাসিক বৃত্তি। সে সময় জয়নুল থাকতেন ৩১ ওয়েলেসলি স্ট্রিটের একটি মেসে। তখন কিছু কমার্শিয়াল কাজও করতেন তিনি। তাই দিয়ে প্রতি মাসে কিছু টাকা সংসারের খরচের জন্য পাঠাতেন তিনি। একসময় স্নাতক শেষ হলো আর্ট কলেজে। আর্ট কলেজে চিত্রকলা ও চিত্রকর্ম বিভাগে প্রথম বিভাগে প্রথম স্থান অধিকার করলেন জয়নুল আবেদিন।
এরপর কয়েকবছর টানা কাজ করেছিলেন জয়নুল। তেতাল্লিশে বাংলার দুর্ভিক্ষ জয়নুল আবেদিনকে একেবারে বদলে দিলো। গ্রাম-বাংলার রোমান্টিক নিসর্গ শিল্পীকে রূপান্তরিত করে ফেলে এক দুর্দান্ত বিদ্রোহী ব্যক্তিত্বে। তারপর থেকে সারাটি জীবনই বিক্ষুব্ধ থেকে গেছেন তিনি। দুর্ভিক্ষ শুরু হওয়ার পরপরই জয়নুল তাদের ময়মনসিংহের বাড়িতে ফিরে গিয়েছিলেন। সেখানেও দুর্ভিক্ষের যে মর্মান্তিক দৃশ্য তা সহ্য হলো না তার, আবার কলকাতায় ফিরে এলেন তিনি। কিন্তু দুর্ভিক্ষপীড়িত দুস্থ মানবতা যেন সে যাত্রায় তার সঙ্গী হয়ে আসে। সেই আবেগই তাকে তাড়িত করে, বাধ্য করে অমানবিক পরিস্থিতির এক মানবিক নির্মাণে। রাতদিন শুধু কলকাতার দুর্ভিক্ষের সেসব নারকীয় দৃশ্যাবলির স্কেচ করতে শুরু করলেন। জয়নুল তখন আর্ট স্কুলের একজন শিক্ষক, আয় খুবই স্বল্প। দুর্ভিক্ষের বাজারে উন্নতমানের শিল্পসামগ্রী তখন যেমন ছিল দুর্লভ, তেমনি দুর্মূল্য। সে কারণে তিনি বেছে নিলেন শুধু কালো কালি আর তুলি। শুকনো তুলিতে কালো চীনা কালির টানে স্কেচ করতে থাকেন অতি সাধারণ সস্তা কাগজের ওপর, ব্যবহার করতেন কার্টিজ পেপার। কখনোবা প্যাকেজিং কাগজ। সাধারণ স্বল্পমূল্যের এসব অঙ্কন সামগ্রী ব্যবহার করে তিনি যে শিল্প সৃষ্টি করলেন তাই পরিণত হলো অমূল্য সম্পদে।
ভবিষ্যতের মানুষ যদি ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের বাংলাকে খানিকটা অনুভবে বুঝতে চায় তাহলে তাকে বিস্তর নথিপত্র ঘাঁটা ছাড়াও দুটি শিল্পবস্তুর নিশ্চয় সন্ধান নিতে হবে – বিজন ভট্টাচার্যের নাটক এবং আবেদিনের ছবি।
কত গভীরভাবে এদের নাটক এবং ছবি ১৯৪৩ সালের বিপর্যয়কে লেখায় এবং রেখায় ফুটিয়ে তুলেছিল ওই দুজন শিল্পীর কথাতেই তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বিজন ভট্টাচার্যের নাটক দেখতে দেখতে জয়নুল আবেদিন বলেছিলেন, ‘তুলি এবং ব্রাশ ছুড়ে ফেলে দিতে ইচ্ছে হয়।’ আর জয়নুলের ছবি দেখে বিজন ভট্টাচার্য বলেছিলেন, ‘থাকত ওইরকম ব্রাশ আর তুলি!’ শিল্পী জয়নুল আবেদিনকে এমনি ধারা অজস্র অভিজ্ঞতা নিয়ে এবং শহর ও গ্রামের সাধারণ জীবনধারার মধ্যে থেকে আর্টের সাধনা করতে হয়েছে।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর ঢাকায় চলে এলেন জয়নুল আবেদিন। ঢাকায় এসে ধরন পাল্টালেন তিনি। নিজেকে নতুন করে সাজালেন। পঞ্চাশের দশকে লোকশিল্পের মোটিফ নিয়ে ছবি আঁকা শুরু করলেন। পাশাপাশি পূর্ববাংলার মানুষ, পশুপাখি, প্রকৃতি নিয়ে তেলরঙ, জলরঙ এবং টেম্পেরায় নিজস্ব একটি ধরন গঠন করে কাজ করতে লাগলেন। লোকশিল্পের প্রভাবে তার আকার দিক এবং বাস্তবধর্মী অন্য ধরনটিতে ভিন্নতা থাকলে একই শিল্পীর আঁকা ব্যাপারটি ঠিকই প্রতিষ্ঠিত ছিল। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি দুই ঢংকে একই সময়ে পাশাপাশি এঁকে গেছেন। এটি বিরল ঘটনা। একই ছবি রস সৃষ্টি এবং ধরন দুটিকে প্রতিষ্ঠিতই করে পছন্দনীয় করে একই রকম খ্যাতিপ্রাপ্তি সবার পক্ষে সম্ভব নয়। এক্ষেত্রে তিনি একক এবং অনন্য।
জয়নুল আবেদিন লোকশিল্পের আদলে ছবি আঁকতে গিয়ে লোকজ মোটিফগুলোকে হুবহু ব্যবহার করেননি। রঙের ব্যাপারেও লোকজ ছবির কাঁচা রঙকে পরিহার করেছেন। সেই সঙ্গে টোনাল তারতম্যও ব্যবহার করেছেন প্রয়োজনে। তিনি অনুকরণকে প্রশ্রয় দেননি বরং ফর্মগুলোকে সহজ করে এক ধরনের আধুনিক রূপ এনেছিলেন। আবার বিষয় বাছাইয়ে পূর্ব বাংলার বৈশিষ্ট্য যেন থাকে এমনসব পরিচিত দিককে গ্রহণ করেছিলেন জয়নুল। যেমন দেখা যায় তার নিজের আঁকা গুণটানা, প্রসাধন, পাইন্যার মা, চারটি মুখ, দুই মহিলা তার প্রিয় চিত্রকর্ম ছিল। পাশাপাশি একই সময়ে জয়নিল কালি ও তুলি আর খাগের কলমে এঁকেছেন ভিন্নধর্মী চরিত্র। এই আঙ্গিকটি জয়নুলের ভীষণ প্রিয় ছিল।
এমন ছবির মধ্যে আমারা দেখি সাঁওতাল দম্পতি, সাঁওতাল রমণীদ্বয়, মই দেওয়া, সংগ্রাম, বিদ্রোহী, কিংবা কাদায় পড়া কাঠবোঝাই গরুর গাড়ি ঠেলার মতো চিত্রকর্ম।
জয়নুলের বেশকিছু স্কেচ ধর্মী ছবি আছে। এগুলো মূলত ভ্রমণের কারণে। পঞ্চাশের দশকে তিনি প্রচুর ভ্রমণ করেছেন, দেশবিদেশ ঘুরেছেন। ওই সময়েই আঁকা। তবু তিনি আক্ষেপ করে বলতেন, "দেশ বিদেশে ঘোরা আর হরেকরকম অন্যান্য কাজ করতে গিয়া সময় ন্যস্ত হইছে অনেক। পুরোদমে ছবি নিয়া থাকা হইলো না।"
আসলে কখনোই পুরোদমে ছবি আঁকার সুযোগ পাননি জয়নুল আবেদিন। তার কারণ তাকে চিত্রকর্মের বাইরেও বহু কিছু করতে হয়েছে। ঢাকা আর্ট কলেজ (যা এখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইন্সটিটিউট), সোনারগাঁয়ে লোক ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন (যা এখন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘর) গড়েছিলেন তিনি। একাধারে আবার শিক্ষকতা, দেশের বাইরে বাংলার চিত্রকর্ম উপস্থাপন।
তিনি কি যে পরিশ্রম আর শ্রম তিনি দিয়েছেন তা অবর্ণনীয়। বলতেন, 'নদীর ছবি আঁকার আগে পানির দোলনই আগে বুঝতে হবে।’ ‘এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোন ছবি হয় না।” বলতেন তিনি।
একবার কর্ণফুলী পেপার মিল কর্তৃপক্ষ জয়নুল আবেদিনকে তাদের নতুন কাগজ কার্টিজ কাগজের বড় একটি রোল পাঠালো। জয়নুল আবেদিন পেয়েই পুরো কাগজজুড়ে কালো রঙের ওয়াশে ড্রয়িং প্রধান ছবি এঁকে ফেললেন নবান্ন উৎসবকে কেন্দ্র করে। আবহমান বাংলার নবান্ন উৎসব। সেই স্ক্রল থেকেই তার "মনপুরা" ছবি আঁকা।
সত্তরের ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের পর ত্রাণকর্মীদের সঙ্গে সরাসরি উপস্থিত ছিলেন জয়নুল আবেদিন। উপকূলীয় এলাকার মানুষের দুঃখ দুর্দশা, ধ্বংসলীলা দেখে প্রচণ্ড মর্মাহত হয়েছিলেন জয়নুল। ঠিক করেছিলেন সেসব নিয়ে ছবি আঁকবেন। বিস্তৃত এলাকা জোড়া উপকূলের মানুষের দুর্গতিকে ছোট পরিসরে আঁকলে সম্পূর্ণতা পাবে না ভেবে তিনি আবার স্ক্রল আঁকার চিন্তা করেছিলেন। এবং তা অবিশ্বাস্য দ্রুততায় এঁকেও ছিলেন।
জয়নুল জলরঙয়ে কাজ করতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করতেন। "ডেভিড ককস" তার অত্যন্ত প্রিয় কাগজ ছিল। হাল্কা বিস্কুট বাদামি রঙের এই কাগজটিতে নামীদামী ব্রিটিশ শিল্পীরা জলরঙয়ে কাজ করতে পছন্দ করতেন। বাংলাদেশের প্রখর সূর্যলোককে জয়নুল আবেদিন ব্যবহার করতে গিয়ে সেই কাগজের হালকা বাদামী টিন্টকে এমন দক্ষতায় কোন রঙ না লাগিয়েই তিনি ছেড়ে যেতেন যে তাতে ভিন্ন মাত্রার সৃষ্টি হতো।
একবার সাংবাদিক মাহফুজ উল্লাহ তাকে এক সাক্ষাৎকারে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘আপনি দুর্ভিক্ষের উপর ছবি আঁকলেন অথচ বন্যার ছবি আঁকলেন না কেন?’
জয়নুল উত্তরে বলেছিলেন, ‘বন্যা প্রকৃতির। তাই এর বিরুদ্ধে করবার কিছুই নেই। দুর্ভিক্ষ মানুষের সৃষ্টি। মানবতার অপমান আমাকে ব্যথিত করেছিল। তাই দুর্ভিক্ষের ছবি এঁকেছি,’ শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন উত্তর দিলেন।
মুক্তিযুদ্ধ জয়নুলকে প্রচণ্ড আলোড়িত করেছিল। দেশ স্বাধীনের পর লেগে গেলেন শিল্পচর্চা সংগঠনের কাজে। এবারে লোকশিল্প পূর্ণ মনোযোগ তার। স্বপ্ন দেখতেন লোক ও কারুশিল্প জাদুঘরের। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরেই বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের সরকার জয়নুল আবেদিনকে দায়িত্ব দিলেন বাংলাদেশের সংবিধানের অঙ্গসজ্জার জন্যে। তিনিও বিনা বাক্যে রাজি। তাকে সাহায্য সহযোগিতা করেন আরও কয়েকজন শিল্পী।
পাকিস্তান আমলে শিল্পাচার্য জয়নুল শিল্পী মুস্তাফা মনোয়ারকে বলেছিলেন, ‘মনোয়ার, দুর্ভিক্ষ হলে সে ছবি আঁকা যায়, নিরন্ন মানুষের হাহাকার ছবিতে দেখানো যায়। কিন্তু পাকিস্তানি শোষণের সময় মনের দুর্ভিক্ষ চলছে—এটা তো কোনো ছবিতে আঁকা যায় না।’
এক স্মৃতিচারণে জয়নুল আবেদিন লিখেছিলেন, যদি কেউ আমাকে জিজ্ঞেস করে আমি ছবি আঁকা শিখলাম কী করে? বা কার কাছ থেকে? তবে উত্তর দিতে পারবো না। বলবো আমার দেশের প্রকৃতি আর পরিবেশ আমাকে ছবি আঁকার অনুপ্রেরণা দিয়েছে। এদেশের আকাশ, বাতাস, নদী, মাঠ, বন, এখানকার মানুষের চলাফেরা, ওঠা-বসা, হাসি কান্না আমাকে ছবি আঁকতে বলে।
যদি বলা হয় বাংলাদেশের চিত্রকলা কিংবা পূর্ববঙ্গের চিত্রকলার জনক কে তবে নিঃসন্দেহে প্রথম উত্তরই হবে জয়নুল আবেদিন। একজন শিল্পী কতোটা প্রভাব বিস্তার করলে এমনটি বর্ণনা সম্ভব। দেশীয় চিত্রকলা, এদেশের মাটি, মানুষ, হাওয়া, আকাশ, সমস্ত কিছু ফুটে এসেছিলো তার চিত্রকর্মে। এদেশের চিত্রকলাকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেয়ার জনক তিনি। তাইতো তিনি শিল্পাচার্য। কেবল পূর্ববঙ্গই নয়, উপমহাদেশের চিত্রকলার ইতিহাস বলতে গেলে অবলীলায় স্থান পাবে তার নাম। তাকে ছাড়া চিত্রকলা অসম্পূর্ণ। তাইতো শিল্পাচার্য বাংলার বুকে একজনই। তিনি শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন।
তিনি কোন মাপের শিল্পী ছিলেন তা বলা কঠিন। তবু একটি ঘটনার কথা বলি। মৃত্যুর দুদিন আগে মুস্তাফা মনোয়ার হাসপাতালে শিল্পাচার্যকে রং-তুলি এগিয়ে দিতেই তিনি কাগজের গায়ে কালো রঙে, কাঁপা হাতে একটি ছেলে আর একটি মেয়ের মুখ এঁকেছিলেন, সেই ছবিটির শিরোনাম ‘টু ফেসেস’। শিল্পাচার্য মুখ দুটি এঁকে সেদিন যেন আগামী দিনকে জানিয়ে দিলেন, এসব নতুন মুখই গড়ে তুলবে নতুন বাংলাদেশ।
শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদীন এর নামেই ময়মনসিংহ পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের জয়নুল আবেদীন ছাত্রাবাস নামকরণ করা হয়।
১৯৭৬ সালের আজকের দিনে আমরা হারিয়েছিলাম এই অবিস্মরণীয় কিংবদন্তিকে। আজ উপমহাদেশের কিংবদন্তি চিত্রশিল্পী, শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের প্রয়াণ দিবস। প্রয়াণ দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই বাংলার মাটি ও মানুষের এই অসামান্য স্রষ্টার প্রতি।