19/08/2023
১৯৯৫ সাল। 'দেহঘড়ি' শিরোনামে একটি অডিও এ্যালবাম বাজারে আসে।
একটি অডিও ক্যাসেটে সাধারণ ১২টি ট্র্যাক থাকত; মানে ১২টি ভিন্ন-ভিন্ন গান থাকত ।কিন্ত 'দেহঘড়ি' এমন একটি এ্যালবাম, যেখানে এপিঠ-ওপিঠ মিলিয়ে ১২টি ট্র্যাকই ছিল 'মন আমার দেহঘড়ি' শিরোনামের একটিই গান! যা ছিল বাংলা গানের ইতিহাসে প্রথম রক-লোকগীতি ফিউশন। গানটি দারুণভাবে জনপ্রিয় হয়েছিল, এক গানে 'দেহঘড়ি' হয়েছিল সুপার হিট।
অডিও এ্যালবাম রিলিজ হলে শুধুমাত্র প্রথম দিনই ৩০,০০০ (তিরিশ হাজার) কপি ক্যাসেট বিক্রি হয়। যা বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রথম দৃষ্টান্ত।
গায়ের রং কালো। মেদহীন লম্বা শরীর। মাথাভরা বাবরি চুল। হাতে ‘বওয়া’ নিয়ে মঞ্চে উঠে যখন দরাজ গলায় গেয়ে উঠতেন ‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিসতিরি বানাইয়াছেন...’ তখন মঞ্চের সামনে বসা অগণিত শ্রোতা-দর্শক বিমোহিত হয়ে পড়তেন সেই সুরে।
তাঁর গায়কি ছিল অসাধারণ। বাংলার মটিঘেঁষা সুর অনন্য হয়ে উঠত তাঁর কণ্ঠে। পল্লিগীতি, মুর্শিদি, ভাওয়াইয়া, দেহতত্ত্ব, লালন-হাসনের গানসহ বৈভবময় লোকসংগীতে প্রায় সব ধরনের গানেই ছিল তাঁর সহজাত পারঙ্গমতা। তবে তাঁর একেবারে নিজের ক্ষেত্র ছিল জারিগান। এ ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন তিনি। বলা যায় লোকসংগীতের এই বিশেষ ধারাটি তাঁর পরিচর্যাতেই প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে নগরীর শ্রোতার কাছে উঠে এসেছিল।
তবে তাঁর এই শিল্পী হয়ে ওঠা অতটা সহজ ছিল না। দেশ স্বাধীনের পর হাইকোর্টে প্রতি বৃহস্পতিবার কাওয়ালী গানের আসর বসত। সেই আসরে রহমান বয়াতীর জন্য ১০ মিনিট সময় রাখা হতো বাংলা গান গাওয়ার জন্য এবং তিনি দুটো গান গাইতেন।
বাংলাদেশ টেলিভিশনের একজন অনুষ্ঠান প্রযোজক তাঁর গান শুনে তাঁকে টেলিভিশনে গান গাওয়ার অনুরোধ জানান এবং তিনি অডিশনে অংশ নেন। যখন জানতে পারেন রহমান বয়াতী আদি ঢাকার মানুষ তখন অডিশন কর্তারা জানিয়ে দেন তাঁকে দিয়ে গান হবে না। কারণ, পুরনো ঢাকার মানুষজন শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন না। আর যারা শুদ্ধ ভাষায় কথা বলতে পারেন না, তাঁদেরকে দিয়ে গান হয় না!
দ্বিতীয়বার অডিশনে একই মন্তব্য করায় তৃতীয়বার তিনি নিজের বাড়ি নবাবগঞ্জ বললে অডিশনে পাশ হন এবং পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বেতারের বিশেষ গ্রেডের শিল্পী ছিলেন।
হ্যাঁ, বলছি আবদুর রহমান বয়াতীর কথা।
তিনি একাধারে গীতিকার, সুরকার, সঙ্গীত পরিচালক এবং প্রসিদ্ধ লোকসঙ্গীত শিল্পী।
রহমান বয়াতীর জন্ম ১৯৩৬ সালের ১ জানুয়ারি, ঢাকার দয়াগঞ্জে। দুই ভাই ও এক বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন ছোট। বাড়িতে গান-বাজনার চর্চা ছিল না। তবে তাঁর গানের গলা ছিল চমৎকার। শৈশব থেকেই তিনি মেতেছিলেন লোকগানের সুরে। পরে গান শিখেছেন বিক্রমপুরের বিখ্যাত লোকসংগীতশিল্পী আলাউদ্দিন বয়াতীর কাছে। মঞ্চ, টেলিভিশন, চলচ্চিত্র, সরকারি বিভিন্ন তথ্যচিত্র ও বিজ্ঞাপনের অসংখ্য গানে কণ্ঠ দিয়েছেন তিনি।
তিনি ১৯৮২ সালে ‘আবদুর রহমান বয়াতী’ নামে বাউল দল গড়ে তোলেন। বাজাতেন দোতারা, হারমোনিয়াম, খঞ্জনি ও ভায়োলিন।
বাংলাদেশ ছাড়াও ভারত, নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, অস্ট্রিয়া, কানাডা, চীন, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের ৪২টি দেশে বাউল গান পরিবেশন করেছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট জর্জ এইচ. ডব্লিউ. বুশের আমন্ত্রণে হোয়াইট হাউসে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি গান গেয়েছিলেন।
আবদুর রহমান বয়াতির অডিও ক্যাসেট প্রকাশিত হয়েছে পাঁচ শতাধিক। এর মধ্যে জারিগানের ক্যাসেট তিন শতাধিক। প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে এসব গান সংগ্রহ করে গেয়েছেন তিনি। পাশাপাশি তিনটি মিক্স অ্যালবামে গান গেয়েছেন তিনি। তাঁর উল্লেখযোগ্য গানের মধ্যে রয়েছে-
‘মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে...'
‘আমি ভুলি ভুলি মনে করি প্রাণে ধৈর্য্য মানে না’
‘আমার মাটির ঘরে ইঁদুর ঢুকেছে...’
‘মরণেরই কথা কেন স্মরণ কর না...’
‘মা আমেনার কোলে ফুটল ফুল...’
‘ছেড়ে দে নৌকা মাঝি যাবো মদিনা...’
এছাড়া 'খোদা বান্দা' শিরোনামে একটি উর্দু কাওয়ালী গান লিখেছেন, সুর করেছেন এবং গেয়েছেন।
তিনি ১৯৮৯ সালে হাফিজুদ্দিন পরিচালিত ‘অসতী’ নামে একটি চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন।
শিল্পকলায় বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০১৫ সালে মরণোত্তর একুশে পদক লাভ করেছেন।
১৯ আগস্ট ২০১৩ সালে রাজধানীর ধানমন্ডির সাতমসজিদ রোডের জাপান-বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
আজ ১৯ আগষ্ট বাংলার বাউল সাধক কিংবদন্তি বাউল শিল্পী আব্দুর রহমান বয়াতির মৃত্যু বার্ষিকী।
গুণী এই শিল্পীর প্রয়াণ দিবসে GAANBAZ পরিবারের পক্ষ থেকে বিনম্র শ্রদ্ধা।
ওপারে ভালো থাকবেন প্রিয় মানুষ, গানের মানুষ।