Alor Kafela

Alor Kafela Official page of Online Newspaper www.alorkafela.com

16/02/2022

اللّٰهُمَّ إِلَيْكَ أَشْكُو ضَعْفَ قُوَّتِى، وَقِلَّةَ حِيلَتِى وهَوَانى عَلَى النَّاس يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ، أَنْتَ رَبُّ المُسْتَضْعَفِينَ، وأَنْتَ رَبَّى إلَى مَنْ تَكِلَنِى إِلَى بَعِيدٍ يَتَجَهَّمُنِى؟ أوْ إلى عَدوٍّ مَلَّكْتَهُ أَمْرِى، إنْ لَمْ يَكُنْ بِكَ غَضَبٌ عَلَىَّ فَلاَ أُبَالِى، غَيْرَ أَنَّ عَافِيتَكَ هِى أَوْسَعُ لى، أَعُوذُ بِنُورِ وَجْهِكَ الَّذِى أَشْرَقَتْ لَهُ الظُّلُمَاتُ، وَصَلُحَ عَلَيْهِ أَمْرُ الدُّنيا وَالآخِرَةِ أَنْ يَحِلَّ عَلَىَّ غَضَبُكَ أوْ أَنْ يَنْزِلَ بى سَخَطُك، لك العُتبى حَتَّى تَرْضَى وَلاَ حَوْلَ وَلاَ قُوَّةَ إِلا بِكَ
‘‘হে আল্লাহ! আমি তোমার কাছে স্বীয় দুর্বলতা, (মানুষকে বুঝাতে) আমার কলা-কৌশলের স্বল্পতা এবং মানুষের কাছে আমার মূল্যহীনতার অভিযোগ করছি। হে সর্বাধিক দয়ালু! তুমি দুর্বলদের প্রভু, আমারও প্রভু। তুমি আমাকে কার কাছে ন্যস্ত করছ? তুমি কি আমাকে দূরের এমন অচেনা কারও হাতে ন্যস্ত করছ, যে আমার সাথে কঠোর ব্যবহার করবে? নাকি কোন শত্রুর হাতে সোপর্দ করছ, যাকে তুমি আমার বিষয়ের মালিক করে দিয়েছ? তুমি যদি আমার উপর রসূান্বিত না হও তাহলে আমি কোন কিছুই পরওয়া করিনা। তবে নিঃসন্দেহে তোমার ক্ষমা আমার জন্য সর্বাধিক প্রশস্ত ও প্রসারিত। আমি তোমার সেই চেহারার আলোর আশ্রয় চাই, যা দ্বারা অন্ধকার দূরিভূত হয়ে যায় এবং যা দ্বারা দুনিয়া ও আখিরাতের সকল বিষয় সংশোধন হয়। এই কথার মাধ্যমে আমার উপর তেমার ক্রোধা নেমে আসা হতে অথবা আমার উপর তোমার অসন্তুষ্টি নাযিল হওয়া থেকে তোমার আশ্রয় চাই। তোমার সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যেই আমার সকল প্রচেষ্টা। তোমার সাহায্য ব্যতীত অন্যায় কাজ থেকে বেঁচে থাকা সম্ভব নয় এবং তোমার তাওফীক ও শক্তি ছাড়া তোমার আনুগত্য করা অসম্ভব’’।

সিসিলি জয় ও পরাজয়: ইতালিতে মুসলমানদের তিন শতকমুহাম্মাদ শাবান আইয়ুবরুপান্তর : মাহদি হাসানসিসিলি। ভূমধ্যসাগরের বুকে জেগে উ...
18/06/2020

সিসিলি জয় ও পরাজয়: ইতালিতে মুসলমানদের তিন শতক

মুহাম্মাদ শাবান আইয়ুব

রুপান্তর : মাহদি হাসান

সিসিলি। ভূমধ্যসাগরের বুকে জেগে উঠা এক চিত্তাকর্ষক দ্বীপ। ইতিহাসের কোনো এক অধ্যায়ে দ্বীপটি ছিল ইসলামি মানচিত্রের অংশ। তখন চলছিল ছোট্ট দ্বীপ রাষ্ট্রটির মধ্যযুগ। এই দ্বীপটি থেকেই মুসলিমরা আস্তে আস্তে করে উপনীত হন দক্ষিণ ইতালির প্রান্তে। পৌঁছে যান পোপ শাসিত ক্যাথলিক খৃস্টান সাম্রাজ্যের রাজধানী রোমের কাছাকাছি। ইসলামের আবির্ভাবের পর প্রথমবারের মতো মুখোমুখি হয় এই দুই পক্ষ।

সিসিলিতে ইসলামি শক্তির এই অস্তিত্বের সূচনা এবং সমাপ্তি উভয়টিই ছিল রোমাঞ্চকর এবং বিস্ময় জাগানিয়া এক উপাখ্যান। দুই শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে সেখানে ছিল মুসলিমদের পদচারণা। এই সময়ে সেখানে শুধু জনবসতি নয়, বরং গড়ে উঠেছিল গোটা এক সভ্যতা। তৈরী হয়েছিল উত্তরাধিকারের এক সিলসিলা। প্রস্থানের হাজার বছর পর আজও তাই সিসিলির বাতাসে নাক ডুবালেই পাওয়া যাবে মুসলিমদের উত্তরাধিকারের ঘ্রাণ। দেখা যাবে মুসলিম ইতিহাসের অমর কিছু স্বাক্ষর।

কী সেই কারণ, যা সিসিলিতে টেনে নিয়ে গিয়েছিল মুসলিম বাহিনীকে? কিভাবে তারা মোকাবেলা করেছিলেন সে সময়কার সুপার পাওয়ার বাইজেন্টাইন এম্পায়ারের সাথে? ভূমধ্যসাগর এবং মধ্যস্থিত সকল দ্বীপের নিয়ন্ত্রণ ছিল যাদের। উত্তপ্ত আগ্নেয়গিরি আর উদগত লাভার এই দ্বীপে আজও মুসলিমদের রেখে যাওয়া স্মৃতির স্বাক্ষর বহন করে কোন বস্তু? সেখানে মুসলিমদের অস্তিত্বের গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন কী কী? চলুন জেনে নেয়া যাক।

মুসলিম নৌবহর প্রতিষ্ঠা: প্রথম আশার আলো

প্রথম হিজরি শতাব্দীর সূর্য অস্তমিত হওয়ার আগেই মুসলিম বাহিনী তখন জয় করে নিয়েছে পুরো উত্তর আফ্রিকা এবং আন্দালুস অঞ্চল। বাদ পড়েনি শাম তথা বৃহত্তর সিরিয়া এবং মিসর ভূখণ্ড। ফলে মুসলিমরা হয়ে যায় বাইজেন্টাইন বিরোধী সবচেয়ে শক্তিশালী পক্ষ। তাদের মধ্যে মুখোমুখি লড়াই হওয়ার সম্ভাবনা ক্রমেই হয়ে উঠতে থকে জীবন্ত। বাইজেন্টাইনরা তখন শাম থেকে আনাতোলিয়া এবং উত্তর আফ্রিকা ও আন্দালুস থেকে নিয়ে ইউরোপীয় মহাদেশের গভীর পর্যন্ত নিজেদের দাপট বিছিয়ে রেখেছিল। ভূমধ্যসাগর পরিণত হয়েছিল সার্বক্ষণিক লড়াইয়ের উন্মুক্ত রণাঙ্গনে। উপকূলীয় শহরগুলো এবং ইসলামি নৌবহর মুখোমুখি হচ্ছিল বাইজেন্টাইন বাহিনীর পক্ষ থেকে ধারাবাহিক প্রতিশোধমূলক অভিযানের। এই পরিস্থিতি দেখে মুসলিমরা প্রয়োজনবোধ করে একটি শক্তিশালী নৌবহর এবং সুরক্ষিত বন্দর প্রতিষ্ঠার। দীর্ঘ সমুদ্রতটের যে বন্দরে নোঙর করবে নৌবহরের শক্তিশালী জাহাজগুলো।

তৎকালীন আব্বাসীয় সাম্রাজ্য টের পেয়েছিল বাইজেন্টাইনদের নৌ-হামলা কতটা বিপজ্জনক হতে পারে । তাই তারা টায়ার শহরে উমাইয়াদের প্রতিষ্ঠিত নৌ মন্ত্রণালয়কে বহাল রাখে। যেখান থেকে প্রস্তুত করা হতো ইসলামি নৌবাহিনীর বিভিন্ন সামগ্রী। অতঃপর ২৪৭ হিজরি মোতাবেক ৬৮১ খৃস্টাব্দে তাঁরা নৌ মন্ত্রণালয় স্থানান্তর করে আরেক প্রসিদ্ধ উপকূলীয় শহর অ্যাকরে। বাইজেন্টাইন এবং আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের এই সংঘর্ষ ক্রমাগত চলতে থাকে সময়ের পৃষ্ঠাজুড়ে। বাইজেন্টাইনদের দুর্বলতার কোনো এক মুহূর্তে আব্বাসীয় সাম্রাজ্য জয় করে ভূমধ্যসাগরের পূর্বে অবস্থিত সাইপ্রাস দ্বীপ। তারপর বিজিত হয় ক্রিট দ্বীপ। শামের উপকূল জুড়ে বাড়িয়ে দেয়া হয় সামুদ্রিক নজরদারি। তারসুস শহরটি হয়ে হয়ে যায় ইসলামি বাহিনীর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ সামরিক নৌঘাঁটি। এ সকল বন্দরের নিয়ন্ত্রণে ছিল তুলুনিয়া সাম্রাজ্য। শাম এবং মিসরজুড়ে তারা নৌ-সামগ্রীর প্রস্তত প্রকল্প অব্যাহত রেখে কাজ করেছিল ইসলামি নৌবহর বৃদ্ধি এবং শক্তিশালী করার লক্ষ্যে। (১)

অপরদিকে উত্তর আফ্রিকা অঞ্চলে ইসলামি বাহিনীর বিজয়ের পর থেকে থেমে থাকেনি বাইজেন্টাইনদের পাল্টা আক্রমণ। ভূমধ্যসাগরীয় দ্বীপ সিসিলি এবং নিকটবর্তী সারডিনিয়া দ্বীপে সর্বপ্রথম ইসলামি নৌ অভিযান পরিচালিত হয়েছিল ৪৪ হিজরি মোতাবেক ৬৬৪ খৃস্টাব্দে। বুরকা শহর থেকে পরিচালিত হয়েছিল এই অভিযান। মিসরের পক্ষ থেকে এ শহরের নৌবহরকে দেয়া হতো সাহায্য ও সমর্থন। এ অভিযানের পর পরিচালিত হয় আরও বেশ কিছু অভিযান। যেমন ৮৪ এবং ৯২ হিজরিতে পরিচালিত হয়েছিল আরও দুটি অভিযান। তবে একের পর এক এই অভিযানগুলোর কোনোটিরই উদ্দেশ্য ছিল না সিসিলি দখল করা অথবা সেখানে অবস্থান করা।

৮৪ হিজরি মোতাবেক ৭০৩ খ্রিষ্টাব্দে তিউনিসিয়ার প্রশাসক মুসা বিন নুসাইর তিউনিসিয়ায় প্রথম যুদ্ধজাহাজ নির্মাণের প্রচেষ্টা করেন। মুসা বিন নুসাইর পরবর্তীতে আন্দালুস তথা স্পেন বিজয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। তিনি তিউনিসিয়ায় জাহাজ নির্মাণ বিভাগ চালু করেন এবং এটিকে নৌ-মন্ত্রণালয়ের সাথে সংযুক্ত করেন। অতঃপর নির্দেশ দেন একশটি নৌযান নির্মাণের। তবে অপর কিছু বর্ণনা অনুযায়ী মুসা বিন নুসাইরের আগের প্রশাসক হাসসান বিন নুমান যুদ্ধজাহাজ নির্মাণ বিভাগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়।

তিউনিসিয়া থেকে ভূমধ্যসাগর অভিমুখে

প্রথম শতাব্দীর শেষভাগ থেকে তিউনিসিয়া পরিণত হয় ইসলামি নৌবাহিনীর অন্যতম সক্রিয় সামরিক নৌ-ঘাঁটিতে। এখান থেকেই প্রেরিত হতো রোমের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে ভূমধ্যসাগরীয় নৌ অভিযান। ৮৯ হিজরি মোতাবেক ৭০৭ খ্রিষ্টাব্দে মুসা বিন নুসাইর উত্তর আফ্রিকার মুসলিম নিয়ন্ত্রণাধীন অঞ্চলের নিকটবর্তী দ্বীপগুলোতে রোমীয় নৌবাহিনীর উপর আক্রমণের লক্ষ্যে পাঠিয়েছিলেন তিউনিসীয় নৌবাহিনীকে। ইসলামি নৌবাহিনী সেখানে স্প্যানিশ উপকূলের নিকটবর্তী মিনোর্কা এবং মিয়োর্কা (বর্তমান পালমা) দ্বীপে রোমকদের পরাজিত করে এই দুই দ্বীপকে ইসলামি সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়। (২)

ইসলামি নৌবাহিনীর ইতিহাসের সেই ঐতিহাসিক এবং গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত থেকেই মুসলিমরা উপলব্ধি করতে শুরু করে সিসিলি এবং এর মধ্যবর্তী পেন্টেলেরিয়া (Pantelleria) দ্বীপের অর্থনৈতিক এবং কূটনৈতিক গুরুত্ব। ভূগোলবিদ এবং মুসলিম পর্যটকগণ ভৌগোলিক অবস্থানের দিক দিয়ে এই দ্বীপের প্রশংসা করেছেন। কারণ, এটি ছিল তিউনিসিয়ার কাছাকাছি দূরত্বে উত্তর আফ্রিকার মুখোমুখি একটি দ্বীপাঞ্চল। তিউনিসিয়া এবং সিসিলির মধ্যে ছিল যোগাযোগ ব্যবস্থা। এখান থেকে আঞ্জীর এবং তুলা আহরণ করা হতো। ৮৮ হিজরি মোতাবেক ৭০৭ খৃস্টাব্দে মুসা বিন নুসাইর এ দ্বীপ দখল করে এটিকে রোমের বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের আক্রমণের প্রতিরোধে সম্মুখ সামরিক ঘাঁটি বানানোর দৃঢ় সংকল্প করেছিলেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য তিনি নির্বাচিত করেছিলেন তাঁর বাহিনীর অন্যতম সুদক্ষ অধিনায়ক আবদুল মালিক ইবনু কুতান আল-ফিহরিকে। আবদুল মালিক তাঁর এই অভিযান লাভ করেছিলেন অভাবনীয় সফলতা। সক্ষম হয়েছিলেন সিসিলির নিকটবর্তী পেন্টেলেরিয়া দ্বীপকে উত্তর আফ্রিকা এবং তিউনিসিয়ার অধিভুক্ত করতে। (৩)

আগলাবিয়া সাম্রাজ্য এবং সিসিলি দখল

১৮৪ হিজরি মোতাবেক ৮০০ খৃস্টাব্দে এসে আব্বাসীয় খলিফা হারুনুর রশিদ ইব্রাহিম বিন আগলাব আত-তামিমিকে আফ্রিকার তিউনিসিয়ার প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আরও সিদ্ধান্ত নেন ইব্রাহিমের পর উত্তরাধিকারসূত্রে তাঁর বংশধররাই হবে এ অঞ্চলের ক্ষমতাসীন। তবে শর্ত ছিল অর্থনৈতিক এবং রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে খেলাফতের অনুগত থাকতে হবে এবং প্রতি বছর বাগদাদে প্রেরণ করতে হবে বাৎসরিক ট্যাক্স। আব্বাসীয় সাম্রাজ্যের গৃহীত এই বিকেন্দ্রিক সিদ্ধান্তটি ছিল এক বিশাল প্রজ্ঞাবাচক পদক্ষেপ। উদ্দেশ্য ছিল, সে সময়কার আব্বাসীয় নাগরিকদের কাঁধ থেকে কষ্ট এবং পরিশ্রমের বোঝা উঠিয়ে দিয়ে এ সমস্ত প্রাদেশিক অঞ্চলগুলোর মাধ্যমে ফায়েদা লাভ করা। যতদিন তারা আব্বাসীয় খলিফার বাইয়াতের অনুগত থাকবে তাদের মাধ্যমে অর্জিত হবে এই উপকার ।

তখনকার আরব এবং আফ্রিকান বারবার মুসলিম সমাজ প্রশাসনিক আনুগত্য মেনে ইব্রাহিম বিন আগলাবকে প্রশাসক হিসেবে গ্রহণ করে নেয়। রাজনৈতিক কৌশল এবং প্রজ্ঞার দিক দিয়ে তিনি ছিলেন অত্যন্ত বিচক্ষণ একজন নেতৃত্ব। প্রশাসনিক ক্ষমতা লাভের অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি তাঁর প্রতিযোগী এবং বিদ্রোহীদেরকে ইরাকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হন। আরব এবং বারবার মুসলিমদের মাঝে জাগিয়ে তুলেন শক্তিশালী চেতনা। তাঁর শাসিত অঞ্চল বিস্তৃত হতে হতে বর্তমান লিবিয়ার পশ্চিমে অবস্থিত ত্রিপোলি শহর পর্যন্ত পৌঁছে যায়। পরবর্তীতে তাঁর বংশধরদের জন্যই স্থির হয়ে যায় এই অঞ্চলের ক্ষমতা। (৪)

২০১ হিজরি মোতাবেক ৮১৭ খ্রিষ্টাব্দে উত্তর আফ্রিকার আগলাবিয়া সাম্রাজ্যের ক্ষমতা গ্রহণ করেন আমির যিয়াদাতুল্লাহ বিন ইব্রাহিম বিন আগলাব। আগলাবিয়া সাম্রাজ্যের শাসকদের মধ্যে তিনিই ছিলেন সবচেয়ে বেশি প্রভাবশালী, বিচক্ষণ এবং শক্তিধর শাসক। ছিলেন তেজস্বী এবং বেপরোয়া প্রকৃতির। তিনি আগলাবি বাহিনীর মাঝে গোপনে জেগে উঠা বিপজ্জনক বিদ্রোহী মনোভাব টের পেয়েছিলেন। ফলে বাহিনীতে সুদানি জাঞ্জ গোত্রীয় সৈন্যদের অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে সুকৌশলে সেনাবাহিনীকে নিয়ন্ত্রণে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন। অতঃপর তিনি উপলব্ধি করেছিলেন তাঁর সাম্রাজ্য, বাহিনী এবং সাধারণ প্রজাদের জন্য সবচেয়ে উত্তম পন্থা হচ্ছে যুদ্ধ অভিযান প্রেরণ করে বিভিন্ন অঞ্চল বিজিত করা। তাই ক্ষমতা গ্রহণের ঊষালগ্ন থেকেই তিনি একটি শক্তিশালী নৌবহর প্রস্তুত করে সেনা প্রস্তুতির নির্দেশ প্রদান করেন। তাদেরকে নির্দেশ দেন সিসিলির নিকটবর্তী সারডিনিয়া দ্বীপে অভিযান পরিচালনা করার। সারডিনিয়া তখন ছিল বাইজেন্টাইন রোম সাম্রাজ্যের করদরাজ্য। আগলাবিয়া নৌবাহিনী সারডিনিয়ার কয়েক স্থানে রোমীয়দেরকে পরাজিত করে এবং বিপুল উদযাপনের মধ্য দিয়ে ফিরে আসে আগলাবিয়া সাম্রাজ্যের রাজধানীতে। যা ছিল তিউনিসিয়ার বর্তমান কাইরাওয়ান শহরের নিকটে। (৫)

যিয়াদাতুল্লাহ ইতালীয় রাজ্যগুলোতে চলমান পরিস্থিতির নজরদারি থেকে উদাসীন ছিলেন না। ২১২ হিজরি মোতাবেক ৮২৭ খৃস্টাব্দে তিনি জানতে পেরেছিলেন যে, কনস্টান্টিনোপলের রোমান এম্পায়ার সিসিলি দ্বীপে কনস্টান্টিন নামক এক বিশপকে নিয়োগ দিয়েছে। দ্বীপের রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত এই বিশপ ফিমি অথবা ইউফেমিয়াস নামক এক দক্ষ অধিনায়ককে নৌবহরের প্রধান হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ফিমি দায়িত্ব গ্রহণের পরপরই উত্তর আফ্রিকার তিউনিসিয়া এবং পার্শ্ববর্তী উপকূলগুলোতে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। তাঁর এই আক্রমণগুলো উপকূলের অধিবাসীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে দিতে সফল হয় এবং অনেক সম্পদ ও বন্দী দখল করে নিয়ে যায়। অতঃপর ফিমি এক আভ্যন্তরীণ বিদ্রোহের মধ্য দিয়ে দ্বীপের প্রশাসককেই পদানত করে ফেলে। কিন্তু নতুন করে সশস্ত্র বিরোধিতা গড়ে উঠায় তাঁর এই ক্ষমতা বেশিদিন টিকে থাকেনি। বাধ্য হয়ে সে আগলাবিয়া সাম্রাজ্যের শাসক যিয়াদাতুল্লাহর কাছে সামরিক সাহায্য প্রার্থনা করে। এর বিনিময়ে সিসিলির ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিশ্রুতি দেয়। (৬)

যিয়াদাতুল্লাহ আগলাবি সাম্রাজ্যের বিশিষ্ট আলিম এবং বিচক্ষণ ব্যক্তিবর্গকে এ ব্যাপারে সমাধান প্রদানের জন্য একত্রিত করেন। ইমাম সাহনুন এবং কাজি আসাদ ইবনুল ফোরাত ছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। তারা একত্রিত হয়ে সিসিলি অভিযান এবং দখলের বিষয়ে পরামর্শ করেন। উপস্থিত ব্যক্তিগণ দুভাগে বিভক্ত হয়ে যান। একভাগের নেতৃত্বে ছিলেন আল্লামা সাহনুন আল-মালেকী। ইতালীয় উপকূলের নিকটবর্তী হওয়ার কারণে তিনি এই দ্বীপ দখলের সিদ্ধান্তকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন। কারণ, নিকটবর্তী হওয়ার ফলে ইতালীয়রা অতি সহজেই সেখানকার মুসলমানদের ক্ষতিসাধন করতে পারবে, আর তিউনিসিয়া থেকে সেখানে সাহায্য পৌঁছাতে বিলম্ব হয়ে যাবে বলে তিনি অভিমত ব্যক্ত করেন। দ্বিতীয় পক্ষের নেতৃত্বে ছিলেন স্বয়ং যিয়াদাতুল্লাহ এবং কাজি আসাদ ইবনুল ফোরাত প্রমুখগণ। তাঁরা মনে করেন, বাইজেন্টাইনদের উচিত শিক্ষা দেয়ার জন্য এবং জিহাদ করে দ্বীপটিকে মুসলমানদের দখলে আনতে এর চেয়ে সুবর্ণ সুযোগ হতে পারে না। ভূমধ্যসাগরে কূটনৈতিক দিক থেকে এই দ্বীপটির গুরুত্ব অনস্বীকার্য।

বৈঠক শেষে যিয়াদাতুল্লাহর পক্ষই প্রাধান্য লাভ করে। তিনি এই বাহিনী এবং নৌবহরের অধিনায়কত্বের ভার অর্পণ করেন কাজি আসাদ ইবনুল ফোরাত এর কাঁধে। তাদের সাথে যোগ দেয় সম্ভ্রান্ত আরবগণ, আন্দালুসের বারবার গোত্রীয় মুসলিমগণ এবং উত্তর আফ্রিকার মুসলিম সমাজের বিশিষ্ট জ্ঞানী-গুনীজন। ২১২ হিজরি মোতাবেক ৮২৭ খৃস্টাব্দের রবিউল আউয়াল সয়াসস থেকে যাত্রা করে এই বাহিনী। সিসিলিতে পৌঁছে তাঁরা চূর্ণ করে ফেলেন সেখানকার দুর্গগুলো, খৃস্টান সেনাবাহিনীকে নাস্তানাবুদ করে তাদের নৌবহরকে নিমজ্জিত করেন ভুমধ্যসাগরের গভীর জলরাশির উদরে। মাজারা, বালাতা প্রভৃতি দ্বীপের বড় বড় শহরগুলো একের পর এক তাদের পদতলে হয় নত।

মুসলিমদের এ বিজয়-যাত্রায় কম্পিত হয়ে উঠে কনস্টান্টিনোপলের প্রাসাদ। রোমক সম্রাট মুসলিমদের প্রতিরোধের জন্য প্রেরণ করে এক বিরাট সামরিক এবং নৌবাহিনী। তার এই বাহিনী অবরুদ্ধ করে রাখে দ্বীপের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত সিরাকাস শহরটিকে। এখানেই সংঘটিতে হয় এক বিরাট যুদ্ধ। ২১৩ হিজরি মোতাবেক ৮২৮ খ্রিষ্টাব্দের রবিউল আউয়ালে এ যুদ্ধে শাহাদাতবরণ করেন বীর মুজাহিদ কাজি আসাদ ইবনু ফোরাত। তবুও মুসলিম বাহিনী লড়াইয়ে থাকে অটল। ইতিমধ্যেই আফ্রিকা থেকে ৩০০ নৌযান সমৃদ্ধ এক সাহায্যকারী বাহিনী এসে পৌঁছায় তাদের কাছে। অবশেষে কয়েকমাসের যুদ্ধ এবং সংঘর্ষের পর মুসলিম বাহিনী বাইজেন্টাইন বাহিনীকে পরাজিত করতে সক্ষম হয়। ২১৬ হিজরি মোতাবেক ৮৩১ খৃস্টাব্দে তাঁরা দখল করে নেন দ্বীপটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ শহর পালেরমো।

এরপর থেকেই সিসিলির বিভিন্ন প্রান্তে মুসলিম বাহিনীর বিজয়যাত্রা ধারাবাহিক চলমান থাকে। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ সিসিলিই হয়ে তাদের অধীন। ২২০ হিজরি মোতাবেক ৮৩৫ খৃস্টাব্দে এসে তারা শুরু করেন নতুন অভিযান। এ সময় মুসলিম বাহিনী দক্ষিণ ইতালির দিকে যাত্রা করে সেখানকার অন্যতম শহর নাপোলি অবরোধ করতে সক্ষম হন। এর ফলে বাইজেন্টাইন এবং রোমানিয়া উভয় সাম্রাজ্যই সমানভাবে চিন্তিত হয়ে পড়ে। এদিকে ইতালির দক্ষিণে মুসলিমদের অস্তিত্ব বাড়তে থাকে ক্রমেই। একপর্যায়ে তারা এড্রিয়াটিক সাগরের ইতালীয় উপকূলের এক বিরাট অংশ দখল করে ফেলেন। (৭)

সিসিলিতে মুসলমানদের দুই শতাব্দী

আগলাবি সাম্রাজ্যের শাসনামলে সিসিলিতে অভিযানগুলো প্রেরিত হতো পশ্চিম থেকে পূর্বদিকে। বিশেষভাবে মাজারা এবং পালেরমো শহর থেকে। ৮২৭-৮৩১ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত টানা চার বছর এ যুদ্ধ চলমান থাকে। এর পরবর্তী দশ বছরে অর্থাৎ ৮৩১ থেকে ৮৪১ খৃস্টাব্দের মধ্যে আরবগণ মাজারা অঞ্চলে তাদের নিয়ন্ত্রণ পাকাপোক্ত করে ফেলতে সক্ষম হন। এখানেই তারা প্রথম আবাস গড়ে তুলেন। বন্দী এবং কৃষকদেরকে নিয়োগ দেন তাদের চাষাবাদী জমিগুলোতে। এভাবেই তারা স্বাচ্ছন্দ্যের সাথে দ্বীপে বসবাস করতে শুরু করেন এবং অর্থনৈতিক দিক থেকেও দ্বীপটি সমৃদ্ধ হতে শুরু করে। ৮৪১ থেকে নিয়ে ৮৫৯ খৃস্টাব্দ পর্যন্ত পরের আঠারো বছরে উর্বর নোটো প্রদেশ দখলের জন্য আরবরা তাদের প্রচেষ্টা দ্বিগুণ করে দেন। ২৪২ হিজরি মোতাবেক ৮৬০ খৃস্টাব্দে তারা সিসিলি বিজয়ের সর্বশেষ গন্তব্য দিমুনা শহর দখলের প্রচেষ্টা শুরু করেন। অবশেষে ২৮৯ হিজরি মোতাবেক ৯০২ খৃস্টাব্দে গিয়ে এ প্রচেষ্টা সফলতার মুখ দেখে। (৮)

একপর্যায়ে পতন ঘটে আগলাবিয়া সাম্রাজ্যের। ২৯৭ হিজরি মোতাবেক ৯১০ খৃস্টাব্দে মাহদির ক্ষমতারোহণের মধ্য দিয়ে শিয়া উবাইদিয়্যাহ ফাতিমিয়্যা সাম্রাজ্য দখল করে নেয় উত্তর আফ্রিকার ক্ষমতা। সেখানে তারা প্রতিষ্ঠা করে নতুন রাজধানী ‘মাহদিয়া’। ক্ষমতার পথ বাধামুক্ত হওয়ার পর মাহদি সিসিলিকে অনুগত করার জন্য সেখানে তাঁর পক্ষ থেকে কতক প্রশাসক প্রেরণ করেন। তবে দ্বীপবাসী পূর্বেকার আগলাবিয়া সাম্রাজ্যের প্রশাসকদেরকে যেভাবে স্বাগত জানিয়েছিলেন তেমনটি দেখা যায়নি উবাইদিয়্যাহ সাম্রাজ্যের প্রশাসকদের বেলায়।

ফাতেমীয়রা ছিল শিয়া মতাবলম্বী এবং সীমালংঘনকারী। দ্বীপবাসী কর্তৃক ফাতেমীয়দের বিরোধিতা এবং তাদের প্রতি শর্তারোপ করার জন্য এর বেশি কিছুর দরকার ছিল না। কিন্তু ফাতেমীয় খলিফা মাহদি সিসিলি দ্বীপবাসী মুসলিমদেরকে সে সুযোগ দেয়নি। সে বেশ কয়েকজন নির্দয় এবং পাষাণ ব্যক্তিকে এখানকার প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত করে। সালিম বিন আবি রাশিদ, তাঁর পরবর্তীতে খলিল বিন ইসহাক ছিল এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য। যাদের সমর্থনে ছিল এক বিরাট সামরিক বাহিনী। এই বাহিনীর সাহায্যে তারা দ্বীপের বিভিন্ন প্রান্তে জেগে উঠা বিদ্রোহকে সম্পূর্ণরূপে দমিয়ে ফেলতে সক্ষম হয়েছিল। এমনকি পাষণ্ড খলিল ইবনে ইসহাক সিসিলির মুসলমানদেরকে সর্বাধিক সংখ্যক হত্যা করে গর্ব করে বলেছিল, ‘যারা নিহতের সংখ্যাকে বেশি বলে তাদের কথা অনুযায়ী আমি হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছি। আর যারা কম বলে তাদের কথা অনুযায়ী আমি এক লক্ষ লোককে হত্যা করেছি। আল্লাহর শপথ, আমি অবশ্যই এর চেয়ে বেশি লোক হত্যা করেছি।’তখন উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্য হতে একজন জবাবে বলেছিলেন, ‘হে আবুল আব্বাস, একজন ব্যক্তিকে হত্যা করার অপরাধই তোমার শাস্তির জন্য যথেষ্ট হবে।’ (৯)

৩৩৬ হিজরিতে বনু কিলাব বংশীয় হাসান ইবনু আলি বিন আবিল হুসাইনের পদার্পণে সিসিলি স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলার সুযোগ পায়। বনু কিলাব ফাতেমীয়দের একান্ত আস্থাভাজন হলেও হাসান ছিলেন উত্তম বৈশিষ্ট্যের অধিকারী। ন্যায়প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের অধিকার ও রক্ত নিয়ে সীমালঙ্ঘন বন্ধ করে তিনি স্থাপন করেছিলেন ব্যতিক্রম নজির। ফলে সিসিলিবাসী তাকে সিক্ত করেছিল ভালোবাসার উচ্ছ্বাস দিয়ে। তিনি সেখানে পাঁচ বছর ছিলেন। অতঃপর ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে সিসিলিবাসী হয় ভীষণ শোকাহত। এরপরের ৯৫ বছরে সিসিলিতে বনু কিলাবের দশজন প্রশাসক অতিবাহিত হন। এ সময়ের মধ্যে দ্বীপবাসী লাইফ-স্টাইল তথা জীবনাচার, জ্ঞান এবং শিষ্টাচারের দিকে অনেক এগিয়ে যায়। এমনিভাবে দ্বীপের প্রতি রোমকদের লোলুপ দৃষ্টিকে প্রতিহত করতে তারা ধারাবাহিক যুদ্ধ করেছেন দক্ষিণ ইতালীয় উপকূলে। এভাবে সিসিলিতে প্রতিষ্ঠিত হয় শান্তি। সিসিলিজুড়ে বইতে থাকে কল্যাণ এবং সুখ-সমৃদ্ধির বাতাস। অধিকাংশ সময়েই সৈন্যরা দক্ষিণ ইতালীয় উপকূলে যুদ্ধরত থাকা এবং সিসিলির সুরক্ষায় বনু কালবের একনিষ্ঠতা ছিল এর অন্যতম কারণ। দ্বীপের যাবতীয় ব্যবস্থাপনায় তারা নিজেদেরকে স্বয়ংসম্পূর্ণ মনে করেছিলেন। (১০)

বনু কালবের প্রায় এক শতাব্দী শাসনের পর সিসিলি প্রবেশ করে এক অস্থির সময়ের কালচক্রে। যেখানে সর্বক্ষণই দেখা যেত অশান্তি, বিদ্রোহ এবং অবাধ্যতার দৃশ্য। বহুসংখ্যক বিদ্রোহীর আত্মপ্রকাশ ঘটে এ সময়ে। তাদের প্রত্যেকেই পুরো দ্বীপের অথবা দ্বীপের কোনো অংশের একক ক্ষমতা দাবি করেছিল। এ সময় ফাতেমীয়রা মাহদিয়া শহর থেকে রাজধানী স্থানান্তরিত করেছিল কায়রোতে। এর ফলে উত্তর আফ্রিকা রূপ নিয়েছিল বিদ্রোহ, রাহাজানি এবং বিশৃঙ্খলার অভয়ারণ্যে। বিদ্রোহ এবং হানাহানিতে নিমজ্জিত হওয়ার ফলে সিসিলি হারিয়ে ফেলে তাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মিত্র তিউনিসিয়াকে।

সিসিলির ইতিহাসের এই নতুন সময়টি ছিল আন্দালুসের তায়েফা তথা বিচ্ছিন্ন রাজাদের সময়ের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। খুব দ্রুতই বিভিন্ন অঞ্চল নিয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ে সেখানকার শাসকরা। এখানেই থেমে থাকেনি, বরং এদের মধ্য থেকে অন্যতম দুই শাসক ইবনুস সামনা এবং আলি ইবনু না’মা জড়িয়ে পড়ে পরস্পরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ। ইবনুস সামনা পরাজিত হয়ে সাহায্য কামনা করে মুসলিমদের শত্রু নরম্যানদের কাছে। যারা তখন শাসন করত মধ্য এবং দক্ষিণ ইতালি অঞ্চল। তারা এই আহ্বানে সাড়া দেয় এবং অধিবাসী মুসলিমদের বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিয়ে ৪৪৪ হিজরি মোতাবেক ১০৫৩ খৃস্টাব্দে অতি সহজেই দ্বীপে পা ফেলতে সক্ষম হয়ে যায়। (১১)

দীর্ঘ আড়াই শতাব্দী সময় পর সিসিলির আকাশের ইসলামি সূর্য চিরতরের জন্য আত্মহুতি দেয় অস্তাচলের লালিমায়।

সিসিলির সোনালী সভ্যতা

ইসলামি শাসনের ছায়াতলে এসে সিসিলি সাক্ষী হয়েছিল সভ্যতার, বিপ্লবের। অর্থনীতি, সামাজিক শিষ্টাচার-সভ্যতা এবং বসবাস ও আবাদ ব্যবস্থা সকল দিক দিয়ে তাঁরা সাক্ষী হয়েছিল এক বৈপ্লবিক জোয়ারের। মুসলিমদের হাত ধরে সিসিলিতে প্রবেশ করেছিল বিভিন্ন ধরণের চাষাবাদ পদ্ধতি এবং ফসলাদি। এ দ্বীপে তাঁরা নিয়ে এসেছিলেন লেবু, কমলা, আখ, ধান, খেজুর, তুলো এবং প্যাপিরাস প্রভৃতি ফসল। এমনকি সিসিলির আবহাওয়া উপযোগী নতুন কিছু কৃষিপদ্ধতিও আবিস্কৃত হয় তখন। পেয়াজ, তুলো ইত্যাদি চাষে তাদের নিজস্ব পদ্ধতি ছিল। মিষ্টি আঙ্গুরের রস উৎপাদনে তাদের ছিল বিশেষ পদ্ধতি। তবে সেখানকার অধিকাংশ মানুষ তরি-তরকারি, শাক-সবজি ইত্যাদির চাষ করত। এর কিছু এসেছিল মুসলমানদের হাত ধরে। পালেরমো ছিল বাগান এবং উদ্যান বেষ্টিত শহর। এর নিকটবর্তী সমতল ভূমিতে চাষ হতো পারস্য জাতের আখ এবং উৎকৃষ্ট জাতের শসাজাতীয় সবজি। (১২)

এমনিভাবে দ্বীপটি সাক্ষী হয়েছিল জ্ঞান এবং সভ্যতার চূড়ান্ত এক বিপ্লবের। বিখ্যাত পরিব্রাজক, ভূগোল বিদ্যার বিশ্বকোষ ‘সুরাতুল আরদ তথা দি ফেস অব আর্থ’ গ্রন্থের রচয়িতা ইবনু হাওকাল চতুর্থ হিজরি শতাব্দীর শুরুতে সিসিলি দ্বীপ ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি সে সময়কার সিসিলির সামাজিক অবস্থা এবং বসবাস ব্যবস্থাপনার একটি আকর্ষণীয় বিবরণ প্রদান করেছেন। বিশেষ করে পালেরমো শহরে দেখেছিলেন তিনি শত শত মসজিদ এবং তালিবে ইলমদের উপস্থিতি। দেখেছিলেন ইলমের সুবিমল মজলিসসমূহ। উস্তাদের কাছ থেকে মৌমাছির মতো ঝাঁক বেঁধে শিক্ষার্থীদের শিক্ষা গ্রহণের নৈসর্গিক দৃশ্য। এক পালেরমোতেই তিনি দুইশোর বেশি মসজিদ দেখে হয়ে পড়েছিলেন হতবাক। আন্দালুসের রাজধানী মসজিদের শহর হিসেবে প্রসিদ্ধ কর্ডোভা (কুরতুবা) ব্যতিত অন্য বড় বড় শহরগুলোতেও তিনি এত মসজিদ দেখতে পাননি। (১৩)

সিসিলির অধিবাসীদের কাছে শিক্ষক এবং শিক্ষার্থীগণ ছিলেন অত্যন্ত সমাদৃত। জনগণের কাছে সেখানকার আলিম, ফকিহ এবং বিজ্ঞ ব্যক্তিগণ ছিলেন চোখের মণিতুল্য। তাদের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হতো হালাল-হারাম। প্রয়োগ করা হতো যাবতীয় বিধিবিধান। বিভিন্ন বর্ণনা থেকে জানা যায়, সেখানে ছিল অনেক সাহিত্যিক এবং বাগ্মীর বাসস্থান। (১৪) ইবনু হাওকালের সূত্রেও এমনটি জানা যায়। শিক্ষা-দীক্ষার প্রতি অধিক গুরুত্বদানের পিছনে অন্যতম কারণ হিসেবে ব্যক্ত করা যায়, দ্বীপটি ছিল ইতালি, বাইজেন্টাইন প্রভৃতি খৃস্টান সাম্রাজ্যগুলোর সম্মুখ অবস্থানে। তাই দ্বীপবাসীরা চেয়েছিলেন সেখানে ইসলামি বিপ্লব ঘটিয়ে দেখিয়ে দিতে। নিজেদের ধর্ম এবং শরীয়াকে পূর্ণরূপে পালন করে এক সুসভ্য সমাজ গড়ে তুলতে। মসজদি এবং মাদরাসার আধিক্য দেখেই বুঝা যায় তাদের এই ইচ্ছা পেয়েছিল বাস্তবতার রূপ।

সিসিলিতে ইসলামি সূর্যের অস্তাগমন এবং সমাপ্তির পালা

প্রথম রজারের নেতৃত্বে নরম্যান খৃস্টানরা দ্বীপে প্রবেশ করে ক্ষমতা দখল, অনেক মুসলিম জনপদের ক্ষতিসাধন এবং কর আরোপ করা সত্ত্বেও মুসলিমরা তখন তাদের পূর্বের শাসকদের অধীনে ইবাদাত এবং ধর্মীয় রীতিনীতি স্বাধীনতার সাথেই পালন করে আসছিলেন। দ্বীপের অর্থনৈতিক, সামরিক এবং শিক্ষা-সভ্যতাগত দিক দিয়ে রেখে আসছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান। কিন্তু ইতালিয়ান লোম্বার্ড এবং ফরাসিদের গমনের ফলে দ্বীপের মুসলিমদের জীবন পরিণত হয় নরকে। চাষাবাদের উর্বর ভূখণ্ডগুলো হারিয়ে তাদেরকে চুকাতে হয় চরম মূল্য। (১৫)

দ্বিতীয় রজার এসে তার পিতার মতোই রাজনৈতিক কর্মপন্থা গ্রহণ করেন। সে অনেক মুসলিম সৈনিককে নরম্যানি বাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করে। মুসলমানদেরকে খৃস্ট ধর্মে দীক্ষিত করার প্রতি সে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। এদিকে পোপশাসিত রোম তাকে মুসলিমদের সাথে সম্প্রীতি করার অপবাদ দিয়ে ক্রমেই চাপ সৃষ্টি করছিল। কিন্তু সে এদিকে কোনো ভ্রুক্ষেপ করেনি। এমনকি তার কিছু বিশেষ আস্থাভাজন ব্যক্তি ছিল মুসলিম। সে ভূগোলবিদ শরিফ ইদ্রিসির পৃষ্ঠপোষকতা করেছিল এবং রৌপ্যের মাধ্যমে পৃথিবীর সর্বপ্রথম গোল মানচিত্র তথা গ্লোব তৈরী করার জন্য তাকে প্রচুর সম্পদ প্রদান করেছিল। ইদ্রিসি তাঁর রচিত মূল্যবান গ্রন্থ ‘নুযহাতুক মুশতাক ফি ইখতিরাকিল আফাক (যা Tabula Rogeriana নামেও পরিচিত)’ দ্বিতীয় রজারকে উপহার হিসেবে প্রদান করেন। তিনি দ্বিতীয় রজারের প্রশংসা করে তাকে রোমের চেয়ে উদার এবং নীতিবান হিসেবে আখ্যায়িত করেন। যিনি ন্যায়পরায়ণতার সাথে শাসন করেছিলেন এবং মুসলিমদের প্রতি উদারতা প্রদর্শন করেছিলেন। সাম্রাজ্যের ব্যবস্থাপনায় তিনি গ্রহণ করেছিলেন সবচেয়ে উত্তম পন্থা এবং উত্তম বিধান অনুযায়ী পরিচালনা করেছিলেন সাম্রাজ্যকে। (১৬)

কিন্তু পোপশাসিত রোমের অব্যাহত চাপে শেষে এসে দ্বিতীয় রজারের এই বদান্যতা ধ্বসে পড়ে। তাদের ডাকে সাড়া দিয়ে সে মুসলমানদেরকে খৃস্টান বানানোর নীতি গ্রহণ করে। তার উত্তরসূরী প্রথম উইলিয়ামের সময় থেকেই শুরু হয় মুসলমানদের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি পর্ব। প্রথম উইলিয়াম সিদ্ধান্ত নেয় অস্ত্রের সাহায্যে দ্বীপকে মুসলিম মুক্ত করার। মুসলিমরা তখন নরম্যানি,ব্যারণ এবং লোম্বার্ডদের সহজ লক্ষ্যে পরিণত হয়। রাজপ্রাসাদের নির্দেশ পেয়ে তারা নেমে পড়ে মুসলিমদের গণহত্যা করার জন্য। খুব দ্রুত সময়ের মধ্যেই সিসিলির বিভিন্ন প্রান্তজুড়ে মুসলিম গণহত্যার লেলিহান শিখা। পালেরমোর মতো বড় শহরও থাকে না এর ছোবল থেকে মুক্ত। মুসলিমরা পালাতে শুরু করে দূরের পর্বতমালা এবং অরণ্যের আড়ালে। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে তারা বেশ কয়েকবার রুখে দাঁড়ালেও প্রথম উইলিয়াম খুব সহজেই তাদেরকে থামিয়ে দিয়েছিল।

আন্দালুসের বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনু জুবাইর আমাদের কাছে এই সিসিলি দ্বীপে ইসলাম এবং মুসলিমদের শেষ দিনগুলোর বিবরণ পেশ করেছেন। তিনি প্রথম উইলিয়ামের সময়ে ৫৮০ হিজরি মোতাবেক ১১৮৫ খ্রিষ্টাব্দে দ্বীপটিতে ভ্রমণ করেছিলেন। দেখেছিলেন সেখানকার মুসলিমদের দুঃখ-কষ্টের দিনগুলো। সাক্ষী হয়েছিলেন তাদের গণহত্যা এবং উৎখাতের প্রচেষ্টার। দেখেছিলেন কীভাবে তাদেরকে দীক্ষিত করা হচ্ছিল ইসলাম থেকে খৃস্ট ধর্মে, বাধা দেয়া হচ্ছিল নামাজ আদায় থেকে, মসজিদ্গুলোকে রূপান্তরিত করা হয়েছিল গির্জায়। তিনি দেখেছিলেন অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে পালেরমোর মুসলিমরা ভালো অবস্থায় ছিল। কিন্তু সিসিলির সেই মুসলিম ব্যক্তিটি ছিলেন কতইনা অসহায়, যিনি নিজের ছোট মেয়েটিকে ইবনু জুবাইরের সাথে পাঠিয়ে দিতে চেয়েছিলেন এই দ্বীপ থেকে দূরে। যে দ্বীপে মুসলমানরা হচ্ছে শোষণের শিকার, যেখানে তাদের জীবনের নেই কোনো নিশ্চয়তা। সেই নিরীহ ব্যক্তিটি বলেছিলেন, তার ছোট্ট মেয়েটিকে নিয়ে গিয়ে লালনপালন করতে, অতঃপর আন্দালুসের কোনো এক সুযোগ্য মুসলিম পাত্রের সাথে তাঁকে বিয়ে দিতে। ইবনু জুবাইরের বর্ণনায় ভেসে উঠা এই দৃশ্যপট সকলের চোখকেই করে দেয় অশ্রুবিগলিত। (১৭)

সিসিলিতে মুসলিমদের শেষদিনগুলো ছিল এমনই অসহায়। তারা হতে থাকে নির্বিচারে গণহত্যার শিকার। নিহত,বিতাড়িত এবং খৃস্টান রূপান্তরিত, এই তিন শব্দের চক্রেই আবর্তিত হতে থাকে সিসিলির মুসলিমদের পরিণতি। কাজি আসাদ ইবনুল ফোরাতের হাত ধরে ইসলামের প্রখর সূর্য দুই শতাব্দীরও বেশি আলো দেয়ার পর হারিয়ে যায় অস্তাচলের আঁধারে। ধীরে ধীরে হয়ে যায় অদৃশ্য। সিসিলির মাটি,অট্টালিকা, গাছপালা, প্রকৃতি আজও সাক্ষী হয়ে আছে মুসলিমদের সেই অবদানের। সিসিলির প্রাচীন স্থাপত্যগুলো যেন ডেকে ডেকে বলে, এই দেখো আমার গায়ে লেগে আছে মুসলিমদের হাতের ছোঁয়া। তবু আমি পারিনি তাদেরকে বাঁচাতে। হায়, আল্লাহ যদি আমাকে দিতেন প্রতিরোধ ক্ষমতা, তবে দেখতো হতো না মুসলিমদের এই অসহায় পরিণতি। তাদের রক্তে লাল হতো না সিসিলির মৃত্তিকা। তবুও হায় থেকে যায় দুঃসহ স্মৃতি, ক্ষণে ক্ষণে পুড়ে মন জ্বলে নিরবধি।

পাদটিকা:—

(১) আত-তানযীমুল বাহরিল ইসলামি ফি শিরকিল মুতাওয়াসসিত, আলি ফাহমি: ৬৫-৬৭।

(২) আল-আসাতিলুল আরাবিয়্যাহ ফিল বাহরিল মুতাওয়াসসিত, ইব্রাহিম আল-আদাওয়ি: ৭১।

(৩) প্রাগুক্ত: ৭৩।

(৪) তারিখু শিমালি ইফ্রিকিয়া, আবদুল আজিজ সালাবি: ২০৮-২১১।

(৫) আল-কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির: ৬/২৩২।

(৬) আল-কামিল ফিত তারিখ, ইবনুল আসির: ৬/২৩৫-৩৬।

(৭) আল-বায়ানুল মুগরিব ফি আখবারিল আন্দালুসি ওয়াল মাগরিব, ইবনু আযারা: ১/১৩৫।

(৮) তারিখুস সিকলিয়া আল-ইসলামিয়্যা, আজিজ আহমাদ: ২৪।

(৯) আল-বায়ানুল মুগরিব ফি আখবারিল আন্দালুসি ওয়াল মাগরিব, ইবনু আযারা: ১/১৩৫।

(১০) আল-আরবু ফি সিকলিয়াহ, ইহসান আব্বাস: ৪৫।

(১১) তারিখু ইবনি খালদুন: ৪/২১০।

(১২) আল-আরবু ফি সিকলিয়াহ, ইহসান আব্বাস: ৭২।

(১৩) আল-মাকতাবাতুস সিকলিয়াহ, আম্মারি: ৬-৭।

(১৪) সুরাতুল আরদ (The face of the earth), ইবনু হাওকাল: ১২৭।

(১৫) তারিখুস সিকলিয়া আল-ইসলামিয়্যা, আজিজ আহমাদ: ৮০।

(১৬) নুযহাতুল মুশতাআক ফি ইখতিরাকিল আফাক, শরিফ ইদ্রিসি: ভূমিকা- ৪।

(১৭) রিহলাতু ইবনি জুবাইর।

-- Fateh24.com এর ঈদসংখ্যা থেকে

ইনি হচ্ছেন মসজিদে নববী শরীফের ইমাম শায়খ শওকত পাশা এবং তাঁর চারপাশে যারা দাঁড়ানো তাঁরা হচ্ছেন ভাগ্যবান আগাগন যারা এই মহান...
18/06/2020

ইনি হচ্ছেন মসজিদে নববী শরীফের ইমাম শায়খ শওকত পাশা এবং তাঁর চারপাশে যারা দাঁড়ানো তাঁরা হচ্ছেন ভাগ্যবান আগাগন যারা এই মহান ইমামের সাথে প্রিয় নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এঁর পবিত্র রওজা শরীফের প্রকোষ্ঠে প্রবেশের সুযোগ পেয়ে ধন্য হন। তিনি ১৯৭০ সালে একবার এই পবিত্র প্রকোষ্ঠের গিলাফ মুবারক পরিবর্তনের সুযোগ পান, সেই দিনটিকে স্মরন করে তিনি বর্ণনা করেন,

"আমি পুরু লেন্সের চশমা পরিধান করতাম, এবং এই চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পেতাম না, কিন্তু প্রিয় নবী কারীম ছল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া আ'লিহি ওয়াছাল্লাম-এঁর পবিত্র রওজা শরীফের প্রকোষ্ঠে প্রবেশের দিনগুলোতে (যখন আমার বয়স ৯০) অলৌকিকভাবে ঘুটঘুটে অন্ধকারেও চশমা ছাড়াই সুচে সুতা ঢুকানোর মত দৃষ্টিশক্তি লাভ করি।

আমার একটা শখ ছিল, আমি আতর সংগ্রহ করতাম। আল্লাহর কসম যেদিন সেই পবিত্র রওজা শরীফের প্রকোষ্ঠ খোলা হল, সেদিন সেই কক্ষে যেই সুগন্ধ পেয়েছি তার মত সুগন্ধিযুক্ত কোন আতর বা সেন্ট আমি জীবনে আর কোনদিন পাইনি।

সেদিন, আমার বার্ধক্যে উপনীত হওয়ার পরও, আমার শরীরে পুরোপুরি যুবকের মত অনুভূতি চলে আসল। আমি সেই পবিত্র কক্ষে প্রবেশ করেছিলাম ডাস্ট এলার্জি নিয়ে, কিন্তু আমার সকল রোগ ভাল হয়ে গেল। একখানা বিশাল বড় পর্দা সড়াতে হয়েছিল, যা আমি একাই সড়িয়ে ফেলি আমার একা কাঁধে বহন করে। পরবর্তীতে সেই পর্দাখানা পাঁচজন যুবকও সড়াতে পারেনি।"

তিনি কাঁদতেন আর এই পবিত্র স্মৃতি বর্ননা করতেন।

- শায়খ মুহাম্মদ আসলাম

“বাদশাহ আলমগীরকুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লীর।”বাদশা আলমগীর বা সম্রাট আওরঙ্গজেব (নভেম্বর ৩,১৬১৮ – মার্চ ৩, ১৭০৭) ষষ্...
04/03/2020

“বাদশাহ আলমগীর
কুমারে তাহার পড়াইত এক মৌলবী দিল্লীর।”

বাদশা আলমগীর বা সম্রাট আওরঙ্গজেব (নভেম্বর ৩,১৬১৮ – মার্চ ৩, ১৭০৭) ষষ্ঠ মোগল সম্রাট। দীর্ঘ ৫০ বছর তিনি রাজত্ব করেছিলেন। ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত মুঘল সাম্রাজ্যের শাসক ছিলেন। আওরঙ্গজেবের পুরো নাম 'আসসুলতানুল আজম আবুল মুজাফফর মুহিউদ্দীন মুহম্মদ আওরঙ্গজেব বাহাদুর আলমগীর বাদশা গাজী'।
ফারসিতে আলমগীর অর্থ জগতবিজেতা ৷

আওরঙ্গজেব (রহ) এ উপমহাদেশের অতীত ঐতিহ্যের হীরক খণ্ড। ১৫ কোটি মানুষকে ৫০ বছর ধরে শাসন করেছিলেন আওরঙ্গজেব। তাঁর রাজত্বকালে মুঘল সাম্রাজ্য প্রথমবারের মতো এতটা বিস্তৃত হয়েছিল যে প্রায় পুরো উপমহাদেশ তাঁর শাসনের করায়ত্ত হয়েছিল। এই ভারতবর্ষে আওরঙ্গজেবের রাজত্বই ছিল ছিল সবচে' বিস্তীর্ণ। আফগান থেকে আরাকান আর কাশ্মীর থেকে কেরালা পর্যন্ত ছিল তার রাজ্য। এই ভারত বর্ষের প্রাচীন আমল আমল থেকে ইংরেজ বর্বরদের উত্থান অবধি এতটা বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে আর কেউ রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। দৈর্ঘ্য প্রস্থ কোন বিচারেই না ৷ [ ক্যামব্রিজ হিস্টোরীর সূত্রে তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমতঃ ৫:৪২ পৃ]

মোগল পরিবারের নিয়মানুযায়ী শাহি কায়দায় তিনি রাজপ্রাসাদে লালিত-পালিত হন। শারীরিক বর্ধনের সঙ্গে সঙ্গে বহুবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে উঠেন। শৈশবের চঞ্চলতায়ই কুরআন-হাদিস-ফিকাহসহ আরবি হস্তাক্ষরবিদ্যায় পান্ডিত্য অর্জন করেন। যৌবনের আগেই প্রকাশিত হয় তার সংকলিত নবীজি (সা.) এর ৪০ হাদিসের গ্রন্থ 'আল-আরবাইন'। তার হস্তলেখা ছিল অত্যন্ত সুন্দর। আগেকার যুগে প্রেস বা ছাপাখানা না থাকায় বই-পুস্তক ও কিতাবাদি হাতে লিখে লিখে কপি তৈরি করা হতো। সম্রাট আওরঙ্গজেব শাসনভার গ্রহণের আগে পবিত্র কোরআন ও আল-আরবাইনের কপি স্বহস্তে লিখে মক্কা শরিফের ছাত্রদের জন্য উপহার পাঠাতেন।

তিনি ছিলেন পাক্কা ঈমানদার, পন্ডিত আলেম, ইবাদতগুজার, খোদাভীরু-মুত্তাকি, বীর্যশালী বীরপুরুষ, ন্যায়পরায়ণ ও মুবাল্লিগ। এমন কোনো ভালো কাজ নেই যা তিনি হাতছাড়া করেছেন। তার যোগ্যতা দিয়েই তিনি ভারতবর্ষ শাসন করেছেন। তিনি ছিলেন ইসলামী সংবিধানের বাস্তবায়নকারী খোলাফায়ে রাশেদিনের মূর্তপ্রতীক সুদক্ষ সম্রাট। আওরঙ্গজেব অল্প বয়সেই ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে যেমন দক্ষতা হাসিল করেছিলেন, তেমনি জাগতিক জ্ঞানবিদ্যা, রাজনীতি, নেতৃত্ব ও রণকৌশলেও নিপুণ হয়ে উঠেছিলেন। মাত্র ১৪ বছর বয়সের ঘটনা। একটা সামরিক হাতি ধেয়ে এসেছিল। সবাই ছোটাছুটি করে পালিয়ে গেল। কিন্তু সাহসী বীর আওরঙ্গজেব মোকাবিলা করে হাতিকে পরাজিত করেছিলেন। মূলত তখন থেকেই তিনি 'বাহাদুর' উপাধিতে ভূষিত হয়েছেন।

মহান কীর্তিমালা : আওরঙ্গজেব (রহ) উপামহাদেশে ইসলাম কায়েম করার সর্বাত্মক চেষ্টা চালান৷ তিনি বিদ‘আত ও কুসংস্কারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। নিজে গান-বাজনায় দক্ষ হওয়া সত্ত্বেও তা শোনা ত্যাগ করেন। পৌত্তলিক ও বিদ‘আতী উৎসবাদি বাতিল করেন। রহিত করেন শির নত করা এবং মাটিতে চুমু খাওয়া। যা পূর্বতন রাজন্যবর্গের জন্য করা হত। বিপরীতে তিনি ইসলামী সম্ভাষণ-বাক্য তথা ‘আসসালামু আলাইকুম’ -এর মাধ্যমে অভিবাদন জানানোর নির্দেশ দেন। সম্ভবত এ কারণে ইসলামের প্রতি বিদ্বেষ পোষণকারী কিছু লেখক তাকে গোঁড়া হিসেবে অপবাদ দেন।

তাঁর প্রশংসিত কাজগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো- কুসংস্কার ও বিদ‘আতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, রাফেযী-শিয়া রাজ্যগুলো নির্মূল এবং বিদ’আতী ও পৌত্তলিক উৎসবাদি নিষিদ্ধ করা ইত্যাদি। এসবের দাবী হলো, তিনি সম্মান, মর্যাদা, নেক দু‘আ পাওয়ার উপযুক্ত। আর এটিই শাসনকার্য পরিচালনায় সালাফ তথা পূর্বসুরীদের কর্মপন্থার বাস্তব প্রয়োগ।

বলা হয়ে থাকে মুঘল সম্রাটদের মধ্যে ইসলামের সবচেয়ে নিকটবর্তী ছিলেন সম্রাট আওরঙ্গজেব, আমাদের বাদশাহ আলমগীর।

ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানে আওরঙ্গজেব রহ. এতই পারঙ্গমতা লাভ করেছিলেন যে, তাঁর উদ্যোগে রচিত বিখ্যাত ফতোয়ার কিতাব 'ফতোয়া আলমগিরি বা আল-ফাতাওয়া আল-হিন্দিয়া' পৃথিবীজুড়ে প্রসিদ্ধি পেয়েছে। ফতোয়া আলমগিরিতে মোট ৬০ অধ্যায় ১০০০ অনুচ্ছেদ-পরিচ্ছেদ ও দৈনন্দিন জীবনের প্রয়োজনীয় প্রায় সব মাসলা-মাসায়েল আছে। ফিকহে হানাফির শাখা-প্রশাখাগত মাসাইলের সবচেয়ে বড় সঙ্কলন এটি। তার দরবার ছিল অসংখ্য আলেমের ঠিকানা। তিনি ও তার তত্ত্বাবধানে দরবারের আলেমরা যৌথভাবে এ ফতোয়াসমগ্র রচনা করেছেন। তিনি এ গ্রন্থের কারণে অমর হয়ে থাকবেন। কেয়ামত পর্যন্ত পুরো পৃথিবীর মুসলমান এতে তাদের সমস্যার সমাধান খুঁজে পাবে।

সিংহাসনারোহণের পর সম্রাট আলমগীর ৩০ পারা কোরআন শরিফ মুখস্থ করেছিলেন। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ঈলম চর্চায় আত্মনিয়োগ করতেন। দিনে-রাতে অনেক বেশি নফল নামাজ পড়তেন। কোরআন তেলাওয়াত, জিকির-আজকার করতেন। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতে পড়তেন। রমজান মাসের শেষ দশক মসজিদে এতেকাফ করতেন। খতম তারাবি নিজে পড়াতেন। তিনি ছিলেন ইবাদতগুজার, শ্রেষ্ঠ শাসক, বীরযোদ্ধা, মুজাহিদ-গাজী।

‘(সম্রাট আওরঙ্গজেব) আমাদের যুগে হিন্দুস্থানের সম্রাট, আমিরুল মুমিনীন ও ইমাম তথা মুমিনদের নেতা ও আমীর, মুসলিমদের এবং রাষ্ট্রব্যবস্থার স্তম্ভ, আল্লাহর পথের মুজাহিদ, বিশিষ্ট আলেম ও আল্লামা, আরেফবিল্লাহ বা আল্লাহর পরিচয় লাভকারী সূফী এবং দীনের সাহায্যে অটল বাদশাহ। নিজ দেশে তিনি কাফিরদের নির্মূল করেন। তাদের করেন পরাস্ত। তাদের গির্জাগুলো গুঁড়িয়ে দেন। তাদের অংশীদারদের করেন দুর্বল। ইসলামের সাহায্য করেন এবং হিন্দুস্থানে ইসলামের মিনার উঁচু করেন। আল্লাহর কালামকে করেন একমাত্র বুলন্দ। হিন্দুস্থানের কাফিরদের থেকে তিনি জিযয়া গ্রহণ করেন।
অব্যাহতভাবে তিনি সুবিশাল সব রাজ্য বিজয় করে যান। যখনই তিনি কোনো শহর বিজয় করতে চাইতেন, তা করেই ছাড়তেন। এমনকি আল্লাহ তাকে সম্মানের জগতে স্থানান্তর অব্দি তিনি ছিলেন জিহাদে। যাবতীয় সময় ব্যয় করেছেন দ্বীনের কল্যাণ ও মহান পালনকর্তার খেদমতে। যেমন সিয়াম, কিয়াম ও সাধনায়- যার কোনোটিও অনেকগুলো মানুষের জন্য কঠিন। এটা আসলে আল্লাহর অনুগ্রহ যাকে ইচ্ছা তিনি তা দান করেন। সম্রাট আলমগীর নিজের সময়গুলো ভাগ করে নিতেন। নির্দিষ্ট সময় ছিল ইবাদত, পাঠদান, সামরিক দফতর, ফরিয়াদকারী, দিনে-রাতে আগত রাজ্যের সংবাদ ও চিঠি পাঠ ইত্যাকার প্রত্যেক কাজের জন্য। একটি কাজের সঙ্গে অন্য কাজের সময় কখনো একাকার হত না। এককথায় তিনি ছিলেন সময়ের সৌন্দর্য-তিলক, সাম্রাজ্য পরিচালনায় তুলনারহিত। তাঁর সাম্রাজ্য ও উত্তম জীবনী নিয়ে ফারসীতে অনেক দীর্ঘ বই সংকলিত হয়েছে। আগ্রহী ব্যক্তিগণ চাইলে সেসব পড়ে দেখতে পারেন।’ (সিলকুদ-দুরার ফী আ‘ইয়ানিল কারনিছ-ছানী ‘আশার: ৪/১১৩)

আওরঙ্গজেবের এই আধ্যাত্মিক ও আত্মিক উৎকর্ষ সাধনের কথা স্বীকার করেছেন শ্রীবিনয় ঘোষের মত লোকও। বলেছেনঃ 'ভারতবর্ষ যদি ইসলাম ধর্মের দেশ হইত তাহা হইলে সম্রাট আওরঙ্গজেব হয়ত ধর্মপ্রবর্তক মুহাম্মদের বরপুত্ররূপে পূজিত হইতেন। বাস্তবিক তাহার মত সচ্চরিত্র,নিষ্ঠাবান,মুসলমান ইসলামের জন্মভূমিতেও দুর্লভ।' তিনি আরো লিখেছেন-'সম্রাট বলতেনঃ বিশ্রাম ও বিলাসিতা রাজার জন্য নহে।' শ্রী-বিনয় মশাই আরো লিখেছেনঃ 'বাস্তবিক বিলাসিতার অভ্যাস আওরঙ্গজেবের একেবারেই ছিল না। বাদশাহের বিলাসিতা তো দূরের কথা, সাধারণ ধনীর বিলাস স্বাছন্দ্যও তিনি ব্যক্তিগত জীবনে এড়াইয়া চলিতেন। লোকে তাঁহাকে যে রাজবেশী 'ফকীর' ও 'দরবেশ' বলিত তাহা স্তুতি নহে ,সত্য। পোশাক-পরিচ্ছেদে, আহারে বিহারে তিনি সংযমী ছিলে। সুরা,নারী,বিলাস তাহাকে স্পর্শ করিতে পারে নাই।' (চেপে রাখা ইতিহাসঃ ১০৫-১০৬পৃ)

সুলতান আওরঙ্গজেবের এই প্রবাদসম সফলতার পেছনে বিপ্লবী সংস্কারক আলিম হযরত মুজাদ্দিদে আলফেসানীর অবদানের কথা ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন। সম্রাট আকবরের ইসলামবিদ্বেষী বিনাশী নতুন চিন্তাধারার প্রেক্ষিতে শ্রদ্ধাভাজন আলিম সমাজ যে মুক্তির প্রদীপ জ্বালিয়ে ছিলেন তার প্রদীপ প্রভায় সর্বাধিক আলোকিত ছিল আওরঙ্গজেবের কাল। ফলে বিজয়, শাসন, ইনসাফ ও সমৃদ্ধির বিচারেও তাঁর শাসনকাল ছিল মোগল ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ অধ্যায়। বিশাল ভারতের মাটিকে সিক্ত করেছিল তাঁর ন্যায় ইনসাফ ৷

আরব সাহিত্যিক শাইখ আলী তানতাবী রহ. তার ক্ষেত্রে ‘খুলাফায়ে রাশিদীনের অবশিষ্টাংশ’ উপাধি প্রয়োগের দাবী করেছেন। তার রচিত ‘রিজালুম মিনাত-তারীখ’ (ইতিহাসের মনীষীরা) গ্রন্থে তিনি তার অমূল্য জীবনী সংযুক্ত করেছেন।

আওরঙ্গজেবের জীবনী শেষ করেছেন তিনি এ কথা বলে, ‘বাদশাহ এমন দু’টি বিষয় করতে সক্ষম হয়েছিলেন যা পূর্ববর্তী কোনো মুসলিম শাসক সক্ষম হন নি:

প্রথম: তিনি পাঠদান কর্ম সম্পাদন বা কিছু সংকলন ইত্যাদি কাজ দাবী করা ছাড়া কোনো আলেম বা পণ্ডিতকে উপঢৌকন বা সম্মানি দিতেন না। এমন যাতে না হয় যে তিনি সম্পদ পেলেন আর অলস হয়ে গেলেন। এতে করে দুটি মন্দ কাজের সন্নিবেশ হবে- অধিকার ব্যতীত সম্পদ গ্রহণ এবং জ্ঞান গোপন করা।

দ্বিতীয়: তিনি প্রথম ব্যক্তি যিনি শরী‘আতের বিধি-বিধানগুলো এক কিতাবে লিপিবদ্ধ করেন, যাকে আইন হিসেবে গ্রহণ করা হয়। তাঁরই নির্দেশ, তত্ত্বাবধান ও সুনজরে ফাতওয়া সংকলনগ্রন্থ প্রণীত হয়। তার নামে যার নাম দেওয়া হয় ‘ফাতাওয়া আলমগীরী’। এটি ‘ফাতাওয়া হিন্দিয়া’ নামে সুবিখ্যাত। ফিকহে ইসলামীতে বিধি-বিধান সংক্রান্ত সবচেয়ে বিখ্যাত ও বিন্যাসের দিক থেকে সবচেয়ে অনবদ্য গ্রন্থ।’ (রিজালুম মিনাত-তারীখ, পৃ. ২৩৬)

আওরঙ্গজেবের মানবতাবোধ, জনদরদ আর চারিত্রিক দৃঢ়তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো পিতা শাহজানের উপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ। ভারত বর্ষে শাহজানের অমর কীর্তি-তাজমহল। প্রিয়তমা স্ত্রী মমতাজকে হারিয়ে তার স্মৃতি স্তম্ভ হিসাবে শাহজাহান পৃথিবীর সপ্তাশ্চর্য এই তাজমহল নির্মাণ করেন। বাইশ বছর ধরে বিশ কোটি বার লক্ষ রূপি খরচ করে নির্মাণ করা হয় এই মহল। এর ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে পড়ে। কিন্তু এতেও তৃপ্ত হয়নি শাহজাহানের বিষাদ-পীড়িত রাজ-হৃদয়। তাই তিনি তুষার শুভ্র আকাশ স্পর্শী তাজমহলের পর ভ্রমর কালো কৃষ্ণ পাথরের আরেকটি তাজমহল তৈরির পরিকল্পনা করেন। যার ভেতরে থাকবে পান্না,হিরা, মনি, পদ্মরাগ প্রভৃতি অমূল্য ধাতুর সংস্থাপন। আর শুভ্র কৃষ্ণ তাজমহলের সংযোগ পথ তৈরি হবে মাটির ভেতর দিয়ে। ইতিহাস বিশ্লেষকদের মতে যদি এই নতুন তাজমহল সৃষ্টি হতো তাহলে দিল্লীর রাজকোষ অর্থনৈতিক পতনের অতল তলে হারিয়ে যেত। দেশ শিকার হতো চরম আকালের। পিতা শাহজাহানকে আরাম কক্ষে বন্দী করে আওরঙ্গযেব দেশ ও জাতিকে সেদিন এই ভয়ানক আকাল থেকে রক্ষা করেন।

আওরঙ্গজেবের অর্থনৈতিক সচেতনতা,সামাজিক সুবিচার সমকালীন পৃথিবীকে স্তম্ভিত করেছিল। বিখ্যাত ঐতিহাসিক ও ফরাসী পর্যটক বার্নিয়ের এবং তাভার্নিবার। তারা উল্লেখ করেছেন-আওরঙ্গযেবের সাম্যবাদ অর্থনীতি ও শাসননীতি এত সুন্দর ছিল যা, যে কোন নিরপেক্ষ মানুষের মনকে আনন্দে বিস্ময়ে অভিভূত করে। কালমার্কসও ইতিহাসের এই অধ্যায় পড়ে অভিভূত ও মুগ্ধ হয়েছিলেন। একথা শ্রী বিনয় ঘোষও তার 'ভারতবর্ষের ইতিহাস' গ্রন্থে স্বীকার করেছেন। বিনয় বাবু লিখেছেন-'বার্নিয়েবের বিশ্লেষণ পাঠ করিয়া কালমার্কসের মত মনিষীও মুগ্ধ হইয়াছিলেন। (চেপে রাখা ইতিহাসঃ ১৩২-১৩৩ পৃ ,ভারতজনের ইতিহাস, পৃঃ ৪৮০)

মার্কিন ইতিহাসবিদ ট্রাশকার মতে, “এটা একটা ভুল ধারণা যে আওরঙ্গজেব হাজার হাজার হিন্দু মন্দির ধ্বংস করেছিলেন। তাঁর সময়ে এমন কোন ঘটনা ঘটেনি যাকে হিন্দুদের গণহত্যা হিসেবে বর্ণনা করা যেতে পারে। সত্যিকার অর্থে আওরঙ্গজেব হিন্দুদেরকে সরকারের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছিলেন।”

জিযিয়া কর প্রবর্তন তিনি করেন কারণ এটা ইসলামের আইন। অন্যদিকে সম্রাট আকবের প্রবর্তন করা অসংখ্য অবৈধ কর যেগুলো অমুসলিমদের উপর করা হয়েছিল সেগুলো তিনি রহিত করেন৷ তাহলে এসব অভিযোগের সত্যতা কতটুকু সেটা আমরা অনুমান করতেই পারি৷

মার্কিন ইতিহাসবিদ অড্রে ট্রাশকা তাঁর বই ‘আওরঙ্গজেব – দ্যা ম্যান অ্যান্ড দ্যা মিথ’ বইয়ে লিখেছেন যে আওরঙ্গজেব হিন্দুদের ঘৃণা করতেন আর তাই মন্দির ধ্বংস করেছেন বলে যে দাবী করা হয়, তা ভুল।

তিনি লিখেছেন, ব্রিটিশদের শাসনের সময় তাদের ‘ডিভাইড অ্যান্ড রুল’ অর্থাৎ জনগোষ্ঠীকে ‘বিভাজন আর শাসন করো’ নীতির আওতায় ভারতে হিন্দু বর্ণবাদী ধারণা উস্কে দেয়ার কাজটি করেছিলেন যেসব ইতিহাসবিদরা, তারাই মূলত: আওরঙ্গজেবের এমন একটি ইমেজ তৈরির জন্য দায়ী।

আওরঙ্গজেব ও সাহিত্য-কৃষ্টি
আওরঙ্গজেব যখন জন্ম নেন তখন সম্রাট ছিলেন তাঁর পিতামহ জাহাঙ্গীর। তিনি ছিলেন শাহ জাহানের তৃতীয় পুত্র। শাহ জাহান ছিলেন চার ছেলের পিতা, আর এদের সবার মা ছিলেন মমতাজ মহল। ইসলাম ধর্মীয় সাহিত্য চর্চার বাইরে তিনি তুর্কি সাহিত্য এবং বিভিন্ন পাণ্ডুলিপি পড়েছেন। অন্যসব মুঘল সম্রাটদের মতোই আওরঙ্গজেব ছোটবেলা থেকেই হিন্দিতে অনর্গল কথা বলতে পারতেন।

আওরঙ্গজেব ১৬৭৯ সালে দিল্লি ছেড়ে দক্ষিণ ভারতে চলে যান। মৃত্যুর আগে তিনি আর উত্তর ভারতে ফিরে আসেননি।

আওরঙ্গজেব তাঁর পুস্তক ‘রুকাত-ই-আলমগীরী’তে লিখেছিলেন যে দক্ষিণ ভারতে যেটির অভাব তিনি সবচেয়ে বেশী অনুভব করতেন, তা হলো আম। জামশেদ বিলিমোরিয়া এই বইটি অনুবাদ করেছেন। বাবর থেকে শুরু করে সব মুঘল সম্রাটই আম খুব পছন্দ করতেন।

ট্রাশকা লিখেছেন আওরঙ্গজেব নিয়মিতই তার সভাসদদের নির্দেশ দিতেন যে তাঁর জন্য যে উত্তর ভারতের আম পাঠানো হয়। কয়েকটা আমের হিন্দি নামকরণও করেছিলেন তিনি, যেমন সুধারস আর রসনাবিলাস ৷

১৭০৭ খ্রিস্টাব্দের ৩ মার্চ ৮৮ বছর বয়সে আহমেদনগরে তিনি ইন্তেকাল করেন। তাঁর মৃত্যুতে মুঘল সাম্রাজ্যের পতন শুরু হয়৷ ওয়াদিয়ে কিদ্দিস বা ঋষিদের উপত্যকা নামক কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হয়।(তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমতঃ ৪:৩৪৩)

ট্রাশকা লিখেছেন যে আওরঙ্গজেবকে দাফন করা হয়েছিল মহারাষ্ট্রের খুলদাবাদে একটি কাঁচা কবরে।
ঠিক এর বিপরীতে, হুমায়ূনের জন্য দিল্লিতে একটি লাল পাথরের মকবরা তৈরি করা হয়েছিল, আর সম্রাট শাহ জাহানকে দাফন করা হয়েছিল জাঁকজমকপূর্ণ তাজমহলে।

ওফাতপূর্ব অবস্থার বর্ণনা দিতে গিয়ে শামসুল উলামা যাকাউল্লাহ দেহলবী (রহ) লিখেছেন-
'শরীরের তাপ ছিল প্রচণ্ড। প্রবল অসুস্থতা সত্ত্বেও উত্তীর্ণ তাকওয়ার বলে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ জামাতের সাথে পড়তেন। একটি ওসিয়তনামা লিখেছেন। তাতে উল্লেখ করেছেন- টুপি সেলাই করে অর্জিত অর্থের অবশিষ্ট সাড়ে চার রুপি দিয়ে আমার কাফন-দাফনের ব্যবস্থা করবে। পাক কুরআনের কপি তৈরি করে অর্জিত অবশিষ্ট আটশ' পাঁচ রূপি গরীব দুঃখীদের মধ্যে বণ্টন করে দিবে।

কবি কাজী কাদের নেওয়াজ যথার্থই বলেছিলেন,
'আজ থেকে চির উন্নত হলো শিক্ষাগুরুর শির
সত্যই তুমি মহান উদার বাদশা আলমগীর'।

Address

Isolutions
Mirpur
1216

Alerts

Be the first to know and let us send you an email when Alor Kafela posts news and promotions. Your email address will not be used for any other purpose, and you can unsubscribe at any time.

Contact The Business

Send a message to Alor Kafela:

Videos

Share