28/11/2022
ছোটোবেলায় আব্বুর উপর একটা ক্ষোভ ছিলো। সবসময় কেমন একটা রাগী রাগী ব্যাপার ছিলো আব্বুর মধ্যে৷ ক্লাস ফোরের পর আর বাইরে খেলতে দেননি। কোনো বান্ধবীর বাসায় যেতে পারিনি কোনোদিন৷ এই দুইটাই ছিলো আব্বুর প্রতি ক্ষোভের বড়ো কারণ৷
একদম ভদ্রসভ্য মেয়ে বলতে যা বোঝায় আমি ছিলাম আগাগোড়া তাই। কিন্তু আমারও মাঝেমধ্যে একটু বাউন্ডুলে হতে ইচ্ছে করতো। আমারও একটু ঘুরতে যেতে ইচ্ছে করতো। বিশেষত, যে সময়টায় খেলা বন্ধ করে দিলো সেই সময়টায় ভয়ানক কষ্ট হতো আমার। এত একলা লাগতো! অথচ ইন্টারেও আব্বুর সাথে ব্যাডমিন্টন খেলেছি আমি। যদিও পারতাম না, তবুও আব্বু আগ্রহ নিয়ে খেলতেন আমাদের সাথে। গত ফুটবল বিশ্বকাপের আগের বিশ্বকাপটা কবে হলো? সেবার আমি আর আব্বু হৈহৈ করে খেলা দেখেছিলাম। এমনিতে ফুটবল ভালো লাগে না আমার। কোনো স্পেসিফিক পছন্দের দলও নেই। আব্বুরও নেই। তবে ম্যারাডোনাকে পছন্দ করতেন আগে। যা হোক, খেলা দেখার সময় মজার একটা ব্যাপার হতো আমাদের মধ্যে। আমি যেদিন যে দল সাপোর্ট করতাম আব্বু তার উল্টোটা করতেন। কারণ, সেইম দল করলে মজা নেই। এরপর আমার দল জিতে যাচ্ছে যাচ্ছে টাইপ ব্যাপার হলে আবার এই দলে চলে আসতেন। বলতেন, আমি তো এই দলেই ছিলাম। তুই নিলি বলে আমি ওই দলে গেলাম।
এত কিছুর পরও নষ্ট হয়েছিলাম আমি। এখন ভাবি, যদি আব্বুর শাসন না থাকতো, কোথায় যেতাম আমি? আব্বুকে দুপুরে বাসায় ফিরতে দেখলেই দৌড়ে বই নিয়ে বসতাম। নো ম্যাটার সময় কয়টা। দুপুর একটা হোক বা দুইটা, বইটা নিয়ে বসতাম। অন্য সময় কী করতাম সেটা বিষয় না। ওটা কেবল ভয় থেকেই করতাম, তা না। আব্বুকে খুশি করার জন্যও করতাম আসলে।
এখন বুঝি, এখন আমার মধ্যে, সুমির মধ্যে যেটুকু ভালো তা আব্বুর ওই রাগের কারণে। আমাদের কি মধ্যবিত্ত বলা যায়? একটা সময় তাই ছিলাম বোধহয়। এরপর বোধহয় নিম্ন মধ্যবিত্তেই নেমে গিয়েছিলাম। তবে মধ্যবিত্ত হোক বা নিম্নমধ্যবিত্ত, তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, আমরা যেখানটায় ছিলাম সেই জায়গাটা। আমাদের বাড়ির পাশেই গুচ্ছগ্রাম ছিলো৷ গুচ্ছগ্রাম জানেন তো? এরশাদ সরকারের আমলে প্রত্যেককে কিছু পরিমাণ জমি দিয়েছিল। আমার সঙ্গে যারা ছিলো, আমরা যারা একসঙ্গে খেলতাম, তারা কেউই বলার মতো কেউ কিছু হয়নি। আমিও কেউ হইনি আসলে। তবু মন্দের ভালো বলতে যা বোঝায় আমি তাই হয়েছি। আমার সময়কার কেউ এসএসসিও পেরোয়নি। আমাদের মধ্যে কখনো বন্ধুত্ব হয়নি। আমার কোনো বন্ধু ছিলো না। এখন বুঝি, বন্ধু হওয়ার মতো কেউ ছিলোও না আমার। পরিবেশের প্রভাবে আমরা ভিন্ন কিছুও হতে পারতাম। হইনি আলহামদুলিল্লাহ!
ওই একটা জায়গা থেকে আজকে আমি যেটুকু ভালো, যেটুকু অর্জন আমার সে আসলে ওই আব্বুর রাগের জন্যই। বারবার আব্বুর কথা আসছে কেন? আমার মা আসলে একটা মাটির মানুষ। মাকে আমরা ভীষণ ভীষণ ভালোবাসি, কিন্তু ভয় পাই না৷ আমার মা শাসন করতে জানেন না। তবু কেন যেন কোনোদিন মায়ের মুখের ওপর কোনো কথা বলতে পারিনি আমরা দু বোনই। মায়ের মতো যদি আব্বুও হতেন, আমরা সত্যি সত্যিই ভেসে যেতাম।
আব্বু কি সারাক্ষণ আমাদের সঙ্গে হম্বিতম্বি করতেন? মোটেই না। উদাহরণ তো দিলামই। সবসময় যা দিয়েছেন, বেস্টটা দিয়েছেন। খাবার হোক বা অন্য কোনো জিনিস, আব্বু তার লেভেলের বাইরে গিয়ে দিয়েছেন। আব্বু ব্যালেন্স করতে জানতেন। ব্যালেন্স করাটা জরুরি ভীষণ।
কোনো ছেলে কাজিনের সাথে মেশাও পছন্দ করতেন না আব্বু। তিনি নিজে ওদের ভীষণ ভালোবাসতেন কিন্তু আমাদের হাতাহাতি, মারামারি, গলাগলি পছন্দ করতেন না। একদম শৈশবের কথা বলছি আমি। মোট কথা, বেশ শাসনের সঙ্গে বড়ো হয়েছি আমরা। এখন বুঝি, আমার সদা হাস্য আব্বুটা কেন অমন রাগী রাগী একটা ভাব নিয়ে চলতেন। আব্বু ভীষণ বিচক্ষণ ছিলেন। কেমন যেন, মানুষের চেহারার সূক্ষ্ম এক্সপ্রেশন দেখে বুঝে যেতেন অনেক কিছু। আব্বু বুঝতেন, এই পৃথিবীটা তার মেয়েদের জন্য মোটেই সেইফ না। তিনিসহ মাত্র দুই তিনটা পুরুষ ছাড়া তার মেয়েরা কোনো পুরুষ, ছেলে, বালকের কাছে সেইফ না। এই দুই তিনটা মানুষ ছাড়া আর কারো কাছে কোনোদিন ছাড়েননি আমাদের। আমার বান্ধবীরা সবাই এসএসসি পরীক্ষা দিতে একাই যেত। আর আব্বু? চাকরিই ছেড়ে দিয়েছিলেন, আমাকে আনা নেওয়া করার জন্য। এতগুলো দিন তো আর ছুটি দেবে না। আমার খুব ইচ্ছে করতো, সবার মতো আমিও একা যাই। আমি তো বড়ো হয়েছি নাকি? কিন্তু আব্বু জানতেন, এই দেশে পাঁচ বছরের বাচ্চা বা আশি বছরের বুড়ি কেউ সেইফ না এদেশে। পনের বছরের কিশোরী তো হট কেক।
আব্বুর প্রতি সেই ক্ষোভ শ্রদ্ধায়, ভালোবাসায় রূপ নিয়েছে আরো সাত বছর আগে। সেই দূরত্ব ভেঙে গিয়েছে আজ থেকে সাত বছর আগে। কিন্তু সেটা আর বোঝাতে পারিনি আমি। আল্লাহ আমাকে সময় বা সুযোগ কোনোটাই দেননি।
আমরা ভাবি, আমাদের বাবা-মায়েরা আমাদের বোঝেন না একদম, ভীষণ ব্যাকডেটেড তারা৷ কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তাদের মতো এত ভালো কেউ বোঝেন না আমাদের। আমরা ভাবি, আমরা সব বুঝি। কিন্তু আমরা আসলে কিছুই বুঝি না। বয়স তাদের যতখানি শিখিয়েছে, তারা যতখানি দেখেছেন আমরা ততখানি দেখিনি, শিখিওনি। আমাদের প্রতি ভালোবাসা তাদেরকে যতখানি কনসার্ন করে, আমরা নিজেরাও আমাদের নিয়ে ততখানি কনসার্ন হতে পারিনি। কারণ, আসলেই তারা আমাদের চাইতে ভালো জানেন, বোঝেন এবং আমাদের ভালো আমাদের চাইতেও বেশি তারা চান।
যাদের বয়স কম তাদের বলছি; আপনি যদি শাসনে থাকেন, আপনার যদি মনে হয় আপনার বাবা-মা বেশি বেশি করেন তো আল্লাহকে থ্যাংক্স দিন। একবার আলহামদুলিল্লাহ বলুন। কারণ আপনার বাবা-মা আপনার জন্য অন্য অনেক বাবা-মায়ের চাইতে বেশি কনসার্ন৷ এই রেসের যুগে তারা ছোটা বাদ দিয়ে আপনার পেছনে পড়ে আছেন যদিও আপনার মনে হচ্ছে, আপনি বড়ো হয়ে গেছেন। কিন্তু ট্রাস্ট মি, এমন একদিন আসবে যেদিন আপনি এই শাসনটা খুঁজে বেড়াবেন কিন্তু কোত্থাও আর পাবেন না। মানু্ষটাই যে আর থাকবে না। থাকবে শুধুই আফসোস আর আফসোস।
আপনারা যারা বাবা-মা আছেন, আপনাদের বলব, দেখছেনই তো চারিপাশে কী হচ্ছে। কেবল মেয়ে সন্তানের বাবা-মা হলেই না। মেয়েদের বেলায় অবশ্যই এক্সট্রা কনসার্ন থাকতে হবে। কিন্তু ছেলে সন্তানও সেইফ না। ছেলেদের সঙ্গেও অনেক অ্যাবিউজের ঘটনা ঘটে। সন্তানের চাইতে গুরুত্বপূর্ণ তো কেউ হয় না! সন্তানের জন্য আপাতদৃষ্টিতে একটু টক্সিক হোন। এটার দরকার আছে খুব। আপনার সন্তানের জন্যই দরকার আছে। একদম ছোট্টো বাচ্চাকেও যার তার কাছে দেবেন না। আমি নিজেই রাস্তাঘাটে পর্যন্ত বাচ্চা দেখলেই আদর করি৷ আমার মুখে এ কথা মানায় না। তবু বলব, নিজের বাচ্চার সেইফটি আপনার নিজেকেই দেখতে হবে। আর কেউ দেখবে না। আজকে ফুটফুটে আয়াতকে মেরে ফেলল। কালকে সেইম ঘটনা যে আপনার আমার সাথে ঘটবে না, তা কিন্তু কেউ বলতে পারে না। শুধুই কী মেরে ফেলা? আমি জানি, আমার এই পোস্ট যারা পড়ছেন, তাদের অনেকেই ছোটোবেলায় অ্যাবিউজের শিকার হয়েছেন। নিজে কতখানি ট্রমার মধ্য দিয়ে গিয়েছেন একবার মনে করুন। আমাদের বাচ্চারা যেন এই ট্রমার মধ্য দিয়ে না যায় সেই খেয়ালটা যেন আমরা রাখি৷ একটু না হয় টক্সিকই হই। অতো আধুনিক হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। তাছাড়াও নিজের ছেলে সন্তানটি যেন বড়ো হয়ে অন্য কারো ট্রমার কারণ না হয়, সে শিক্ষাটা দেওয়ারও তো দরকার আছে।
রব্বির হাম হুমা ক্বমা রব্বাইয়ানি সাগিরা...