10/06/2019
এক বিঘত সরে গেলে জাহান্নামের জ্বালানী পাথর
আজ আমরা সবাই আমল নিয়ে ব্যস্ত। আমল যেন নিখুঁত হয়, আমলে যেন কোন ত্রুটি না থাকে সেজন্য আমরা সদা সর্বদা সজাগ সতর্ক থাকি। দীর্ঘ সময় ব্যয় করে হলেও আমরা চেষ্টা করি সহীহ শুদ্ধভাবে যেন আমলগুলো করা যায়। এই যেমন রোজার মাসে আমরা সবাই রোজা রাখি। রোজা যেন না ভাঙে, রোজা যেন হালকা হয়ে না যায় সে জন্য আমরা ঘড়ি দেখে ঠিক সময়ে উঠে সেহরী খাই, আবার মাগরিবের আযান পর্যন্ত অপেক্ষা করি, আযান ঠিকভাবে শোনার পর ইফতার করি।
আবার অনেকে রোজার ক্ষতির কথা ভেবে সুগন্ধি ব্যবহার থেকেও দূরে থাকি। দুনিয়াবি কাজ স্তিমিত রেখে হলেও আমরা চেষ্টা করি রোজায় যেন ব্যাঘাত না ঘটে। আবার ধরুন নামাজ। আমরা সবাই সহীহভাবে নামাজ আদায় করতে চেষ্টা করি। সেজন্য আমরা খুব নিখুঁতভাবে ওজু করি। এত নিখুঁতভাবে সুন্নাত, মুস্তাহাবগুলো পালন করি যেন নাকের একটা পশমও যেন শুকনো না থাকে। যদিও এটি বাধ্যতামূলক নয়। তবুও করি। এভাবে আমরা প্রতিদিন প্রতিনিয়ত বহু আমল করে যাচ্ছি।
কিন্তু আমাদের এই সব গুরুত্বপূর্ণ আমলগুলো ব্যর্থ হয়ে যাবে যদি না আমরা আল্লাহর রসুলের (সা.) উপর অর্পিত সত্যদীন প্রতিষ্ঠার কর্মসূচিটি সামষ্টিক জীবনে প্রয়োগ না করি। এর কথাই রসুলাল্লাহ বলেছিলেন যে, “এমন একটা সময় আসবে যখন তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া কেবল ঘুম নষ্ট করা হবে আর রোযা রাখা না খেয়ে থাকা হবে (হাদিস, ইবনে মাজাহ, আহমাদ, তাবারানী, দারিমি, মেশকাত)”। অর্থাৎ আমাদের শত আমলও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হবে। কিন্তু কেন? এই কেন এর উত্তর জানার জন্য আমাদের ১৪০০ বছর আগে ফিরে যেতে হবে।
মানবজীবনে ন্যায়, সুবিচার, শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহ তাঁর শেষ রসুলকে একটি জীবনব্যবস্থা দিলেন। সেই জীবনব্যবস্থা সামষ্টিক জীবনে প্রয়োগের ফলে আরবের ওই অজ্ঞ, মূর্খ, অশিক্ষিত, উপেক্ষিত, বর্বর মানুষগুলো সোনার মানুষে রূপান্তরিত হয়ে গিয়েছিল। জ্ঞানে-বিজ্ঞানে, সামরিক শক্তিতে তারা শিক্ষকের আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সময়ের দুই পরাশক্তি রোম ও পারস্যকে পরাভূত করে ফেলেছিল ওই ছোট আরবজাতিটি।
এজন্যই আল্লাহ বলেছেন, ‘আমি আমার রসুলকে সঠিক পথ প্রর্দশন (হেদায়াহ) এবং সত্যদীন দিয়ে প্রেরণ করলাম এই জন্যে যে তিনি যেন একে (এই হেদায়াহ ও জীবনব্যবস্থাকে) পৃথিবীর অন্যান্য সমস্ত জীবনব্যবস্থার উপর বিজয়ী করেন (সুরা ফাতাহ-২৮, সুরা তওবা-৩৩ ও সুরা সফ-৯)। আবার আল্লাহর রসুল (সা.) বলেছেন- “আমি আদিষ্ট হয়েছি মানব জাতির বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সংগ্রাম চালিয়ে যেতে যে পর্যন্ত না সমস্ত মানুষ আল্লাহকে একমাত্র এলাহ এবং আমাকে তাঁর রসুল বলে মেনে নেয় (হাদীস- আবদাল্লাহ বিন ওমর (রা.) থেকে- বোখারী, মেশকাত)”।
এখন কথা হচ্ছে, এই যে আল্লাহ তার রসুলকে একটি জীবনব্যবস্থা দিলেন, কিন্তু এই জীবনব্যবস্থা প্রয়োগ করার জন্য তিনি কোন কর্মসূচি দিবেন না তা তো হয় না। রসুলাল্লাহর হাতে গড়া উম্মতি মোহাম্মদী জাতিটি নিশ্চয় নিজেদের মনগড়া কর্মসূচি দিয়ে অর্ধ দুনিয়ায় শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন নি। তাহলে কী সেই কর্মসূচি? মানবজীবনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য যে নীতি আল্লাহ তাঁর রসুলকে দিয়েছেন সেই নীতির উপর ভিত্তি করে একটি পাঁচদফা কর্মসূচি তিনি তাঁর রসুলকে দান করলেন। ‘এই ৫ দফা কর্মসূচি তিনি তাঁর উম্মাহর উপর অর্পণ করার সময় বলছেন, এই কর্মসূচি আল্লাহ আমাকে দিয়েছেন, (আমি সারাজীবন এই কর্মসূচি অনুযায়ী সংগ্রাম করেছি) এখন এটা তোমাদের হাতে অর্পণ করে আমি চলে যাচ্ছি’।
সেগুলো হলো:
(১) ঐক্যবদ্ধ হও।
(২) (নেতার আদেশ) শোন।
(৩) (নেতার ঐ আদেশ) পালন কর।
(৪) হেজরত কর (যাবতীয় শেরক ও কুফরের সম্পৃক্ততা পরিহার করা)।
(৫) (এই দীনুল হককে পৃথিবীতে প্রতিষ্ঠার জন্য) আল্লাহর রাস্তায় জেহাদ কর।
যে ব্যক্তি (কর্মসূচির) এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হল, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু (বন্ধন) খুলে ফেলল- যদি না সে আবার ফিরে আসে (তওবা করে) এবং যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামাজ পড়লেও এবং রোজা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানী পাথর হবে [আল হারিস আল আশয়ারী (রা.) থেকে আহমদ, তিরমিযি, বাবউল এমারাত, মেশকাত]।
অর্থাৎ প্রথম দায়িত্ব হচ্ছে ঐক্যবদ্ধ হওয়া। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, আল্লাহ ছাড়া আর কারো হুকুম মানি না এই কথার উপর পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। তারপর কর্মসূচীর দ্বিতীয় দফা হচ্ছে, শোনা। ওই ঐক্যবদ্ধ জাতির একজন নেতা থাকবে, যার কথা ওই জাতির সকলে শুনবে। তৃতীয় দায়িত্ব হচ্ছে, আনুগত্য। অর্থাৎ ওই ঐক্যবদ্ধ জাতিটি তাদের নেতার সকল কথা শুনে তা পালন করবে। শর্তহীন, প্রশ্নহীন, দ্বীধাহীন আনুগত্য করবে। চতুর্থ দায়িত্ব হচ্ছে, হেজরত। অর্থাৎ যাবতীয় অন্যায়, অসত্যের, শেরক, কুফর থেকে নিজেকে তারা মুক্ত করবে। পঞ্চম দায়িত্ব হচ্ছে, সংগ্রাম করা। অর্থাৎ যাবতীয় অন্যায়, অসত্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করা। আল্লাহর সত্যদীনকে বিজয়ী করার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা করা।
এই পাঁচটি কর্মসূচিকে তারা ধারণ করে আল্লাহর রসুলের (সা.) হাতে গড়া জাতিটি আল্লাহর তওহীদ অর্থাৎ সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়লো। তারপর তারা একে একে প্রায় অর্ধ-দুনিয়া ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে নিয়ে আসলো। কিন্তু এরপর ঘটলো মহাদূর্ভাগ্যজনক ঘটনা। জাতি তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্য ভুলে গেল। তারা আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাদ দিয়ে রাজা-বাদশাহদের মতো ভোগ বিলাসিতায় নিজেদের ডুবিয়ে দিল। আল্লাহর দেওয়া এই কর্মসূচিকে ভুলে গিয়ে তারা জাতির ঐক্যে ভাঙন ধরালো।
দীনের সহজ সরল বিষয়গুলো নিয়ে তারা সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম ব্যাখা বিশ্লেষণ করে করে জাতিকে বিভিন্ন ফেরকা মাজহাবে বিভক্ত করে খ- বিখ- করে ফেলল। আল্লাহ পূর্বেই কোর‘আনে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেছিলেন যে, যদি তোমরা (সত্য প্রতিষ্ঠার) অভিযানে বের না হও, তবে তিনি তোমাদেরকে মর্মন্তুদ শাস্তি দিবেন এবং অপর জাতিকে তোমাদের স্থলাভিষিক্ত করবেন। (সুরা তওবা ৩৮-৩৯)। তাঁর কথা মোতাবেক এই জাতিকে অন্য জাতির গোলামে পরিণত করলো। এরপর একে একে বিভিন্ন জাতি এসে তাদের ধ্বংস করে দিলো, তাদের ভূখ- কেড়ে নিল, তাদের নারীদের ধর্ষণ করল।
আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচি ও জীবনব্যবস্থা প্রত্যাখানের ফলে পুরো জাতি অন্য জাতির গোলাম, পদানত দাসে পরিণত হলো।
সেই থেকে আজ পর্যন্ত এই জাতি অন্য জাতির দয়া, অনুগ্রহে, লাথি মার খেয়ে, অন্য জাতির অনুকম্পা নিয়েই বেঁচে আছে। এই জাতিকে রক্ষা করার জন্য, ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য বহু আন্দোলন, দল, ফেরকা ইত্যাদি গড়ে উঠেছে। তারা তাদের আদর্শ, মতবাদ দিয়ে মানুষকে প্রভাবিত করেছেন, ইসলাম প্রতিষ্ঠার সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়েছেন। অনেকে নিজেদের জীবনও দিয়ে দিয়েছেন কিন্তু তারা কেউই সফল হতে পারে নি। কেউই আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে পারে নি।
এর কারণ হিসেবে বলা যায়, ওই যে আল্লাহর দেওয়া এই পাঁচদফা কর্মসূচি, যে কর্মসূচিকে ধারণ করে উম্মতে মোহাম্মদী জাতিটি অর্ধদুনিয়ায় ইসলাম প্রতিষ্ঠা করেছিল, সেই কর্মসূচিটি অনুসরণ না করা। অর্থাৎ এখানে একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, আল্লাহর সত্যদীন প্রতিষ্ঠার জন্য আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচি অপরিহার্য। যেহেতু সেই সমস্ত দল তাদের নীতি হিসেবে আল্লাহর দেওয়ার কর্মসূচির বদলে তাদের নিজেদের মনগড়া কর্মসূচি নিয়েছে তাই তারা তাদের কাজে কোন সফলতা পাই নি, আল্লাহর সাহায্যও লাভ করে নি।
বিগত চৌদ্দশ বছরে ক্রমাগত বিকৃত হতে হতে আল্লাহর রসুলের প্রকৃত ইসলাম আজ হারিয়ে গেছে। বাহ্যিক দিক থেকে এই ইসলাম আল্লাহ রসুলের (সা.) ইসলামের মতো হলেও আকিদা, চরিত্রে ও আত্মায় সম্পূর্ণ বিপরীত। কেননা পুরো জাতি সম্মিলিতভাবে আল্লাহর দেওয়া জীবনব্যবস্থা তাদের সামষ্টিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক জীবন থেকে প্রত্যাখান করেছে, তারা আল্লাহর দেওয়া কর্মসূচিকে বাদ দিয়ে নিজেদের মনগড়া কর্মসূচিকে ধারণ করেছে। এই অবস্থায় জাতি যত আমল করুক, যতই নামাজ, রোজা, হজ, যাকাত করুক না কেন কোন কিছুই কাজে আসবে না। কোনো রকমের আমলই আল্লাহর দরবারে কবুল হবে না।
কারণ আল্লাহর দেওয়া সত্যদীনকে প্রত্যাখানের ফলে জাতি কার্যত কাফের, মোশরেকে পরিণত হয়েছে। এজন্যই রসুলাল্লাহ বলেছেন- যে ব্যক্তি এই ঐক্যবন্ধনী থেকে এক বিঘত পরিমাণও বহির্গত হল, সে নিশ্চয় তার গলা থেকে ইসলামের রজ্জু খুলে ফেলল- যদি না সে আবার ফিরে আসে। আর যে ব্যক্তি অজ্ঞানতার যুগের (কোনও কিছুর) দিকে আহ্বান করল, সে নিজেকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করলেও, নামাজ পড়লেও এবং রোজা রাখলেও নিশ্চয়ই সে জাহান্নামের জ্বালানী পাথর হবে।
মনে রাখতে হবে, এই হাদিসটি অমুসলিমদের প্রসঙ্গে বলা হয়নি, বরং এমন মুসলিম যারা নামাজ পড়ে, রোজা রাখে এবং নিজেদেরকে মুসলিম বলে বিশ্বাস করে তাদের প্রসঙ্গে বলা হয়েছে। আমরা এত গুরুত্বপূর্ণ একটি হাদিসকে একেবারে এড়িয়ে সারাজীবন হাজারো আমলের পাহাড় গড়ে তুলছি অথচ পাঁচ দফার একটি দফাতেও আমরা নেই। আল্লাহর রসুল অপর একটি হাদিসে দীনের পাঁচটি বুনিয়াদি বিষয়ের তালিকা দিয়েছেন। সেটা হলো- ইসলামের বুনিয়াদ পাঁচটি- ঈমান (তওহীদ), সালাত, যাকাত, হজ্ব, সওম। ঠিক তেমনি এই হারিস আল আশয়ারি (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসটিতে তিনি আরো পাঁচটি কাজের তালিকা দিয়েছেন এবং বলে দিয়েছেন এর থেকে আধ হাত সরে গেলেও একজন মানুষ আর মুসলমান থাকবে না। তাহলে কত গুরুত্বপূর্ণ এই হাদিস।
হেযবুত তওহীদের প্রতিষ্ঠাতা এমামুয্যামান জনাব মোহাম্মদ বায়াজীদ খান পন্নী এই হাদিসটিকেই ইসলাম প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি হিসাবে চিহ্নিত করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন তাঁর বইয়ে বক্তব্যে। রসুলাল্লাহর গোটা কর্মজীবন পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যাবে এই কর্মসূচির পাঁচটি দফাই তিনি জাতির মধ্যে গেড়ে দেওয়ার চেষ্টা করে গেছেন। একটি জাতি, একজন নেতা, পিঁপড়ার মতো শৃঙ্খলা, মালায়েকের মতো আনুগত্য, দুর্বার সংগ্রাম এই ছিল উম্মতে মোহাম্মদীর জীবন ইতিহাস। আমাদের জীবনযাত্রার সঙ্গে সেই জাতির জীবনযাত্রার ন্যূনমত মিলও নেই। আমরা কেবল মিল করার চেষ্টা করছি দাড়িতে, লেবাসে যেগুলো আদৌ রসুলাল্লাহর মিশনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়।