পূর্বে কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার (বর্তমানে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে) অন্তর্ভুক্ত ছিল। ১৮৬৯ সালে কুষ্টিয়ায় একটি পৌরসভা প্রতিষ্ঠিত হয়। হ্যামিলটন'স গেজেট প্রথম কুষ্টিয়া শহরের কথা উল্লেখ করে।
বাউল সম্রাট লালন শাহের মাজার কুষ্টিয়া সদরে অবস্থিত
অবশ্য কুষ্টিয়া কোনো প্রাচীন নগর নয়। সম্রাট শাহজাহানের রাজত্বকালে এখানে একটি নদীবন্দর স্থাপিত হয়। যদিও ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ বন্দর বেশি ব্যবহার করত, তব
ুও নীলচাষী ও নীলকরদের আগমনের পরেই নগরায়ন শুরু হয়। ১৮৬০ সালে কলকাতার (তৎকালীন ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর রাজধানী)সাথে সরাসরি রেললাইন স্থাপিত হয়। একারণে এ অঞ্চল শিল্প-কারখানার জন্য আদর্শ স্থান বলে তখন বিবেচিত হয়েছিল। তৎকালীন সময়ে যজ্ঞেশ্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কস(১৮৯৬), রেনউইক এন্ড যজ্ঞেশ্বর কোম্পানী (১৯০৪) এবং মোহিনী মিলস (১৯১৯) প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৪৭-এ ভারতবর্ষ ভাগের সময় কুষ্টিয়া পৃথক জেলা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। এর সাবডিভিশন ছিল কুষ্টিয়া সদর, চুয়াডাঙ্গা ও মেহেরপুর। তৎকালীন এস ডি ও মৌলভি আব্দুল বারী বিশ্বাস কে প্রধান করে ১৯৫৪ সালে গঙ্গা-কপোতাক্ষ প্রকল্পের সদর দপ্তর স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু সরকারী অফিস কুষ্টিয়ায় স্থাপনের পরে শহরটিতে পুনরায় উন্নয়ন শুরু হয়।
ভৌগোলিক সীমানা
কুষ্টিয়া জেলার আয়তন ১৬২১.১৫ বর্গকিলোমিটার। এর উত্তরে রাজশাহী, নাটোর ও পাবনা, দক্ষিণে চুয়াডাঙ্গা ও ঝিনাইদহ জেলা, পুর্বে রাজবাড়ী এবং পশ্চিমে পশ্চিমবঙ্গ ও মেহেরপুর জেলা অবস্থিত।
কুষ্টিয়ার প্রধান নদী পদ্মা, গড়াই, মাথাভাঙ্গা, কালীগঙ্গা ও কুমার। এখানে গড় সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৩৭.৮°সে এবং গড় সর্বনিন্ম তাপমাত্রা ১১.২°সে। বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত ১৪৬৭ মি.মি.।
প্রশাসন
কুষ্টিয়া জেলা ৬টি উপজেলা, ৪টি পৌরসভা, ৩৯টি ওয়ার্ড, ৭০টি মহল্লা, ৬১টি ইউনিয়ন পরিষদ, ৭১০টি মৌজা ও ৯৭৮টি গ্রামে বিভক্ত। উপজেলাগুলো হলো:
কুমারখালী উপজেলা
কুষ্টিয়া সদর উপজেলা
খোকসা উপজেলা
দৌলতপুর উপজেলা
ভেড়ামারা উপজেলা
মীরপুর উপজেলা
জনসংখ্যা
কুষ্টিয়া জেলার জনসংখ্যা ১৭,১৩,২২৪ জন, যার মধ্যে ৫০.৮৬% পুরুষ ও ৪৯.১৪% মহিলা। জনসংখ্যার ৯৫.৭২% মুসলিম, ৪.২২% হিন্দু ও ০.০৬% অন্যান্য ধর্মালম্বী।
শিক্ষা
কুষ্টিয়ায় ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত।
অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মধ্যে রয়েছেঃ
মেডিক্যাল কলেজঃ ১
সরকারি কলেজঃ: ৩
বেসরকারি কলেজঃ: ৩০
সরকারি উচ্চবিদ্যালয়ঃ ৩
বেসরকারি উচ্চবিদ্যালয়ঃ ১৭৩
বেসরকারি নিম্ন বিদ্যালয়ঃ ৩৮
সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ ৩৩০
বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ঃ ২৭৫
কিন্ডারগার্টেনঃ ৩৯
মাদ্রাসাঃ ৩৭
কারিগরী প্রশিক্ষণ কেন্দ্রঃ ২
আইন কলেজঃ ১
প্রতিবন্ধীদের বিদ্যালয়ঃ ১
শিক্ষক প্রশিক্ষণ কেন্দ্রঃ ২
উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: মিশন প্রাথমিক বিদ্যালয় (স্থাপিত ১৮৯৮), কুষ্টিয়া সরকারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ (স্থাপিত ১৯৪৭), কুষ্টিয়া ইসলামিয়া কলেজ (স্থাপিত ১৯৬৮), কুষ্টিয়া হাই স্কুল এবং কুষ্টিয়া জিলা স্কুল (স্থাপিত ১৯৬০)।
বৃহত্তর কুষ্টিয়া
ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ থেকে কুষ্টিয়া কয়েকটি সাবডিভিশন নিয়ে গঠিত একটি বড় জেলা, যার প্রতিটি সাবডিভিশন পরবর্তীতে জেলা হয়েছে। কিন্তু এই তিন জেলা চুয়াডাঙ্গা, মেহেরপুর ও কুষ্টিয়ার মানুষের কাছে বৃহত্তর কুষ্টিয়া শুধুই একটি অতীত নয়, আরও কিছু। বিশেষভাবে উল্লেখ করা যায় যে, এই অঞ্চলের ও অবিভক্ত নদীয়া জেলার আদি বাসিন্দাদের মুখের ভাষার সাথে আধুনিক প্রমিত বাংলার ঘনিষ্ঠ মিল পাওয়া যায়। এই তিন জেলার আধিবাসীদের বৃহত্তর সমাজকে বৃহত্তর কুষ্টিয়া জেলা বলা হয়। বিভিন্ন সংস্থা যেমনঃ "বৃহত্তর কুষ্টিয়া এসোসিয়েশন", "বৃহত্তর কুষ্টিয়া সমাজ" এই তিন জেলার জনগনের উন্নয়নে কাজ করে যাচ্ছে।
কৃষি
বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলের মত কুষ্টিয়াতেও প্রধানত ধান, পাট, আখ, ডাল, তৈলবীজ ইত্যাদি চাষ করা হয়। তবে জেলাটিতে তামাক ও পানের চাষও লক্ষণীয়।
অর্থনীতি
বাংলাদেশের অন্যান্য বিভিন্ন অঞ্চলের মতো কুষ্টিয়া কেবল চাষাবাদের উপর নির্ভরশীল নয়। চাষাবাদের পাশাপাশি কুষ্টিয়ায় শিল্প কারখানা গড়ে উঠেছে। কুষ্টিয়ায় অনেক তামাকের কারখানা রয়েছে। এর মধ্যে নাসির টোব্যাকো লিমিটেড ও ব্রিটিশ-আমেরিকান টোব্যাকো উল্লেখযোগ্য। বাংলাদেশের বৃহত্তম বৈদ্যুতিক তার তৈরির কারখানা বি.আর.বি. কেবলস কুষ্টিয়ায় অবস্থিত। জেলার কুমারখালি উপজেলায় গড়ে উঠেছে উন্নতমানের ফ্রেব্রিকস শিল্প। এখানে উৎপাদিত ফ্রেব্রিকস সামগ্রী দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া কুষ্টিয়ায় অসংখ্য চালের মিল রয়েছে। বিভিন্ন কলকারখানা গড়ে ওঠায় এককভাবে কৃষিকাজের উপর নির্ভরতা কম।
চিত্তাকর্ষক স্থান
কুষ্টিয়া একটি প্রাচীন জনপদ। পূর্বে কুষ্টিয়া নদীয়া জেলার একটি মহকুমা ছিল। এ কারণে দেখার মত অনেক স্থান কুষ্টিয়ায় রয়েছে।
রবীন্দ্রনাথের কুঠিবাড়ী: শিলাইদহের কুঠিবাড়ী রবীন্দ্রনাথের স্মৃতিবিজড়িত। এখানে আম্রকাননে কবিগুরু অনেক গান ও কবিতা রচনা করেছেন। সংস্কারের অভাবে বর্তমানে কূঠিবাড়ীর অবস্থা খারাপ। তবুও কবিপ্রেমীরা এখানে এসে কবি সম্পর্কে অনেক কিছু জানতে পারবেন। কুঠিবাড়ীটি বর্তমানে জাদুঘর হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে।
ফকির লালন শাহের মাজার: বাংলার বাউল সম্রাট ফকির লালন শাহ এই কুষ্টিয়া জেলার ছেঁউড়িয়াতে জন্ম গ্রহন ও কর্ম সম্পাদন করেছিলেন । তার মাজার বর্তমানে বাউলদের আখড়া হিসেবে পরিচালিত আছে । লালন ভক্তের কাছে তাই অঞ্চলটি পূণ্যভূমি রূপে পরিগণিত।
পাকশী রেল সেতু:
বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রেল সেতু পাকশী রেল সেতু কুষ্টিয়ার ভেড়ামারায় আছে। হার্ডিঞ্জ ব্রীজ সেতুর একটি স্প্যান ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় বিমানের গোলায় ধ্বংস হয়ে যায়।
বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব
১. সাধক লালন ফকির: ধারনা করা হয় বর্তমান কুমারখালী থানার চাপড়া-ভাঁড়রা গ্রামে তার জন্ম আনুমানিক জন্ম -১৭৭৪ ইং, মৃত্যু- ১৮৯০ ইং।তিনি তাঁর বাউল গানের জন্য বিখ্যাত। তাঁর বাঁধা মরমী গানগুলো আজ সারা বিশ্বে সমাদৃত।
২.প্যারী সুন্দরী: মিরপুর উপজেলার সদরপুরের অধিবাসী। জন্ম-১৮০০, মৃত্যু-১৮৭০। নীলকর টমাস আইভান কেনির কৃষকদের উপর অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষক আন্দোলন করেন।
৩. কাঙ্গাল হরিনাথ মজুমদার: জন্ম কুমারখালী১৮৩৩ ও মৃত্যু-১৮৯৬ । একাধারে সাময়িক পত্রসেবী , সমাজ বিপবী ও বাউল কবি ছিলেন। তাঁর রচিত বিজয়বসন্ত বাংলা ভাষা সাহিত্যের উল্লখযোগ্য গ্রন্থ।
৪. মোহিনী মোহন চক্রবর্তী: কুমারখালী এলঙ্গী গ্রামেজন্ম-১৮৩৮ ও মৃত্যু-১৯২১। তিনি একাধারে চাকুরীজীবি ও ব্যবসায়ী ছিলেন । তিনি চক্রবর্তী এন্ড সন্স নামে পূর্ববাংলার সর্ববৃহৎ কাপড়ের কল নির্মান করেন।
৫.গগন হরকরা: অনুমান করা হয় কুমারখালী শিলাইদহের গোবরখালী কসবা গ্রামে তার জন্ম। আনুমানিক জন্ম-১৮৪৫মৃত্যু-১৯১০। ডাকহরকরা ও পিওন হওয়া সত্বেও গানে পারদর্শী ছিলেন। তার লিখিত ‘আমি কোথায় পাব তারে ,আমার মনের মানুষ যেরে’ গানটির আঙ্গীক ও সুরের অনুসরনে রবীন্দ্রনাথ জাতীয় সঙ্গীত রচনা করেন।
৬.মীর মশাররফ হোসেন: কুমারখালী থানার লাহিনীপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম । জন্ম-১৮৪৭,মৃত্যু-১৯১১। বাংলা সাহিত্যে তাঁর অবদান অনসীকার্য। তাঁর সবচেয়ে জনপ্রিয় গ্রন্থ ‘‘বিষাদ সিন্ধু’’।
৭.অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়: মিরপুর থানার শিমুলিয়া গ্রামেজন্ম-১৮৬১, মৃত্যু-১৯৩০। ইতিহাসবিদ,আইনজীবি ও সাহিত্যিক। তাঁর আলোচিত দু’টি গ্রন্থ হচ্ছে সিরাজদ্দৌলা ও মীর কাশিম। বিজ্ঞান সম্মত প্রণালীতে বাংলা ভাষায় ইতিহাস রচনায় পথিকৃত।
৮.যতীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় ওরফে বাঘা যতীন: কুমারখালী থানার কয়া গ্রামেজন্ম-১৮৭৯, মৃত্যু-১৯১৫। দেশকে ইংরেজের কবল থেকে মুক্ত করতে এই স্বদেশী নেতা সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করেন।
৯.ড. রাধা বিনোদ পাল: কুষ্টিয়ার সেলিকপুর গ্রামে জন্ম।জন্ম-১৮৯৬,মৃত্যু- ১৯৬৭। তিনি আইন সম্পর্কিত বহু গ্রন্থের রচনা করেন। এছাড়া তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আন্তর্জাতিক সামরিক আদালতের বিচারক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেন।
১০.ড.কাজী মোতাহার হোসেন: কুমারখালী উপজেলার লক্ষিপুর গ্রামে তাঁর জন্ম।জন্ম- ১৮৩৭,মৃত্যু- ১৯৮১। একাধারে সাহিত্যিক,শিক্ষাবিদ,সঙ্গীতজ্ঞ ও দাবাড়ু ছিলেন।১৯৬৬ সালে বাংলা একাডেমী ও ১৯৭৯ সালে স্বাধীনতা পুরুষ্কার লাভ করেন।
১১.মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা: পৈতৃকনিবাস কুমারখালী উপজেলার নিয়ামতবাড়ীয়া গ্রামে।জন্ম- ১৯০৬, মৃত্যু- ১৯৭৭।বাঙ্গালী মুসলিম মহিলাদের মধ্যে প্রথম সনেট ও গদ্য ছন্দে কবিতা লিখেছেন।বাংলা একাডেমী সাহিত্য পুরুষ্কার ১৯৬৭ এবং একুশে পদক ১৯৭৭।
১২. আজিজুর রহমান:কুষ্টিয়া থানার হাটশহরিপুর গ্রামেজন্ম- ১৯১৪, মৃত্যু-১৯৭৮।একাধারে কবি, গীতিকার ও কুষ্টিয়ার ইতিহাস সন্ধানী। তার রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ২০০০।১৯৭৯ সালে একুশে পদক পান।
১৩.আকবর হোসেন: কুমারখালী উপজেলার কয়া গ্রামে জন্ম- ১৯১৭, মৃত্যু- ১৯৮১।তিনি ছিলেন জনপ্রিয় উপন্যাসিক। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে অবাঞ্জিত,কি পাইনি,নতুন পৃথিবী প্রভৃতি।
১৪. রোকনুজ্জামান দাদাভাই: কুষ্টিয়ার ভেড়ামারা থানায় জন্ম- ১৯২৫, মৃত্যু- ১৯৯৯। খ্যাতনামা শিশু সংগঠক।শিশু সাহিত্যে ১৯৬৮ সালে বাংলা একাডেমী পুরুস্কার পান।
১৫. কাজী আরেফ আহমেদ: কুষ্টিয়া সদর উপজেলার ঝাউদিয়া গ্রামে জন্ম- অজ্ঞাত, মৃত্যু- ২০০০। মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট সংগঠক ছিলেন।