05/02/2024
"""'""আমাদের শীতকাল ও গ্রামিন জীবন!!!!
শীতের হাওয়ায় লাগল নাচন আমলকীর এই ডালে ডালে/ পাতাগুলো শিরশিরিয়ে ঝরিয়ে দিল তালে তালে।’ এখন শীতকাল। কুয়াশার চাদর মুড়ি দিয়ে শীত আমাদের দুয়ারে উপস্থিত। এই শীত শহরের মানুষের মধ্যে যত না প্রভাব ফেলে, তার চেয়ে বেশি প্রভাব ফেলে গাঁও-গেরামের মানুষের জীবনযাপনে। শীত ঋতু বিচিত্র অনুভূতি নিয়ে মানুষের জীবনে উপস্থিত হয়। পৌষ, মাঘ—এই দু মাস শীতকাল। শীতের আগমনে গাছপালার সবুজ পাতা ঝরে যায়। শুকনো পাতার মর্মর শব্দ কানে লাগে। উত্তরের ঠান্ডা বাতাস শরীরের রক্তকণিকায় কাঁপন ধরিয়ে দেয়। এ সময় গরিব সাধারণ মানুষের কষ্টের সীমা থাকে না।
পঞ্চগড়, দিনাজপুর, বগুড়া, রংপুর, নীলফামারী, তেঁতুলিয়া, শ্রীমঙ্গল, রাজশাহী, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন স্থানে শীত জাঁকিয়ে বসে। প্রায় প্রতি বছর এসব জায়গায় শীতের কষ্টে শিশু-বুড়োরা বেশি কষ্ট পায়। শীতের সময় বিভিন্ন আক্রান্ত হয়। সর্দি, কাশি, জ্বর লেগেই থাকে। অ্যাজমা রোগীদের কষ্টের সীমা থাকে না এ সময়। শীতের তীব্রতায় অসংখ্য মানুষ মারা যায়। কনকনে ঠান্ডার এই উপদ্রব দেখে কবি বলছেন—
হিম হিম শীত শীত
শীত বুঝি এল রে
কনকন ঠান্ডায়
দম বুঝি গেল রে।
শীতের যন্ত্রণা শুধু মানবজীবনে প্রভাব ফেলে না প্রকৃতিতেও এর প্রভাব দারুণ রকম লক্ষণীয়। এই ঋতুতে খাল-বিল, নদী-নালা, পুকুর-ডোবা অনেকাংশে শুকিয়ে যায়। নদ-নদীর বুকে বড় বড় চর জাগে। লঞ্চ, স্টিমার, ফেরি, ছোট-বড় জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। গ্রামের মানুষের যাতায়াতে তখন অনেক কষ্ট পোহাতে হয়। দূর পথ ঘুরে যেতে হয় আত্মীয় কিংবা বন্ধুর বাড়ি।
গ্রামীণ জনপদে শীতের এত এত কষ্ট থাকা সত্ত্বেও এই ঋতু মানুষের জীবনে আনন্দেরও বার্তা নিয়ে আসে। এই আনন্দও কিন্তু কম নয়। পাতাঝরা দিনেও গ্রামের কৃষক ভাইয়েরা অল্প পরিশ্রমে মাঠঘাটে নানা রকম শীতের সবজির চাষ করেন। এ সময় গ্রামের মাঠে, বাড়ির আঙিনায়, রাস্তার আশপাশে লালশাক, সরিষা, বেগুন, টমেটো, ফুলকপি, বাঁধাকপি, বিভিন্ন জাতের লাউ, বিভিন্ন জাতের শিম, ধনেপাতা প্রভৃতির ব্যাপক চাষ করা হয়। মাঠে মাঠে বিচিত্র ফসল মুগ্ধ করে আমাদের। গ্রামের এসব ফসল প্রতিদিন গাড়ি ভর্তি করে শহরে বিক্রির জন্য পাঠানো হয়। এসব ফসলের পুষ্টিগুণ বলে শেষ করা যাবে না।
এ সময় পুকুর-ডোবা, নদ-নদী ও বিলের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় মাছ শিকারের ধুম লেগে যায়। নানা ধরনের ছোট মাছ যেমন পুঁটি, মলা ঢেলা, ট্যাংরা, কাচকি, চিংড়ি, তেলাপিয়া ইত্যাদি পাওয়া যায়। সেই সঙ্গে বোয়াল, শোল, আইড়, চিতল, রুই, পাঙাশ, বাইন, বাঘাসহ নানা ধরনের বড় বড় ভিন্ন স্বাদের প্রচুর মাছ পাওয়া যায়।
এ সময় হাওর-বাওরে অতিথি পাখিরা এসে ভিড় করে। অতিথি পাখি গ্রামীণ সৌন্দর্যকে আরও বিকশিত করে। তা ছাড়া পুকুরে বিলে লাল শাপলা দেখা যায়। লাল শাপলা গ্রামের প্রকৃতিকে আরও উজ্জ্বল করে তোলে। ঘরে ঘরে থাকে পাকা ধান। খেজুর রস দিয়ে তৈরি করা হয় খেজুরের গুড়, মইরছা গুড়, পাটালি গুড় ইত্যাদি। বাজার থেকে সংগ্রহ করে এসব গুড় ও চালের গুঁড়া দিয়ে নানা জাতের ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের পিঠা তো আছেই। এ সময় ঘরে ঘরে বানানো হয় ভাপা, পুলি ও রসের পিঠা। ঐতিহ্যবাহী এসব পিঠা গ্রামের মানুষ নিজেরা যেমন খায়, তেমনি দূরে আত্মীয়-বন্ধুদের বাড়িতেও পাঠায়।
শীতে মানুষের জীবনচিত্রটা সত্যি অন্যরকম। বাড়ির উঠানে, পুকুর ঘাটে, বাজারে, রাস্তার পাশে খড়-কুটো জ্বালিয়ে গোল হয়ে বসে গ্রামের সাধারণ মানুষ শরীরটাকে উষ্ণ করার চেষ্টা করে। এটাও এক ধরনের আনন্দময় চিত্র। আবার সকালে ঘন কুয়াশার চাদর ভেদ করে বাড়ির উঠানে কিংবা পুকুরঘাটে রোদ নেমে এলে শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাই রোদ পোহানোর জন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়। এ ঋতুতে নানা ধরনের খেলায় মেতে ওঠে গ্রামের ছেলেমেয়েরা। মাঠে চলে হাডুডু, দাঁড়িয়াবান্ধা, ফুটবল, ব্যাডমিন্টন ইত্যাদি খেলা। অনেক বাড়িতে বসে জারি ও পালা গানের আসর। বসে মেলা। কোথাও কোথাও আয়োজন করা হয় যাত্রাপালার। গ্রাম ও শহরে এ সময় ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা নানা ওয়াজ-মাহফিলের আয়োজন করে। মোট কথা শীতের সময় প্রকৃতিতে জীর্ণশীর্ণ ভাব থাকলেও জনপদে এক ধরনের উৎসবের আবহ বিরাজ করে।
কপি-পেস্ট