08/03/2023
"বন্ধ্যা"
আজ আমার স্বামীর গায়ে হলুদ, ওর গায়ে প্রথম হলুদ আমিই ছুঁইয়ে দিলাম। ক'টা নারী এত সৌভাগ্য নিয়ে পৃথিবীতে আসে! ছলছল দুটি নয়ন নিয়ে নয়না তার স্বামীর কপালে হলুদ ছুইয়ে দিলো। রবির চোখ দুটোও শুষ্ক নয়, প্রচুর বৃষ্টির পরে মাটি যেমন ভিজে থাকে ঠিক তেমন হয়ে আছে রবির চোখ দুটো।
রবিকে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে আমি আমার বেড রুমে এলাম। কি বিশাল শূন্য লাগছে ঘরটাকে! এত আসবাব পত্রের মাঝেও ঘরটা শূন্য ফাঁকা। এই আট বছরের মধ্যে আজকেই প্রথম আমি রবিকে ছাড়া ঘুমাবো। ঘুম কি আসবে আজ? বা কোনো কালেও কি ঘুম আসবে এই দু চোখে?
শূন্য বিছানায় হাত রেখে ছুইয়ে দেখছি এইখানে মানুষটা শুয়ে থাকতো। আট বছরের কত খুনসুটি, কত স্মৃতি, কত ভালোবাসা সব এই ঘরটার সাথে জড়িয়ে আছে। মনে পড়ছে আমার বাসর রাতের কথা। কত লাজুক লাজুক সেই অনুভূতি! চোখ তুলে রবির দিকে লজ্জায় তাকাতে পারছিলাম না, আর রবিও হুট করে সেদিন লাজুক হয়ে গেছিল। দু'জনই আসামীর মত মাথা নিচু করে বসে ছিলাম। সেই দিনটার স্মৃতি আজ চোখ ভরা জল নিয়ে ভাবছি।
মনে পড়ছে আমাদের টুইন বেবির গল্প, মনে পড়ছে বেবিদের নাম রাখা নিয়ে আমাদের সেই টক মিষ্টি ঝগড়ার কথা। সব আজ স্মৃতি হয়ে গেছে শুধুই স্মৃতি।
হে আল্লাহ এত কিছু সইবার ক্ষমতা কেন দিচ্ছো? সব সহ্য ক্ষমতা তুলে নাও! কি লাভ এত কিছু সহ্য করে এই বেঁচে থেকে? একজন অক্ষম নারী তার স্বামীকে অন্য একটা নারীর সাথে বাসর ঘরে ঢুকিয়ে দিয়ে কতটা নির্লজ্জের মত বেঁচে আছে! এই লজ্জা এই অপমান নিয়ে আমি এখনও নির্লজ্জের মত শ্বাস নিচ্ছি।
আমি বন্ধ্যা, আমার এই অক্ষমতা ঢাকবার মত পৃথিবীতে এমন কোনো গোপন স্থান আছে কি? নেই, কোত্থাও নেই। আট বছরের সংসার জীবনে আমাদের কোনো সন্তান হয়নি। একটা বেবি এডপট করতে চেয়েছিলাম কিন্তু শ্বাশুড়ী মা সরাসরিই রবিকে বললেন-
--কার না কার পাপের ফল অনাথ আশ্রমে রাইখা আসে, বৈধ সন্তান হইলে ঠিকই কোনো না কোনো আত্মীয় ওই বাচ্চার দায়িত্ব নিতো। আর ওইসব পাপ আমি আমার সংসারে রাখতে পারব না। বউ বাচ্চা দিতে পারতেছে না এইটা তার অক্ষমতা তাই তাকে বল, তোর দ্বিতীয় বিয়েতে সে যেন সম্মতি দেয়।
আমি আর রবি দু'জনই আম্মার রুমে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে শুনছি। কথাগুলো শুনছি আর আঁচল দিয়ে চোখ মুছতেছি। রবি সংসারের কোনো ব্যাপারে কথা বলে না কিন্তু একটা এডপট বেবী আমিই ওর কাছে আবদার করে ছিলাম। কিন্তু এই বাড়িতে শ্বাশুড়ী মায়ের বিনা হুকুমে কিছুই হয় না। তাই "একটা এডপট বেবি চাই" সেই দরখাস্ত নিজের মায়ের কাছে দিতে গিয়েই এত কথা শুনতে হলো রবিকে। অনেকক্ষণ চুপ থাকার পর রবি বলল-
--আম্মা দত্তক বাচ্চা বাসায় উঠতে দেবেন না ঠিক আছে তাই বলে সন্তানের জন্য দ্বিতীয় বিয়ে করব এটা কেমন কথা?
--এইটা কেমন কথা বলতেছিস তুই রবি? তুই আমার একটাই ছেলে আর সে যদি নিঃসন্তান হয় তাহলে বংশ তো এখানেই শেষ! আট বছর অপেক্ষা করেছি আর নয় এবার আমি নাতীর মুখ দেখতে চাই!
--আম্মা একটু বোঝার চেষ্টা করেন, এই যুগে মানুষ দ্বিতীয় বিয়েটাকে ভালো চোখে দেখে না। আর নয়নার কি হবে?
--মানুষের ভালো দেখাদেখি দিয়ে তো আর আমার চলবে না! আর নয়না তোর দ্বিতীয় বিয়ের পর যদি এই বাড়িতে থাকতে চায় তবে থাকবে আর না চাইলে বাপের বাড়ী চলে যাবে।
--এটা কেমন কথা আম্মা? এটা তার সাথে অন্যায় করা হবে!
--তোকে ন্যায় অন্যায় নিয়ে ভাবতে হবে না। তুই যদি বিয়ে না করিস তবে এই মুহূর্ত থেকেই আমি আহার ত্যাগ করলাম।
দু'দিন হলো আম্মা পানি পর্যন্তও খায়নি। বয়স্ক মানুষ সুগার আছে, অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। ডাক্তার আনা হয়েছিল কিন্তু ডাক্তারকে উনি তার রুমে ঢুকতে দেননি। সারাবাড়ি জুড়ে অশান্তি বিরাজ করছে। রবির মুখের দিকে তাকাতে পারছি না, কি যে বলব বুঝেই উঠতে পারছি না। দু'দিন ধরে আমরা দুটো মানুষ দুই ধরনের লজ্জায় কেউ কারো মুখের দিকে তাকাতে পারছি না। আমার লজ্জা আমি বন্ধ্যা আর রবির লজ্জা তার মা তাকে দ্বিতীয় বিয়ে দেবার জন্য এত কঠোর একটা পণ করেছেন সেটা। আমি কিভাবে সব কিছু ম্যানেজ করব ভেবে পাচ্ছি না আর রবিকেই বা আমার কি বলা উচিত! তবুও কিছু বলাটা জরুরি কারণ নিজেকে অপরাধী রূপে আর দেখতে পারছি না। একটা সন্তান জন্ম দিতে পারছি না, বংশ রক্ষা করতে পারছি না এই কষ্ট কি একাই ওদের? আমার কি কষ্ট হয় না? আমার হৃদয় কি ক্ষতবিক্ষত হয় না?
মা হতে না পারার অক্ষমতার যন্ত্রণা বুকে চেপে রেখে বললাম-
--তুমি দ্বিতীয় বিয়ে করো রবি!
কথাটা বলতে মুখ না আটকালেও বুকটা যে আটকালো সেটা শ্বাস নিতে গিয়েই টের পেলাম। রবির আমার দিকে অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল-
--তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে নয়না?
--একবার ভেবে দেখো রবি, আম্মা অসুস্থ হয়ে পড়েছে এভাবে আর দু'দিন চললে উনি আর বাঁচবেন না। আর আমি কারও মৃত্যুর দায়ভার নিতে পারবো না।
--কিন্তু আমি কীভাবে আরেকটা বিয়ে করতে পারি বলো?
--পারবে, অনেকেই পারে।
--অনেকের কথা জানি না, আমি জানি তোমাকে ছাড়া অন্য নারীর কথা আমি ভাবতেও পারি না।
বুকে পাথর চেপে বললাম,
--আমি এসব শুনতে চাই না রবি।
--একটা অশান্তি নিভাতে গিয়ে আমি চিরকালের অশান্তি বাড়িতে আনতে পারি না।
--কি করবে তাহলে? যাও তোমার মাকে সুস্থ করো।
--আমি কি করব নয়না তুমি বলে দাও?
কথাটা বলেই রবি হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করল। কি সান্ত্বনা দেবো তাকে? আর নিজেকেই বা কি বলে বোঝাবো? তবুও আমার কিচ্ছু করার নেই। আমার সামনে এই একটাই অপশন হলো আমি নিরুপায়।
আমি শ্বাশুড়ী মায়ের রুমে গিয়ে বললাম-
--আম্মা আপনার ছেলে বিয়ে করতে রাজী হয়েছে আর আমিও রাজী। আপনি প্লিজ এখন খেয়ে নিন!
--বাচ্চা ভোলাতে এসেছো? রবি এসে আমার মাথায় হাত রেখে কসম করলে তবেই আমি খাবো। এখন তুমি যাও আর অকারণে আমার রুমে আসবা না।
আমি হতাশ হয়ে ফিরে এলাম। ছলছল জল নিয়ে রবির দিকে তাকিয়ে বললাম-
--প্লিজ একবার রাজী হয়ে যাও!
রবি অসহায়ের মত আমার দিকে চেয়ে আছে। শ্বাশুড়ী মায়ের শারীরিক অবস্থা সত্যিই খুব খারাপ কারণ উনি খাবারসহ ঔষধ খাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন। আজ যদি উনার নিজের মেয়ে থাকত আমার পজিশনে তবে কি উনি এমনটা করতে পারতেন?
আমি রবির পায়ে পড়ে হাউ মাউ করে কাঁদতে শুরু করলাম। রবি আমাকে টেনে দাঁড় করিয়ে বলল-
--এই পাগলি নিজের কথা ভেবেছো একটিবার?
যে নারী সন্তান জন্মদানে ক্ষমতা রাখে না তার বোধহয় নিজের কথা ভাবা উচিত নয়। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে বললাম-
--ভেবেছি তো! আমি জানি তুমি সারাটা জীবন আমাকে ভালোবাসবে। আর তোমার সন্তানকে বুকে নিয়েই আমি মাতৃসুখ অনুভব করব।
আমার কথা শুনে রবি কাঁদতে শুরু করল। মনে মনে বললাম, "আমি জানি তুমি সারাজীবন আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। আমি এই পরিবারের ছাই ফেলা ভাঙা কুলো হয়ে যাব।"
অবশেষে রবির খালাত বোন ভূমিকে বিয়ে করতে রাজী হলো রবি।
এইসব নানান ভাবনায় আমার রাত শেষ হলো।
ভোর হয়ে গেছে, ছাদে গেলাম প্রকৃতির সাথে আলিঙ্গন করতে। কিন্তু আকাশ বাতাস প্রকৃতি সব কিছুকেই ধূসর মনে হলো তাই চলে এলাম। নাস্তা রেডি করলাম। এতটা বছর ধরে এই সংসারের সব কাজ আমিই করেছি, অথচ আজ নিজেকে বাড়ির বুঁয়া মনে হচ্ছে। কি আজব মানুষের অনুভূতি! স্বামী থাকলে কাজ করাকে সংসার করা মনে হয় আর স্বামী বিহীন কাজগুলো দাসী বানিয়ে দেয়। অথচ এই সংসারটার জন্যই আমি উচ্চ শিক্ষিত হওয়া শর্তেও কোনো চাকরি করিনি আর সেই সংসারেই আমি আজ গ্র্যাজুয়েট দাসী।
আমি টেবিলে খাবার রেডী করতেই নতুন বউ রুম থেকে বাহিরে এলো। ভূমির চোখেমুখে লাজুক লাজুক খুশি ছড়িয়ে আছে। সেটাই তো স্বাভাবিক কারণ বাসর রাত একজন নারীর জীবনে শত জনমের শ্রেষ্ঠ্য রাত। একটা রাত একই বাড়িতে দুটো নারীর দুই ভাবে পোহালো।
আমি রবির জন্য অপেক্ষা করছি, সে কখন বাহিরে আসবে! সারাটা রাত তাকে দেখিনি। সারারাত কি অনেক দীর্ঘ সময়? আমার কাছে তো এক যুগ মনে হয়েছে।
রবি আধা ঘন্টা পরে বেরিয়ে এলো। আমার চোখের সাথে সে চোখ মেলাতে পারছে না কিন্তু আমি অপলক তার দিকে চেয়ে আছি। আমি খাবার বেড়ে দিতে যেতেই ভূমি আমার হাত থেকে খাবারের বাটি নিয়ে বলল-
--আমি দিচ্ছি
আমি ওখান থেকে সরে আসতেই রবি বলল-
--নয়না খাবার বেড়ে দাও!
রবির কথা শুনে আমার চোখে জল চলে এলো। মরার চোখে যে কি হয়েছে কারণে অকারণেই শ্রাবণ বয়! আমি মাথা নিচু করে রবিকে খাবার বেড়ে দিচ্ছি হঠাৎ টপটপ করে কয়েক ফোটা অশ্রু রবির হাতে পড়তেই রবি চমকে উঠে আমার দিকে তাকাল। আমি চোখ মুছে রুমে চলে গেলাম।
কি করে আমার রাত দিন কাটবে রবি? কীভাবে আমি বেঁচে থাকব তোমাকে ছাড়া? এত বড় জীবনটা কবে ফুরাবে?
রবি নাস্তা না করেই আমার রুমে এলো। আমি নিজেকে সামলে নিয়ে স্বাভাবিক ভাবেই বললাম-
--উঠে এলে কেন? যাও নাস্তা করে নাও!
রবি কোনো উত্তর না দিয়ে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকল। আমার মনে পড়ে গেল, আমার বিয়ের পরের দিনের কথা। রবি নাস্তার প্লেট রুমে এনে বলেছিল-
--এই যে দেখো নাস্তার প্লেট, কি ভেবেছ তোমার জন্য এনেছি? উহু এখন তুমি আমাকে খাইয়ে দেবে।
নতুন বিয়ে হয়েছে, কি লজ্জার কথা! তবুও সেদিন রবি জোর করে আমাকে খাইয়ে দিতে বাধ্য করেছিল। এছাড়াও এই আট বছরে অসংখ্যবার আমি তাকে খাইয়ে দিয়েছি। আমাদের মধ্যে সব ছিল, ভালোবাসা, মায়া, শ্রদ্ধা, বিশ্বাস, শুধু একটা সন্তানই ছিল না। একটা শূন্যতা এতগুলো পূর্ণতাকে ভুল প্রমান করে দিয়েছে। এত এত স্মৃতি আমি কোথায় লুকিয়ে রাখব আল্লাহ্? কোথায় বা নিজেকেই লুকাব?
--রাতে একটুও যে ঘুমাওনি সেটা তোমার চোখ বলে দিচ্ছে নয়না।
--তুমিও তো ঘুমাওনি তাই না?
আমার কথা শুনে রবি অপরাধীর মত মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। এই কথাটা বোধহয় আমার বলা উচিত হয়নি। নিজে তো কষ্ট পাচ্ছি আর সারাটা জীবন এই কষ্ট বয়ে বেড়াবো তাই বলে মানুষটাকেও কষ্ট দেবো? নাহ এটা অনাচার হবে। মানুষটার চোখ দুটোও জলে ভরে গেছে। আমি নিজেকে স্বাভাবিক করে বললাম-
--আজকেও কি তোমাকে আমার খাইয়ে দিতে হবে?
আমার কথা শুনে রবি আমাকে জড়িয়ে ধরে আকুতি করে কাঁদতে শুরু করল। আমিও আর নিজেকে সামলে নিতে পারলাম না। রবির বুকে মুখ গুঁজে আর্তনাদ করে কাঁদলাম। জানি এরপর হয়ত আর কখনোই তার বুকে মুখ গুঁজে কাঁদার ভাগ্য আমার আর হবে না। স্বামীর ভাগ দিইনি আমি, আমার স্বামী পুরোটাই অন্যের হয়ে গেছে।
বিয়ের একমাস পর রবির নতুন বউ কন্সিভ করল। সারা বাড়িতে খুশির হাওয়া বইছে। রবির মুখের দিকে তাকিয়ে বুঝলাম যে, আট বছর ধরে এই খুশিটাকে সে আড়ালে লুকিয়ে রেখেছিল। আমি অভাগীনি বলেই এতটা বছর এই খুশিটাকে বাহিরে আনতে পারিনি। হয়ত সে অনেক কষ্টও চেপে রেখেছিল যা আমাকে কখনো টের পেতেও দেয়নি।
আজকাল সবাই নতুন বউ ভূমিকে নিয়ে খুব ব্যস্ত। আমার চোখের সামনে আমার ভালোবাসার মানুষটিও একটু একটু করে বদলে গেল। রবিও নিজের গর্ভবতী বউয়ের যত্নের ত্রুটি রাখে না। টাইমলি খাবার খাওয়ানো, ঔষধ খাওয়ানো সবকিছুর সে খেয়াল রাখে। আমার কথা ভাবার মত কেউ নেই এ বাড়িতে। আমি খেলাম কি খেলাম না তার খোঁজ কেউ রাখে না। বরং ভূমির যত্নের ত্রুটি হলে রবির কাছে আমাকে জবাবদিহি করতে হয়। শ্বাশুড়ীমা ভূমির ঘরে আমাকে যেতে দেন না, যদি আমি ভূমির গর্ভের সন্তানের কোনো ক্ষতি করে ফেলি সেই ভেবে। যার ভেতরের মা হবার এত আকাঙ্ক্ষা, সে কি করে পারবে কোনো অনাগত শিশুর ক্ষতি করতে? সতীনরা বোধহয় এমন নিম্নশ্রেণীর কাজ করতেই পারে!
আমি এ বাড়ির পার্মানেন্ট বুঁয়া হয়ে গেলাম। দিনরাত পরিবারের সবার খেয়াল রাখাটা বোধহয় বুঁয়ার কাজ নয়। কিন্তু স্বামী বিহীন এই সংসারে আমার অবস্থান কোথায় সেটা কি কেউ বলতে পারবে?
আমার বাবা বহুবার এসেছেন আমাকে নিতে কিন্তু আমি যাইনি। কিছু না হোক রোজ তো রুবিকে দেখতে পাই এইটুকুই বা কম কিসে? কিন্তু এ বাড়ির কেউ এইটুকুও আমাকে দিতে চায় না।
রবির ছেলে অবিকল রবির মত দেখতে হয়েছে। আমার স্বামীর সন্তান অথচ ওই সন্তানের মা আমি নই, এমনকি ওই বাচ্চাটাকে আমার কোলে নেয়ারও কোনো অধিকার নেই। আমি বন্ধ্যা তাই কল্যাণ অকল্যাণ বলেও তো কিছু কথা থাকে। আজকাল সেই কল্যাণ অকল্যাণ রবিও মানে। সেটা দেখে অবশ্য আমি অবাক হই না। কারণ নিজের সন্তানের প্রতি এমন দূর্বলতা প্রতিটা বাবারই থাকে। রোজ নিজের এই অবহেলিত রূপ দেখে দেখেও আমি মাটি কাঁমড়ে এবাড়িতেই পড়ে আছি। কিন্তু বাচ্চাটার অসুখ করলেই ভূমি বলে, আমার মত বাঁজা নারীর দৃষ্টি লেগে নাকি বাচ্চা অসুস্থ। আল্লাহ আর কত লাঞ্ছনা আমার কপালে লিখে রেখেছ? নিজের স্বামীকে ভালোবাসার দায়ে এরচেয়ে যদি আমার ফাঁসি হতো তবুও হয়ত সম্মান নিয়ে মরতে পারতাম। আর এই ধরনের কথা রবিও বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। একদিন রবি আমার রুমে এসে বলল-
--নয়না আমি একটা বাসা দেখেছি তুমি গোছগাছ করে নাও, এখন থেকে তুমি ওখানেই থাকবে।
--কেন রবি?
--রোজ অফিস থেকে ফিরে একই রকমের অশান্তি আর ভাল্লাগে না।
--আচ্ছা ঠিক আছে।
কথাটা বলেই রবি চলে যাচ্ছিল। আজকাল রবি আমার রুমে আসাই ভুলে গেছে। আমি তাকে পেছন থেকে ডেকে বললাম-
--সেই নতুন বাসাতে মাঝে মাঝে তুমি যাবে তো?
সে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল-
--যাব, তোমার খরচাদি দিতে যেতে তো হবেই।
এক বছর ধরে আমি এই নতুন বাসাতে একা থাকি না, একটা পথশিশুকে নিজের কাছে রেখেছি। তার নাম রেখেছি আঁখি। পাঁচ বছরের আঁখি রাস্তায় ভিক্ষা করত। একদিন তার সাথে আমার দেখা হয় রাস্তায়, ভিক্ষা চাইছিল। সে জানেই না তার বাবা মা কে। এমন কি তার নিজের নামটাও ছিল না। কত বছর ধরে সে পথে পথে ভিক্ষা করত সেটাও সে জানত না।
আমি একটা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষকতা করছি, আঁখিকেও স্কুলে ভর্তি করেছি। আঁখি আমাকে মা বলে ডাকে। রবি মাসে এক দু'বার আসে কিন্তু দশ পনেরো মিনিটের বেশি থাকে না। আমি আর রবির থেকে কোনো টাকা নিই না। আমাদের মা মেয়ের সংসার আমার অল্প রোজগারেই বেশ চলে যায়। রবির টাকার দরকার আমার কোনোকালেও ছিল না, চেয়েছিলাম রবিকেই। সেই রবি আমাকে ভুলে যায়নি, বাস্তবতা রবির মন থেকে নয়নাকে মুছে দিয়েছে। আর বাস্তবতাই হয়ত একজন বন্ধ্যা নারীকে আঁখির মা বানিয়ে দিয়েছে।
সমাপ্ত