19/12/2023
ক্লাসের বেঞ্চে সেদিন হঠাৎ করেই এক মজার জিনিস আবিষ্কার করলাম।কেউ বেঞ্চে কলম দিয়ে দুই লাইনের চিরকুট লিখে রেখে গেছেন।
বেঞ্চে স্টুডেন্টরা সবসময়ই কিছু না কিছু লিখে রেখে যায়, এতো হিজিবিজি লেখার মাঝে আলাদাভাবে চিরকুটটাকে দেখা যায় না।আমিও দেখতে পেতাম না, যদি না আজ স্যারের একঘেয়ে লেকচার থেকে বাঁচার জন্য বেঞ্চের লেখাগুলো পড়া শুরু করতাম।
চিরকুটটা এমন -
'প্রিয় পুষ্প'
– “নীল শাড়িতে আজ তোমাকে অনেক সুন্দর লাগছিলো।এখন থেকে সব অনুষ্ঠানে নীল শাড়িটা পরে আসবে। ”
এটুকুই লেখা।আমি অন্য লেখাগুলোও পড়লাম, কিন্তু তেমন চিরকুট আর একটিও দেখতে পেলাম না।স্যারের ক্লাস শেষে এক ঘন্টার অফ পিরিয়ড। সবার মতো আমিও ক্লাস থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিলাম, হঠাৎ মনে হলো, অন্য বেঞ্চগুলোও একবার খুঁজে দেখি। এমন চিরকুট আরো পেতে পারি। ব্যাপারটা পুরোপুরি পাগলামি, কিন্তু কেন যেন খুব কৌতূহল হচ্ছিলো।
প্রথম তিন-চারটি বেঞ্চে কিছুই পেলাম না। কিন্তু এরপরের বেঞ্চেই পেলাম সেই কাঙিক্ষত চিরকুট, একই হাতের লেখা -
'প্রিয় পুষ্পা'
– “ তুমি তো খুব সুন্দর কবিতা আবৃত্তি করো। তোমার এই গুণটা আমার জানাই ছিলো না। এতো গুণ একজন মানুষের মাঝে কিভাবে থাকতে পারে? ”
এবং এরপর বেশ কয়েকটি বেঞ্চে এমন লেখা দেখতে পেলাম।
'প্রিয় পুষ্পা'
– “ তুমি কি জানো, যখন তুমি উদাস হয়ে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকো, তখন তোমাকে কি অপূর্ব লাগে? আবার এটাও মনে হয়,তোমার মনে অনেক দুঃখ।এতো দুঃখ কেন তোমার? ”
'প্রিয় পুষ্পা'
– “ তুমি আজ ওভাবে কাঁদছিলে কেন? খুব খারাপ লাগছিলো তোমাকে দেখে। তুমি কি জানো, একজন তোমার দুঃখের সমব্যথী হতে চায়? ”
'প্রিয় পুষ্পা'
– “ অনেকদিন তোমায় দেখি না। শুনেছি, খুব অসুস্থ তুমি। তোমার বাসার সামনে গিয়ে প্রতিদিন দাঁড়িয়ে থাকি, ভেতরে যাওয়ার সাহস হয় না। তুমি তাড়াতাড়ি সুস্থ হয়ে ক্লাসে আসো। আমার মনের কথাটি এবার সত্যি তোমার সামনে বলবো। ”
ওটাই শেষ। সবগুলো বেঞ্চ খুঁজে ওমন চিরকুট আর দেখতে পেলাম না।পুষ্পা নামের মেয়েটিরও আর কোনো খোঁজ পাইনি।
'
'
'
এর ঠিক দুই বছর পর। পড়ালেখা শেষ করে তখন চাকরি খুঁজছি। এরমধ্যেই আমাদের পাশের ফ্ল্যাটে এক নতুন দম্পতি ভাড়া এলেন। বাইরে আসা যাওয়ার পথে মাঝেমাঝে তাদের সাথে দেখা হয়। বউটি বয়সে তরুণী, দেখতেও বেশ সুন্দর। কিন্তু তার বরটি যেমন বয়স্ক, দেখতেও তেমন অভদ্র ধরনের।
প্রায়ই তাদের ঘর থেকে ঝগড়া আর চেঁচামেচির শব্দ শুনতাম। মাঝে মধ্যে মেয়েটির কান্নার শব্দও শুনতে পেতাম। দারোয়ান একদিন বলেছিলেন লোকটি নাকি রাতে মাতাল হয়ে বাসায় আসেন।
এরমধ্যেই একদিন বাইরে থেকে বাসায় আসার সময় দেখলাম পাশের ফ্ল্যাটে অনেক মানুষের ভীড়। কেউ একজন বললো যে, ঐ বাসার লোকটি নাকি তার বউকে মারছিলো, সেসময় কেউ পুলিশে ফোন করে দিয়েছে। পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গেছে লোকটিকে।বাসায় ঢোকার পথে খোলা দরজা দিয়ে মেয়েটিকে দেখতে পেলাম। চেহারায় আঘাতের ছাপ ফুটে আছে।
এর তিন-চারদিন পর মেয়েটি আমাদের বাসায় এলেন। তিনি আর থাকবেন না তার স্বামীর সাথে, বাবার বাড়িতে চলে যাচ্ছেন, তার আগে একবার দেখা করতে এসেছেন মায়ের সাথে। কারো কাছ থেকে নাকি শুনেছেন, পুলিশকে আম্মাই কল করেছিলেন। তাই শেষ বারের মতো আম্মাকে ধন্যবাদ জানাতে আসা।
মাকে বললেন,
- 'আন্টি, আপনি ঐদিন পুলিশে ফোন না করলে শয়তানটা আমাকে মেরেই ফেলতো।'
আম্মা উনাকে বসতে বলে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলেন। আমি ভেতরের ঘরে, এরমধ্যেই আম্মা আমাকে ডাকলেন।
আমি উনাদের সামনে যেতেই আম্মা বললেন,
- 'দেখো, ও তোমাদের ভার্সিটিতে তোমার সাবজেক্টেই পড়তো।'
আমাকে উনি আমার ব্যাচ জিজ্ঞেস করলেন। ব্যাচের নাম শুনে বললেন,
- 'ওহ, তুমি তাহলে আমার তিনবছরের জুনিয়র।'
বেশ কিছুক্ষণ কথা হলো আপুর সাথে। তার নাম জিজ্ঞেস করতেই তিনি বললেন, তার নাম 'পুষ্পা।'
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
- 'আপু, আপনি কি কখনো কবিতা আবৃত্তি করেছেন?'
পুষ্পা আপু হেসে বললেন,
- 'হ্যাঁ, ভার্সিটির দু'একটা ফাংশনে আবৃত্তি করেছিলাম।কেন?'
আমার ফোনে চিরকুটগুলোর ছবি ছিলো, সেগুলো আপুকে দেখালাম।ছবিগুলো দেখতে দেখতে আপু অবাক হয়ে গেলেন। বললেন,
- 'মনে তো হচ্ছে আমার জন্যই লেখা।'
- 'কে এগুলো লিখেছেন, আপনি জানেন?'
- 'না।'
- 'এখানে যে লেখা আছে আপনি সুস্থ হলেই সে আপনার সামনে যাবে?'
- 'আসলে আমি আর ভার্সিটিতেই যাইনি। আমার টাইফয়েড হয়েছিলো। দুমাস বাসায় ছিলাম। এর মাঝখানে সেমিস্টার ফাইনালও হয়ে যায়, একবছর ইয়ার ড্রপ হয়ে যায় আমার। সেই সময়ই এই বিয়ের প্রস্তাবটা আসে। বাসা থেকে বিয়েও দিয়ে দিল জোর করে। ছেলে ভালো চাকরি করে, অনেক টাকা পয়সা, আর কিছু দেখার তো দরকার ছিলো না।'
এটুকুই বলেই আপু কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। এরপর বললেন,
- 'বিয়ের পর ভার্সিটির কারো সাথেই আর যোগাযোগ ছিলো না।'
- 'আপু, আপনি কি ছবিগুলো নিবেন?'
- 'না। তুমি ছবিগুলো ডিলিট করে দিও।'
- 'আচ্ছা।'
- 'তুমি কি জানতে, কে লিখতো চিরকুটগুলো?'
- 'না, জানি না।'
পুষ্পা আপু চলে গেলেন। আমি একটা ব্যাপার বুঝতে পারছিলাম, আপু একটা জিনিস লুকাচ্ছেন। চিরকুটগুলো কে লিখেছিলো, তিনি জানতেন। তার চোখে তেমনই আভাস দেখা যাচ্ছিলো।
আমিও একটা ব্যাপার লুকিয়েছিলাম। জাকির ভাইয়ের কথাটা আপুকে বলি নি।পুষ্পা আপুর খোঁজ না পেলেও, আমি জাকির ভাইয়ের খোঁজ পেয়েছিলাম। চিরকুটগুলো জাকির ভাই লিখেছিলেন।তার বন্ধু-বান্ধবরা অনেকেই জানতেন, জাকির ভাই পুষ্পা আপুকে পছন্দ করতেন। সেই বন্ধুদের একজনের কাছ থেকে আমি তাদের গল্প শুনেছিলাম। পুষ্পা আপুর কোনো ছবি ছিলো না বন্ধুটির কাছে। থাকলে হয়তো এতোদিন বসে থাকতে হতো না পুষ্পা আপুর খোঁজে। আর খোঁজ বা এমনিও পেতাম কই? বিয়ের পরতো তার বন্ধু-বান্ধবরাই তার খোঁজ জানতো না। তিনিও কোনো খোঁজ জানতেন না তাদের।
এজন্যই আমি আপুকে জাকির ভাইয়ার নামটি বলি নি। কারণ নামটি বললে সাথে সাথে জাকির ভাইয়ের মৃত্যুর খবরটিও বলতে হতো। পুষ্পা আপুর বিয়ের পরদিন জাকির ভাইয়ার মৃতদেহ পাওয়া যায় রেললাইনের পাশে। আশেপাশের সবাই বলেছেন, অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিলেন জাকির ভাই, ট্রেন আসার হুইসেল শুনতে পাননি।
ভালো থাকুক পুষ্পা আপু। জাকির ভাইয়ের মৃত্যুর খবর দিয়ে তার দুঃখের ভার আর বাড়াতে চাই না।
(সমাপ্ত)
----------------
#ছোটগগল্প
#প্রিয়_পুষ্পা
#লেখা_সোয়েব_বাশার