10/06/2024
ঘটক বলেছিল আমার বোনকে দেখতে ছেলে আর ছেলের বাবা মা আসবে। আমরা সেই হিসাবেই আয়োজন করেছিলাম। পরে দেখি ছেলের সাথে আরও অনেকে এসেছে। সাথে কিছু বাচ্চাও আছে। বাবা আমায় আড়ালে ডেকে নিয়ে ১২ হাজার টাকা হাতে দিয়ে বলল,
- “আবির, তাড়াতাড়ি বাজারে যা। খাসি মাংস, মুরগীর মাংস, যা যা লাগে সব কিনে নিয়ে আয়।
আমি আমার এক বন্ধুকে সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি বাজারে গেলাম। সবকিছু কিনলাম শুধু খাসির মাংসটা কেনা হলো না। একে তো বৃষ্টি তার উপর গ্রামের ছোট একটা বাজার। তাই ওখানে খাসির মাংস সব সময় পাওয়া যায় না। বাবাকে যখন ফোনে বললাম, বাজারে কোথাও খাসির মাংস পেলাম না তখন বাবা বললো, “যেভাবে পারিস খাসির মাংসের ব্যবস্থা কর। তা নাহলে আমার সম্মান থাকবে না”
বাইকে করে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে গেলাম থানার কাছে বড় বাজারে। মাংস কিনে বাড়ি পৌছাতে একটু দেরি হয়ে গেল। বাবা আমার দিকে অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়ে বললো, দেরি করলি কেন?
এতো অল্প সময়ে এগুলো রান্না করবে কিভাবে?”
এই বৃষ্টির দিনেও বাবা ঘামছেন। চোখে মুখে বাবার ভয়ের ছাপ স্পট বুঝা যাচ্ছে। আমার শিক্ষক বাবাকে এতোটা আসহায় আগে দেখি নি।
আমি বললাম,-আপনি চিন্তা করবেন না। সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। আপনি উনাদের সাথে বসে বসুন।
মাকে রান্নার কাজে সাহায্য করার জন্য আমার বোন রান্নাঘরে ঢুকতেই মা বাধা দিয়ে বললো,
- “তুই কেন রান্নাঘরে এলি? ষ রুমে যা। গিয়ে তৈরি হয়ে নে।
বোন বললো, “মা তুমি পারবে না একা হাতে এতোকিছু সামাল দিতে। আমি একটু সাহায্য করি?”
মা বললো, “আমি পারবো একা সামাল দিতে। তুই তৈরি হয়ে থাক। ওরা কখন না কখন মেয়ে দেখতে চাইবে”
আমি ছেলে মানুষ রান্নার এতো কিছু বুঝি না। তবে এটা ওটা কেটে দিয়ে মাকে যতটুকু পারি সাহায্য করার চেষ্টা করছিলাম। কেউ চায়ে চিনি খায় না, কারো বা চায়ে চিনি কম হয়ে গেছে। কেউ সিগারেট খাবে তাকে সাথে নিয়ে সেইভ জায়গায় যাওয়া। সাথে আসা বাচ্চাদের দেখাশোনা করা এইসব করতে গিয়ে আমার ছোট ভাইটাও দেখি ক্লান্ত হয়ে গেছে।
৫ মিনিট পর পর বাবা রান্না ঘরে এসে মাকে বলে, “কি গো রান্না কত দূর হলো?”
কপালে জমে থাকা ঘামটা মা আঁচল দিয়ে মুছতে মুছতে বলে, “এইতো হয়ে গেছে আরেকটু”
রান্না হয়ে গেলে খাওয়ার পর্ব শুধু। আমি আর বাবা নিজ হাতে সবাইকে পরিবেশন করছিলাম। বাবা বারবার বিনয়ের সহিত বলছিলো, “ জানি না রান্না কেমন হয়েছে। কোন ভুল ক্রটি হলে ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন?”
উনাদের খাবার খাওয়ার স্টাইল দেখে মনে হচ্ছিলো উনারা তিন বেলায় ফাইভ স্টার হোটেলে কাঁটা চামচ দিয়ে খাবার খান। এখানে হাত দিয়ে খাবার খেতে হচ্ছে বলে উনারা কিছুটা বিরক্ত। উনারা যত খাবার খেয়েছে তার চেয়ে বেশি নষ্ট করেছেন।
বাচ্চা খাচ্ছে না বলে বাচ্চার মা ধমক দিয়ে বলে, “ এই তুমি খাচ্ছো না কেন? এই নাও মাংস”
বাচ্চা বলে, “আমি খাবো না”
বাচ্চার মা বলে, “ তোমাকে খেতেই হবে এই নাও মাংস” এইবলে বাচ্চার প্লেটে পুরো বাটিই ঢেলে দেয়।
খাওয়ার পর্ব শেষে মেয়ে দেখানোর পর্ব শুধু। আমার অনার্স পাস করা বোনকে দেখাশুনা করে হাতের লেখা নিয়ে, শেষে পাত্রের মা আমার বাবাকে বললো,
“আসলে মেয়ে আমাদের পছন্দ হয় নি। আমরা আমাদের ছেলের জন্য একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজছিলাম।”
পাত্রের বড় বোন বললো, “ মেয়ে দেখছি কিছুটা খাটো তাছাড়া মেয়ের বয়সটাও একটু বেশি”
কথাগুলো শুনে আমার বড়বোন মাথা নিচু করে নিরবে চোখের জল ফেলছিলো। কেন জানি আমার আর সহ্য হচ্ছিলো না। আমি তাদের বললাম,
-কেন, আপনারা কি জনতেন না আমার বোন শ্যামলা। আমি তো ঘটককে আমার বোনের এডিট ছাড়া ছবি দিয়েছিলাম। তাছাড়া আপনারা কি জানতেন না আমার বোনের উচ্চতা ৫ফুট ২ ইঞ্চি আর আমার বোন অনার্স পাশ করেছে? আমি তো সবই ঘটককে বলেছি আগে থেকেই
পাত্রের জামাইবাবু আমতা আমতা করে বললো,
- “হ্যাঁ সবই জানতাম। তারপরেও এসেছিলাম সামনাসামনি একবার মেয়েকে দেখতে”
দাঁতের সাথে দাঁত চেপে রেখে নিজের রাগটা কন্ট্রোল করে বললাম,-সামনা-সামনি দেখলে কি হতো? আমার বোন তো আর শ্যামলা থেকে ফর্সা হয়ে যেতো না। তার উচ্চতাও বেড়ে যেতো না কিংবা তার বয়সও কমে যেতো না। তাহলে শুধু শুধু আপনারা এতো কষ্ট করে আসতে গেলেন কেন?
পাত্রের বড় বোন কিছুটা রেগে বললো,
“ আমরা মেয়ে দেখতে এসেছি বলে দোষ করে ফেলেছি নাকি?”
আমি বললাম, না আপনারা কোন দোষ করেন নি। ৩ জনের জায়গায় ১৫ জন এসেছেন এতে আপনাদের দোষ হয় নি, খাবার খাওয়ার চেয়ে নষ্ট করেছেন বেশি এতেও আপনাদের দোষ হয় নি। আপনারা ছেলের জন্য ফর্সা, লম্বা, কম বয়সী মেয়ে খুঁজছেন। যার কোনটাই আমার বোনের মধ্যে নেই। সেটা জানার পরেও আপনারা এখানে এসেছেন এতে আপনাদের দোষ হয় নি। দোষ তো করেছে আমার বাপ মা। উনারা কেন শ্যামলা মেয়ে জন্ম দিলো। দোষ করেছে আমার বোন। কেন সে আপনাদের অপমান নিরবে সহ্য করলো। দোষ তো করেছি আমি। কেন এখনো পায়ের জুতা গুলো হাতে তুলে নিই নি…
আমার কথা শুনে বাবা আমার গালে থাপ্পড় মেরে আমাকে থামিয়ে দিয়ে উনাদের কাছে মাফ চাইলো। সবাই চলে গেলে বাবা আমার কাছে এসে আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো, “ যেদিন নিজে মেয়ের বাবা হবি সেদিন বুঝবি মেয়ের বাবাদের কত কি সহ্য করে নিরব থাকতে হয়”
রাতে বোনের রুমে গিয়ে দেখি সে এখনো কান্না করছে। ১৫ জন মানুষের সামনে যখন একজন মেয়েকে রিজেক্ট শব্দটা শুনতে হয় তখন অপমানে চোখে জল আসবেই। ছোট ভাইটা ক্লান্ত শরীর নিয়ে শুধু ডাল মেখে ভাত খাচ্ছে অথচ কিছুক্ষণ আগেও রোস্ট, খাসির মাংস, মাছ ভাজা সব রান্না হয়েছে। নিজের দিকে তাকিয়ে দেখি বৃষ্টিতে ভেজা টিশার্টটা শরীরেই শুকিয়ে গেছে।
আমাদের সমাজে কিছু কিছু মানুষ এখনো দলবল নিয়ে মেয়ে দেখতে যায়। তারপর কব্জি ডুবিয়ে খেয়ে, মেয়ে পছন্দ হয় নি বলে, বুক ফুলিয়ে চলে আসে। অথচ একটি বারও ভেবে দেখে না ১০জনের সামনে যে মেয়েটাকে রিজেক্ট করা হলো সেই মেয়েটা কতটা কষ্ট পেতে পারে। ২জনের কথা বলে ১০জন গিয়ে যখন হাজির হয় তখন মেয়ের পরিবারের মানুষজন কতটা বিব্রতকর পরিস্থিতে পড়তে পারে।
বিয়ের কথাবার্তা চলাকালীন মেয়েকে আলাদা ভাবে আপনি নিজে একবার দেখুন। যদি মেয়েকে দেখে আপনার পছন্দ হয় তাহলে বাবা-মা আর সাথে দুএকজন মুরব্বি নিয়ে মেয়ের বাড়িতে যান।
Copy post