19/05/2024
‘সেকালের পাঠশালা ও তার শিক্ষা ব্যবস্থা’
যাঁরা শ্রী সত্যজিৎ রায় পরিচালিত পথের পাঁচালি চলচ্চিত্রটি দেখেছেন, তাঁদের নিশ্চই গুরুমহাশয়ের সাজে সজ্জিত অভিনেতা শ্রী তুলসী চক্রবর্তী'র পাঠশালার দৃশ্যটি মনে আছে, যেখানে অপু পড়তে যেত। বেশ রাগী গুরুমশাই সেজেছিলেন শ্রী তুলসী চক্রবর্তী। বাস্তবে কেমন ছিল সেকালের পাঠশালা? কেমন ছিল তার শিক্ষা ব্যবস্থা? সেকাল বলতে সেই সময়ের কথা বলা হচ্ছে যখন বিদ্যাসাগর মহাশয় রচিত বর্ণপরিচয় এবং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত সহজপাঠ ছাত্রদের হাতে ওঠে নি। তখনকার শিক্ষা ব্যবস্থা ও পাঠশালার শিক্ষা ছিল বর্তমানের থেকে একেবারে ভিন্ন। মেয়েদের তখন পাঠশালায় যাবার অনুমতি ছিল না, তাই পাঠশালায় ছাত্রীরা থাকতেন না। এই প্রাচীন শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের বহু জ্ঞানী-গুণী মনীষী কে দিয়েছে। স্বয়ং পন্ডিত বিদ্যাসাগরও এরূপ পাঠশালায় নিজের ছাত্র জীবন শুরু করেছিলেন। শরৎচন্দ্র বা বঙ্কিমচন্দ্রের মতন ব্যক্তিরাও শুরু করেছিলেন পাঠশালা থেকেই।
সেকালে বর্তমান সময়ের ন্যায় বই হাতে করে স্কুলে গিয়ে পাঠারম্ভ করার রীতি ছিল না। প্রথমে একটা শুভদিন দেখে হাতে খড়ি হত এবং সেদিন পুরোহিত ঠাকুর অপেক্ষা গ্রামের গুরুমহাশয়ের প্রাপ্য বেশি ছিল। শিক্ষার্থী বালক কে শুভদিনে প্রাতঃকালে স্নান করিয়ে নতুন কাপড় পড়িয়ে দেওয়া হত। তারপরে পুরোহিত মশাই সরস্বতী পূজা করতেন। তারপরে গ্রামের পাঠশালায় গুরুমশাই মাটিতে খড়ি দিয়ে বড় বড় করে অ, আ, ক, খ (বেশি অক্ষর নয়) লিখে দিতেন এবং শিক্ষার্থী কে সেই লেখার ওপরে দাগা বুলাতে হত। এরই নাম ছিল ‘হাতেখড়ি’।
এই হাতেখড়ি হয়ে গেলে একটা শুভদিন দেখে ছেলেকে পাঠশালায় ভর্তি করে দেওয়া হত। পাঠশালায় তখন ছাপা বইয়ের বিশেষ প্রবেশাধিকার ছিল না। ছেলেরা তালপাতায় প্রথমে লেখা আরম্ভ করত। গুরুমশাই বা পাঠশালার সর্দ্দার ছেলেরা অর্থাৎ বড় ছেলেরা তালপাতায় ক, খ, গ, ঘ লিখে দিত, আর প্রথম শিক্ষার্থী তাতেই দাগা বুলাতো। তালপাতায় হাত ঠিক হলে ছেলেকে কলাপাতায় প্রোমোশন দেওয়া হত। তারপরে যখন হাতের লেখা মনের মতন হত, তখন ছাত্র কাগজে লেখার অনুমতি পেত। আর এই ‘তালপাতার ছাত্র’ থেকে ‘কলাপাতার ছাত্র’ হয়ে ‘কাগুজে ছাত্র’ হতে একজন ছাত্রের সাধারণত চার-পাঁচ বছর লাগতো। এর প্রধান কারণ যে, হাতের লেখার ওপরে সেকালের গুরুমহাশয়রা বিশেষ নজর দিতেন ও যত্ন নিতেন। তাই তখনকার ছাত্রদের হস্তাক্ষর অতি সুন্দর হত।
‘বর্ণপরিচয়’, ‘শিশুশিক্ষা’ বই বঙ্গদেশের পাঠশালায় প্রচলিত হবার আগে একখানি বটতলার বই পাঠশালায় খুব কদর পেত। সেই বইয়ের নাম ছিল 'শিশুবোধক'। এই বই আবার ছাত্রদের হাতে দেওয়া হত না। এটি ছিল পাঠশালার সম্পত্তি। বইখানির আগাগোড়া গুরুমশাই আর সর্দ্দার পোড়োদের কণ্ঠস্থ থাকত। তাঁরা সকল ছাত্র কে লাইন বেঁধে দাঁড় করিয়ে, সেই বই থেকে সুর করে একটু একটু করে আবৃত্তি করতেন, আর সকল ছাত্র তেমনি করে আবৃত্তি করত। সর্দ্দার পোড়োরা এমনি করে ফলা, বানান, শতকিয়া, কড়াকিয়া, নামতা, মনকষা প্রভৃতি ঘোষণা করতেন, আর সকলে তারই প্রতিধ্বনি করত। এমনি করে ছাত্রেরা ওই সকল নিরস নামতা, কড়া গন্ডা, মাসমহিনা সমস্তই অনায়াসে শিখে ফেলত; অক্লেশে সমস্ত কণ্ঠস্থ হয়ে যেত; ছেলেরা বুঝতেও পারতো না যে, তাঁরা ভীষণ অঙ্কশাস্ত্রটা এমন সহজে আয়ত্ব করে ফেলেছে। সত্যেন্দ্র প্রসন্ন সিংহ তাঁর বাল্য জীবনের কথা প্রসঙ্গে লিখেছিলেন যে, তিনি তাঁদের গ্রামের পাঠশালায় যে গণিত শিখেছিলেন, তাতেই তাঁর সুদীর্ঘ জীবনের হিসাব-নিকাশ চলে গিয়েছে, সেই পাঠশালার অঙ্কশাস্ত্রই তাঁর গণিতের পুঁজি ছিল। অতীতে যারাই পাঠশালায় পড়েছিলেন, তাঁরা সকলেই তাঁদের লেখনী তে স্বীকার করেছিলেন যে, সেকালের পাঠশালায় যে শুভঙ্করের সাক্ষাৎ পাওয়া গিয়েছিল তা পাটিগণিতের লঘুকরণ, লঘিষ্ঠ সাধারণ, ত্রৈরাশিক প্রভৃতি অপেক্ষা অধিক কাজের ছিল। অতি সহজ উপায়ে সেগুলি ছাত্রদের এমন নিজস্ব হয়ে যেত যে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত সে হিসাবের ভুল হত না।
এবারে আসা যাক সেকালের পাঠশালার ছাত্র - শাসন প্রসঙ্গে। বর্তমানের শিক্ষা ব্যবস্থায় ছাত্র - শাসন নিয়ে বিস্তর বিতর্ক ও হৈচৈ হয়। কিন্তু সেকালের তুলনায় এখনকার ছাত্র - শাসন কে নিতান্তই শিশু বলা চলে। বর্তমানে শিক্ষকরাই উল্টে ছাত্রদের সমঝে চলেন, তখন ছিল সম্পূর্ণ উল্টো বিষয়। এখনকার ছাত্ররা ইচ্ছা করলেই স্কুল কামাই করে, তারপরে স্কুলে যাবার দিন বাবা বা মা বা কোনও অভিভাবকের কাছ থেকে একটা চিঠি লিখিয়ে নিয়ে গেলেই হল, তাঁদের আর কিছু ভাবতে হয় না। নিতান্ত অমনোযোগী ও দুরন্ত ছেলেও স্কুলে তেমন শাস্তি পায় না। কোনও কোনও বেসরকারি স্কুলে আর্থিক জরিমানা করা হয়, নয়ত সব স্কুলেই হয়ত দাঁড়িয়ে থাকতে হয় একঘন্টা বা আধ-ঘন্টার জন্য। শিক্ষকের বেতের ভয় একরকম উঠেই গিয়েছে বলতে হলে। কিন্তু সেকালের পাঠশালার গুরুমশাইরা যে শাস্তি দিতেন সেটা শুনলে এখন অবিশ্বাস্য লাগতে বাধ্য এবং সাথে চিন্তা করলে হৃদকম্পও হবে।
সেকালের পাঠশালা থেকে ফাঁকি দেবার কোনও জো ছিল না। ছাত্র মনোযোগী হোক বা অমনযোগী, শান্ত হোক বা দুরন্ত, তাঁদের শিক্ষার সব ভার বাড়ির কর্তারা গুরুমশাইয়ের ওপরে ছেড়ে দিতেন। এবং সেই শাসন ক্ষমতা পেয়ে গুরুমশাইরা যে উপায় অবলম্বন করতেন, তার জন্য তাঁরা ছাত্রদের দিদিমা-ঠাকুরমাদের কাছে বিস্তর অভিধান বহির্ভূত গালাগালিও শুনতেন। কিন্তু তা সত্বেও তাঁরা কোনও ভাবে ছাত্রদের ওপর থেকে তাঁদের শাসনের রাশ আলগা হতে দিতেন না।
ধরা যাক, কোনও ছাত্র দিন তিনকের জন্য হয়ত পাঠশালায় উপস্থিত হয় নি। বর্তমানের পুলিশের গোয়েন্দাদের মতন সেকালের পাঠশালার ছাত্রদের মধ্যেও গোয়েন্দা থাকত। যে ছাত্র পাঠশালায় অনুপস্থিত, তাঁর সন্ধানে সেই ছাত্র গোয়েন্দারা খোঁজ শুরু করত। হয়ত তাঁরা সেই অনুপস্থিত ছাত্রের বাড়ি থেকে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলো যে, ছাত্রটি বাড়ি থেকে যথাসময়ে পাঠশালায় যাবার জন্য বের হয়, কিন্তু সেখানে গিয়ে পৌঁছায় না, অনেকটা বর্তমানের ছাত্রদের স্কুল পালানোর মতন, তখন তাঁরা সেই ছাত্রের পিছনে লেগে পড়ত। সেই ছাত্র কোথায় যায়, কি করে সময় কাটায় এসবের পুঙ্খানুপুঙ্খ তথ্য তাঁরা সংগ্রহ করত। সব তথ্য খবর প্রমাণ সমেত জোগাড় করে তাঁরা সেগুলো কানে তুলে দিত গুরুমশাইয়ের। এরপরে গুরুমশাই সেই অনুপস্থিত ছাত্র কে গ্রেপ্তার করে আনার হুকুম দিতেন। মোটামুটি পাঁচ-ছয়জন ছাত্র একাজের জন্য বের হয়ে পড়ত। ধরুন, সেই ছাত্রের নাম হয়ত নিতাই। তখনকার গ্রামে ফলের বাগানের কমতি ছিল না। গাছে ফলও প্রচুর থাকত, আর সেগুলো পেড়ে খেলে, নিতান্তই যদি বাগানের মালিক কিপটে না হতেন, তাহলে কেউ বাধা দিত না। এবারে ভাবুন, নিতাই নামের সেই ছাত্রটি রোজ পাঠশালা ফাঁকি দিয়ে তাঁর গ্রামের ঘোষদের বাগানে হানা দিত, গাছে চড়ে ফল ভক্ষণ করত। গুরুমশাইয়ের প্রেরিত গ্রেপ্তারি পরোয়ানা সমেত গোয়েন্দা ছাত্ররা সেখানে গিয়ে তাঁকে হাতে-নাতে পাকড়াও করল। গোয়েন্দারা সংখ্যায় ভারী, তাই বাধ্য হয়ে নিতাই কে অসহায় আত্মসমর্পণ করতে হল। এখন যতই আত্মসমর্পণ করুক, গোয়েন্দারা কিন্তু নিতাই কে হাঁটিয়ে নিয়ে আসবে না, হাজার হলেও গুরুমশাইয়ের আদেশ। তাঁরা নিতাই কে চ্যাংদোলা করে নিয়ে পাঠশালায় গুরুমশাইয়ের কাছে নিয়ে যাবার জন্য অগ্রসর হত। সাথে তাঁরা চিৎকার করে সকল কে জানান দিয়ে সমস্বরে ছড়া কাটতো,
“নিতাই যাবে শ্বশুরবাড়ি, সঙ্গে যাবে কে?
পাঠশালাতে জোড়া বেত নাচতে লেগেছে।”
ছাত্রের নাম অনুসারে ছড়ায় তাঁর নাম বদলে যেত, কিন্তু বাকি ছড়া আর পদ্ধতি একই থাকত।
আবার কখনও এই ছড়াও শুনতে পাওয়া যেত,
“এক তুলসী, দুই তুলসী, তিন তুলসীর পাতা।
গুরুমশাই বলে দেছেন কান মলবার কথা।।”
খালি ছড়া আওড়ালেই তো হবে না, কথার সাথে কাজের সম্পর্ক রাখতে হবে, বিশেষতঃ গুরুমশাই যেখানে আদেশ করেছেন, তাই ছড়া বলতে বলতে গোয়েন্দা ছাত্ররা গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া ছাত্রের কানদুটোও আচ্ছা করে মুলে রাঙা করে দিত। এখনকার ছাত্ররা এটাকেই কঠোর শাস্তি বলে মনে করবে, কিন্তু এখানেই ঘটনা শেষ হত না। এগুলো ছিল শাস্তির শুরুমাত্র, পাঠশালায় পৌঁছনোর পরে আরও কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা হত। পিঠে পড়ত জোড়া বেত। এটা ছিল শাস্তির দ্বিতীয় পর্ব। এটা শেষ হলে, কড়া রোদ হোক বা প্রবল বর্ষা বা প্রচন্ড শীত, ছাত্রকে পাঠশালার উঠানে দুই পা ফাঁক করে হাতে থান ইঁট নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে হত। এগুলো ছাড়াও আরও বহুল রকমের শাস্তি গুরুমশাইরা সেকালের অবাধ্য, দুরন্ত ছাত্রদের জন্য আবিষ্কার করেছিলেন। এগুলো বর্তমানে কল্পনাতেও আনা যায় না।
এবারে বলা যাক পাঠশালার শিক্ষা প্রণালীর কথা। সেকালের বালকগণ ছয়-সাত বৎসর বয়সে পাঠশালায় প্রবেশ করত, আর পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করতে তাঁকে ষোল-সতেরো বৎসর বয়স পর্যন্তও তাঁকে পাঠশালায় অবস্থান করতে হত। স্থূলবুদ্ধি, অমনযোগী ছাত্রদের বাইশ-তেইশ বৎসর বয়স পর্যন্তও পাঠশালায় অধ্যয়ন করাটা তখনকার দিনে বিশেষ কোনও ব্যাপার ছিল না। তবে ওই বয়স পর্যন্ত যারা পাঠশালায় থাকত বা থাকতে বাধ্য হত, তাঁদের অভিজ্ঞতা খুব একটা সুখকর হত না। পাঠশালার দুষ্টু বালকেরা সেই সব অধিক বয়সী ছাত্রদের নানা প্রকারে উত্যক্ত করত, তাঁদের নিয়ে ঠাট্টা-তামাশা করত, এমনকি তাঁদের নিয়ে ছড়া কাটতেও ছাড়ত না।
সেকালের পাঠশালার ছাত্রদের দেখলেই চিনতে পারা যেত। কোনও ইউনিফর্মের বালাই তখন ছিল না। কিন্তু ছাত্ররা মোটামুটি একই ধরনের পোষাক পরিধান করত। তাঁদের পরনে থাকত মসী-রঞ্জিত স্বদেশী মোটা জোলার ধুতি; নাকে, মুখে, গালে, হাতে পায়ে বিশেষতঃ তাঁদের পায়ের দুই হাঁটুতে বহুদিনের সঞ্চিত চিত্র বিচিত্র কালির দাগ থাকত। বর্তমানের ন্যায় তখন বিবিধ নামের ও বিবিধ ধরণের সাবান ছিল না, অনেকে তো সাবান কি পদার্থ সেটাও জানতেন না। খোল ও ডালবাটা তখন সাবানের কাজ করত। মাঝে মাঝে পিসিমা-মাসিমাদের এসব দ্রব্যের দ্বারা প্রক্ষলনের মলিনতা কিছু কম পড়ত মাত্র।
পাঠশালায় প্রত্যেক ছাত্রের বসার জন্য স্বতন্ত্র আসন থাকত। তার অধিকাংশই ছিল নলের চাটাই, পাটির ছিন্ন খন্ড, বুনানো ছোট হোগলা এবং ছালার চট।
লেখার প্রথমেই উল্লেখ করেছি যে, ছাত্ররা লেখা আরম্ভ করত তালপাতায়। পাঠশালা ছুটি হলে তালপাতার গড়া আসন মুড়ে ছাত্ররা নিজের বাড়িতে নিয়ে যেত আবার পাঠশালায় আসার সময় সেটা সাথে করে নিয়ে আসত। তালপাতায় লেখা শিক্ষা শেষ হলে, অপেক্ষাকৃত বড় ছেলেরা কলাপাতায় লিখত, তারপরে সেই শিক্ষা সমাপ্ত হলে বয়স্ক ও শ্রেষ্ঠ ছাত্ররা কাগজে লেখার অনুমতি পেত। তাঁদের কাগজ-কলম একটা মোটা পুরানো কাপড়ের খণ্ডে মুড়ে বাঁধা হত। এর ডাক নাম ছিল ‘বস্তানি’ বা ‘দপ্তর’। বড় ছাত্রদের এই দপ্তরে দু’-একখানি পুস্তকও থাকত। সেই সব পুস্তকের নাম ছিল ‘শিশুবোধক’, ‘গঙ্গাভক্তি-তরঙ্গিনী’ ইত্যাদি।
অধিকাংশ ছাত্র খাগের কলমে লিখত। তখন ফাউন্টেন পেন ছিল কল্পনার অতীত। এমনকি লোহার বা পিতলের নিব বা লম্বা কাঠের হ্যান্ডেল তখনও চালু হয় নি। পেনের কলম কদাচিৎ কারও কারও কাছে দেখা যেত। কালি থাকত মাটি কিংবা কড়ির দোয়াতে। চীনা মাটির তৈরি দোয়াত কে বলা হত ‘কড়ির দোয়াত’। ছাত্ররা নিজের হাতে কালি তৈরি করত। কালি তৈরির উপকরণ ছিল নারকেলের ছোবড়া, বাঁশের খোসা, ভাতের হাঁড়ির তলা থেকে ঝিনুকে চাঁচা কালি, লোহা, হরতকি ও পোড়া চালের জল ইত্যাদি। এরমধ্যে লোহা আর পোড়া চালের জলের কালি উৎকৃষ্ট বলে গণ্য হত। বাঁশের খোসা আর নারকেলের ছোবড়া পুড়িয়ে যে কালি তৈরি হত সেটা নিম্নমানের হত। ভাতের হাঁড়ির কালি মধ্যম রকমের বলে গণ্য হত। ছাত্ররা কালি তৈরি করার সময় একটা ছড়া কাটতো,
“কালি ঘুটি কালি ঘুটি সরস্বতীর বরে,
যার দোয়াতের ঘন কালি মোর দোয়াতে পড়ে।”
সেসময় দেশে ও গ্রামে এখনকার মতন উৎকৃষ্ট কাগজ ছিল না। দেশীয় জোলারা এক ধরনের মোটা কাগজ প্রস্তুত করত, সেটার দিস্তা ছিল তিন/চার পয়সা। শ্রীরামপুরী ও অন্যান্য প্রকারের সাদা কাগজ অল্প বিস্তর পাওয়া যেত। সেই কাগজে লিখতে আরম্ভ করলে ছাত্ররা বিশেষ গৌরান্বিত বোধ করত।
এখন যেমন রবিবারে স্কুল ছুটি থাকে তখন তেমন কোনও নিয়ম ছিল না। তখন চতুর্দশী, অমাবস্যা, প্রতিপদ ও পূর্ণিমা এই চারটে তিথিতে পাঠশালার কাজ বন্ধ থাকত। এই ছুটির সময়ে ছাত্ররা লেখার কালি প্রস্তুত করত, বন-জঙ্গল থেকে খাগের কলম সংগ্রহ করে আনত এবং দশ-পনেরো দিনের উপযোগী কলার পাতা কেটে রাখত। এই ছুটি আসলে ছাত্রদের আনন্দের সীমা থাকত না। তাঁরা গরমের দিনে দলে দলে মিলিত হয়ে গ্রামের পুকুরে, অপ্রশস্ত খালে ঘন্টার পর ঘন্টা সাঁতার কেটে, ডুব দিয়ে একেক জন আরক্ত-নয়ন হয়ে উঠতো। পুনরায় আহারান্তে বিকেল বেলা আম, জাম, গাব, বেতফল প্রভৃতি সেকালের গ্রাম্য ফলের অন্বেষণে সকলে জঙ্গলে ও বাগানে পরিভ্রমণ করত, এবং গাছে চড়ে ফলাহারে উদর্পূর্তি করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরত। শীতের দিনে খেজুর রস, কখনও বলে আবার কখনও না বলে, নানা ভাবে শিয়ালীর (যারা খেজুর গাছ কাটে) অগোচরে পান করত। ভাদ্র মাসে নষ্টচন্দ্রের রাত্রিতে ফল প্রভৃতি চুরি করলে কোনও অপরাধ হয় না, এই বাক্যের সারবত্তা উপলব্ধ করে ছাত্ররা এবং গ্রামের যুবকেরা একযোগে প্রতিবেশী গৃহস্থের বাড়ি থেকে শশা, কলা, তাল, নারকেল ইত্যাদি অবাধে মহোৎসাহে আত্মসাৎ করে উদরসাৎ করত। নষ্টচন্দ্রের রাতে ছেলেরা এসব করেই থাকে বলে গৃহস্থরা এসব অত্যাচার উপেক্ষা করতেন।
এখন যেমন বিয়ের জন্য পাত্রের শিক্ষায় প্রাপ্ত ডিগ্রী প্রধান, কুলশীল, ছেলের চরিত্র পরের কথা - তখন কিন্তু এরূপ ব্যবস্থা ছিল না। তখন ছেলের বংশ, তাঁর স্বাস্থ্য ও তাঁর স্বভাব-চরিত্রের সন্ধান আগে নেওয়া হত। এরপরে আসত ছেলের বিদ্যার পরিচয়। ছেলের বিদ্যার পরিচয় নেবার সময় দেখা হত তাঁর হস্তাক্ষর এবং তাঁর পরীক্ষা নেওয়া হত মৌখিক অঙ্কের। যে ছেলের হস্তাক্ষর ভালো ও যে মুখে মুখে ভালো অঙ্ক করতে পারত, তাঁকেই জামাই হিসাবে মনোনীত করা হত।
তখন হাতেখড়ি ব্যাপারটা ছিল এখনকার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। শিশুদের হাতেখড়ি হয়ে গেলে গুরুমশাই তালপাতায় একটি লোহার শলা দিয়ে ‘ক’ থেকে ‘ক্ষ’ পর্যন্ত এঁকে দিতেন। কোন অক্ষরের কোন স্থান থেকে প্রথম কলম ধরে কোথায় শেষ করতে হবে, গুরুরা সেটা বালকদের হাতে ধরে লিখে শিখাতেন। গুরুমশাই নিজের হাতের মুঠোর মধ্যে শিশুর কলম সংযুক্ত হাত রেখে লিখতেন। একেই 'হাতে ধরে লেখা' বলত।
পাঠশালায় অক্ষর পরিচয়েরও একটা সুন্দর নিয়ম ছিল। তাতে শিশুদের কৌতূহলী চিত্ত সহজেই অক্ষর পরিচয় লাভ করতে পারত। প্রত্যেক অক্ষরের আগে একটা অদ্ভুত বিশেষণ যুক্ত করা হত। বিশেষণগুলো সত্যি-সত্যিই অক্ষরের অবয়ব অনুসারে থাকত। যেমন-
কাকুরে ‘ক’, মাথায় পাক ‘ঙ’, দোমাত্রা ‘জ’, পিঠে বোঁচকা ‘ঞ’। নাইমাত্র ‘ণ’, হাঁটুভাঙা ‘দ’, কাঁধেবাড়ী ‘ধ’, পুটুলিয়া ‘ন’,
পেটকাটা ‘ব’, অন্তস্থ্য ‘ব’, পেটকাটা ‘ষ’, ইত্যাদি।
এই ‘ক’ ‘খ’ শিক্ষার পরেই ছাত্ররা তালপাতাতেই ফলা ও বানান লিখত। ফলার মধ্যে কয়েকটা নামই উল্লেখযোগ্য। যেমন- ক্য, ক্ৰ, ক্ল, ক্ক, কৃ, আঙ্ক, সিদ্ধি ইত্যাদি। এইভাবে ‘ক’ থেকে ‘হ’ পর্যন্ত প্রতিটি ব্যাঞ্জনের সাথে য, র, ন, ল, ব, ম, ঝ এবং রেফ প্রভৃতি বর্ণের যোগ করে লিখতে হত। আঙ্ক, আস্ক, ফলার ঙ, ঞ, ন, ম এই কয়েকটি অর্থাৎ বর্গের পঞ্চম বর্ণগুলির যোগে এবং আস্ক ফলার যোগে ব্যঞ্জন ও বিসর্গ সন্ধির যুক্তবর্ণগুলিই কার্যত লেখার শিক্ষা দেওয়া হত। এই ফলা শিক্ষার সময়টা সকল বালকের কাছে অতি কঠিন শিক্ষার কাল বলে মনে হত। এগুলো কোনও বালক তিন-চার মাসের মধ্যে শিখে নিতে পারলে সে বিশেষ প্রশংসা পেত।
গণিত শিক্ষার জন্য এক থেকে একশো পর্যন্ত রাশি লেখাকে শতকিয়া, এক কড়া থেকে আশি কড়ায় ২০ গন্ডা পর্যন্ত লেখাকে কড়াকিয়া বলা হত। পাঠশালায় এই তালপাতায় গণিত শিক্ষার সময়েও অক্ষরের ন্যায় রাশি শিক্ষার জন্য একেকটি বিশেষণ অথবা পদার্থের নাম শেখানো হত। তাতে অঙ্ক-রাশির পরিচয় সহজ হত। এই পদ্ধতি বর্তমানেও বাংলা মাধ্যমে আছে। একে চন্দ্র, দুইয়ে পক্ষ, তিনে নেত্র, চারে বেদ ইত্যাদি।
তালপাতার শিক্ষা শেষ হলে শুরু হত কলার পাতায় শিক্ষা। এতে লোকের নাম লেখাই প্রধান ছিল। অর্থাৎ বানান যোগে ভাষার ভিতরে যত নাম আছে সেগুলো লিখতে গেলে কার্যত ভাষা শিক্ষা বা সামান্য সাহিত্য শিক্ষার কাজ হত। তারপরে কড়াকিয়া, পণকিয়া, সেবকিয়া এবং ছটাক, মণ প্রভৃতি লিখতে শেখানো হত। কেবলমাত্র লিখলেই হত না, প্রতিদিন দুই বেলা করে এইসব অঙ্কের যোগ বিয়োগ করতে হত। গুণ শেখার জন্য ২০০ ঘর পর্যন্ত নামতা শিক্ষাই একমাত্র শ্রেষ্ঠ পন্থা ছিল। এইভাবে এক বছর বা ছয় মাস ধরে কলার পাতায় লেখা শিক্ষা শেষ হলে বালক হাতে পেত কাগজ।
কাগজে প্রথমে পত্র লেখাই শ্রেষ্ঠ বিষয় ছিল। যারা কাগজে লিখত তাঁরা প্রধান ছাত্রদের মধ্যে পরিগণিত হত। গুরুজনদের কাছে পাঠ লেখা, কনিষ্ঠদের কাছে, সমবয়সীদের কাছে নানা ভাবের পাঠ লেখা শিখতে হত। তারপরে কওয়ালা, কর্জ্জপত্র ইত্যাদি সংসার পথের উপযোগী অনেক দলিল লেখার শিক্ষা দেওয়া হত। পাঠশালায় উচ্চ-গণিত শেখার সময়ে কালিকষা, মাসমহিনা, মনকষা, জমাবন্দী, রোজনামা লিখন, খতিয়ান, তেরিজ লিখন এবং শুভঙ্করী প্রভৃতি শিক্ষা দেওয়া হত। এটাই পাঠশালার শেষ শিক্ষা বলে গণ্য হত।
এই পাঠশালার শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে তখনকার দিনের অনেক গণ্য মান্য ব্যক্তি চাকরি করেছেন, শিক্ষকতা করেছেন আবার সাহিত্যিক, বহুভাষাবিদ, বৈজ্ঞানিক এমনকি গণিতজ্ঞ পর্যন্ত হয়েছেন। পাঠশালা সকাল আর বিকেল, দুই বেলাই বসত। উপরের শ্রেণীর ছাত্ররা নিচের শ্রেণীর ছাত্রদের তাঁদের লিখিত বিষয়গুলি পড়িয়ে দিত। উচ্চ শ্রেণীর ছাত্ররা বলতে গেলে ছিল গুরুমশাইয়ের সহযোগী। পাঠশালার ছুটি হলে দুইবার সমস্ত ছাত্র একত্র হয়ে নামতা পড়ত। দুই তিনজন উচ্চ শ্রেণীর ছাত্র কোনও উঁচু জায়গায় দাঁড়িয়ে সুর করে নামতা বলত, আর বাকিরা তাঁদের সাথে সুর মেলাতো। এই নামতা পড়া ছিল পাঠশালা বন্ধের মৌখিক বিজ্ঞপ্তি। একে বলা হত ‘ডাক-নামতা’। পাঠশালার একজন মধ্যম মানের ছাত্রও অনায়াসে ২০০ ঘর পর্যন্ত নামতা জানত।
(তথ্যসূত্র:
১- সেকালের কথা, রায় শ্রীজলধর সেন বাহাদুর।
২- সেকালের কথা, রবীন্দ্র কুমার দাশগুপ্ত, গাঙচিল (২০১২)।
৩- সেকাল ও একাল, রাজনারায়ণ বসু।)
©Samparko- সম্পর্ক