10/10/2020
জীবনে বাঁচার জন্য আমরা খাবার খাই। খাবারের মধ্যে আছে সস্তা খাবার, বাজে খাবার এবং পুষ্টিসম্মত সুষম খাবার। আবার দামি ও সস্তা খাবারও আছে। সবচেয়ে বেশি ভালো পুষ্টিসম্মত সুষম খাবার। অনেকে মনে করেন পুষ্টিসম্মত সুষম খাবার খেতে হলে খরচ বেশি পড়বে অনেক দামি হবে। কথাটা কিন্তু মোটেই ঠিকনা। বুদ্ধি জ্ঞান দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা দিয়ে বিবেচনা আর ভেবে-চিন্তে তালিকা করলে কম দামেই প্রয়োজনীয় সুষম পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবারের জোগান দেয়া যায় খাওয়া যায়। খাবারের প্রতি আমাদের যেমন অতি রসনা বিলাস আর আগ্রহ আছে পুষ্টির প্রতি কিন্তু তেমনটি নেই। সে কারণেই পুষ্টি নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয় অহরহ। আমাদের দেশে পুষ্টিতে যেমন ভুগছি আবার অতিপুষ্টিতেও ভুগছি কেউ কেউ। এ শুধু পুষ্টি জ্ঞানের অভাবেই এমনটি হয়। একটু বিবেচনা পরিকল্পনা আর মেধা দক্ষতা খাটালে আমরা নিয়মিত পরিমিত পুষ্টি সমৃদ্ধ খাবার খেয়ে ভালোভাবে সুস্থ সবল হয়ে বেঁচে থাকতে পারি, হাজারো অসুখ-বিসুখ রোগবালাই থেকে নিজেদের মুক্ত রাখতে পারি। আসলে আমাদের প্রয়োজন দৈহিক, মানসিক আর বুদ্ধিবৃত্তির প্রয়োজনে খাদ্য গ্রহণ।
বাংলাদেশ খাদ্য উৎপাদনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হলেও শিশু ও মাতৃপুষ্টি নিশ্চিতকরণ এবং ব্যক্তিগত ও পারিবারিক পর্যায়ে বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্যের সমন্বয়ে পরিপূর্ণ পুষ্টি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ এখনও বিরাট চ্যালেঞ্জ। বিশেষ করে শিশু পুষ্টির জন্য মায়ের দুধ পান ও পরিপূরক খাবার গ্রহণের হার এখনও অপ্রতুল। ব্যক্তির খাবারে খাদ্য উপাদান যথাযথ পরিমাণে না থাকা বা অতিরিক্ত থাকা অপুষ্টি এবং দীর্ঘমেয়াদি রোগে আক্রান্ত হওয়ার প্রধান কারণ। সুষম খাদ্য নির্বাচন ও গ্রহণের মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলো সহজেই প্রতিরোধ করা সম্ভব। খাদ্যের সাথে সুস্বাস্থ্যের সম্পর্ককে সঠিকভাবে প্রকাশ করার জন্য এখনও গবেষণার প্রয়োজন। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী বর্তমানে ২ রকমের অপুষ্টির শিকার। খাদ্যের অভাবজনিত পুষ্টিহীনতা এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগগুলো। খাদ্যের অভাবজনিত উল্লেখযোগ্য পুষ্টিহীনতার মধ্যে রয়েছে খর্বকায়, নিম্ন ওজন এবং কৃশকায়। খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি অসংক্রামক রোগগুলো হলো স্থূলতা, উচ্চরক্তচাপ, ডায়াবেটিস, হৃদরোগ, স্ট্রোক, ক্যান্সার ও বেশি বয়সে হাড় নরম হয়ে যাওয়া।
খাদ্য গ্রহণের সাথে জড়িত অপুষ্টি এবং খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার কমানোর লক্ষ্যে বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া হয় যে, নিজস্ব খাদ্যাভ্যাসের সাথে মিল রেখে প্রতিটি দেশের একটি খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা থাকা প্রয়োজন। জাতীয় খাদ্য ও পুষ্টিনীতি এবং বাংলাদেশ জাতীয় পুষ্টি পরিকল্পনা ১৯৯৭ এর অন্যতম প্রধান লক্ষ্য ছিল খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা প্রকাশ। খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলোর মৃত্যুহার অপুষ্টিজনিত মৃত্যুর হারের চেয়ে বহুগুণ বেশি। এজন্য বাংলাদেশ জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা, কৃষি ও পুষ্টি সংক্রান্ত বিনিয়োগ পরিকল্পনায় (২০১১-২০১৫) এবং জাতীয় পুষ্টিনীতি ২০১৫ তে জাতীয় খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকা প্রকাশকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়। এছাড়াও জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থা এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রতিটি জাতিকে নিজস্ব খাদ্য গ্রহণ নির্দেশিকায় বিশেষ কতগুলো তথ্যযুক্ত করার পরামর্শ দেয়। সাম্প্রতিক খাদ্যের অভাবজনিত অপুষ্টির চিত্র, খাদ্য সংক্রান্ত দীর্ঘমেয়াদি রোগের হার, সাম্প্রতিক খাদ্য গ্রহণের ধরন, এছাড়াও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে প্রকাশিত বিভিন্ন বয়সের খাদ্য উপাদানের চাহিদা, মৌসুমি খাবার এসব অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বর্তমান খাদ্য উপাদানের চাহিদা, মৌসুমি খাবার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করে বর্তমান খাদ্য নির্দেশনা করা হয়েছে। গবেষণালব্ধ জ্ঞানের ভিত্তিতে প্রণীত খাদ্য গ্রহণ নির্দেশনা উন্নত পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণে সাহায্য করবে।
আঞ্চলিক খাদ্যাভাসের সাথে খাদ্য বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। মৌলিক খাদ্যগুলো অর্থাৎ ভাত, রুটি, মাছ, মাংস, দুধ ডিম, ডাল, শাকসবজি ও ফলমূল সঠিক পরিমাণে গ্রহণ করতে হবে। খাদ্য গ্রহণ প্রক্রিয়ায় খাদ্য বিনিময় ও পরিবেশনের ওপর গুরুত্ব দেয়া জরুরি। সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য প্রত্যেক খাদ্য বিভাগ থেকে পরিমিত পরিমাণে খাদ্য গ্রহণকেই প্রাধান্য দেয়া উচিত। পুষ্টিসম্মত খাদ্য গ্রহণের লক্ষ্যগুলো হলো- বাংলাদেশের জনগণের পুষ্টিগত অবস্থার উন্নয়ন এবং পুষ্টি উপাদনের অভাবজনিত রোগগুলো প্রতিরোধ করা; গর্ভবতী ও স্তন্যদাত্রী মায়েদের যথাযথ পুষ্টিগত অবস্থা বজায় রাখা; শিশুদের সঠিকভাবে মায়ের দুধ ও পরিপূরক খাবার খাওয়ানো নিশ্চিত করা; খাদ্যাভ্যাসের সাথে সম্পর্কিত দীর্ঘমেয়াদি রোগগুলো প্রতিরোধ এবং নিয়ন্ত্রণ করা; বয়স্কদের সুস্বাস্থ্যের সাথে আয়ুষ্কাল বাড়ানো। বাংলাদেশের জনসংখ্যার মধ্যে এক তৃতীয়াংশের বেশি শিশু প্রোটিন ও ক্যালরিজনিত পুষ্টিহীনতায় ভোগে, যার মধ্যে খর্বাকৃতি ৩৬ শতাংশ, কৃষকায় ১৪ শতাংশ এবং নিম্ন ওজনে রয়েছে ৩৩ শতাংশ। গড়ে এক চতুর্থাংশ মহিলা দীর্ঘস্থায়ী ক্যালরিজনিত অপুষ্টিতে ভোগে, যাদের অধিকাংশেরই দেহে একই সাথে জিংক, আয়রন ও আয়োডিনের স্বল্পতা রয়েছে। এসব আমাদের সর্তকতার সাথে লক্ষ রাখতে হবে।
আদর্শ খাদ্য গ্রহণের জন্য...
জনগণের সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য খাদ্য গ্রহণ ১০টি নির্দেশাবলি এবং পুষ্টিবার্তা আছে। যা সাধারণ জনগণের জন্য সহজবোধ্য । এটি পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণ সম্পর্কে সময়োপযোগী ধারণার প্রেরণা জোগাবে। এর মাধ্যমে জনগণ কোন খাদ্য কি পরিমাণ গ্রহণ করবে, প্রতিদিন কি পরিমাণ তেল, লবণ, চিনি ও পানি গ্রহণ করবে সেই সম্পর্কে বিজ্ঞানভিত্তিক ধারণা পাওয়া যাবে। এতে বিভিন্ন খাদ্যের সুফল ও কুফল সম্পর্কেও সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া হয়েছে। নির্দেশাবলিতে নিরাপদ খাদ্য ও রান্না সম্পর্কিত প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দেয়া হয়েছে, যা প্রয়োগ করলে খাদ্যের পুষ্টি উপাদানের অপচয় রোধ হবে এবং সুস্বাস্থ্য বজায় থাকবে। প্রতিদিন সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ খাদ্য গ্রহণ; পরিমিত পরিমাণে তেল ও চর্বিজাতীয় খাদ্য গ্রহণ; প্রতিদিন সীমিত পরিমাণে আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ; মিষ্টিজাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণ গ্রহণ; প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পানি ও পানীয় পান; নিরাপদ খাদ্য গ্রহণ; সুষম খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি নিয়মিত শারীরিক শ্রমের মাধ্যমে আদর্শ ওজন বজায় রাখা; সঠিক পদ্ধতিতে রান্না, সঠিক খাদ্যাভ্যাস এবং সুস্থ জীবনযাপনে নিজেকে অভ্যস্তকরণ; গর্ভাবস্থায় এবং স্তন্যদানকালে চাহিদা অনুযায়ী বাড়তি খাদ্য গ্রহণ; শিশুকে ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ দিন এবং ৬ মাস পর বাড়তি খাদ্য প্রদান।
প্রতিদিনের সুষম ও বৈচিত্র্যপূর্ণ পুষ্টি...
প্রতিদিন চাহিদা অনুযায়ী ভাত, রুটি বা অন্যান্য শস্যজাতীয় খাদ্য গ্রহণ; ভাত ও রুটির সাথে ডাল-মাছ-মাংস-ডিমজাতীয় খাবারের সমন্বয়ে তৈরি খাদ্য গ্রহণ; চাল অতিমাত্রায় না ধুয়ে বসাভাত রান্না ও গ্রহণ; লাল চাল ও লাল আটা হলো প্রোটিন, আঁশ, তেল, খনিজ লবণ ও ভিটামিনের উৎস সে জন্য পারতপক্ষে এগুলো বেশি করে গ্রহণ। প্রতিদিন মাঝারি আকারের ১-৪ টুকরা মাছ-মাংস এবং ১ থেকে ১/২ কাপ ডাল (৩০-৬০ গ্রাম) গ্রহণ; প্রাণিজ প্রোটিনের অনুপস্থিতিতে ভাত ও ডাল অথবা মুড়ি ও ছোলার ওজনের আদর্শ অনুপাত ৩:১ বজায় রাখা; প্রতিদিন কমপক্ষে ২টি মৌসুমি ফল (১০০ গ্রাম) গ্রহণ করা। ১টি চাপা কলা, ১টি আমড়া এসব খাওয়া; খাদ্য গ্রহণের পর আয়রনের পরিশোষণ বাড়ানোর জন্য ভিটামিন সি সমৃদ্ধ ফল যেমন আমলকী, পেয়ারা, জাম্বুরা, পাকা আম খাওয়া; প্রতিদিন অন্তত ১০০ গ্রাম বা ১ আঁটি শাক এবং ২০০ গ্রাম বা ২ কাপ সবজি গ্রহণ; সুস্থতার জন্য প্রতিদিন কমপক্ষে ১ কাপ (১৫০ মিলিলিটার) দুধ বা আধা কাপ দই গ্রহণ; বৃদ্ধকালে ননিতোলা দুধ এবং সয়াদুধ গ্রহণ করুন।
তেল ও চর্বিজাতীয় পুষ্টিবার্তা : প্রতিদিন প্রাপ্ত বয়স্ক জনপ্রতি গড়ে ৩০-৪৫ মিলিলিটার বা ২-৩ টেবিল চামচ তেল গ্রহণ; রান্নায় প্রধানত উদ্ভিজ তেল যেমন- সরিষা, সয়াবিন, রাইসব্রান তেল ব্যবহার; ঘি, ডালডা ও মাখন যথাসম্ভব কম ব্যবহার; অতিরিক্ত ভাজা এবং তৈলাক্ত খাবার বর্জন; নিয়মিত উচ্চ চর্বিযুক্ত বেকারির খাদ্য কেক, পেস্ট্রি, ফাস্টফুড, হটডগ, বার্গার, উচ্চ ক্যালরিযুক্ত খাদ্য পরোটা, কাচ্চি, বিরিয়ানি, পোলাও, কোরমা, রেজালা, প্রক্রিয়াজাত মাংস, গ্রিল চিকেন এসব পরিহার করা। এ খাবারগুলোতে ট্রান্সফ্যাট থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর; বাজারের সনদবিহীন খোলা তেল গ্রহণ থেকে বিরত থাকা আবশ্যকীয়।
আয়োডিন ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্যের পুষ্টিবার্তা প্রতিদিন ১ চা চামচের কম পরিমাণ আয়োডিনযুক্ত লবণ গ্রহণ; খাবারের সময় বাড়তি লবণ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা; উচ্চমাত্রার লবণাক্ত খাদ্য বাদ দেয়া বা সীমিত পরিমাণে গ্রহণ; টেস্টিং সল্ট গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকা। দৈনিক ২৫ গ্রাম বা ৫ চা চামচ এর কম পরিমাণে চিনি গ্রহণ করা; মিষ্টি কোমল পানীয় বর্জন করা; বেকারির তৈরি খাবার বিস্কুট, কেক, জ্যাম জেলি, চকলেট, ক্যান্ডি মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় খাদ্য সীমিত পরিমাণে গ্রহণ করা; বিভিন্ন প্রকার মৌসুমি ফল খেয়ে প্রাকৃতিক চিনি গ্রহণকে উৎসাহিত করা। আর পানি গ্রহণ সংক্রান্ত পুষ্টিবার্তা হলো- প্রতিদিন ১.৫-৩.৫ লিটার অর্থাৎ ৬-১৪ গ্লাস বিশুদ্ধ পানি পান করা; কোমল পানীয় এবং কৃত্রিম জুসের পরিবর্তে ডাবের পানি অথবা টাটকা ফলের রস পান করা বেশি পুষ্টিসম্মত।
গর্ভবতী নারীর জন্য...
গর্ভাবস্থায় আয়রন সমৃদ্ধ খাদ্য যেমন মাংস, বুটের ডাল, পাটশাক, কচুশাক, চিড়া গ্রহণ; এ সময় মৌসুমি ফল বিশেষ করে খাবারের পর পর খাওয়া; চা, কফি প্রধান দুই খাবারের মধ্যবর্তী সময়ে গ্রহণ; গর্ভাবস্থায় সঠিক ওজন বৃদ্ধি বজায় রাখা; একবারে খেতে না পারলে বারে বারে খাওয়া; খাবার সম্পর্কিত ভ্রান্ত ধারণা ও কুসংস্কার এড়িয়ে চলা; নিয়মিত স্বাস্থ্য পরিচর্যা ও চেকআপ করানো।
শিশুদের জন্য...
শিশু জন্মের পর ১ ঘণ্টার মধ্যে শাল দুধ পান করানো; শিশুর বৃদ্ধির জন্য ৬ মাস বয়স পর্যন্ত শুধু মায়ের দুধ খাওয়ানো; প্রসূতি মায়ের জন্য পারিবারিকভাবে আন্তরিক সহযোগিতা ও পর্যাপ্ত বিশ্রাম নিশ্চিত করা; শিশুর ৬ মাস পূর্ণ হলে মায়ের দুধের পাশাপাশি যথাযথ পরিপূরক খাবার আলুসিদ্ধ, ডিমসিদ্ধ, পাকাকলা, খিচুড়ি দেয়া এবং ২ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ খাওয়ানো; ১ বছর বয়স থেকে শিশু নিজে নিজে খাবে, জোর করে খাওয়ানো ঠিক নয়; শিশুকে কোমল ও মিষ্টি পানীয় দেয়া থেকে বিরত রাখা কেননা এগুলো দাঁতের ক্ষয় ঘটায়; স্তন্যদাত্রী মাকে ধূমপান, মদ্যপান, তামাক ও ক্ষতিকর ওষুধ সেবন থেকে বিরত রাখা।
পুষ্টিসম্মতভাবে রান্না...
সবজি রান্নার জন্য উচ্চ তাপে ও কম সময়ে রান্নার পদ্ধতি অনুসরণ করা; ভাঁপানো এবং সেঁকা খাবার বেশি পুষ্টিসম্মত; কাটার পরে ফল ও সবজি বাতাসে খোলা অবস্থায় না রাখা; রান্নার সময় ঢাকনা ব্যবহার করা; কম পানিতে কম মশলায় রান্না করা; ভাজায় ব্যবহৃত তেলে পুনঃব্যবহার এড়িয়ে চলা; রান্নার পর খাদ্যাভাসের জন্য : খাবার সময়মতো গ্রহণ এবং অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণ এড়িয়ে চলা; খাবার ভালোমত চিবিয়ে খাওয়ার অভ্যাস কার; খাবারের শেষে মৌসুমি ফল খাওয়া; কম বয়সী ও বৃদ্ধদের অতিরিক্ত খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত রাখা।
সুস্থ জীবনযাপনে...
খাবারের পরপরই ঘুমানোর অভ্যাস বাদ দেয়া এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখার জন্য দৈনিক ৬-৮ ঘণ্টা সুনিদ্রার অভ্যাস করা; দৈনিক কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট শারীরিক পরিশ্রম করা; ধূমপান, মদ্যপান, তামাক এবং সুপারি চিবানোর মতো অভ্যাসগুলো বাদ দেয়া; খাওয়ার আগে, খাওয়ার পরে, রাথরুম ব্যবহারের পরে এবং বাইরে থেকে বাড়িতে ঢুকে সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার অভ্যাস করা; প্রতি সপ্তাহে একবার নখ কাটা; ২ বছর বয়স থেকে প্রত্যেকে (গর্ভবর্তী মা ব্যতীত) ৬ মাস পরপর একবার কৃমিনাশক ট্যাবলেট খাবারের পর গ্রহণ করা; বছরে অন্তত একবার পুরো শরীর মেডিকেল চেকআপ করানো আবশ্যকীয়।
নিরাপদ খাদ্য গ্রহণে...
বাসি, পচা ও দূষিত খাদ্য গ্রহণের ফলে মানুষের মারাত্মক অসুস্থতা এমনকি মৃত্যুও হতে পারে। ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস এবং ছত্রাকের আক্রমণ খাদ্য ও পানীয়কে বিষাক্ত করে তোলে। ইঁদুর ও বিষাক্ত পোকামাকড় খাদ্যকে অগ্রহণযোগ্য করে তোলে। খাদ্য তৈরিতে নিয়োজিত ব্যক্তির উন্মুক্ত কাটাস্থান ও ক্ষত এবং ব্যক্তিগত অপরিচ্ছন্নতার কারণে খাদ্য দূষিত হয়। ধুলাবালি, মশামাছিও খাদ্যকে দূষিত করে। নোংরা ও অস্বাস্থ্যকর স্থানে মুরগি ড্রেসিং এর সময় জীবাণু দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। অতিরিক্ত হরমোন প্রয়োগে গরু ও মহিষ মোটাতাজা করা হয়, যা মানব স্বাস্থ্যের জন্য নিরাপদ নয়। বাদুড় ও পাখি খেজুর ও তাল গাছের রসকে বিষাক্ত করে ফেলে যা জীবনের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরূপ। অনেক সময় জুস, খোলা সরবত ও কোমল পানীয় তৈরিতে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়ম মানা হয় না। যার ফলে খাদ্যবাহিত বিভিন্ন রোগ টাইফয়েড, ডায়রিয়া, আমাশয় এসবে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেড়ে যায়। এছাড়াও খাদ্যে ভেজাল দ্রব্য মিশ্রণ, অনুমোদনবিহীন ও মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকর রঙ ও গন্ধের ব্যবহার করা হয়, যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ।
ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ও রঙ ব্যবহারের মাধ্যমে নষ্ট, বাসি ও নিম্নমানের খাবরকে আকর্ষণীয় করে তোলা হয়। টিনজাত ও প্যাকেটজাত খাদ্যে বিদ্যমান বিভিন্ন কৃত্রিম রাসায়নিক পদার্থ যেমন- টেস্টিং সল্ট, ট্রান্সফ্যাট ছাড়াও অনুমোদনবিহীন ও মাত্রাতিরিক্ত খাদ্য সংযোজন দ্রব্য ব্যবহার করা হয়, যা দেহে স্থূলতা, স্তন ক্যান্সার, প্রোস্টেট ক্যান্সার, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে। আমাদের দেশে অধিক মুনাফার জন্য শাকসবজি ও ফলফলাদি মৌসুমের আগে বাজারজাত করার জন্য অননুমোদিত কিংবা মাত্রাতিরিক্ত হরমোন ব্যবহার করার প্রবণতা দেখা যায়। অন্যদিকে শাকসবজি ফলফলাদি, মাছ এসব পচনশীল খাদ্যে ফরমালিনের অপব্যবহার হয়ে থাকে যা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর। প্রাকৃতিকভাবে পরিপক্ব ফল ও শাকসবজিতেই পুষ্টিগুলো পরিপূর্ণভাবে পাওয়া যায়। খাবার প্রস্তুত ও গ্রহণকালে খাদ্য নির্বাচন, লেবেল, খাদ্য সংরক্ষণ, উৎপাদন ও মেয়াদ, খাদ্য হস্তান্তর এবং ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবিধি সম্পর্কিত জ্ঞান ও ধারণা খাদ্যকে নিরাপদ করে এবং সুস্বাস্থ্য অটুট রাখতে সাহায্য করে।
নিরাপদ পুষ্টিবার্তা : ভরা মৌসুমে পরিপক্ব শাকসবজি ও ফলমূল ক্রয় করুন যা পুষ্টিতে পরিপূর্ণ এবং সাশ্রয়ী; খাদ্য গ্রহণের আগ পর্যন্ত পচনশীল খাদ্যকে ফ্রিজে বা ঠা-া জায়গায় রাখা; দূষিত পানি দ্বারা তৈরি এবং জীবাণুযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বিরত থাকা; মাছ, মাংস, শাকসবজি ও ফলমূল ক্রয় করার সময় যথাসম্ভব রঙ, গন্ধ ও আকার যাচাই করা; কাটা, ক্ষতযুক্ত খাদ্যদ্রব্য ও পাখি দ্বারা দূষিত খাদ্য গ্রহণ থেকে বিরত থাকা; ঢাকনাবিহীন বা খোলা খাবার গ্রহণ থেকে বিরত থাকা। নিরাপদ খাদ্য গ্রহণের সাথে শারীরিক কসরতের ও প্রয়োজন আছে অনেক। কেননা সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত ও পরিমিত ব্যায়াম করা খুব জরুরি। সে পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিদিন শারীরিক পরিশ্রম করা একান্ত প্রয়োজন। সেজন্য আমাদের প্রতিদিন- গৃহস্থালির কাজকর্ম করা; যন্ত্রের ওপর নির্ভরশীলতা কমিয়ে কাজে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করা; প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিটে ২-৩ মাইল হাঁটা, ব্যায়াম করা; লিফট বা চলন্ত সিঁড়ি ব্যবহারের পরিবর্তে সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। সুষম খাদ্য গ্রহণ এবং শারীরিক শ্রমের সমন্বয়ে আদর্শ ওজন বজার রাখা; প্রতিদিন কমপক্ষে ৩০-৪৫ মিনিট বিভিন্ন শারীরিক শ্রম যেমন- হাঁটা, দৌড়ানো ব্যায়াম করা, সাইকেল চালানো, সাঁতার কাটা এসবে অভ্যস্ত হওয়া: খাদ্য গ্রহণের পরে হালকা শারীরিক শ্রম যেমন হাঁটা অথবা ঘরের কাজকর্ম করা খুব দরকার।
প্রাপ্ত বয়স্কদের খাবার পুষ্টিসম্মত এবং পুষ্টিবিদ অনুমোদিত হওয়া দরকার। পুষ্টিবিদরা বলেন প্রতি বেলায় প্লেটে একজন বয়স্ক মানুষের জন্য খাবারের তালিকায় থাকবে ৪০০ গ্রাম ভাত (৫৩ শতাংশ); ৫০ গ্রাম মৌসুমি ফল (৭ শতাংশ); ২০০ গ্রাম মিশ্রিত সবজি (১৫ শতাংশ); ২০ গ্রাম ডাল (৪ শতাংশ); ৫০ গ্রাম মাছ-মাংস-ডিম (৬ শতাংশ); ১০০ গ্রাম শাক (১৫ শতাংশ)। এভাবে হিসাব করে খেলে আমরা পুষ্টিসম্মত খাবার খেয়েছি বলে ধরে নেয়া হবে এবং আমরা সুস্থ থাকব। আসলে নিয়ম মেনে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার খেলে আমরা সুস্থ থাকব প্রতিদিন প্রতীক্ষণ।
খাদ্য গ্রহণে আমাদের অনেক বদঅভ্যাস আছে। যেমন যে খাবারটি আমরা বেশি পছন্দ করি তা বেশি খাই সব সময় খাই। খাবার টেবিলে আমাদের খাদ্যে ডাইভারসিটি কম। কিন্তু জরুরি দরকার বেশি সংখ্যক খাদ্যের সমাহার। প্রতিদিন প্রতি বেলায় কিছু শাকসবজি, ফল, আমিষ এসবের সাথে ভাত থাকতে পারে। এসবের প্রতি আইটেম কিছু কিছু খেলে রুচিও বদলাবে সাথে পুষ্টির সমাহারে আমরা উপভোগ করতে পারব। আমাদের আরেকটি ত্রুটি হলো আমার ৩ বেলা বেঁধে খাই। সকাল দুপুর রাত। কিন্তু নিয়ম হলো দিনভর সময় সুযোগ পেলে হালকা কিছু খাবার সব সময় খাওয়া। এতে পুষ্টিশক্তি সুষমতা রক্ষা পায় অনায়াসে। সতেজ বিষমুক্ত পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের প্রতি আমাদের যেন বেশি নজর থাকে সে দিকে সতর্কতার সাথে লক্ষ রাখতে হবে। পুষ্টিসম্মত খাবার খেয়ে আমরা পুষ্টিসমৃদ্ধ জাতিতে পরিণত হব এটাই হোক আমাদের নিত্য এবং আন্তরিক ও কার্যকর অঙ্গীকার।
কৃষিবিদ ডক্টর মো. জাহাঙ্গীর আলম*