05/01/2025
উপর তলা থেকে চিৎকার করে কান্নার আওয়াজ আসছে… সাথে শোনা যাচ্ছে - মা আর করবো না।
বিষয়টা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটু আগেই তো তাদের বাড়িতে আমাদের নেমন্তন্ন ছিলো। তার ছেলে চাকরি নতুন পেয়েছে সেজন্য। কতো অমায়িক পরিবার। কি রেখে কি খেতে দিবে, কিভাবে খাতির যত্ন করবে, সে নিয়ে তাদের কতো হৈ হুল্লোড়। তাহলে এই অল্প সময়ের মধ্যে কি হলো?
যেহেতু সে আমার ভাড়াটিয়া তাই সাহস করে যেতেও পারছি না। অনাধিকার চর্চা হয়ে যায় কিনা সে ভয়ে।
স্ত্রীকে ডেকে বললাম - কে কাঁদছে এভাবে? জানো কিছু?
সে দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললো - আর কে? তুমি যেই মাসিমনির একটু আগে প্রশংসা করলে - কত্তো ভালো মানুষ সে! তার ছেলের বউ এর সাথে চিল্লাচ্ছে।
আমি কিছুটা স্তব্ধ হয়ে বললাম - কেনো? উনাকে দেখে তো এমন লাগলো না!
আমার স্ত্রী বললো - থাক, তোমার সাথে তর্কে যাবো না। মহিলা মানুষের বিষয়। তুমি বুঝবে না।
এই বলে সে চলে গেলো। আমি টিভি দেখতে লাগলাম। হঠাৎ মনে হলো উপর তলায় ঠাস করে কিছু পরে ভাঙলো, আর এরপর আরো জোরে চিৎকার।
আর নিতে পারছিলাম না। বাড়িওয়ালা হিসেবে এবার ওদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ভাবলাম।
চশমাটা চোখ থেকে খুলে হাঁটা দিলাম উপর তলায়।
কলিং বেল দিতেই সব চুপচাপ হয়ে গেলো।
১-২ মিনিট পর অর্ধেক দরজা খুলে মুখ বের করলেন মাসীমণি ।
হাসি মুখে এগিয়ে বললেন - কি হইসে বাবা?
আমি বললাম - একটু আগে কান্নার আওয়াজ পেলাম। তারপর মনে হলো কি যেন ভেঙে গিয়েছে। কি হয়েছে? কোন সমস্যা?
মাসীমণি বললেন - আরে না বাবা। বউমা কাজ করতে গিয়ে হাতে লেগে টেবিলের কাঁচ টা ভেঙে গেছে। নিজে থেকেই ভয়ে কান্না করছে। ভয় পাইসে, আমি যদি কিছু বলি সেজন্য।
আমার কাছে কেন যেন তেমন কিছু মনে হলো না।
পুরুষ মানুষ তাই জোর করে ঢুকতেও পারলাম না। চলে আসলাম সেখান থেকে।
কিন্তু আসার পর থেকে মাথা ধরে আছে। তাই সহ্য না করতে পেরে আমার স্ত্রীকে ডেকে বললাম - চলো তো আমার সাথে।
সে বললো - কোথায়?
আমি হাত ধরে টান দিয়ে তাকে নিয়ে গেলাম উপর তলায়।
আবার কলিং বেল দিলাম। এবার আরও সময় নিয়ে দরজা খুললো তারা। এবার দরজা খুললো মাসীমণি'র ছেলে। একদম ঘামিয়ে আছে সে। বয়সে আমার সমবয়সী হলেও বিয়ে করেছে আমার মেয়ের বয়সী একটা মেয়েকে।
সে জিজ্ঞাসা করলো - কিছু বলবেন ভাই?
বললাম - তোমার মায়ের সাথে কথা আছে। ভেতরে যাবো।
সে বললো - মা পুজো করছে। পুজো শেষে বলছি যেন আপনার সাথে দেখা করে আসে।
আমি খানিকটা ধাক্কা দিয়েই বললাম - এখনই দেখা করবো।
এই বলে ঘরে ঢুকে আমার মাথা ঘুরে গেলো। ফ্লোরে রক্তের ছোপ ছোপ দাগ। সামনের ঘরের টি টেবিলটার গ্লাস ভেঙে নিচে পরে আছে। ঘরের ভেতরটা নিশ্চুপ।
আমাদের বাধা দেওয়ার পরও ভেতরে গিয়ে পুরুষ মানুষ হয়েও চোখে জল চলে আসলো। ময়না (ছেলের বউ) মেঝেতে পড়ে আছে। নাক মুখ দিয়ে রক্তে ভেসে যাচ্ছে।
আমার স্ত্রী দৌড়ে গিয়ে তাকে ধরলো। মাসীমণি আরেক রুম থেকে দৌড়ে এসে বললো - একটু আগে বাথরুমে পইড়া ব্যথা পাইসে। আমি এখন ডাক্তারের কাছে নিতাম।
আমি বললাম - বাথরুমে পরে গিয়েছে তো মুখে গামছা বাঁধা কেন?
ওরা একটু নড়ে উঠলো। মাসীমণি র স্বামী আমাকে এসে বললো - বাবা বসেন। সব খুলে বলতেসি।
আমার স্ত্রী তখন বললো - ময়নার জ্ঞান নাই। ডাক্তারের কাছে এখনই নিতে হবে।
আমি মাসীমণি কে বললাম - আপনাদের সাথে আমি পরে কথা বলবো।
এই বলে একটু সাইডে গিয়ে হাসপাতালে ফোন করলাম। আর ফোন করলাম আমাদের দারোয়ানকে। মেইন গেইট টা বন্ধ করতে বললাম।
আর সবশেষে ফোন দিলাম আমাদের এলাকার থানায়।
তারা জানতো না থানায় যে ফোন করেছি। একেক জন অস্থির হয়ে উঠলো। হঠাৎ ময়না ময়না বলে কেঁদে উঠলো মাসীমণি। শ্বশুর সাহেবও কম যান না। তিনিও অভিনয় করে চোখ মোছা শুরু করলেন।
শুধুমাত্র একজন অভিনয় করছিলো না। সে হলো ময়নার স্বামী। সে যেন ফোঁস ফোঁস করে উঠছিলো রেগে। আর বারবার বলছিলো - আমাদের ব্যাক্তিগত ব্যাপারে আপনি নাক গলাচ্ছেন কেন?
আমি কোন উত্তর দিলাম না। শুধু দেখে যাচ্ছিলাম সবাইকে।
ময়নাকে আমার স্ত্রীকে আর মেয়েকে সহ অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতাল পাঠিয়ে দিলাম। সাথে যাওয়ার জন্য তার বাড়ির সবাই খুব জোর করলেও আমি সবাইকে নিষেধ করে দেই। আর অন্য ৩ ফ্লাটের ভাড়াটিয়া ঘরের পুরুষদের ফোন করে আসতে বলি।
তাদের আটকাই। থানা থেকে লোক আসলে তাদের হাতে এই ভদ্র পরিবারকে তুলে দেই।
এরপর হাসপাতালে গিয়ে দেখি ময়নার চিকিৎসা চলছে।
২ দিন পর পুলিশ তার স্টেটমেন্ট নিতে আসে। আমি সেখানে উপস্থিত ছিলাম। যে কারণে সেদিন ময়নার উপর নির্যাতন হয়েছিলো তা শুনে যে কোন শয়তানও একবার চোখের জল ফেলতো বোধহয়।
বিয়ের শুরু থেকেই কাজের মেয়ের মতো তার সাথে আচরণ করা হতো। কারণ সে গরীব ঘরের মেয়ে। নাহলে অতোটুক মেয়েকে এই বয়স্ক লোকের সাথে কোন বাবা মা ই বা দেয়। খাবারের কষ্ট দেওয়া হতো। আর এটা প্রথমবার তার গায়ে হাত তোলা হয়নি। তাই আমরা সেদিন যখন তাদের বাড়িতে খেতে গিয়েছিলাম। সেদিন সে লুকিয়ে কিছু পোলাও তার ওরনায় বেঁধে বাথরুমে নিয়ে খাচ্ছিলো। কিন্তু ধরা পরে যায়। এরপর তাকে অমানবিক নির্যাতন করা হয় খাবার চুরি করে খাওয়ার দায়ে। একদম ৩ জন মিলে যে যেভাবে পেরেছে মেরেছে মেয়েটাকে। ভগবান মাফ করুক। কতো খাবার প্লেটে ফেলে উঠি আমরা প্রায়ই। আর এই খাবারের জন্য কেউ মার খেলো? কেনো খেলো?
এগুলো বলার সময় আমার স্ত্রীও পাশে ছিলো। চোখ মুছে আমার দিকে এগিয়ে বলছে - মেয়ে বিয়ে দিবো না আমরা। দরকার নাই। মেয়ের খাওয়ার জন্য কতো চিন্তা করি, আর সেই মেয়ে যদি অন্যের ঘরে গিয়ে ভাতের বদলে মার খায় তাহলে তেমন বিয়ের দরকার নেই।
আমিও তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম - সবাই এক না। সবাই খারাপ না। সবাইকে আবার দেখতে মানুষ লাগলেও আসলে তারা মানুষ না।
আমি নিজে ময়নাকে সুস্থ হওয়ার পর উকিল ধরিয়ে মামলা করাই। ময়না তার বাবার বাড়ি ফেরত যেতে চায়নি। তাই তার বাবার অনুমতি নিয়ে আমার বাড়িতেই রেখে দেই। আমার একটা মেয়ে। তার সাথেই ময়না থাকে। এতে আমার স্ত্রীও কোনদিন একটা কথা বলেনি।
শত হলেও একজন মেয়ের বাবা আমি।
আর এভাবেই যদি সবাই রুখে দাড়াতো তাহলে এই সমাজে এমন নির্যাতনকারী আর সাহস করে কাউকে নির্যাতন করতো না।
"Domestic Violence" কে না বলুন। আশে পাশে কাউকে এমন হতে দেখলে তার বিরুদ্ধে যা করার দরকার সব করুন। এতে অন্তত কারো না কারো জান বেঁচে যাবে।