03/01/2024
কনে দেখার ক্ষেত্রে ১৫টি ইসলামি দিক-নির্দেশনা ও শিষ্টাচার
▬▬▬❂❣❂▬▬▬
নিঃসন্দেহে বিয়ে মানব জীবনে সবচেয়ে সুন্দর ও মধুময় সম্পর্কের নাম। এই সম্পর্ক স্থাপনের পূর্বে যুবক-যুবতীগণ একে অপরকে পছন্দ-অপছন্দের বিষয়টি খুব গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইসলাম বিয়ের পূর্বে বিবাহেচ্ছু যুবককে তার স্বপ্নের রাজকন্যাকে একনজর দেখে নেয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু অনেকেই এর সঠিক নিয়ম-পদ্ধতি সম্পর্কেও অবহিত নয়। যার কারণে এ বিষয়ে আমাদের সমাজে নানা বিভ্রান্তি, ভুল ধারণা ও শরিয়ত বিরোধী কার্যক্রম ছড়িয়ে আছে।
তাই নিম্নে আমরা এ বিষয়ে শরিয়তের ১৫টি দিক-নির্দেশনা এবং শিষ্টাচার তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
১. কনে দেখার শর্তাবলী:
বর্তমান শতকের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ফকিহ আল্লামা শাইখ মুহাম্মদ বিন সালেহ আল উসাইমিন রাহ. বলেন, কনে দেখার চারটি শর্ত রয়েছে। যথা:
১. বিয়ের দৃঢ় ইচ্ছা থাকা।
২. মনে প্রবল ধারণা থাকা যে, কন্যাপক্ষ বিয়ের প্রস্তাবে সাড়া দিবে।
৩. কনে দেখার ক্ষেত্রে কু প্রবৃত্তি ও কামনার মনোভাব না থাকা।
৪. নির্জনে না হওয়া।
এ চারটি শর্তের কোনও একটি লঙ্ঘিত হলে, কোনও নারীর দিকে দৃষ্টিপাত করা হারাম।
২. কনে দেখার বিধান:
যে ব্যক্তি কোনও মেয়েকে বিয়ে করতে চায় তা জন্য সুন্নত হল, পাত্রীকে দেখা। না দেখে বিয়ে করা সুন্নত পরিপন্থী। (তা ওয়াজিব নয়)
৩. কনে দেখার পূর্বে ইস্তিখারা করা এবং তার সম্পর্কে জানা:
কনে দেখতে যাওয়ার পূর্বে ইস্তিখারা করা সুন্নত। তৎসঙ্গে তার সম্পর্কে তার এলাকার মানুষ, শিক্ষক ও পরিচিতজনদের নিকট তার চরিত্র, আদব-কায়দা, চাল-চলন ও দীনদারী সম্পর্কে জানার চেষ্টা করা এবং পরামর্শ নেয়া উচিৎ। এসব করার পর, কনে দেখতে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া ভালো।
৪. কনে দেখার ক্ষেত্রে সীমারেখা:
কনে দেখার সীমা হল, (অধিক বিশুদ্ধ মতে) তার মুখমণ্ডল, মাথার চুল, ঘাড়, দু হাতের কব্জি ও পায়ের পাতা দেখা; এর বেশি নয়। [শাইখ বিন বাজ, উসাইমিন সহ অনেক আলেম এমত পোষণ করেছেন।] কোনও মেয়ের প্রতি বিয়েতে আগ্রহ বা অনাগ্রহ সৃষ্টি হওয়ার জন্য এ কয়েকটি অঙ্গ দেখাই যথেষ্ট।
৫. সাজ-সজ্জা, অলঙ্কার ও সুন্দর পোশাক পরিধান করা:
পাত্রীর জন্য সামান্য কিছু সাজ-সজ্জা, অলঙ্কার পরিধান ও সুন্দর পোশাকে শালীন ভাবে পাত্রের সামনে আসা দোষিণীয় নয়। তবে এত বেশি মেকআপ করা উচিৎ নয়, যার ফলে তার প্রকৃত রূপ ঢাকা পড়ে যায়। বরং সিম্পল ইজ বেস্ট। কিছু মানুষ বিউটি পার্লার থেকে এমন কড়া মেকআপ করে আসে যে, তার বাস্তব অবস্থা সম্পূর্ণ পাল্টে যায়। এটা অনুচিত। অন্যথায় বিয়ের পর স্বামী তার স্ত্রীর বাস্তব অবস্থা দেখার পর দাম্পত্য জীবনে সমস্যা সৃষ্টি হতে পারে।
৬ সশরীরে উপস্থিত হয়ে পাত্রী দর্শন:
সশরীরে উপস্থিত হয়ে সামনাসামনি পাত্রী দেখা অধিক উত্তম। তবে গোপনে বা অপ্রস্তুত অবস্থায় দেখাও জায়েজ আছে।
৭. ছবি ও ভিডিও কলে পাত্রী দর্শন:
ছবি লেনদেন বা ভিডিও কল এর মাধ্যমেও পাত্রী দেখা জায়েজ আছে কিন্তু এর উপর ভিত্তি করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়া উচিত নয় যতক্ষণ না সশরীরের উপস্থিত হয়ে দেখা হয়। কারণ ছবি/ভিডিও ইডিট করে বা প্রযুক্তি ব্যবহার করে প্রকৃত অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব। তাছাড়া ছবি/ভিডিওতে সাধারণত: পাত্রী মাথা, মুখমণ্ডল বা শরীরের উপরিভাগ দেখা হয়। এতে সম্পূর্ণ দেহাবয়ব সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যায় না।
৮. পাত্রী দেখার ক্ষেত্রে অন্যের উপর নির্ভর করা:
নিজে না দেখে অন্যের দেখার উপর সিদ্ধান্ত না নেওয়াই উত্তম। কারণ প্রত্যেকটি মানুষের নিজস্ব রুচি বোধ, পছন্দ-অপছন্দ, চিন্তা-ভাবনা ও দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। তারা সে আলোকে সব কিছু মূল্যায়ন করে। সুতরাং তাদের দৃষ্টিভঙ্গির সাথে বিবাহেচ্ছু ব্যক্তির দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তা-চেতনার মিল নাও হতে পারে। যা হয়ত পরবর্তীতে তাদের দাম্পত্য জীবনকে প্রভাবিত করবে। তবে জ্ঞানীদের মতামত ও মূল্যায়নকে বিবেচনা করা ভালো।
অনেক যুবক লজ্জা-শরম বা লাজুকতার কারণে মা-বাবা, ভাই-বোনদের দেখার উপর নির্ভর করে বিয়ের সিদ্ধান্ত নেয়। এটি অনুচিত। কারণ দেখা যায়, যদি বিয়ের পর তার স্ত্রী অপছন্দ হয় তাহলে যাদের দেখার উপর নির্ভর করে বিয়ে করেছিলো তাদেরকে সে দোষারোপ করে। এতে সৃষ্টি হয় ঝগড়া-ঝাটি ও নানা অশান্তি।
৯. কনে দেখার সঠিক নিয়ম:
কনে দেখার ক্ষেত্রে ইসলাম অনুমতি দেয় একমাত্র বিবাহেচ্ছু ব্যক্তি (পাত্র) অথবা পাত্রের মা, বোন ইত্যাদি মহিলাদেরকে; অন্য কাউকে নয়।
পাত্রের আপন ভাই, চাচাতো ভাই, ফুফাতো ভাই, দুলাভাই/ভগ্নীপতি, বন্ধু-বান্ধব, চাচা, খালু, ফুফা, মামা ইত্যাদি কোনও পুরুষ ব্যক্তির পাত্রীকে দেখার অনুমতি নেই। এ সকল ব্যক্তিদের সাথে বিয়ের পূর্বে এবং পরে সর্বাবস্থায় পর্দা রক্ষা করা ফরজ। এমনকি পাত্রের পিতা এবং দাদা-নানারাও দেখতে পারবে না-যদিও তারা বয়স্ক হয়। কারণ বিবাহ সংঘটিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তারা মাহরাম নয়।
সঠিক পদ্ধতি হল, একমাত্র পাত্র কনের বাবা, ভাই, দাদা, চাচা ইত্যাদি মাহরাম পুরুষ কিংবা তার মা, বোন ইত্যাদি মহিলাদের উপস্থিতিতে তাকে দেখবে।
১০. যাদের জন্য কনেকে দেখা জায়েজ নয়:
আমাদের সমাজে বেশিরভাগ পরিবারে এমনভাবে কনে দেখানো হয় যে, সেখানে পাত্রের বন্ধু-বান্ধব ও অন্যান্য পুরুষ আত্মীয়-স্বজন এবং কনে পক্ষের নন মাহরাম আত্মীয়-স্বজন ও এলাকার মুরব্বিরা উপস্থিত থাকে। তাদের সামনেই কনেকে পূর্ণ সাজ-সজ্জা সহকারে এবং অলঙ্কারাদি পরিহিত অবস্থায় উপস্থিত করে মাথার চুল, হাতের বাহু, পা, কাঁধ ইত্যাদি প্রদর্শন করা হয়। অনেক সময় তার মাধ্যমে এ সকল নন মাহরাম পুরুষদেরকে আপ্যায়ন করানো হয়। আর তারা সবাই মিলে তার রূপ-সৌন্দর্য, চলাফেরা, আচরণ ইত্যাদি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করতে থাকে। ফলে তা অনেকটা বাজারে গরু দেখার মত অবস্থা হয়। এটি শরিয়ত বহির্ভূত প্রথা-যা পরিবর্তন হওয়া জরুরি।
১১. বায়োডাটা লেনদেন:
বর্তমানে পাত্র-পাত্রী পরস্পরকে জানার জন্য বায়োডাটা আদান-প্রদান করার প্রথা প্রচলিত হয়েছে। এটি একটি ভালো পদ্ধতি। কারণ এর মাধ্যমে তারা একে অপরের ব্যক্তিগত বিভিন্ন বিষয় যেমন: নাম-পরিচয়, বয়স, শারীরিক গঠন, দেহের রং, শিক্ষা-দীক্ষা, যোগ্যতা, পছন্দ-অপছন্দ, আগ্রহ-অনাগ্রহ, ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা ইত্যাদি বিষয়গুলো সহজে জেনে নিতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মিথ্যা ও ভুল তথ্য পরিবেশন করা হারাম।
১২. ছবি লেনদেন:
বায়োডাটার সাথে কনের ছবি সংযুক্ত করা অথবা বিয়ের উদ্দেশ্যে সাধারণভাবে ছবি লেনদেনের ব্যাপারে কথা হল, এ ক্ষেত্রে সতর্কতা অবলম্বন করা জরুরি। কনের ছবি পাত্র বা পাত্রের মা-বোন ইত্যাদি নারী ছাড়া ঘটক বা অন্য কেউ যেন দেখতে না পায় সে বিষয়ে সতর্ক করতে হবে। আর বিয়ে সংঘটিত না হলে সে ছবি যেন, কোনোভাবে পাত্র বা পাত্রপক্ষ সংরক্ষণ না করে সে বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে। তাই পাত্র বিশ্বস্ত ও ইমানদার না হলে তার নিকট পাত্রীর পর্দা হীন ছবি সরবরাহ করা উচিত নয়।
১২. প্রশ্ন করা:
কনে দেখতে গিয়ে প্রয়োজনীয় কিছু প্রশ্ন করা দোষণীয় নয়। তবে এমন বিষয়ে প্রশ্ন করা অনুচিত, যা কনে বা তার পরিবারকে বিব্রত করতে পারে।
১৩. কনে দেখার পর উপহার প্রদান:
কনে দেখার পর যদি তাকে পাত্র উপহার হিসেবে কিছু টাকা-পয়সা ইত্যাদি দেয় তাহলে তা গ্রহণ করতে বাধা নেই। তা দেওয়া ও নেওয়া উভয়টি জায়েজ। কারণ এটি আমাদের একটি প্রচলিত সামাজিক প্রথা (العرف)। আর সামাজিক প্রথাকে ততক্ষণ হারাম বা বিদআত বলা যাবে না যতক্ষণ না তা ইসলামের কোনও বিধানের সাথে সাংঘর্ষিক হয়।
১৪. কনে পছন্দ না হলে:
কনে পছন্দ না হলে বা কোনও কারণে বিয়ে সংঘটিত না হলে মানুষের সামনে কনে বা তার পরিবারের বদনাম ও সমালোচনা করা বৈধ নয়। কারণ তা গিবতের অন্তর্ভুক্ত। আর ইসলামে গিবত হারাম।
১৫. বিয়ের পূর্বে শরিযত বিরোধী কার্যক্রম:
পাত্রী দেখার পর বিয়ের পূর্বে পরিচয়ের নামে ছেলে-মেয়ের যত্রতত্র ঘোরাঘুরি, নিষ্প্রয়োজনীয় দীর্ঘ ফোনালাপ, চ্যাটিং, হাসি-তামাশা, লং ড্রাইভ, শরীর স্পর্শ ইত্যাদি সম্পূর্ণ হারাম। অনেক সময় মেয়ে পছন্দ হলে আংটি পরানোর পর তাদের মাঝে প্রায় স্বামী-স্ত্রীর মত আচরণ ও কথাবার্তা শুরু হয়-যা অবশ্যই গুনাহের। সুতরাং এসব অবশ্যই পরিত্যাজ্য।
মনে রাখতে হবে, কনেকে আংটি পরানো বা এ্যাংঙ্গেজমেন্ট ইসলামি সংস্কৃতি নয়। বরং তা অমুসলিমদের থেকে অনেক মুসলিম গ্রহণ করেছে। তাই এ প্রথা থেকে মুসলিমদের বের হয়ে আসার উচিৎ। আর আংটি দেয়া মানে বিয়ে নয়। আকদ তথা ইজাব-কবুল ছাড়া বিয়ে সংঘটিত হয় না। এর আগ পর্যন্ত তাদের পরস্পরের মধ্যে পর্দার বিধান পরিপূর্ণ বলবত থাকবে।
আল্লাহ আমাদেরকে আমাদের ইসলামি শরিয়তের সুন্দরতম আদব-শিষ্টাচার ও দিক-নির্দেশনাগুলো অনুসরণ করে পবিত্র ও মধুময় দাম্পত্য জীবন গঠনের তাওফিক দান করুন। আমিন।
আল্লাহু আলাম।