04/02/2023
বেঁচে থাকার জন্য সব কিছুতেই একটা সুন্দর কিছু খুঁজে বের করতে হয় I
বিয়ের পর পর আমরা প্রথম যে বাড়িটিতে উঠেছিলাম, সেটি ছিল একটা ছয় তলা বাড়ি I প্রতি তলায় চারটি করে ইউনিট I আমরা থাকতাম তিন তলায় I বাড়িটির সবচেয়ে সুন্দর যে জিনিসটি, সেটি ছিল, তার ছাদ I
অনেক বড় একটা ছাদ I চারপাশে কোন উঁচু বাড়ি না থাকার কারণে আরো সুন্দর লাগতো I চারদিকে অনেক খোলা বলে আকাশটাকে মনে হতো অনেক বড় I আমরা প্রায় রাতেই ছাদে বসে গল্প করতাম I
কিন্তু, একদিন সেই বাড়ি ছাড়ার সময় হয়ে গেলো I
জীবনের প্রয়োজনে I
সেই বাসা থেকে বের হওয়ার সময় মনে হয়েছিল, এমন সুন্দর বাসা আমাদের জীবনে আর কোনদিন আসবে না I
কিন্তু পরের বাসাটিতে আরেকটি জিনিস খুঁজে পেলাম I কুমিল্লা শহরের হাউজিং ইষ্টেটের সেই বাসাটির পাশেই একটা বড় পুকুর I আমাদের বেড রুমের জানালা দিয়ে সেই পুকুরটা দেখা যেত I বৃষ্টির দিনে সেই পুকুরে বৃষ্টির পানি পড়ার দৃশ্য ছিল অসম্ভব সুন্দর I আর পূর্ণিমাতে পুকুরে চাঁদের প্রতিচ্ছবি আমরা মুগ্ধ হয়ে দেখতাম I
সেই বাড়ি থেকে যেদিন বের হয়ে গেলাম, আমাদের দুজনের ভীষণ মন খারাপ I আমার মা পাশে ছিলেন I আমাদের মন খারাপ দেখে মা সেদিন চোখের পানি ফেলে কেঁদেছিলেন I
তৃতীয় বাড়িতে গিয়ে দেখি, বসার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে একটা বড় আম গাছ I
আম গাছটা একা ছিলোনা I প্রায়শঃ দেখতাম, দুইটা শালিক গাছের ডালে বসে গল্প করতো I মাঝে মাঝে দুই একটা তোতা পাখিও আসতো I সেই আম গাছটাই আমাদের পুকুরের মায়া ভুলিয়ে রাখলো I
তারপর একদিন আবারো সময় হয়ে গেলো I
ব্যাগ গোছানো শুরু হলো, আবারো নতুন যাত্রা.........
অস্ট্রেলিয়া এসে পাঁচটা বাড়িতে থাকার পর, এই মেলবোর্ন শহরে প্রথম এসে যে বাড়িটিতে উঠলাম সেই বাড়িটির সামনে দাঁড়ালে খুব কাছেই একটা পাহাড় দেখা যেত I আমার ছোট মেয়েটা মাঝে মধ্যে কি সব বলে বলে সেই পাহাড়টাকে ডাকতো I
যেহেতু বাড়িটা আমরা নিজেরা কিনে উঠেছিলাম, ভেবেছিলাম সেখানেই বাকি সময়টা থাকবো I তাছাড়া পাহাড়টার প্রতি আমাদের একটা মায়া জন্মে গিয়েছিলো I
কিন্তু না I
আবারো ছাড়তে হবে, সেই ঘর !
নিজেদের ও বাচ্চাদের বন্ধু-বান্ধব সহ পাশা-পাশি থাকবো বলে, অন্য মহল্লায় চলে আসলাম I
এখন আমরা এই নতুন বাড়িতেই থাকি I নিজেরা দেখে শুনে, পছন্দ করে বানিয়েছি I
দুইতলা ঘর I উপর তলায় আমাদের মেইন বেড রুমের সাথে একটা বড় বারান্দা আছে I সেই বারান্দায় দাঁড়ালে দেখা যায়, একটা লেইক I
আমাদের আবারো একটা পুকুর I
মেলবোর্নের আকাশ এমনিতেই অনেক নীল, এখানে বৃষ্টিও হয় অনেক I
যেদিন অনেক বৃষ্টি হয়, সেদিন লেইকটা কানায় কানায় পানিতে ভরে যায় I
ভাবছি আমার শেষ বাড়িতে কি থাকবে?
আমার ছোট মাটির ঘর !
আমি কি দেখবো সেখানে?
কবি রুমি ভাবতেন, কবরে যাওয়ার পর তিনি দেখবেন একটা পর্দা I তাঁকে বিদায় দিয়ে সবাই যখন চলে যাবে, তিনি সেই পর্দা তুলে বেহেস্ত দেখবেন I
রুমি সেই বেহেস্তের কল্পনায় বিভোর থাকতেন I
রুমি, আসলে আল্লাহকে ভয় পাওয়ার চেয়েও বেশি ভালোবাসতেন I
ভালোবেসে তিনি লিখেছেন, তাঁর বিখ্যাত কবিতা ,"When I die"
"When you leave me in the grave
don’t say goodbye
remember a grave is only a curtain
for the paradise behind "
When the sun sets or
the moon goes down
It looks like the end
It seems like a sunset
but in reality it is a dawn"
কেন তিনি আল্লাহর সেই ভালোবাসাটা এমন গভীর ভাবে অনুভব করতেন তার কারন বোধ হয় আমাদের নবীর একটা ছোট গল্প I
একদিন রাসূল (সাঃ) ও ওমর (রাঃ) এবং কয়েকজন সাহাবী দাঁড়িয়ে দেখছেন একজন মহিলা তার সন্তানকে হারিয়ে খুব হন্যে হয়ে খুঁজছেন I কান্না জড়ানো কণ্ঠে
সন্তানের নাম ধরে ডাকছেন I আর সেই বাচ্চাটির বয়েসী যাকেই দেখছেন, তাকেই জড়িয়ে ধরছেন I
আদর দিয়ে দিচ্ছেন I
এই দৃশ্য দেখে আমাদের নবীর চোখে পানি চলে আসলো I তিনি নীরবে কাঁদলেন I
উমর (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ ! আপনি কাঁদছেন?
নবীজি গায়ের চাদরের কাপড় দিয়ে চোখ দুটো একটু মুছে নিয়ে বললেন,
"আচ্ছা, তোমারদের কি মনে হয়, এই মা যখন তার সন্তানকে খুঁজে পাবেন তিনি সেই বাচ্চাটাকে নিয়ে আগুনে ফেলে দিবেন?"
সাহাবীরা সাথে সাথে বললেন,
না, অবশ্যই না I এমন একজন মা সেটা কখনই করবেন না I
নবীজি তখন আরো ভালোবাসার কণ্ঠে বললেন,
"মনে রেখো, আল্লাহ তোমাদেরকে এই মায়ের চেয়েও অনেক অনেক বেশি ভালোবাসেন" (গল্প সূত্র: বোখারী)
রুমির মত কল্পনা করুন I আল্লাহ ভালোবেসে ক্ষমা করে দিলেন I ছোট সেই মাটির ঘরের ডান পাশের দেয়ালে একটা জানালা I সেই জানালা দিয়ে দেখা যাচ্ছে দূরের কোন বেহেস্ত..........
"মাটির ঘর, মায়ার ঘর"
-ডা.শামছুল আলম