05/12/2024
এডিস মশা বাহিত (ডেংগু, চিকুনগুনিয়া ও জিকা) রোগের লক্ষণ এবং পরীক্ষার উপায়
এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু ও চিকুনগুনিয়া সহ আরও একটি রোগ হয়, সেটি হল জিকা। এই ভাইরাসগুলি মশার কামড়ের মাধ্যমে মানব শরীরে প্রবেশ করে। এডিস গণের দুটি প্রজাতি এডিস ইজিপ্টি ও এডিসএলবোপিকটাস এই ভাইরাসের বাহক হিসেবে পরিচিত।
লক্ষণ।
ডেংগু ভাইরাসের চারটি টাইপ আছে, এগুলিকে বলে সেরোটাইপ এবং এগুলির নাম হল DENV-1, DENV-2, DENV-3 এবং DENV-4। একটি সেরোটাইপের সংক্রমণ পরবর্তীতে অন্য সেরোটাইপের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষম নয়। প্রকৃতপক্ষে, ভিন্ন সেরোটাইপ দ্বারা পরবর্তীতে সংক্রমণের ফলে ডেঙ্গু হেমোরেজিক ফিভার (DHF) এবং ডেঙ্গু শক সিন্ড্রোম (DSS) এর মত জীবন—হুমকি পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে।
সাধারণভাবে, ডেঙ্গু ভাইরাসে আক্রান্তরা হয় উপসর্গবিহীন (৮০%) অথবা সাধারণ জ্বরের মত সামান্য উপসর্গ। ডেঙ্গুর বৈশিষ্ট্য হলো হঠাৎ জ্বর হওয়া, মাথাব্যথা (সাধারণতঃ দু’চোখের মাঝে), মাংসপেশি ও হাড়ের সংযোগস্থলে ব্যথা, র্যাশ বেরোনো, বমি বমি ভাব, ডায়রিয়া (সাম্প্রতিক প্রাদুর্ভাবে দেখা যায়), হালকা বা অস্বাভাবিক রক্তক্ষরণ।
তীব্র পেটে ব্যথা, ক্রমাগত বমি, দিনে ৩ বারের বেশী, শরীরে পানি জমা, মিউকোসাল রক্তপাত, অলসতা, অস্থিরতা, প্লেটলেটের সংখ্যা দ্রুত হ্রাসের সাথে হেমাটোক্রিট বৃদ্ধি এগুলি দেখা দিলে নিবিড় পর্যবেক্ষণ এবং হাস্পাতালে চিকিৎসার প্রয়োজন।
জিকার ক্ষেত্রে ৮০ শতাংশ ক্ষেত্রে আক্রান্ত ব্যক্তির মধ্যে রোগের কোনো লক্ষণ দেখা যায় না। বাকি ২০ শতাংশ ক্ষেত্রে কিছু উপসর্গ দেখা দেয়। আক্রান্ত ব্যক্তির চামড়ায় লালচে দানার মতো ছোপ (র্যাশ) দেখা দেয়। সঙ্গে মাথাব্যথা, চোখ লালচে হওয়া, মাংসপেশি ও গিঁটে ব্যথা থাকে। আক্রান্ত হওয়ার ৩ থেকে ১২ দিনের মধ্যে উপসর্গ দেখা দেয়, থাকে ২ থেকে ৭ দিন। গর্ভবতী মা জিকায় সংক্রমিত হলে গর্ভের সন্তানের ‘মাইক্রোসেফালি’র ঝুঁকি থাকে। অর্থাৎ মাথা ছোট হয়। বয়স্ক মানুষেরা আক্রান্ত হলে তার গুলেনবারি সিনড্রোমের (জিবিএস) আশঙ্কা থাকে। এর ফলে আক্রান্ত ব্যক্তি চলনশক্তি হারিয়ে ফেলেন।
চিকুনগুনিয়া উপসর্গ বিহীন হতে পারে তবে সাধারণত ৭২-৯৭% ক্ষেত্রে উপসর্গ দেখা দেয়। রোগটি সাধারণত আকস্মিক উচ্চমাত্রার জ্বর, জয়েন্টে ব্যথা ও ফুসকুড়ি নিয়ে শুরু হয়। ফুসকুড়ি রোগের শুরুতেই দেখা দিতে পারে তবে অনেক সময় রোগ শুরু হওয়ার দুই থেকে তিন দিন পর জ্বর কমতে শুরু করলে ফুসকুড়ির আবির্ভাব হয়। এছাড়া অন্যান্য উপসর্গের মধ্যে রয়েছে মাথাব্যথা, ক্লান্তি, পেটব্যথা, ফটোফোবিয়া বা আলোর দিকে তাকাতে সমস্যা, কনজাংটিভাইটিস। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তিন থেকে চার দিনের মধ্যে জ্বর সেরে যায়। তবে হাড়জোড়ের ব্যথা ব্যথার তীব্রতাও প্রচণ্ড। ফলে রোগীর স্বাভাবিক হাঁটাচলা, হাত দিয়ে কিছু ধরা এমনকি হাত মুঠ করতেও বেশ কষ্ট হয়। আর শরীর প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে।
পরীক্ষা
ডেংগু
জ্বরের ১ থেকে ৫ দিনঃ NS1 এন্টিজেন
৫ দিন পরঃ ডেঙ্গু IgM/ IgG (ELISA অথবা Rapid ICT)
নিউক্লিক এসিড সনাক্তকরণঃ RT-PCR (জ্বরের ১ম ৫ দিনের মাঝে)
চিকুনগুনিয়া
৫ দিন পরঃ IgM/ IgG (ELISA অথবা Rapid ICT)
নিউক্লিক এসিড সনাক্তকরণঃ RT-PCR (জ্বরের ১ম ৫ দিনের মাঝে)
জিকা
৫ দিন পরঃ IgM/ IgG (ELISA অথবা Rapid ICT)
নিউক্লিক এসিড সনাক্তকরণঃ RT-PCR (জ্বরের ১ম ৫ দিনের মাঝে)
তবে ডেংগু, চিকুঙ্গুনিয়া বা জিকা তিনটি ভাইরাস টেস্টের জন্যই PCR পদ্ধতি সবচেয়ে স্পেসিফিক কিন্তু এটি ব্যয়বহুল এবং এর জন্য দক্ষ জনবল ও আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রয়োজন, যা সর্বত্র সহজলভ্য নয়। কিন্তু কোভিড মহামারীর সময়ে দেশের অনেক স্থানে পিসিআর মেশিন স্থাপন করা হয়েছে। সেখানে যদি এই ভাইরাসগুলির পিসিআর কিট সরবরাহ করা হয়, তাহলে পিসিআর করেও রোগ নির্ণয় করা সম্ভব।
যে কোন ভাইরাসের IgG যদি কারো পজিটিভ আসে তাহলে বুঝতে হবে তার আগে সেই ভাইরাস দিয়ে ইনফেকশন হয়েছিল। চিকুনগুনিয়া একবার হলে ২য় বার হওয়ার কোন সম্ভাবনা নাই, কিন্তু ডেংগু ও জিকা হতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব ল্যাবরেটরি মেডিসিন এন্ড রেফারেল সেন্টার এর ভাইরোলজি বিভাগে সম্পাদিত একটি গবেষণায় প্রাপ্ত ফলাফল পর্যালোচনা করে দেখা যায়, ডেঙ্গু রোগ দ্রুত সনাক্তকরণের জন্য NS1 ELISA পদ্ধতিটি ৯৪ শতাংশ কার্যকর যেখানে NS1 ICT পদ্ধতিটি শতকরা ৫৬ ভাগ ক্ষেত্রে কার্যকর পাওয়া গিয়েছে। ELISA প্রক্রিয়াটি ICT অপেক্ষা কিছুটা ব্যায়বহুল, যেটা খুব নগণ্য। তথাপি উল্লেখ্য যে, বাংলাদেশের সকল জেলাতে ELISA মেশিন এবং দক্ষ মেডিকেল টেকনোলজিষ্ট রয়েছে। এই ২টি পদ্ধতির (ELISA & ICT) পরীক্ষাই ডেঙ্গু রোগ এর নিশ্চিতকরণ পরীক্ষা RT-PCR পদ্ধতির সাথে (ভাইরাস সনাক্তকরণের জন্য RT-PCR gold standard) তুলনা করে প্রাপ্ত।
প্রতিকার
মশার কামড় থেকে সুরক্ষাই এডিস মশা থেকে বাঁচার সবচেয়ে ভালো উপায়। শরীরের বেশির ভাগ অংশ ঢাকা রাখা (ফুল হাতা শার্ট এবং ফুল প্যান্ট পরা), জানালায় নেট লাগানো, প্রয়োজন ছাড়া দরজা জানালা খোলা না রাখা, ঘুমানোর সময় মশারি ব্যবহার করা, শরীরে মশা প্রতিরোধক ক্রিম ব্যবহার করার মাধ্যমে মশার কামড় থেকে বাঁচা যায়। আবাসস্থল ও এর আশপাশে মশার প্রজনন ক্ষেত্র ধ্বংস করতে হবে। বাসার আশপাশে ফেলে রাখা মাটির পাত্র, কলসী, বালতি, ড্রাম, ডাবের খোলা ইত্যাদি যেসব জায়গায় পানি জমতে পারে, সেখানে এডিস মশা প্রজনন করতে পারে। এসব স্থানে যেন পানি জমতে না পারে সে ব্যাপারে লক্ষ রাখা এবং নিয়মিত বাড়ির আশপাশে পরিষ্কার করা। সরকারের মশা নিধন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করা। যেহেতু এ মশা আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত থেকে জীবাণু নিয়ে অন্য মানুষকে আক্রান্ত করে, কাজেই আক্রান্ত ব্যক্তিকে যাতে মশা কামড়াতে না পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নেওয়া।
মোঃ মাহাদী হাসান
মেডিকেল ল্যাব টেকনোলজিস্ট।
কেন্দ্রীয় পুলিশ হাসপাতাল।