19/11/2024
"হ্যালো,হোটেল রিসেপসান থেকে বলছি। স্যার, একটি স্থানীয় মাছধরা জেলে, অনেকক্ষণ ধরে এসে বসে আছে, আপনাদের সঙ্গে দেখা করতে চায়। বলছে কী নাকি খুব একটা জরুরি দরকার।"
"আমাদের সঙ্গে আবার কিসের দরকার! না, না আমাদের কারো সঙ্গে কোনও দরকার নেই। বলুন এই ভরদুপুরে আমরা কারও সঙ্গে দেখা করবো না।"
"না স্যার, দুপুরে নয়, ওরা প্রায় সেই সকাল সাড়ে দশটা থেকেই এসে বসে আছে। প্রথমে তো ভাগিয়েই দিয়ে দিয়েছিলাম, কিন্তু ওরা নাছোড়বান্দা।"
"বসে আছে মানে? না না আমরা কারুর সঙ্গে দেখা করবো না। আমাদের মনমেজাজ ঠিক নেই। "
"বলেছি স্যার সব বলেছি।
কতোবার তো একই কথা বললাম। কতবার বোঝালাম, স্যার, ম্যামের মনখারাপ, ওঁরা কারো সঙ্গে দেখা করবেন না। ডাইনিংরুমে খেতেও নামছেন না, রুম সার্ভিস, ঘরে গিয়ে লাঞ্চ, ডিনার ব্রেকফাস্ট সব কিছু পৌঁছে দিয়ে আসছে, আর তাঁরা কিনা তোমার কথায়, দোতলা থেকে একতলায় নেমে রিসেপসানে আসবেন তোমাদের সঙ্গে দেখা করতে! তবুও স্যার, ওরা কিছুতেই কিছু মানতেই চালছে না। গোঁ ধরে বসে আছে। কেবলই বলে চলেছে, কী নাকি খুব জরুরি একটা দরকার।
ছেঁড়া ফতুয়া আর ময়লা ধুতি পরা একটা লোক যদি, বৌ, বাচ্চা সমেত, আমাদের এই ঝাঁ চকচকে রিসেপসানের মেঝেতে বসে থাকে, তা হলে আমাদের কী অবস্থা হয় ভাবুন তো । আমাদের রেপুটেশানের তো বারোটা বেজে যাবে।"
"তা বসে থাকতে দিচ্ছেনই বা কেন! ভাগিয়ে দিন। আপনাদের দারোয়ান নেই?"
"হ্যাঁ স্যার, তাই করেছি। যেতে কী চায়। এই ঠা ঠা রোদ্দুরেও রাস্তার ওপারে, পাঁচিলের এক পাশে বসেই আছে। বলছে খুব দরকার, দেখা না করে নাকি নড়বেই না। আরও বলছে, পাঁচ মিনিটের বেশি সময় নেবে না। তাতে যদি সারারাতও রাস্তায় বসে থাকতে হয়, তাই থাকবে। ব্যাপারটা একটু যদি বোঝার চেষ্টা করেন স্যার। সম্ভব হলে একবার কথা বলে ব্যাপারটা যদি মিটিয়ে নেওয়া যায়...।"
" বুঝেছি, বুঝেছি। আরে বাবা, গতকাল সমুদ্রে স্নান করতে গিয়ে আর একটু হলে যে দুর্ঘটনাটা ঘটে যেতে পারতো, মানে আপনাদের ম্যাডাম আর একটু হলেই, মানে ওই নুলিয়াটারই জন্যেই বেঁচে ফিরেছেন আর কী। তা সেটা তো আর অস্বীকার করছি না! কালই তো ওকে, টাকাপয়সা দিয়ে খুশি করে দিতে চেয়েছিলাম, ইয়ে মানে যতটা সম্ভব আর কী! বলতে গেলে সাধাসাধিও করা হলো, তখন তো নিল না কিছুতেই। উল্টে বড়ো বড়ো জ্ঞানের কথা বললো। মানুষের প্রাণ ঈশ্বরের দান, রাখলে নাকি তিনিই রাখেন। ও তো নিমিত্ত মাত্র! প্রাণ বাঁচানো নাকি পুণ্যের কাজ! তা আজ আবার কী হলো! আফশোষ হয়েছে বুঝি! তা বেশ তো, ডেকে আনো ওকে, দেখি কত টাকায় রফা হয়!"
হোটেলের লোক রাস্তার ওপার থেকে ওদের ডেকে আনতে গেছে। হুঁহ্ মহান হওয়া যেন অতোই সোজা! অবশ্য কিছু টাকা দিয়ে দিতে পারলে ভালোই হয়, ঋণের বোঝাটা একটু হ্ হালকা হয় যদি, আফটার অল তার স্ত্রীর প্রাণটা তো বাঁচিয়েছে। যদিও সেভাবে ভেবে দেখলে ক'টা টাকায় প্রাণের মূল্য হয় না, তবুও অত ভাবলে কি আর চলে!"
কালকের সেই নুলিয়াটা, তার স্ত্রী তাদের বাচ্চা ছেলেটাকে নিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে।
" শুনলাম সকাল থেকেই বসে আছো। তা কী কী বলবে বলো।"
"ম্যাডাম কোথায় ?"
"আবার ম্যাডামকে কী দরকার, যা বলার আমাকেই বলো না! "
"না স্যার, ওঁকেও দরকার।"
মেজাজটা ক্রমশ চড়ছে। তাঁর স্ত্রীর প্রাণটা বাঁচিয়েছে বলে মাথাটা কিনে নিয়েছে যেন! হঠাৎ সচেতন হলেন, নাঃ এভাবে ভাবাটাও ঠিক না। দেখাই যাক না কী বলে। মোটাসোটা, দাঁও মারতে এসেছে সে বিষয়ে এখন আর কোনও সন্দেহই নেই, তবে আবার ম্যাডামকে কেন! প্যাঁচ কষছে সে তো বোঝাই যাচ্ছে। তার স্ত্রীর মনটা আবার বড্ড নরম। বড়ো কোনোও প্রতিশ্রুতি দিয়ে না বসে। নাঃ মাথাটা ঠান্ডা রাখা দরকার। একটা রফা তো করতেই হবে।
মোবাইলে স্ত্রীকে, ডেকে পাঠালেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই নেমে এলেন তিনি। মুখটা একেবারে শুকিয়ে গেছে। হবেই তো কাল যা মানসিক ধকল গেছে, প্রাণটা কোনওমতে বেঁচেছে তাই না কতো! সেই মুহূর্তগুলো মনে আনতে চান না মোটেও তবুও যতোই জোর করে সরাতে চান, কিছুতেই যেন সরে না, তার উপরে দিদিশ্বাশুড়ির দেওয়া পাঁচভরির সোনার চেনটাও গেছে। কলকাতায় তো আর সাহস করে পরা হয় না, ভেবেছিলেন বেড়াতে এসেই না হয় ক'টা দিন একটু গলায় ঝোলাবেন। সমুদ্রের স্নানের সময় খুলে রেখে যেতে ভুলে গেছিলেন। সেটা গলাতেই ছিলো। আসলে হঠাৎ ঢেউয়ের টানে যে এভাবে ভেসে যাবেন তা কি ভেবেছিলেন! প্রাণে বাঁচার ধস্তাধস্তির সময় কখন যে খুলে পড়ে গেছে, নাকি ওই জল খেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়ে থাকার সময়ে যখন পেটে চাপ দিয়ে জল বের করছিল লোকটা, তখন ও-ই টেনে নিল! তাই মনে হয় কোনো বখশিশ নিতে চায় নি! আর ভাবতে পারেন না। শরীরটা যেন আর চলে না, কোনওমতে নীচে রিসেপশনে এসে দাঁড়ালেন।
"এবার তাড়াতাড়ি বলো তো কি বলার আছে। আমাদের শরীর, মন কোনটাই ভালো নেই।"
এবার নুলিয়ার বৌটি সামনে এগিয়ে এলো , তারপর কোল আঁচলের খুঁটে বাঁধা একটা ময়লা কাগজের ঠোঙা বের করে তার হাতে দিয়ে, নিজস্ব ভাষায় বললে,
"দেখে নাও, তোমার জিনিস ঠিক আছে কিনা।"
মোড়কটি খুলতেই ঝিকিয়ে উঠলো সেই পাঁচভরির হার। হতভম্ব হয়ে সবাই চেয়ে রইলো, মলিনবেশী শীর্ণকায়া দরিদ্র সেই মহিলাটির মুখের দিকে।
"কোথায় পেলে,"
স্খলিতকন্ঠের কথাগুলো যেন ভেসে এলো কোন সুদূর হতে।
"আজ সকালে আমরা, হাঁড়ি নিয়ে ঢেউয়ে ভেসে আসা মাছ ধরছিলাম, আমাদের ছেলেটা তীরের কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ঝিনুক তুলছিলো। হারটা বালির মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল তো, সামান্য একটু অংশ বের হয়ে ছিল,তখনই ওর নজরে পড়ে। বালি খুঁড়ে বের করে আমাকে দেখায়। আমি দেখেই চিনতে পেরেছিলাম। কাল তোমার গলায় ছিলো তো, আর তোমরা যে এই হোটেলে উঠেছো, সেটাও কাল তোমাদের এখানে পৌঁছে দেবার সময় দেখে গেছিলাম। ভাগ্যিস! যাক্ যার জিনিস, তাকে ফিরিয়ে দিতে পেরে বাঁচলাম। বড্ডো দুশ্চিন্তায় ছিলাম। আসি তাহলে!"
পড়ন্ত সূর্যকে পিছনে ফেলে ওরা তিনজন হেঁটে ফিরে যাচ্ছিলো। ওদের ছায়াগুলো দীর্ঘ থেকে দীর্ঘতর হচ্ছে। হোটেলের সিঁড়িতে হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলো নিশ্চুপে শুধু চেয়েছিল সেইদিকে। কারুর মুখে কথা সরছে না। তারা শুধু দেখছিল তিনটি প্রকৃত ধনী মানুষ, এগিয়ে যাচ্ছে। পিছনে পড়ে থাকছে তাদের দীর্ঘ ছায়া।