31/12/2023
পিতা, নেতা ও দা'ঈ ইলাল্লাহ হিসেবে
আল্লামা সাঈদী রহ. যেমন ছিলেন .. [পর্ব ১]
🖍️... মাসুদ সাঈদী
১৪ আগস্ট ২০২৩। সোমবার। মুসলিম উম্মাহর শোকাবহ ডায়েরিতে বা শোকের দিনলিপিতে আরো একটি কালো দিন যুক্ত হলো। দীর্ঘ ১৩ বছর ১ মাস ১৬ দিন আওয়ামী জালিম সরকারের রাজনৈতিক রোষানলের শিকার হয়ে কারান্তরীণ থাকা অবস্থায় সরকারি ব্যবস্থাপনায় রহস্যজনক অসুস্থতা ও সন্দেহজনক চিকিৎসায় ইন্তেকাল করেন মুসলিম উম্মাহর প্রিয় রাহবার, গোটা মুসলিম জাহানে সুপরিচিত আল্লাহর দ্বীনের একনিষ্ঠ দা'ঈ, বিশ্বনন্দিত মুফাসসিরে কুরআন, ইসলামী আন্দোলনের বীর সিপাহসালার, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সম্মানিত নায়েবে আমীর, জননন্দিত মাজলুম জননেতা, আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা, কুরআনের পাখি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী রাহিমাহুল্লাহ। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিঊন।
প্রিয় নবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ সা.-কে হারানোর দিনের চেয়ে বড় ব্যথা আর কষ্টের দিন মুসলিম উম্মাহর শোকাবহ ডায়েরিতে আর নেই। যারা নবীজির আদর্শ এবং জীবনব্যবস্থাকে বুকে ধারণ করে জীবন পরিচালনা করেছেন, যারা নিজেদের জীবনকে আল্লাহ এবং তাঁর রাসূলের রঙ্গে রঙিন করে নিয়েছেন, তাদেরকে হাদিসের ভাষায় ওলামা বলা হয়েছে নবীজির সা. ভাষ্যমতে এই ওলামারাই নবীদের প্রকৃত ওয়ারিশ। নবীজির ইন্তেকালের পর বিভিন্ন সময়ে একে একে নবীর এই ওয়ারিশদের ইন্তেকাল মুসলিম উম্মাহর জন্য ভীষণ বেদনার, কষ্টের এবং শোকের। দিন যায়, বছর যায়, যুগ পার হয়– এক এক করে দুনিয়ার সংক্ষিপ্ত সফর শেষ করে নবীর ওয়ারিশ ওলামারাও চলে যান মহান প্রভুর সান্নিধ্যে। আর মুসলিম উম্মাহর শোকাবহ ডায়েরিতে এক এক করে বাড়তে থাকে শোকের দিনলিপি।
১৪ আগস্ট ২০২৩, মুসলিম উম্মাহর জন্য সে রকমই একটি দিন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতাকে হারানোর দিন। আমার পরম শ্রদ্ধেয় নেতাকে হারানোর দিন। আল্লাহ তাআলার পথের একনিষ্ঠ একজন দাঈকে হারানোর দিন। নবীজির ওয়ারিশ মজলুম আলেমে দ্বীন আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে হারানোর দিন। একজন আলেমের মৃত্যুকে নবীজি সা. গোটা জাহানের মৃত্যুর সাথে তুলনা করেছেন। নবীজি বলেছেন, 'একজন আলেমের মৃত্যু মানে গোটা জাহানের মৃত্যু।' (সুনানে বায়হাকি: ৩য় খণ্ড, হাদিস
নং-১৫৭)। আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর মতো একজন আলেমকে হারিয়ে গোটা মুসলিম জাতি তাই আজ ব্যথিত! শোকে স্তব্ধ! আল্লাহ তাআলা মুসলিম উম্মাহকে এই শোক সইবার শক্তি দান করুন।
শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী (রাহিমাহুল্লাহ), যাকে নিয়ে আজ দু'কলম লিখতে বসেছি, যার জীবনের কিছু দিক আজ তুলে ধরতে বসেছি- তিনি একাধারে আমার পিতা, তিনি আমার নেতা, তিনি একজন বিশ্বনন্দিত দাঈ ইলাল্লাহ। একজন পিতা, একজন নেতা এবং দাঈ ইলাল্লাহ হিসেবে আল্লামা সাঈদী কেমন ছিলেন, তাঁকে এই ক্যাটাগরিগুলোতে আমি কেমন দেখেছি, কেমন পেয়েছি, সেই বর্ণনা দেওয়ার মতো উপযুক্ত ভাষা, লেখার যোগ্যতা কোনোটাই যে আমার নেই! কত হাজার শব্দ লেখার পর এই ক্যাটাগরিগুলোতে তাঁকে যথাযথভাবে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব হবে- তার অনুমানও আমি করতে পারছি না। এরপরও সাহস সঞ্চয় করে আজ বসেছি আমার পরম শ্রদ্ধেয় শহীদ পিতাকে নিয়ে দু'কলম লিখতে ।
শহীদ আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার মাধ্যমেই আমাদের চার ভাই- মরহুম মাওলানা রাফীক বিন সাঈদী, শামীম বিন সাঈদী, আমি ও নাসীম বিন সাঈদীকে দুনিয়াতে পাঠিয়েছেন। একজন উঁচু মানের, উন্নত চরিত্রের ব্যক্তিকে বাবা হিসেবে পেয়ে আমরা যে কতটা তৃপ্ত, তা শুধু মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনই ভালো জানেন। তিনি আজ শহীদ। একজন শহীদ পিতার সন্তান আমরা। এটাও আমাদের জন্য চরম সৌভাগ্যের এবং পরম তৃপ্তির একটা বিষয়। আল্লাহ রাব্বুল আলামিন একজন মানুষকে দুনিয়াতে এতটা মর্যাদার অধিকারী কী করে বানান, কেন একজন মানুষকে আল্লাহ দয়া করে জগৎজোড়া এতটা খ্যাতি দান করেন, কীসে একজন মানুষকে আল্লাহ তাআলা এতটা উঁচুতে অবস্থান দান করেন, কোন কোন গুণাবলী একজন মানুষকে মানুষের এতটা ভালোবাসার পাত্র বানিয়ে দিতে পারেন- তা আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতাকে খুব কাছ থেকে দেখে দেখে কিছুটা হলেও বুঝতে সক্ষম হয়েছি। আলহামদুলিল্লাহ।
আল্লাহ তাআলা মানুষকে সম্মান ও ইজ্জত দান করেন। তেমনি মানুষের জীবনে জিল্লতিও তিনিই দান করেন । এগুলো সবই মানুষের নিজের হাত দ্বারা অর্জিত, কর্মের ফল । কাউকে যদি তিনি সম্মানিত করেন অবশ্যই এই সম্মান তার কর্মের দ্বারা আল্লাহর কাছ থেকে প্রাপ্ত হন। কাউকে যদি তিনি অসম্মানিত করেন, এটিও তার কর্ম দ্বারা অর্জিত । হাদিস এসেছে, 'আল্লাহ যদি কাউকে ভালোবাসেন তাহলে দুনিয়াবাসীর অন্তরে ওই বান্দার জন্য আল্লাহ ভালোবাসা তৈরি করে দেন। ফলে পুরো ফেরেশতাকুল এবং দুনিয়াবাসী তাকে ভালোবাসতে শুরু করে। (মুসনাদে আহমদ: ৮৫০০)। আজ আল্লামা সাঈদীর জন্য পুরো দুনিয়া জুড়ে যে ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে সেটা নবীজির এই হাদিসেরই সচিত্র উদাহরণ।
আব্বা সাধারণত দেশ এবং বিদেশ সফর মিলিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। শুধু আব্বার ব্যস্ততার বর্ণনা দেওয়ার জন্যই আরো বিশাল মাপের একটি লেখা তৈরি হতে পারে। খুব সংক্ষিপ্ত আকারে এই বর্ণনা দেওয়া সম্ভব না। কিন্তু আব্বা যতই ব্যস্ত কিংবা পেরেশান থাকতেন না কেন- যখনই নামাজের সময় হতো, মনে হতো আব্বার মতো এত ফ্রি এবং অবসর মানুষ দুনিয়ার বুকে আর দ্বিতীয়জন নেই। তখন মনে হতো নামাজ ছাড়া আর কোনো কাজই দুনিয়াতে তার নেই। নামাজের প্রস্তুতি, মসজিদে যাওয়া, স্থিরচিত্তে দীর্ঘ সময় ধরে নামাজ আদায় করা; এসব দেখে বুঝাই যেত না যে তিনি কিছুক্ষণ আগেই ব্যস্ততার সমুদ্রের গভীর থেকে ওঠে এসেছেন। নামাজ আদায় শেষেই আবার সেই গভীরে ডুবে যাবেন । এর মধ্যে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। দ্রুত নামাজ শেষ করার কোনো তাড়া নেই। মনে হতো নামাজের সময় হয়েছে মানেই দুনিয়ার সকল কাজ থেকে তিনি অবসর গ্রহণ করেছেন।
প্রসঙ্গক্রমে একটি কথা মনে পড়ে গেল। ১৯৯৬ সালে পিরোজপুর-১ আসনে আব্বার প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময়কার কথা। ফজরের নামাজের পর থেকে শুরু করে সারাটা দিন নির্বাচনী এলাকার এ মাথা থেকে ও মাথা পর্যন্ত অক্লান্ত পরিশ্রম করে ঘর্মাক্ত শরীর ও ক্লান্ত দেহ নিয়ে আব্বা যখন রুমে ফিরতেন- তখন আব্বার সফরসঙ্গীরা গোসল শেষে নামাজ পড়ে তাদের ক্লান্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়তেন নরম বিছানায়, আর আমার আব্বা আল্লামা সাঈদী তখন তাঁর ক্লান্ত দেহ নিয়ে লুটিয়ে পড়তেন জায়নামাজে। এভাবে প্রতিটি রাতেই মহান প্রভুর কুদরতি পায়ে সিজদায় লুটিয়ে পড়তেন তিনি। ফজরের নামাজের আগে তিনি কিছুটা সময় ঘুমাতেন। ফজরের ওয়াক্তে তিনিই আবার
সবার আগে উঠতেন, অন্যদেরকেও তিনিই ঘুম থেকে উঠাতেন। এভাবেই চলেছে নির্বাচনের পুরোটা সময়। নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ শেষে ভোট গণনা চলছিল। গণনা শেষ হওয়ার পরেও ভোটের ফলাফল ঘোষণা করতে স্থানীয় প্রশাসন গড়িমসি করছিল। ভোটের ফলাফল কী হয়, কী হয় সবাই তখন এক অজানা ভয়, আশঙ্কা ও পেরেশানিতে অস্থির! জেলা প্রশাসকের অফিসের ভেতরে ও বাইরে তখন নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী সকল প্রার্থী ও তাদের সমর্থকদের সরব উপস্থিতি। চলছিল মুহুর্মুহু স্লোগান। সে রকম চরম একটি মুহূর্তেও সেখানে উপস্থিত ছিলেন না একজন- তিনি আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী। সবার কৌতূহলী দৃষ্টি তখন আব্বাকে খুঁজছিল। কোথায় তিনি! কোথায় তিনি? ঠিক সেই মুহূর্তে পিরোজপুর সদর থানার ওসি এসে সবাইকে জানালেন, ‘সাঈদী স্যার এশার নামাজের পর থেকেই সদর থানা মসজিদে আছেন।’ তার সাথে কয়েকজন লোক আছে। সেখানে তিনি নামাজ আদায় করছেন।’ উপস্থিত সকলের চোখ ছানাবড়া হয়ে গেল। এমন পেরেশানির মুহূর্তেও নামাজে মানুষের মনোযোগ আসে কীভাবে?
রাত ১১-১২টার দিকে ভোটের ফল ঘোষণা করা হলো। ডিসি সাহেব যখন ঘোষণা করলেন, সপ্তম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পিরোজপুর-১ আসন থেকে বেসরকারিভাবে নির্বাচিত হয়েছেন- দাঁড়িপাল্লা প্রতীক নিয়ে আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, ঠিক তখনও আমার পরম শ্রদ্ধেয় পিতা আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী সেখানে উপস্থিত ছিলেন না। তখন মোবাইল ফোনের প্রচলনও ছিল না । তাই তাঁকে নির্বাচনের রেজাল্ট জানানোর জন্য সবাই ছুটে চললো সদর থানার ওসির দেওয়া তথ্য মতে সদর থানা মসজিদের দিকে। সেখানে গিয়ে আব্বাকে পাওয়া গেল না। মসজিদে খোঁজ নিয়ে জানা গেল তিনি কিছুক্ষণ আগে তাঁর মায়ের কাছে (আমার দাদী) গেছেন। এই খবর পেয়ে হাজারো জনতা ছুটলো আবার আমার দাদীর বাড়ির দিকে। সেখানে গিয়ে সবাই জানতে পারলেন- আল্লামা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী তাঁর সম্মানিতা মায়ের পায়ের কাছে (আমি নিজে দেখেছি, আব্বা সারাজীবন তাঁর মায়ের কাছে গেলে তার পায়ের কাছেই বসতেন) বসে গল্প করছেন। উপস্থিত জনতা 'লিল্লাহি তাকবির-আল্লাহু আকবর' বলে চিৎকার করে কেঁদে উঠলেন। জনতা ভেবেই ব্যাকুল– এমন চরম একটি পেরেশানির মুহূর্তে একজন মানুষ কীভাবে এত শান্ত, এত ধীরস্থির থাকতে পারেন?
আব্বাকে নির্বাচনের রেজাল্ট জানানো হলো। আব্বা তখনো তাঁর মায়ের পায়ের কাছেই বসা ছিলেন। আব্বা বিছানা থেকে ওঠে হাঁটু গেড়ে বসে তাঁর মায়ের দু'পায়ে দুটি চুমু দিলেন। এরপর দীর্ঘ সময় নিয়ে দু'রাকাত নফল নামাজ পড়লেন। নামাজ শেষে তিনি জনতার সামনে এলেন। সকলকে সালাম ও কৃতজ্ঞতা জানালেন। উপস্থিত সবাইকে নিয়ে গভীর রজনীতে আকাশের দিকে দু'হাত তুলে চোখের পানি ফেলে মহান রবের শুকরিয়া আদায় করলেন।
আব্বা চিৎকার করে ফরিয়াদ করতে লাগলেন- 'হে আমার রব! যে দায়িত্ব, যে আমানত তুমি আমার উপর অর্পণ করেছো তা পালন করার তাওফিক আমাকে দাও। জনগণের হক আদায়ের তাওফিক আমাকে দাও। আমার যোগ্যতা তুমি বাড়িয়ে দাও।'
এর বেশ কিছুদিন পর একদিন আব্বার কাছে আমি জানতে চাইলাম, 'আব্বা! নির্বাচনের দিন রেজাল্ট জানার জন্য সবাই যখন অস্থির-পেরেশান, ঠিক তখন আপনি রেজাল্ট ঘোষণার জায়গায় ছিলেন না- আবার রেজাল্ট ঘোষণার সময়ও আপনি উপস্থিত ছিলেন না। আপনি বাড়ি এসে দাদীর পায়ের কাছে বসে ছিলেন। আপনি এত শান্ত, এত ধীরস্থির কীভাবে ছিলেন?
আমার আব্বা আমাকে বললেন- 'হে আমার কলিজার টুকরা! নামাজে ধীরস্থির হও, সময় দাও- আল্লাহ আজ্জাওয়াজাল জীবনটাকে স্থির করে দিবেন।'
আল্লাহু আকবার। এই অল্প অথচ পাহাড়ের সমান ওজনদার এক কথায় আমি আমার সকল প্রশ্নের উত্তর পেয়ে গেলাম।
সাধারণত আব্বা যখন দেশে থাকতেন তখন আমাদের সব ভাইদেরকে নিয়ে আব্বা একসাথে মসজিদে যেতেন। ফজরের আযান হওয়ার আগেই আমরা যে যে ফ্লোরে থাকি সেসব ফ্লোরে আব্বা এসে আমাদের সকল ভাইকে ঘুম থেকে ডেকে তুলতেন। খুব কম সময়ই আমরা আব্বাকে ডেকে তোলার সুযোগ পেয়েছি। যদিও আমরা আব্বার সাথে মসজিদে যাওয়ার জন্য তাঁর ডাকের অপেক্ষায় থাকতাম। আব্বা যখন আমাদের নিয়ে মসজিদের উদ্দেশে বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামতেন, আব্বাকে দেখামাত্রই রাস্তায় চলাচল করা মানুষগুলো আব্বার সম্মানে যার যার জায়গায় দাঁড়িয়ে পড়তেন। তারা চেষ্টা করতেন আব্বা তাদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় তারা আব্বাকে আগে সালাম দেবে। কিন্তু বেশিরভাগ সময়েই তারা সফল হতেন না। দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর পাশে আসার আগেই একটু দূর থেকে আব্বা নিজেই আগে সালাম দিয়ে দিতেন। আব্বা পাশ অতিক্রম করে যাওয়া পর্যন্ত মানুষগুলো ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতো আব্বার সম্মানে। মসজিদে ঢুকেই আব্বা যেখানে জায়গা পেতেন সেখানেই বসে পড়তেন, কখনোই মুসল্লিদের ডিঙিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করতেন না।
আব্বা দেশে থাকাকালীন আব্বার দিনলিপি কখনোই আমরা রুটিনের বাহিরে যেতে দেখিনি। তিনি যত ক্লান্তই থাকতেন না কেন, দিনে যত পরিশ্রমই করতেন না কেন- গভীর রাতে ওঠে জায়নামাজে দাঁড়িয়ে যাওয়া আব্বার মিস হতো না। সাধারণত আব্বা রাত ১১টা থেকে ১১.৩০টার মধ্যে ঘুমিয়ে যেতেন। রাতের খাবার তিনি আমাদেরকে নিয়ে খাওয়ার চেষ্টা করতেন, কিন্তু মাঝে মধ্যেই আমাদের বাসায় ফিরতে রাত হতো বলে অনেক সময়ই আমরা আব্বার সাথে বসে একসাথে খেতে পারতাম না। পরিমিত সুন্নতি আহারে অভ্যস্ত ছিলেন তিনি। রাত ১০টার মধ্যে রাতের খাবার শেষ করে ছাদে উঠে কিছু সময় হাঁটাহাঁটি করতেন। আমিও আব্বার পাশাপাশি হাঁটতাম। হাঁটতে হাঁটতে আব্বা আমাকে কুরআন হাদিস থেকে বিভিন্ন উপদেশমূলক নসিহা করতেন। নবীদের জীবনী থেকে বিভিন্ন শিক্ষণীয় ঘটনাবলি শোনাতেন। আমি তন্ময় হয়ে শুনতাম আর বিভিন্ন প্রশ্ন করে আব্বার কাছ থেকে আরো কিছু জানতে চাইতাম। আব্বার চেহারায় কখনো বিরক্তির ভাব আমি দেখতাম না। হাঁটা শেষ হলে আব্বা নিচে নেমে ফ্রেশ হয়ে সোজা তাঁর বিছানায় চলে যেতেন।
বেশিরভাগ সময়ই আব্বা কখনো রাত ৩/৩:৩০টার বেশি ঘুমাতেন না। কখনো কখনো আরো আগেই ওঠে যেতেন । ফজরের পর আব্বা গায়ে মেশকে আম্বর মাখতেন। রাসূল সা. সুগন্ধি পছন্দ করতেন । আব্বা নবীজির অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সুন্নতের পাশাপাশি এই সুন্নতটাকেও মনপ্রাণ দিয়ে আঁকড়ে ধরেছিলেন। সুগন্ধির প্রতি আব্বার এক ধরনের মোহ ছিল। আব্বা কোনো জিনিস ধরলে বা যে কোনো জিনিস তিনি ব্যবহার করে রেখে দিলে আমরা সহজেই বুঝতে পারতাম যে, হয় এটা আব্বা ধরেছেন অথবা ব্যবহার করেছেন। আব্বা সিঁড়ি দিয়ে নেমে বাইরে গেলেও আমরা টের পেতাম, কেননা পুরা সিঁড়ি তখন সুগন্ধিতে ভরে যেত। আপনারা এটা জেনে কী ভাববেন জানি না, এমনও হতো- আব্বা যখন আমাদেরকে কোনো পারপাসে টাকা দিতেন, আব্বার দেওয়া সেই টাকাতেও আমরা আব্বার ব্যবহার করা আতরের গন্ধ পেতাম।
সৌদি সরকার কাবার গিলাফে ব্যবহার করা সুগন্ধিগুলো মাঝে মাঝে আব্বার জন্য হাদিয়া হিসেবে পাঠাতেন। আব্বা গভীর রাতে উঠে গায়ে সুগন্ধি মেখে চলে যেতেন ৫ তলায় অবস্থিত আব্বার স্টাডি রুমে। আব্বার জীবনের এমন কিছু ঘটনা আছে যেগুলো আমরা পরিবারের সদস্যরা ব্যতীত আর কেউই জানে না। আজকের এই লেখাতেও আমি এ বিষয়ে কিছু লিখবো না। আলিমগণ বলে থাকেন, 'আওলিয়াদের কারামত সত্য।' আমরা বুঝতাম না আব্বার কাছ থেকে মাঝে মাঝে সেরকম কোনো বিষয় প্রকাশ হতো কিনা!
গভীর রাতে আব্বা স্টাডি রুমে ঢুকে মহান রবের সাথে এক গভীর মোলাকাতে মগ্ন হয়ে যেতেন। আব্বা সালাতুত তাহাজ্জুদসহ বাকি সময় চোখের পানিতে সিজদায় কাটাতেন। কিছু সময় কিতাব অধ্যয়ন করতেন। ব্যক্তিগত কালেকশনে আব্বার লাইব্রেরিতে কুরআন-হাদিসের দুর্লভ সব তাফসির গ্রন্থের পাশাপাশি বিজ্ঞান, রাজনীতি, আইন, ইতিহাস, ধর্মতত্ত্ব, ভূমণ্ডল, নারী অধিকার, শ্রমিক অধিকারসহ বিভিন্ন বিষয়ের ওপর দুর্লভ সব বইয়ের কালেকশন আছে। তিনি মাঝে মধ্যে গভীর রজনীতে কিতাবের গভীর সমুদ্রে ডুব দিতেন। স্টাডি করতেন। নোট করতেন।
আব্বা তার সন্তানদের দ্বীনের ব্যাপারে কঠোর ছিলেন। কিন্তু আব্বার মতো সন্তানদের প্রতি এত স্নেহশীল পিতা আমরা কম দেখেছি। আব্বা শরিয়তের ব্যাপারে আমাদের প্রতি যেমন কঠোর ছিলেন, তেমনি সন্তান এবং পরিবারের চাহিদা পূরণে আব্বার মতো যত্নশীল এবং স্নেহশীলও আমরা কম দেখেছি। সন্তানদের প্রতি দ্বীনি উপদেশে আব্বাকে লোকমান আ. এর প্রতিচ্ছবি মনে হতো। তিনি সবসময় আমাদেরকে নবীজির একটি হাদিস স্মরণ করিয়ে দিতেন যে, মানুষ মারা যাওয়ার পর তার সকল আমলের দরজা বন্ধ হয়ে যায় শুধুমাত্র তিনটি ছাড়া। তার মধ্যে এক নাম্বারেই হলো নেক সন্তান ।' (মুসলিম: ১৬৩১)।
আব্বা সব সময় বলতেন, ‘তোমরা আমার কবরে আমলে জারির উৎস। তোমাদেরকে নেক সন্তান হিসেবে গড়ে তুলতে পারলে এটার ফল আমি কবরে শুয়ে শুয়ে পাব। তোমরা আমার জন্য নেক সন্তান হও, আল্লাহ তায়ালা তোমাদের সন্তানদেরকেও তোমাদের জন্য নেক সন্তান বানিয়ে দিবেন।'
আব্বা এই কথাগুলো বলতে গিয়ে হঠাৎ ডুকরে কেঁদে উঠতেন আর বলতেন, 'আমি কি আমার আব্বা আম্মার জন্য নেক সন্তান হতে পেরেছি? আল্লাহ তায়ালা কি আমাকে আমার আব্বা আম্মার নেক সন্তান হিসেবে কবুল করেছেন?' এ কথা বলে সাথে সাথে আব্বা আকাশের দিকে হাত উঁচিয়ে দোয়া করতে থাকতেন- ‘আয় আল্লাহ! আমাকে আমার আব্বা আম্মার জন্য এবং আমার সন্তানদেরকে আমার জন্য তোমার প্রিয় হাবিবের ঘোষণা অনুযায়ী সৎ এবং নেক সন্তান হিসেবে কবুল করে নাও।' আমরা আব্বার
কান্নাজড়িত কণ্ঠের আকুতির সাথে আমিন আমিন বলে চোখের পানিতে বুক ভাসাতাম।
[ ইনশাআল্লাহ আগামীকাল পাবেন পর্ব ২ ]
Masood Sayedee