06/12/2024
ফ্যাসিবাদের সহজপাঠ...
তখন শাহবাগ জমজমাট। কিছু উঠতি ও নব্যবিপ্লবীর সঙ্গে জাতীয়তাবাদ, বাম, শাহবাগ ইত্যাদি নিয়া আলোচনা করতেছিলাম। বয়সের ধর্মে তাদের রক্ত গরম, পূর্বসূরীদের অগ্রাহ্য করার তাড়না আছে। কালের ধর্মে তারা বই পাঠক নয়, বরং পত্রিকা পাঠক টাইপের, পরের মুখে ঝাল খায় এবং ‘লিংক দেন প্লিজ’ ঘরানায় জ্ঞান আহরণ করে। তো শাহবাগ কেনো তারুণ্যের আকাঙ্খাকে ধারণ করতে ব্যর্থ হইতেছে এবং এই ক্ষেত্রে কেনো তাদের নেতৃত্বের উপস্থিতি এবং সেই সুবাদেই বিপ্লব জরুরী এই প্রসঙ্গে যাবতীয় ইডিওটিক লজিক তারা পেশ করতেছিলো। এক যুগ আগে তাদের নেতৃত্বের নেতৃত্বরে যুক্তির পানিতে গোছল করাইয়াও যা মানাইতে পারি নাই তা তারা মানবে- এই স্বপ্নদোষে কদাচিত আমি ভুগি না।
তো তারা সমাজতন্ত্রের কথা বইলা অনলাইনে তাদের কথিত বিপ্লবীচর্চার মাধ্যমে আসলে ডানপন্থীদের পারপাজ সার্ভ করতেছে এইটা তারা ধারণ করতে ব্যর্থ। উল্টা বললো শাহবাগের বর্তমান নেতৃত্ব ফ্যাসিবাদী। তারা ফ্যাসিবাদের মদদে (আওয়ামী লীগ সরকার) এবং ফ্যাসিবাদের প্রতিষ্ঠায় দালালের ভূমিকায় অবতীর্ণ হইছে বইলা তাদের প্রতিবাদে নামতে হইছে এবং আমি যে তাগো মইধ্যে ছা*গুগিরি আবিষ্কার করতেছি এইটাও ফ্যাসিবাদের স্বরূপ! হা মরণ! আমি যে বারবার ইতিহাসের চাকা ঘুরে এবং তা শুদ্ধ হওয়ার জন্য, সাবধান করার জন্য তা কি এমনি বলি!
তার আগে জানা যাক চিংকুরা ফ্যাসিবাদ বলতে আসলে কী বোঝে, এইটার প্যাটার্ন হিসেবে ব্রিটিশ হিস্টোরিয়ান ইয়ান কেরশের থিওরিরেই এরা ফতোয়া মানে। কমরেড জয়নাল আবেদীন এর একটা অনুবাদ দিছেন এইরকম:
১. তীব্র সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী মতাদর্শ (জয় বাংলা!) যা প্রকাশ্যেই সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের পক্ষে (ভারত?) ওকালতি করে।
২. সমাজতন্ত্র বিরোধী, মার্ক্সবাদ বিরোধী (অমি পিয়াল গং!)।অন্যতম প্রধান লক্ষ্য শ্রমিক সংগঠন ও তাদের মার্ক্সবাদী রাজনৈতিক দর্শনকে (গণসংহতি!) নিশ্চিহ্ন করতে চাওয়া।
৩. একটি গণপার্টি তৈরি করে সমাজের সব অংশের সমর্থন নিয়ে, কিন্তু এদের প্রধান সমর্থন আসে মধ্যবিত্তদের দিক থেকে। কৃষকদের একটা অংশকেও আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়। এছাড়া সমাজের নানা মূল্যহীন, অস্থায়ী অনিশ্চিত ভাসমান চরিত্রের মানুষজনকে সংগঠিত করতে পারে।
৪. একজন নেতাকে মহত্ব দিয়ে, প্রচার দিয়ে, তাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে (বঙ্গবন্ধু!)।
৫. কোনো বিরোধী কিংবা সম্ভাব্য বিরোধীদের অস্তিত্বটুকু সহ্য করতেও তীব্র অনীহা এবং এই অনীহার বহিঃপ্রকাশ ঘটে তীব্র সন্ত্রাস, প্রকাশ্য হিংসা এবং নির্দয় নিষ্পেষনের মাধ্যমে।
৬. যুদ্ধ এবং সমস্ত সামাজিক বিষয়কে মহত্ব (মুক্তিযুদ্ধ!) দেওয়ার চেষ্টা করে। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তী তীব্র সামাজিক রাজনৈতিক সংকট সমাধানের পথ হিসেবে যুদ্ধের পক্ষে ওকালতি করে।
৭. সমাজের অভিজাত, শিল্প ও কৃষিমালিক, সামরিক এবং আমলাতন্ত্রের নেতৃত্বের সঙ্গে জোট তৈরি করে ক্ষমতায় আসে।
৮. শুরুতে প্রতিষ্ঠান বিরোধী জনপ্রিয় বিপ্লবী বক্তৃতা দিলেও, ক্ষমতায় এসে পুঁজিবাদী প্রতিষ্ঠানের একনিষ্ঠ সেবক হিসেবেই কাজ করে। মূল শ্রেণী লক্ষ্য অভিন্ন হলেও এই বৈশিষ্ঠ্যগুলোও আর পাঁচটা বুর্জোয়া শাসনের থেকে ফ্যাসিবাদিদের আলাদা করে দেয়।
ইন্টেরেস্টিং তাই না! এইবার আমরা যদি ফ্যাসিজমের উৎস, উৎপত্তি, ইতিহাস এবং এর আদি কম্পোনেন্টগুলা দেখি তাইলেই আমরা বুঝে যাবো ফ্যাসিবাদের নেপথ্য শক্তি আসলে কারা, কারা গণতন্ত্র হত্যায় প্রতিক্রিয়াশীলদের সহযোগী হিসেবে কাজ করে, মানুষকে বিভ্রান্ত করে নানারকম অপপ্রচার চালিয়ে। সবার আগে আসি ফ্যাসিবাদের মূল কম্পোনেন্টে যা সমাজতন্ত্রের ভাষায় মধ্যবিত্ত পেটি বুর্জোয়া। বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের চর্চা করে কোন শ্রেণী? এই দেশে সর্বহারাদের জন্য আন্দোলনের কথা বলে কোন শ্রেণী? বাংলাদেশের শিক্ষিত জনগনের সিংহভাগ কোন শ্রেণী থেকে আসা? মার্কসবাদ-মাওবাদ-বিপ্লব ইত্যাদি পাঠ এবং ধারন করার যোগ্যতা (প্রিভিলেজ বুঝাইতে) কারা রাখে? তাইলে কি দাড়াইলো ব্যাপারটা? মধ্যবিত্ত পাতি বুর্জোয়া শ্রেণী থিকা আইসা, সেই শ্রেণীতে জন্মগ্রহণ ও বড় হইয়া এবং জেনেটিকালি-প্র্যাকটিকালি অ্যান্ড মোরালি ওই শ্রেণীরে ধারণ কইরা বিপ্লবের গলাবাজি অবশ্যই সমাজতন্ত্রের মূল চেতনার সঙ্গে সাংঘর্ষিক। তো এই কনফ্লিক্ট বা দ্বন্দ্বরে অগ্রাহ্য বা অস্বীকার কইরা বা লুকায়া আর কোনো দ্বন্দ্বের আলোচনা করাটা কত বড় ভন্ডামি তা কি নব্য বিপ্লবীরা বোঝেন?
আরেকটু প্রিসাইসলি বলি, পেটি বুর্জোয়া কারা? লেনিন কিংবা মার্কস-এঙ্গেলসে এই শ্রেণী দিয়া বোঝানো হয় ছোট উৎপাদনকারী কিংবা ব্যবসায়ীদের যারা পুজিবাদের বিকাশে ক্রমশ দুর্বলতর হয়। লেনিন এদের জন্য তাই বিশেষ বিশেষণ ব্যবহার করছেন ট্রানজিশনাল (অতিক্রান্তিকালীন শ্রেণী)। এখন পুজিবাদের বিকাশে পেটি বুর্জোয়াদের এই গ্রুপটা বিপন্ন হইলেও বিস্তার পায় আরেকটা শ্রেণী, তারা হইলো ছাত্র-শিক্ষক, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক বীমাসহ বিভিন্ন সরকারী বেসরকারী সেবা প্রতিষ্ঠান, সরকারী আধাসরকারী প্রতিষ্ঠানের মাইনে করা কর্মচারী। এরা সরাসরি উৎপাদন কিংবা পুজি সৃষ্টি কিংবা ব্যবসায় জড়িত না হইলেও পেটি বুর্জোয়ার একটা শক্তিশালী উপাদান। পেটের জন্য পেটি বুর্জোয়া হইবেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করবেন, জাতিসংঘের নানা প্রতিষ্ঠানে চাকুরি করবেন, বিভিন্ন এনজিও খুলবেন, তাগো অনুদানে বিভিন্ন প্রজেক্টে কাজ করবেন, সাম্রাজ্যবাদের মুখপাত্র হিসেবে পরিচিত পাওয়া সংবাদপত্রে বড় চাকুরি করবেন, আর বক্তৃতা দিবেন সমাজতন্ত্রের, বিপ্লবের, দিনবদলের! আর সেইটার প্রতিবাদ করলেই অমি পিয়াল খারাপ, ফ্যাসিবাদের দালাল! বিনোদন আর কারে বলে!
তো এই শ্রেণীচরিত্র ব্যবসায়ে মনোপলির বিরুদ্ধে, বড় পুজিবাদের বিরুদ্ধে সে সর্বহারার পর্যায়ে নেমে যাবে এই বিপন্নতাই তারে ‘সবার জন্য সমান অধিকার, সমান সুযোগ’ শ্লোগান দেওয়ায়। কিন্তু কদ্যপি এই সাম্যবাদ সমাজতন্ত্ররে রিপ্রেজেন্ট করে না। কারণ এই শ্রেণী বরাবরই বিপ্লবের বিরুদ্ধে থাকে, তার লক্ষ্য অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, ধা্পে ধাপে বুর্জোয়া হওয়া, অভিজাত শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হওয়া। তাই সে পরোক্ষভাবে তাদেরই তাবেদারি করে, তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপাত করে এবং এরা লেনিনের ভাষায় পাওয়ার ফেটিশে ভোগে। উচ্চ ও নিম্নবিত্তের মাঝামাঝি অবস্থানে প্রলেতারিয়েত হওয়ার বিপন্নতা থেকেই সে রাষ্ট্রের কাছে আশ্রিত। সে রাষ্ট্রযন্ত্রে ওই অংশকেই আসীন দেখতে চায় যে তারে সবসময় রক্ষা করবে। তাই তাবেদারিতার চূড়ান্ত চর্চায় সে সবসময় ওই অংশকেই প্রাধান্য দেয় ক্ষমতায় আসার জন্য, সেটা নির্বাচনের মাধ্যমেই হোক কিংবা অগণতান্ত্রিক পদ্ধতিতেই হোক। গায়ের জোরে সর্বহারার এবং শ্রমিক সমাজের প্রতিনিধি সাইজা বুর্জোয়াদের সঙ্গে তাদের অধিকারের জন্য মুলামুলি করা এবং ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধার কইরা বুর্জোয়াদের স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখায় এগো তৎপরতা তো আমরা অহরহই দেখি।
তো ফ্যাসিজমে জনক যিনি সেই বেনিত্তো মুসোলিনিও একসময় ইতালিয়ান সমাজতান্ত্রিক পার্টির (পিএসআই)নেতা ছিলেন। পার্টির মুখপত্র আভান্তির সম্পাদক ছিলেন বিধায় দলের নীতিনির্ধারকদের একজন বাইডিফল্ট। তার দর্শনই ছিলো মিথ এবং মিথ্যা। সবকিছুরে মিথ্যার প্রলেপ দিয়া সাদারে কালো আর কালোরে সাদা বানানোর যে চর্চার শুরু তার হাত ধইরা এই বাংলাদেশে কারা সেইটা করে? যে ফ্যাসিবাদের উত্থান তার হাতে সেইটা বামদের থিকা কোন অংশে কম ছিলো আদর্শে ও নীতিতে? ফ্যাসিস্টদের মূল কম্পোনেন্ট যে র্যাডিকাল সিন্ডিকালিস্ট, তাগো থিকা আদর্শ ও রাজনৈতিক চর্চায় কতখানি তফাৎ এখনকার শ্রমিকদের পক্ষে (সর্বশেষ সাভারের রানাপ্লাজার ঘটনায়) গলাবাজি করা বিপ্লবীদের? সিন্ডিকালিস্ট থিওরিতে শ্রমিক ধর্মঘটের মাধ্যমেই বিপ্লব হবে, সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হবে, উৎপাদন বন্ধ থাকলে রাষ্ট্র দুর্বল হবে এবং শ্রমিকদের প্রাধান্য মেনে নেওয়া হবে ক্ষমতায়! তো গার্মেন্টসে হরতাল কইরা কী কী হইলো? আমাদের যেসব কনট্রাক্ট আসার কথা সেগুলা চইলা গেলো বিদেশী রাষ্ট্রের কাছে। মালিকের ক্ষতি করতে গিয়া শ্রমিকের পেটে লাথি মাইরা কী আদায় কইরা দিলো বিপ্লবীরা?
১৯১৯ সালের ২৩ মার্চ প্রথম ফ্যাসিস্ট সম্মেলনের যে রেফারেন্ডাম, সেইটার প্রধান দাবিগুলা চলেন দেখি:
১. আইন করে শ্রমিকদের মজুরির স্বীকৃতি
২. নুন্যতম মজুরি নির্ধারণ
৩. শিল্প প্রতিষ্ঠানে কারিগরি পরিচালনার ক্ষেত্রে শ্রমিকদের অধিকার এবং শিল্পপতিদের উপর করের হার বাড়ানো
৪. ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলার সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা।
৫. দরিদ্র ও ভূমিহীনদের জন্য জমির ব্যবস্থা
৬. মেয়েদের সার্বজনীন ভোটাধিকার এবং সংসদে সমান সুযোগ
৭. নতুন সংবিধান তৈরির জন্য নতুন জাতীয় সংসদ গঠন।
ওয়েল এইসব কথাবার্তা এই একশ বছর পরে আইসা কারা নতুন কইরা বলে? পোপের এবং ভ্যাটিকানের বিরুদ্ধে বিপ্লবের ঘোষণা দিয়া সেই ভ্যাটিকানের অস্তিত্ব টিকাইতেই ফ্যাসিবাদের উত্থান এবং অধিষ্ঠান। এই দেশে ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াত শিবিরের বিরুদ্ধে কথিত বিপ্লবের ঘোষণা দিয়া কারা তাদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য প্রাণপাত করতেছে তা কি আমরা দেখি না?
খালি মিথ্যা আর মিথ্যা। মিথ্যা গল্প দিয়া মানুষের চরিত্রহানী, মিথ্যা গল্প দিয়া মানুষরে বিভ্রান্ত করা, মিথ্যা গল্প দিয়া আন্দোলনের বারোটা বাজানো এইসব কবে ছাড়বা? তোমাগো দুই প্রিয় চরিত্রের উদ্ধৃতি দিয়া শেষ করি।
‘কমিউনিস্টদের ব্যক্তিগত ত্যাগ-তিতীক্ষা এত অধিক যে শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। কিন্তু তারা যে মিথ্যার চর্চা করেন, তার জন্য লজ্জিত এবং দুঃখিত হওয়ার প্রয়োজন তারা আদৌ অনুভব করেন না। খুব সম্ভবত সারা দুনিয়ায় আচরণে এবং প্রচারের মধ্যবর্তী যে ফারাক তার জন্যই কমিউনিজমের ভরাডুবি ঘটলো’ - (বদরুদ্দিন উমর প্রসঙ্গে আহমদ ছফা; একাত্তর : মহাসিন্ধুর কল্লোল, মার্চ ১৯৯৩)।
‘বিপ্লবীদের অতিকথনে দোষ নেই’, চারু মজুমদারের এই থিওরিতে আর কতদিন চলবা?
সৎ হও, বিবেকবান হও। যা করতেছো যা বলতেছো তা কার স্বার্থসিদ্ধি করতেছে সেইটা অনুধাবন করো। তারপর আমারে এবং আমাদের গালি দিও, চরিত্রহানী কইরো।
আফসুস, তোমরা চিংকুরা বিপ্লবী আজ, আমরা ফ্যাসিস্ট বটে!...
20241211