12/08/2024
শহুরে মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী কেন খালেদা জিয়াকে ঘৃণা করে সেটা চিন্তা করে আমি কয়েকটা কারণ বের করতে পেরেছি।
এক.
খালেদা এক বিরল গুনের অধিকারী। বাংলাদেশের রাজনীতি তো বটেই, সমাজেও এই গুন আপনি পাবেন না। এবং এই গুনটা খুবই আন্ডাররেটেড।
কিছু ডিগ্রিধারী লোক - আবরারকে খুন করা ডিগ্রিধারী শিক্ষিত লোক আর কি - খালেদাকে ব্যঙ্গ করবে যে খালেদা এইট পাশ। অথচ খালেদা যে এইট পাশ এই সত্যটা খালেদার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। খালেদা নিজের অজ্ঞতা নিয়ে এতটাই সচেতন যে সে কখনো স্ক্রিপ্ট না দেখে বক্তব্য দেয় না। তার স্ক্রিপ্ট লিখে দেয় অভিজ্ঞরা। সে প্রতিটা সিদ্ধান্তের জন্য সংশ্লিষ্ট এক্সপার্টদের মতামত নেয়। সে জানে সে এইট পাশ, তার সীমাবদ্ধতা আছে।
এই যে নিজের অজ্ঞতাকে বুঝতে পারে এবং তদানুযায়ী জ্ঞানীদের পরামর্শ মত চলা - এই বিরল গুন আপনি বাংলাদেশ তো বটেই, সারা দুনিয়াতেই খুব কম পাবেন।
সক্রেটিস বলত সক্রেটিস অন্যদের চেয়ে বেশী জ্ঞানী এই কারণে না যে সক্রেটিস অন্যদের চেয়ে বেশী জানে। কিন্তু সক্রেটিস বেশী জ্ঞানী কারণ সক্রেটিস তার অজ্ঞতাগুলি জানে। আমি বলব না খালেদা সক্রেটিস। কিন্তু সক্রেটিসের এই বৈশিষ্ট্য আপনি খালেদার মধ্যে পাবেন।
এর ফলাফলও হাতেনাতে দেখতে পাবেন আপনারা। খালেদা কখনো অশ্রাব্য, বাজে, ফাউল কথা বলে না। অথচ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ সম্পর্কে বলা হয় যে সে যখন মুখ খোলে তখন তার দলের ভোট রাতারাতি কমে যায়। বেডরুমের নিরাপত্তা দেওয়া যাবে না কিংবা "দেই, ইলেক্ট্রিসিটি বন্ধ করে দেই" মার্কা কথা খালেদা কখনো বলে নাই। খালেদা কখনো ইম্প্রম্পটু স্পিচ দেয় না। খালেদা জানে সে এইট পাশ তাই সে তার অভিজ্ঞ পরামর্শকদের উপর নির্ভর করে। খালেদার মধ্যে বিন্ধুমাত্র প্রিটেনশাসনেস বা অহংকার নাই।
লাইফে শুধুমাত্র একবার খালেদা বেফাঁস কথা বলেছে। ২০১৩ সালের ২৯শে ডিসেম্বর তাঁকে যখন বালুর ট্রাক দিয়ে আটকে দেওয়া হল, তাঁর গাড়ি বের করতে দেওয়া হল না, তখন খালেদা বলেছিলেন গোপালগঞ্জ জেলার নামই পালটে দেবেন। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচীটার নামটাও ভুলভাল বলছিলেন। কারণ, আফটার অল, খালেদা তো এইট পাশ। এইরকম অসভ্য পরিস্থিতিতে স্ক্রিপ্টবিহীন অবস্থায় খালেদা পড়তে চানও না, তৈরীও ছিলেন না।
অথচ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কথা শোনেন। পার্থক্যটা বুঝতে পারবেন। আপনি ঘণ্টার পর ঘণ্টা খালেদার বক্তব্য শুনতে পারবেন। মনে হবে একজন স্টেটসম্যানের বক্তব্য শুনছেন। পরিষ্কার, ফর্মাল, নিখাঁদ। অথচ তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের কথার মাঝে খিস্তি-খেউড় আর ব্যক্তিগত খোশগল্প ছাড়া কিছুই পাবে না। খালেদা তার কোন বক্তব্যে "আমি এইটা করেছি, আমি সেইটা করেছি; আমি অমুক বানিয়েছি, তমুক জায়গায় বিদ্যুৎ দিয়েছি" এইধরণের কথা বলেন নাই। কারণ খালেদা একজন এইট পাশ স্টেটসম্যান যার বক্তব্য সবসময় এক্সপার্টরা লিখে দেয়। খালেদা কখনো রাষ্ট্রকে তার ব্যক্তিগত সম্পত্তি মনে করেন না।
কিন্তু জাফরপড়ুয়া মধ্যবিত্ত জানোয়ার কেন এই অনেস্টি পছন্দ করবে বলেন? তার দরকার আবেগ। তার দরকার প্রিটেনশন। সে আবরার পিটিয়ে কামানো বুয়েটের ডিগ্রি নিয়ে বড়াই করতে চায়। আইবিএ পড়ে সিগারেট বিক্রির চাকরি করা নিয়ে তার বড়ই অহংকার। সে শুধু বোঝাতে চায় খালেদা এইট পাশ, খালেদা মূর্খ। খালেদাকে ঘৃণা না করলে আসলে তার শহুরে মধ্যবিত্ত জানোয়ার স্বরুপটা স্পষ্ট হয় না।
দুই.
খালেদার আরেকটা বড় দোষ খালেদার এলিটিজম। দেখেন, খালেদা কিন্তু আপা না। খালেদা ম্যাডাম। খালেদা এই ব্যাপারে খুবই ক্লিয়ার - সে স্টেটসম্যান। সে রাষ্ট্রের পলিটিকাল এলিট। সে বিরানী রান্নার ছবি ফেসবুকে ছড়িয়ে ইমোশন নিয়ে ব্যবসা করে না। নিজের আঁকা ছবি নিয়ে সে প্রদর্শনী করে না। বাচ্চাদের কোলে নিয়ে ফটোসেশন করে না। খালেদার মধ্যে এই ধরণের ইমোশনাল কাজকর্ম দেখবেন না।
খালেদা খুবই ফর্মাল এবং তার কথা খুবই স্পষ্ট - তার সাথে আমাদের সম্পর্ক পলিটিকাল লিডার এবং ভোটারের। পলিটিকাল লিডার হিসাবে সে এলিট। তবে এর মানে এই না যে ভোটাররা প্রজা। ভোটাররাই তাকে পলিটিকাল লিডার বানিয়েছে। কাজেই ভোটাররা চাইলে খালেদাকে গালিও দিতে পারে। এবং সেটা ভোটাররা দিয়েছেও। বিশ্বাস না হলে খালেদা আমলে প্রথম আলো খুলে দেখুন - শিশির ভট্টাচার্য খালেদাকে নিয়ে কি জঘন্য, অরুচিকর কার্টুন এঁকেছে নির্ভয়ে ও বিনা বাঁধায় সেইটা আজকের বাংলাদেশে বসে আপনি কল্পনা করতে পারবেন না। কিন্তু এর মানে এই না যে খালেদা ক্রিকেট দলকে ব্যবহার করে, জাফর ইকবালকে লেলিয়ে দিয়ে, সোলায়মান সুখনের মাধ্যমে, মানুষের আপা সেজে, কওমীদের জননী সেজে আপনাদের ব্ল্যাকমেইল করবে।
খালেদা যেমন তার এইট পাশ অবস্থা নিয়ে সচেতন। তেমনি সে ফর্মার আর্মি চিফের ওয়াইফ, সাবেক ফার্স্ট লেডি, তিনবারের প্রাইম মিনিস্টার, একাধিকবারের লিডার অব দ্য অপজিশন স্ট্যাটাস নিয়েও সচেতন। খালেদা ইজ ক্লাস। শি উযেস ডিগ্নিটি এন্ড প্রাইড।
খালেদার এই ব্রুটাল অনেস্টি এবং ফর্মালিটি শহুরে মধ্যবিত্ত জানোয়ারের ভালো লাগে না। শহুরে মধ্যবিত্ত জানোয়ারের চাই ল্যাটকানো আবেগ। রাস্তায় খুন হতে, কার্টুন আঁকার কারণে জেলে যেতে, বা ফুডপান্ডার ডেলিভারিম্যানের ভয়ে তটস্থ থাকতে শহুরে মধ্যবিত্ত জানোয়ারদের আপত্তি নাই। তবে শর্ত হচ্ছে শি হু মাস্ট নট বি নেমড যদি একটু আবেগ দেখাতে পারে। সাকিবকে ডেকে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতে পারে। সাকিবের বাচ্চাটাকে একটু কোলে নিয়ে আদর করতে পারে। মাছ ধরার ছবি ফেসবুকে দিতে পারে। রিকশায় চড়ার ছবি দেখিয়ে মাটির মানুষের ভাব ধরতে পারে। ম্যাডামের বদলে আপা ডাক শুনতে পছন্দ করে। এগুলা হইলেই সাত খুন মাফ।
তিন.
খালেদার আরেকটা বড় সমস্যা খালেদা ন্যাচারালি বিউটিফুল। শুধু যেই সেই বিউটি না, নিরানব্বই শতাংশ বাঙ্গালী মেয়ের স্বপ্নের বিউটি। ন্যাচারালি খালেদা শাদা। আভিজাত্যের কারণে খালেদার মেক আপও সর্বদা ফার্স্ট ক্লাস। তার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ যেখানে মাটির মানুষ সাজতে চায় পোশাকের মাধ্যমে, খালেদা সেইখানে তার এক্সট্রা অর্ডিনারি বিউটির সাথে মানানসই এক্সট্রাঅর্ডিনারি মেক আপ ব্যবহার করে। জামদানি শাড়ির বাংলাদেশে একমাত্র খালেদাকেই শিফন শাড়িতে মানায়।
এই জিনিসটা অনেকেরই পছন্দ না। শহুরে মধ্যবিত্ত জানোয়ারদের অনেকেই খালেদাকে ঘৃণা করে এই ঈর্ষা থেকে। কিভাবে একটা মহিলা ন্যাচারালি, উইদাউট এনি এফোর্ট এত এলিগ্যান্ট, এত ম্যাজেস্টিক, এবং এত সুন্দরী হইতে পারে! এতশত স্কিনকেয়ার দিয়েও যেইখানে তারা ফেয়ার কমপ্লেকশনেট হইতে পারতেছে না সেইখানে এই মহিলা কিভাবে এফোর্টলেসলি অনায়াশে সেন্ট্রাল এশিয়ান বিউটি হয়ে বসে আছে - এই আক্ষেপ শহুরে মধ্যবিত্ত শিক্ষিত মেয়েদের অনেকের মধ্যেই পাবেন।
যাহোক, খুব সম্ভবত খালেদা জিয়াকে কিছুদিনের মধ্যেই মেরে ফেলা হবে। আমার জেনারেশনের অধিকাংশেরই খালেদা শাসনামল মনে নাই। খুব অল্পবয়সে পত্রিকা পড়তে শুরু করায় (এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ক্রিকেট দল স্পেশাল একটা থ্যাংক্স পাবে) এবং অবজার্ভেশনের ব্যাপারে জন্মগত সচেতনতা থাকায় আমার মনে আছে কেমন ছিল খালেদার শেষ শাসনামল। কাজেই জাফর ইকবালদের রচিত ইতিহাসের বাইরে আমি জানি আসলেই কেমন ছিল স্বাধীন বাংলাদেশ। খালেদার শাসনামলে একসাথে ৬৩ জেলায় বোমা ফুটেছিল। কারণ সেসময় রাষ্ট্র সবার মোবাইলে আড়ি পাতত না। সন্ত্রাস ছিল, কারণ সার্ভেইলেন্স কম ছিল। খালেদার শাসনামলে সারের দাবীতে আন্দোলন করায় কৃষক মরেছিল। তারপর তার প্রতিবাদে তীব্র সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। কারণ কেউ তখন বলে নাই "কৃষকদের আন্দোলন থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নেওয়ার চেষ্টা করছে বিরোধী দল।" খালেদার শাসনামল অনেক খারাপ ছিল। একারণে চালের মূল্য দুই পয়সা বাড়লেও প্রথম আলোতে প্রথম পাতায় লিড নিউজ হত। এতই দমবন্ধকর ছিল খালেদা জিয়ার শাসনামল যে প্রতিদিন দেশের সব বুদ্ধিজীবী, এলিট নাগরিক, আর প্রথম আলো-ডেইলি স্টার খালেদা, খালেদার পরিবার, খালেদার ক্যাবিনেটের সব মিনিস্টারকে রুটিন করে গালি দিত, ব্যঙ্গ করত, অরুচিকর কার্টুন আঁকত। কিন্তু একদিনও এদের কেউ কারওয়ান বাজারে খালেদাকে গালি দিয়ে কার্টুন জমা দিয়ে বাসায় ফেরার সময় গুম হওয়ার বা মামলা খাওয়ার ভয় করে নাই।
আমি সেই বাংলাদেশ দেখেছি।
ভালো থাকবেন, বাংলাদেশ। আমরা স্বাক্ষী দিব, শিফন শাড়ি পরে আপনি যতটা ভাল মুসলমান ছিলেন ততটা ভাল মুসলমান নামাজ পড়তে পড়তে কপালে কালসিটা ফেলে দেওয়া বোনের জমি মেরে দেওয়া বুয়েট পাশ ঘুষখোর আলহাজ্ব সেকুলার মধ্যবিত্ত শিক্ষিত বাঙ্গালী কোনকালে হতে পারবে না।
ছবিঃ ২০১২ সালে বিরোধী দলীয় নেতা হিসাবে ভারত সফরকালে খালেদাকে সালাম দিয়ে স্বাগত জানাচ্ছেন ততকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। বর্তমানে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি দুই হাত জোর করে নমস্কার দিয়ে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে স্বাগত জানান। অবশ্য রাষ্ট্রীয় প্রটোকল অনুসারে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী এখনও সালাম দিয়েই নমস্কারের জবাব দেন।
PS: আমি সাধারণত যে ন্যারেটিভ জনগনকে দোষ দেয় সে ন্যারেটিভকে প্রত্যাখ্যান করি। তবে এই একবার আমি এই এক্সেপশন করতে রাজি আছি। আমি চাই যেই শহুরে মধ্যবিত্ত জানোয়ার আপনাকে মরতে দিচ্ছে সেই শহুরে মধ্যবিত্ত জানোয়ারের পাল যেন শেষ হয়ে যায়। তারা যেন করোনা, ডেঙ্গু, চিকনগুনিয়া, সড়ক দূর্ঘটনা, ধর্ষণ, র্যাগিং, ফুডপান্ডা ডেলিভ্যারিম্যানদের দৌরাত্ম ইত্যাদিতে ছাড়খাড় হয়ে যায়। খোদা যেন এদের প্রত্যেকের অপরাধের হিসাব চুকিয়ে দেন।
দ্য মিড্ল ক্লাস মাস্ট বি পানিশ্ড। দ্য মিড্ল ক্লাস ইজ হেভিলি আন্ডারপানিশ্ড। দ্য মিড্ল ক্লাস মাস্ট পেরিশ।
লেখকঃ - নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন বাংলাদেশী।