01/12/2022
আমরা যখন কোনো বইয়ে নবীজি (সা.)-এর নামাজের বিনয় ও একাগ্রতা সম্পর্কে কিছু পড়ি, অথবা সাহাবি, তাবেয়ি এবং সালাফে সালেহিনের নামাজের বিনয় ও একাগ্রতা সম্পর্কে, তখন অনুভব করি, আমরা এমন এক কল্পজগৎ সম্পর্কে পড়ছি, আমাদের সময়ে যার বাস্তবায়ন সম্ভব নয়।
আসলে নামাজে বিনয় ও একাগ্রতার বিভিন্ন স্তর রয়েছে, যা অনুসরণের মাধ্যমে একজন নামাজি ব্যক্তি ধীরে ধীরে নিজের একাগ্রতা বাড়াতে পারে। একটি স্তর থেকে আরেকটি স্তরে ধারাবিকভাবে সে আহরণ করে। প্রথম স্তর থেকে যতই উপরের দিকে উঠবে, ততই তার বিনয় বাড়তে থাকবে। আসুন বিনয় ও একাগ্রতার এরকম ৫টি স্তর সম্পর্কে আজ জেনে নিই:
👉🏻 প্রথম স্তর: অনুধাবন
নামাজের ভিতর আপনি যা বলছেন সেটা অনুধাবন করা এবং পঠিত আয়াত, জিকির ও দোয়াগুলোর কাঙ্ক্ষিত অর্থ বুঝতে পারা। এটাই হলো নামাজের বিনয় ও একাগ্রতার প্রথম বা সর্বনিম্ন স্তর। এটা যদি আপনি পূরণ করতে না পারেন, তাহলে নামাজ সম্পূর্ণভাবে তার প্রাণ হারাবে এবং এমন নামাজিকে কিছুতেই বিনম্র ও একনিষ্ঠ বলা হবে না!
এই প্রথম স্তরের নামাজি আয়াতগুলোয় আল্লাহ তাআলার বর্ণিত আদেশের অর্থ বুঝবেন এবং তা পূর্ণভাবে ধারণ করবেন। পঠিত ঘটনা থেকে শিক্ষা অনুধাবন করবেন। যে জিকিরের মাধ্যমে তিনি আল্লাহ তাআলার মহত্ত্ব ঘোষণা করেন, তার পার্থক্য জানবেন এবং বারবার পঠিত দোয়ার শব্দগুলোর অর্থ বুঝবেন। তবে এখানে এটা উদ্দেশ্য নয় যে, এই নামাজিকে আয়াতের জটিল ব্যাখ্যা বুঝতে হবে কিংবা ভাষার সূক্ষ্ম বিষয়াবলিও অনুধাবন করতে হবে। বরং উদ্দেশ্য হলো, তিনি মোটামুটি অর্থটা বুঝতে পারবেন, যেটা পর্যায়ক্রমে তাকে সৎ কাজের প্রতি ধাবিত করবে।
👉🏻 দ্বিতীয় স্তর: আশা-আকাঙ্ক্ষা
এই স্তরে আশা-আকাঙ্ক্ষা করার অর্থ হলো, আয়াতের মধ্যে আপনি যে নেয়ামতের কথা পড়বেন, আল্লাহ তাআলার নিকট সে নেয়ামতের প্রত্যাশা করবেন এবং কুরআনের মধ্যে যে শাস্তির বিবরণ পাবেন, আল্লাহর নিকট সে শান্তি থেকে মুক্তির প্রত্যাশা করবেন। মুমিনদের যে গুণাবলির বিবরণ দেওয়া হয়েছে, আপনি সেই গুণে গুণান্বিত হওয়ার আশা করবেন। যথা, সততা, বিশ্বস্ততা, একাগ্রতা, তওবা, আল্লাহর দিকে প্রত্যাবর্তন ইত্যাদি। পাশাপাশি আপনি যেন কাফের, মুনাফেক, অবাধ্য এবং মন্দস্বভাবের লোকদের গুণে গুণান্বিত না হন এটাও কামনা করবেন। যথা, অত্যাচার, অহংকার, হিংসা, অবাধ্যতা, ঔদ্ধত্য ইত্যাদি। যখন কুরআনুল কারিমের কোনো ঘটনা পাঠ করবেন এবং তা থেকে মুমিনদের পুরস্কার ও জালিমদের শান্তির কথা জানবেন, তখন কামনা করবেন, আপনাকে যেন মুমিনদের সঙ্গে ওঠানো হয়। এমনইভাবে আশা করবেন, উক্ত ঘটনায় জালেমদের ওপর যে শাস্তি আপতিত হয়েছে, তা যেন আপনার ওপর আপতিত না হয়।
👉🏻 তৃতীয় স্তর: ভয়ভীতি
এই স্তরে এসে নামাজির উপলব্ধি হয় যে, সে দাঁড়িয়েছে সকল জগতের প্রতিপালকের সামনে। এটি এমনই এক উপলব্ধি, যা মানুষকে ভীত না করে পারে না। একজন নামাজিকে এই স্তরে পৌঁছতে হলে, তাকে একাগ্রতার আগের দুটি স্তর পার হয়ে আসতে হবে। কারণ সে যদি কুরআনের আয়াত এবং নামাজের দোয়াগুলোর অর্থ সম্পর্কে অজ্ঞ ও উদাসীন থাকে, আল্লাহর নিকট প্রাপ্তির প্রত্যাশা থেকে মুক্ত থাকে, তাঁর প্রদত্ত নেয়ামতসমূহের ব্যাপারে অনাগ্রহী থাকে এবং তাঁর পাকড়াও সম্পর্কে ভীত না থাকে, তাহলে সে কিছুতেই সেই মহান সত্তার সামনে নিজের অবস্থান নির্ণয় করতে পারবে না, যিনি সকল আসমান ও জমিনের মালিক।
দ্বিতীয় যে বিষয়টি নামাজিকে ভীতির স্তরে উপনীত করে, সেটা হলো তার এই উপলব্ধি যে, কুরআনুল কারিমে মুমিনদের যে আমল ও কর্ম সম্পর্কে সে পাঠ করে, তার নিজের আমল তো তাদের আমলের সমতুল্য নয়, তার নিজের একনিষ্ঠতা তো তাদের একনিষ্ঠতার মতো নয়, তার ঈমান তো তাদের ঈমানের মানের নয় এবং তার দান-সদকা তাদের দান-সদকার মতো নয়, এমন আরও অনেক বিষয়। এমনইভাবে নিজেকে সে সর্বক্ষণ তুচ্ছ ও নগণ্য মনে করতে থাকে এবং অনুভব করে, সে যা আমল করেছে, তা অতি অল্প, সামান্য ও তুচ্ছ। এই তুচ্ছ আমল তাকে কিছুতেই মুক্তি দিতে পারবে না, বরং এটা হয়তো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে গ্রহণই করা হবে।
👉🏻 চতুর্থ স্তর: জ্ঞানযুক্ত ভয়
নামাজি ভীতির স্তর থেকে এ স্তরে স্বতঃস্ফূর্ত উন্নীত হয়। এই স্তরের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য হলো, শরীরে এমন বাহ্যিক নিদর্শন প্রকাশ পাওয়া, যেটা ভীত অন্তরের অবস্থা প্রকাশ করে। এটা অন্তরের এমন অস্থিরতা নয় যে, সেটা কেবল নামাজি নিজে অনুভব করে, বরং এটা এমনই ব্যাপক ভয়, নামাজি যেটাকে লুকিয়ে রাখতে সক্ষম হয় না। তাই এমন কিছু বাহ্যিক নিদর্শন প্রকাশ পায়, যেগুলো তার তীব্র ভয়ের প্রতি ইঙ্গিত করে। যেমন এই ভয়ের নিদর্শন হিসাবে শরীরে কাঁপুনি বা কম্পন শুরু হতে পারে, এমনকি ভয়ে মানুষের পশম দাঁড়িয়ে যেতে পারে। ঠিক এই অবস্থার কথাই আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘…এর (অর্থাৎ কুরআনের) দ্বারা তারা প্রকম্পিত হয়।’ (সূরা যুমার, ২৩)
👉🏻 পঞ্চম স্তর: প্রশান্তি
এই স্তরের অধিকারীর সংখ্যা খুবই কম। আর এটাই হলো বিনয় ও একাগ্রতার শীর্ষ চূড়া। এই অবস্থায় নামাজি কুরআনুল কারিমের প্রতিটি হরফ বা বর্ণ উপভোগ করে। জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত সে দয়াময় আল্লাহ তাআলার সামনে অতিবাহিত করে। এই উচ্চস্তরের নামাজি নামাজকে কখনো নিছক এমন এক দায়িত্ব হিসাবে অনুভব করে না যে, এটা সম্পন্ন করে সে অবসর হতে চায়। বরং সে অনুভব করে, নামাজ হলো আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে তার জন্য এক বিশেষ উপহার, এর দ্বারা তার অন্তর প্রশান্ত হয়, এর দ্বারা সে নিজেকে সৌভাগ্যবান করে। সে কারণে এই স্তরে উপনীত নামাজি এমনসব আশ্চর্য অবস্থা অনুভব করেন, যারা এই অবস্থায় উপনীত হয়েছে, তারাই কেবল সেগুলো বুঝতে পারে।
যেমন একটি অবস্থা হলো, নামাজের জন্য অপেক্ষা করা। এই স্তরে উপনীত ব্যক্তি সর্বক্ষণ সেই নির্ধারিত সময়ের প্রতীক্ষায় থাকেন, যখন তিনি তার প্রতিপালকের সঙ্গে নির্জন আলাপে নিমগ্ন হবেন। আরেকটি অবস্থা হলো, তিনি নামাজ থেকে বের হতে চান না। ফলে আপনি তাকে খুব দীর্ঘ নামাজ আদায় করতে দেখবেন। আরেকটি অবস্থা হলো, তিনি তার চারপাশের কোনো কিছুই আর অনুধাবন করেন না। কোনো আওয়াজ শোনেন না। কিছু দেখেন না। পৃথিবীতে যতকিছুই ঘটুক না কেন, কোনো কিছুই তাকে প্রভাবিত করতে পারে না। এ ছাড়া তিনি তখন সকল ব্যথা ও কষ্টের কথা ভুলে যান।
আলোচনার শেষে, একটি কথার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দিতে চাই, সেটি হলো, একাগ্রতার এই স্তরগুলোয় উত্তীর্ণ হওয়ার ক্ষেত্রে ধীরতা ও ধারাবাহিকতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আমরা যদি প্রথমেই তৃতীয় বা চতুর্থ স্তরে আরোহণের চেষ্টা করি, এটা হয়তো আমাদের উপকারের চেয়ে ক্ষতিই করবে বেশি। কারণ দ্বিতীয় স্তরটি অন্তরে আল্লাহ তাআলার ভালোবাসার সৃষ্টি করে। আর তৃতীয় ও চতুর্থ স্তরদুটি অন্তরে তার ভীতি ও জ্ঞানযুক্ত ভয়ের সৃষ্টি করে। ভালোবাসার আগেই ভয় সৃষ্টি হওয়া কোনো সঠিক পদ্ধতি নয়। এটি বান্দাকে ইবাদতের স্বাদ বা মিষ্টতা থেকে বঞ্চিত করে। তার একাগ্রতার মাঝে বিঘ্ন ঘটায়, বরং তার পূর্ণ ঈমানের মাঝেও বিরূপ প্রভাব ফেলে। আর প্রথম স্তরটি বিতর্কহীনভাবে সকলের আগে থাকা আবশ্যক। এটি হলো অনুধাবন, জ্ঞান ও অনুভবের স্তর। আর অজ্ঞতা ও অস্পষ্টতার ওপর একাগ্রতা সৃষ্টি হওয়া অসম্ভব। এজন্য মুমিনের জন্য আবশ্যক হবে প্রথমে এটা অতিক্রম করা, এরপর একে একে অন্যগুলোর দিকে এগিয়ে যাওয়া। আল্লাহই একমাত্র সক্ষমতা দানকারী।