16/01/2024
শ্রমিকদের গুরুত্ব আমরা কতটা বুঝি?
-শিমুল বিশ্বাস।
বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে শ্রমজীবী মানুষের শ্রম ও ঘামের ওপর। কৃষি উৎপাদন, প্রবাসী রেমিট্যান্স এবং গার্মেন্ট শ্রমিকরাই সচল রেখেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। আরও স্পষ্ট করে বললে, তুলনামূলক স্বল্পশিক্ষিত মেহনতি মানুষই বাংলাদেশের আর্থিক খাতের প্রাণশক্তি। আর মধ্য ও উচ্চশিক্ষিত বিরাট এক জেনারেশন এ দেশে বেকার! কিন্তু দুর্ভাগ্য, যাদের পরিশ্রমে রক্ত আর ঘামে বাংলাদেশের অর্থনীতির চাকা ঘুরছে, তারা আজ অধিকার থেকে বঞ্চিত। ন্যায্য প্রাপ্যটা পাওয়ার জন্য রাজপথে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে। ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্তান-পরবর্তী বাংলাদেশে এখনো শ্রমিক আন্দোলনের ইতিহাস অনেক উজ্জ্বল। উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান এবং ’৭১-এর স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে শ্রমিক আন্দোলন বড় ভূমিকা রেখেছে। ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিকশ্রেণি শুধু নিজের জন্য নয়, সামগ্রিকভাবে দেশের উন্নয়ন ও গণমানুষের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই-সংগ্রাম করে থাকে।
’৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থান, ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী ’৯০-এর গণ-অভ্যুত্থানেও শ্রমিক কর্মচারীরা জোটবদ্ধ হয়ে (স্কপ) ছাত্রজনতার সঙ্গে মিলে স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে রাজপথে লড়াই করে রক্ত ঝড়িয়েছে। স্বৈরাচারের পতন, গণতন্ত্র ও মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিক-কর্মচারীরা বারবার রক্ত ঝরিয়েছে। কলকারখানা ও অফিস ছেড়ে শ্রমিকরা রাজপথে নেমে এসেছে। অধিকারের প্রশ্নে ঐতিহাসিকভাবে শ্রমিকশ্রেণি যুগে যুগে আপসহীন।
সত্তরের দশকে গাজীপুরের টঙ্গী, নারায়ণগঞ্জের আদমজী, খুলনার খালিশপুর, যশোরের নোয়াপাডা আর চট্টগ্রামের শ্রমিক আন্দোলন এ দেশের রাজনীতির গতিপথ পালটে দিয়েছিল। জনগণের অতীত ত্যাগকে যথাযথ মূল্যায়ন করা হয়নি। আওয়ামী লীগের কিছুসংখ্যক নেতাকর্মী অবাধ লুটপাট ও ভোগদখল টিকিয়ে রাখার জন্য সুস্থ ধারার রাজনীতিকে কলঙ্কিত করেছে। বিশেষ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে গবেষণা, বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চা এবং চিরাচরিত সহাবস্থানের ধারা বিনাশ করেছে এবং অফিস, প্রতিষ্ঠান ও কলকারখানায় শ্রমিক অন্দোলনের টুঁটি চেপে ধরে রেখেছে। বাংলাদেশের বাস্তবতায় শ্রমিকশ্রেণি এবং ছাত্রসমাজ ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সবচেয়ে কার্যকর শক্তি। ছাত্রসমাজ ও শ্রমিকশ্রেণি জেগে উঠলে বাংলাদেশের নতুন ইতিহাস লেখা সম্ভব। অলরেডি শ্রমিকরা নতুন উদ্যমে সংগঠিত ও সোচ্চার হয়েছে। গার্মেন্ট, পরিবহণসহ বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক-অপ্রতিষ্ঠানিক শ্রমিকরা নিজেদের অধিকার নিয়ে মাঠে নামছে।
২.
বাংলাদেশে প্রায় ১৮ কোটি মানুষের মধ্য প্রায় ১২ কোটি ভোটার এবং বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী শ্রমিক কর্মচারীর সংখ্যা ৭ কোটি ৩৫ লাখ। ৭ কোটি ৩৫ লাখ শ্রমিক-কর্মচারীর মধ্য নিবন্ধিত শ্রমিক-কর্মচারীর সংখ্যা ৭০ লাখ এবং অনিবন্ধিত শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটি ৬৫ লাখ। আন্তর্জাতিক মানবাধিকার ও শ্রম সংস্থার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শ্রমিকশোষণ ও নির্যাতনের ঘটনা উদ্বেগজনক। শ্রম আইন অনুযায়ী, বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত শ্রমিক-কর্মচারীদের সংগঠন করার অধিকারকে স্বীকৃতি দেওয়া হলেও পুলিশ ও আওয়ামী লীগদলীয় ক্যাডারদের সহায়তায় সরকার ভিন্নমতসহ বিএনপি সমর্থক ট্রেড ইউনিয়নের অফিসগুলোর বেশির ভাগই দখল করে নিয়েছে। সরকারসমর্থক শ্রমিক লীগ বিরোধীদল সমর্থক শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রম পেশিশক্তি ও প্রশাসনিক হস্তক্ষেপে বন্ধ করে দিয়েছে।
আওয়ামী লীগ ১/১১-এর চক্রান্তের ধারাবাহিকতায় ক্ষমতা হাতে পেয়ে বিরোধীপক্ষকে ভয়ভীতি দেখিয়ে ট্রেড ইউনিয়ন কার্যক্রমে অংশ নিতে বাধা দিয়ে আসছে। ফলে সরকারি-বেসরকারি প্রায় সব প্রতিষ্ঠানে একতরফাভাবে শ্রমিক লীগ সিবিএ নির্বাচিত হয়। আওয়ামী লীগসমর্থক শ্রমিক লীগ সরকারি ক্ষমতা ও পেশিশক্তির জোরে অবৈধ ও অনৈতিকভাবে সিবিএ নির্বাচিত হয়ে শ্রমিক দলের অন্তর্ভুক্ত বেসিক ইউনিয়নের নেতাকর্মীদের গণহারে দেশের একপ্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে হয়রানিমূলক বদলি শুরু করে। আওয়ামী লীগ সরকার বিরোধীদল সমর্থক শ্রমিক-কর্মচারীদের বরাদ্দকৃত বাসা বাতিল করে তাদের বাস্তুচ্যুত করে। বিরোধীদলীয় সমর্থক শ্রমিক-কর্মচারীদের ঘন ঘন হয়রানিমূলক বদলির ফলে শ্রমিক নেতাদের সন্তানদের লেখাপড়া বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে।
হয়রানিমূলক বদলিই শুধু নয়, মিথ্যা মামলায় জড়িয়ে অনেককে চাকরিচ্যুত, বেতন-ইনক্রিমেন্ট বন্ধ, এমনকি শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের মাধ্যমে অনেককে সর্বস্বান্ত করে দেওয়া হয়েছে। ফলে নিয়মতান্ত্রিক ও স্বাভাবিক শ্রমিক আন্দোলন হুমকির মুখে পড়েছে। জুলুম-নির্যাতনের মাধ্যমে ভিন্নমতকে স্তব্ধ করে দেওয়ার এ এক বড় আওয়ামীচক্রান্ত; যা খালি চোখে ধরা পড়ছে খুব কম। এতদসত্ত্বেও মিরপুর, গাজীপুর, ভালুকা, নারায়ণগঞ্জ আর চট্টগ্রামের শ্রমিকশ্রেণি জেগে উঠলে জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা সময়ের ব্যাপার মাত্র। আকাশচুম্বী দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির বাজারে শ্রমিকদের বর্তমান বেতনে জীবনযাপন বড়ই কঠিন হয়ে গেছে। এ অবস্থার অবসানের জন্য লড়াই করে তারা চাকরি হারাচ্ছে, নির্যাতিত হচ্ছে, মার খাচ্ছে। এ ভয়াবহ শোষণ যন্ত্রণার বিরুদ্ধে শ্রমিকশ্রেণি বিদ্রোহ, বিপ্লবের মাধ্যমে মুক্তির সংগ্রামে বৃহৎ উপন্যাস হয়ে দাঁড়াবে। সেদিকেই যাচ্ছে পরিস্থিতি।
৩.
বিএনপির শান্তিপূর্ণ সমাবেশ বানচাল করার লক্ষ্যে ২৬ অক্টোবর বিনা ওয়ারেন্টে শ্রমিক দল ঢাকা মহানগর দক্ষিণের মুগদা থানা কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক ফজলুর রহমান কাজলকে পুলিশ গ্রেফতার করে। পুলিশের দেওয়া মিথ্যা মামলায় আদালত কাজলকে জামিন না দিয়ে কারাগারে প্রেরণ করে। আটকাবস্থায় কাশিমপুর কারা কর্তৃপক্ষের মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনে কাজল অসুস্থ হয়ে পড়ে। কারা কর্তৃপক্ষ হাতে হ্যান্ডকাফ ও পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরিয়ে ২৬ ডিসেম্বর ঢাকা মেডিকেলে, পরবর্তীকালে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। বিনা বেডে হাসপাতালের ফ্লোরে দুহাতে হ্যান্ডকাফ ও পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় ২৮ ডিসেম্বর রাতে শ্রমিক দল নেতা ফজলুর রহমান কাজল বিনা চিকিৎসায় মারা যান। কারাগারে আটক শ্রমিকনেতা কাজলের হাতে-পায়ে ডান্ডাবেড়ি পরা অবস্থায় মৃত্যুতে সচেতন মহল থেকে প্রতিবাদ হলেও সরকার ও কারাকর্তৃপক্ষ একেবারে চুপ। প্রকৃতপক্ষে কাজলের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়নি। মৃত্যুর তদন্ত ও বিচার হতে হবে।
৪.
এত স্বপ্নভঙ্গ আর হতাশার মধ্যে আশার দিক হচ্ছে গণতন্ত্রকামী জনতার পাশাপাশি শ্রমিকরা আবার সংগঠিত হচ্ছে। শ্রমিকশ্রেণি সংগঠিত প্রতিরোধের মাধ্যমে নিজেদের কথা বলছে। রাস্তায় নামছে। রক্ত ও জীবন দিতেও পিছপা হচ্ছে না। শ্রমিকশ্রেণি নতুন ইতিহাস লেখার রসদ জোগাচ্ছে। নব উদ্যমে আন্দোলন ও সংগ্রামের ভিত্তি তৈরি করছে। শ্রমিকদের পক্ষে সোচ্চার হয়েছে দেশ ও বিদেশের গণতান্ত্রিক শক্তি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন শ্রমিক অধিকারের পক্ষে কথা বলছেন। শ্রমিকদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করলে, নির্যাতন করলে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার আওয়াজ উঠছে। বাংলাদেশের শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী কল্পনা আক্তারের নাম উল্লেখ করে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ও বিদেশ সচিব এন্টনি ব্লিঙ্কেন কথা বলছেন। এসব পদক্ষেপ বাংলাদেশের অধিকারবঞ্চিত শ্রমিক আন্দোলনে নতুন আশার দিক। শ্রমিকশ্রেণির সাংগঠনিক ও সমষ্টিগত লড়াই সমাজে ন্যায় ও সমতা প্রতিষ্ঠার জন্য। শ্রমিকরা সাহস পাচ্ছে, সংগঠিত হচ্ছে, রাস্তায় নামছে শুধু বেতনের জন্য নয়, দেশ ও জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্যও। ২০২৩ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৪০ বছর পর ২১টি শ্রমিক সংগঠন ‘জাতীয় শ্রমিক কর্মচারী কনভেনশনে’ মিলিত হয়ে ঐক্যবদ্ধ শ্রমিক আন্দোলন গড়ে তোলার প্রত্যয় ঘোষণা করেছে।
এ ঘোর দুঃসময়ে দরদি রাজনীতির পাশাপাশি কৃষক, শ্রমিক আর ছাত্র আন্দোলনই পারে বাংলাদেশকে মুক্তির পথ দেখাতে। দেশে এখন কৃষক আন্দোলন নেই, এ সুযোগে সরকার অত্যাবশ্যকীয় পরিষেবা বিলের মাধ্যমে শ্রমিক আন্দোলনের হাতে-পায়ে বেড়ি পরাতে চায়। স্বাভাবিকভাবে বৃহত্তর গণ-আন্দোলন গড়ে উঠতে পারছে না! দেশ ও জাতির এ ক্রান্তিলগ্নে শ্রমিক অধিকার নিয়ে সোচ্চার হওয়ার ঘটনা আমাদের নতুন স্বপ্ন দেখায়। নিজেদের অধিকার এবং গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার আন্দোলনেও শ্রমিক আন্দোলন অনেক বেশি প্রয়োজন। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং মার্কিন পদক্ষেপ শ্রমিকদের প্রাপ্য অধিকার পাওয়ার ক্ষেত্রে সহায়ক হবে। নতুন দিনের সূচনা করতে শ্রমিক আন্দোলন অতীতের মতো ভবিষ্যতেও নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করবে। শ্রমিকদের মুক্তি এবং বাংলাদেশের মুক্তির জন্য শ্রমিক আন্দোলনের কোনো বিকল্প নেই।
অতীতে শ্রমিকশ্রেণি বারবার সভ্যতার গতিপথ পালটে দিয়েছে। আধুনিক সমাজে আজও শ্রমিকের সেবা ছাড়া একটি মুহূর্তও কল্পনা করা যায় না। শ্রমিকদের রক্ত আর ঘামের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এ সভ্যতা। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি থেকে বঞ্চিত রেখে তাদের ওপর জুলুম করা চরম মানবাধিকারের লঙ্ঘনের শামিল। এ জুলুমের অবসান করে একটি কল্যাণকামী ও ন্যায়ভিত্তিক রাষ্ট্র গঠনের জন্য দরকার কার্যকর আন্দোলন। আসুন এ লড়াইয়ে অংশ নিয়ে মা, মাটি আর মাতৃভূমিকে মুক্ত করি।
দৈনিক যুগান্তরের উপ-সম্পাদকীয়তে লিখেছেন
বিএনপি চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার বিশেষ সহকারী, প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা এডভোকেট সামসুর রহমান শিমুল বিশ্বাস।